বহে কাল নিরবধি-যারা পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে! by এম আবদুল হাফিজ

নাগরিক জীবনের সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে যদি কোনো সুহৃদ আপনাকে স্মরণ করে টেলিফোনে আপনার কুশল জানতে চায় অবশ্যই আপনি অভিভূত হবেন। এমনই একজন মাত্র কদিন আগে আমাকে টেলিফোন করলে আমার তো বেশ কয় মিনিট লাগল তাকে চিনতে। যখন চিনলাম, আমার লজ্জার যেন অবধি ছিল না।


আমার অতি অকৃত্রিম বন্ধু আনোয়ার হাশিম। সর্বশেষ জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তো এক ঠায় বেশি দিন থাকেন না। তাই ঢাকা ছাড়া সম্ভবত বেইজিংয়ে একবারই দেখা হয়েছিল। বিপদে পড়ে জেনেভায় গিয়ে তাকে সত্যি কথা বলতে পুনরাবিষ্কার করলাম। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে, অন্যের কাজে লাগতে পারায়ই তাঁদের আনন্দ। কী করে জেনেভায় তাঁর আতিথেয়তায় জড়িয়ে গেলাম, পটভূমি না বললে তো তা পরিষ্কার হবে না।
নব্বইয়ের দশকে সুইজারল্যান্ডের বার্নভিত্তিক সুইস পিস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আমি এক জলবায়ু পরিবর্তন গবেষণা কার্যক্রমে কাজ করি। এ বাবদ অন্তত আধা ডজনবার আমাকে সে দেশে প্রতিবার সপ্তাহখানেকের জন্য যেতে হয়েছিল। একেকবার একেক স্থানে গবেষণা-সংশ্লিষ্টরা মিলিত হতাম এবং তাতে করে কাজের অগ্রগতি সমন্বিত হতো। কখনো বার্ন, কখনো জেনেভা, কখনো জুরিখ। গবেষণার সর্বশেষ সমন্বয়ের বৈঠকটি হয়েছিল ইতালির সীমান্ত ঘেঁষে লেক ম্যাগ্নোলিয়ার ওপরে মন্টিভেরিটা নামক এক পাহাড়ের চূড়ায়। এটি সুইজারল্যান্ডের লোকার্নো প্রদেশে, যেখানে জুরিখ থেকে দুই ঘণ্টায় পৌঁছা যায়।
জুরিখ রেলস্টেশনে যাত্রীদের হেভি লাগেজ রাখার লকার আছে। যেসব যাত্রী জুরিখের বাইরে কোথায়ও যায়, তারা সাধারণত হালকাভাবে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তাদের ভারী জিনিসগুলো স্টেশনের লকারে রেখে যায়। আমিও তা-ই করেছিলাম। শুধু একটি হ্যান্ডব্যাগ ও একটি ব্রিফকেস নিয়ে লোকার্নো যাই। মন্টিভেরিটা একটি আবাসিক সেমিনারকেন্দ্র, ব্রিটেনের সাসেক্সে অবস্থিত উইল্টন পার্কের মতো। মন্টিভেরিটায় বিশ্বের শখানেক জলবায়ু বিশেষজ্ঞের সমাগম হয়েছিল। পরিচিতদের মধ্যে দিল্লির পার্থ ঘোষকে পেয়েছিলাম সেখানে।
খুব শক্ত বিষয় যেখানে আলোচিত হয়, সেখানেই দেখেছি আনন্দ-স্ফূর্তি ও হৈ-হুল্লোড়ের অনেক আয়োজন থাকে। স্মরণীয় চার-পাঁচ দিন লোকার্নোতে কাটিয়ে যখন দেশে ফেরার পথে জুরিখে পৌঁছলাম, বিপত্তি হলো সেখানেই। বানহফ স্ট্যাসেতে অবস্থিত জুরিখ রেলস্টেশনে পৌঁছে টুকিটাকি কিছু কিনলাম। সুইজারল্যান্ডের চকোলেট বিশ্বখ্যাত। কিনলাম তা-ও। অতঃপর সেগুলো যখন স্যুটকেসে গুছিয়ে রাখছিলাম নিবিষ্ট মনে, আমার পাশেই ছিল ব্রিফকেস। যেহেতু এর পরই রওনা দেব এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে, আমার ট্র্যাভেল ডকুমেন্টস ছিল ব্রিফকেসেই। গোছগাছ শেষ করে যখন টিকিট কাউন্টারে যাব, পাশে তাকিয়ে দেখি আমার ব্রিফকেস নেই। চারদিকে দৃষ্টিক্ষেপণ করার পর শরীরের রক্ত হিম হয়ে এলো। নাহ্, নেই তো নেই-ই। আমার অনেক বিদেশ ভ্রমণে অনেক জায়গায়ই বেকায়দায় পড়েছি। কিন্তু এটি ছিল অভিনব। পাশ্চাত্যের দেশগুলো সম্বন্ধে অনেকের এমন ধারণা আছে যে সেখানে শুধু ফেরেশতারাই বাস করে। রাস্তায় সোনার দলা পড়ে থাকলেও তা ছোঁয় না!
মুহূর্তে পাশ্চাত্য সভ্যতার সেসব কল্পকাহিনী উবে গেল। আমি এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে রেলস্টেশনের পুলিশ কাউন্টারে গেলাম। ভাষাবিভ্রাটের জন্য আকারে-ইঙ্গিতে আমার ব্রিফকেসটি খোয়া যাওয়ার কথা জানালাম। অনেক সহানুভূতি দেখালেও পুলিশ আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারল না। আবার ফিরে এলাম খোয়া যাওয়ার জায়গাটিতে। খাঁ খাঁ করছে এক শূন্যতা। তদুপরি ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এসব মিলিয়ে সব কিছুই আমার কাছে বিদ্রূপের মতো লাগল।
পুলিশ কাউন্টারে আমাকে যথাশিগগির একটি পাসপোর্ট সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছিল। তা না হলে নাকি আমার সমস্যা আরো বাড়বে। আমি শুধু জানতাম যে জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘ দপ্তরের জন্য সেখানে একটি দূতাবাস আছে। একবার জেনেভা হয়ে লন্ডন যাওয়ার পথে সেই দূতাবাসে স্বল্পকালীন যাত্রাবিরতির সময় আমাকে সাহায্য করা হয়েছিল। স্থির করলাম, অনতিবিলম্বে জেনেভায় যাব আমার পাসপোর্ট ও খোয়া যাওয়া টিকিট সংগ্রহের চেষ্টায়। ভাগ্যিস ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের টিকিটের কম্পিউটার রেফারেন্স নম্বরটি আমার মনে ছিল। কিন্তু জেনেভার প্রথম ট্রেনটি ছাড়বে শেষরাতের দিকে। তারই অপেক্ষায় বিনিদ্র রাত কাটালাম প্লাটফর্মের চেয়ারে হেলান দিয়ে।
আমার মনে এক গাদা দ্বিধা ও সংকোচ। জানিও না যে জেনেভার দূতাবাসে কে আছেন দায়িত্বে। তিনি কি আমাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দেবেন? এমনিতেই স্টিফকলার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ইউরো রেল গতিবেগে সম্ভবত দুই ঘণ্টায় পৌঁছলাম জেনেভায়। তখনো ভোরের আলো ফোটেনি। কোথায় যাব স্টেশন থেকে। আগে একবার যাত্রাবিরতির অভিজ্ঞতা থাকায় দূতাবাসটির লোকেশন মোটামুটি জানা ছিল। স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয়। কিন্তু দূতাবাসের অফিসটি ছিল দোতলা অথবা তেতলা। নিচতলাটি যতদূর মনে আছে, একটি বাণিজ্যিক অফিস। ভবনটির কাছাকাছি যেতেই সেই অফিসটি খোলা হচ্ছিল। আমিও নিচতলা উন্মুক্ত পেয়ে সেখানে ঢুকে পড়লাম। কেউ কিছু বলল না। তাই সাহস সঞ্চয় করে লিফট ধরে ওপরে গেলাম। দরজায় টোকা দিতেই দূতাবাসের এক লুঙ্গিপরা কর্মচারী বেরিয়ে এলেন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম রাষ্ট্রদূতের নাম। আনোয়ার হাশিমের নাম শুনে সাহস পেলাম।
চারদিকে আরো আলো ফুটতেই তাঁকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, ফ্রান্স থেকে তাঁর এক মেহমান এসেছেন। একটুক্ষণের মধ্যে তাঁকে বিদায় দিয়ে তাঁর লিম্যুজিনটি দূতাবাসে পাঠিয়ে দেবেন, আমি যেন সোজা তাঁর বাসভবনে যাই। আরো কিছু তিনি দূতাবাসের কর্মচারীকে বলে দিলেন, যার ফলে কার্যত তখন থেকেই আমার সমস্যাগুলোর জট খুলতে থাকল। গরম গরম কফি এলো। তা পান করার পরই ওই কর্মচারী আমার ফটো তুলতে কাছেই একটি স্টুডিওতে নিয়ে গেল। ফিরে এসে পাসপোর্টের জন্য একটি ফর্ম পূরণ করলাম। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রদূতের বিশালকায় বনেদি গাড়িটি পৌঁছে গেছে। আমরা কাছেই ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের অফিসে গেলাম। বন্ধ দেখে আমি একাই এবার রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে রওনা হলাম।
আনোয়ার হাশিম বাইরের ফটকে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং একসঙ্গে অনেক প্রশ্ন করলেন। সেগুলোর উত্তর দিতে দিতেই আমরা ভেতরে গিয়ে প্রাতরাশের টেবিলে বসলাম। মনে হলো, কত দিনের পরিচিত স্বজনের সঙ্গে খুব তৃপ্তি করে নাশতা করলাম। অতঃপর লন্ড্রি থেকে আনা তাঁরই ধবধবে পাঞ্জাবি-পাজামা পরে সারা রাত ধকলের পর লম্বা ঘুম দিলাম। আনোয়ার হাশিম অভয় দিলেন যে এখানকার অফিসগুলো দেরিতে খুললেও রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। তাই আমার নতুন টিকিট সংগ্রহে কোনো অসুবিধা হবে না।
যা ভাবিনি, তা-ই হলো। দুপুরের মধ্যে আমার হাতে এসে পৌঁছল নতুন পাসপোর্ট ও টিকিট। জুরিখ থেকে প্রতি সন্ধ্যায় দুবাই হয়ে করাচির ফ্লাইট। ভাবলাম, সেদিনই জুরিখ থেকে রওনা হওয়া যায়। বাদ সাধলেন আনোয়ার হাশিম। বললেন, সেকি, জেনেভায় এলে লোকে জেনেভা লেকের প্রেমে পড়ে যায়। অনেকে জেনেভার অদূরে ফরাসি আলপ্স্-এ হিচ্-হাইকিং করে। জেনেভায় পা রেখেই সঙ্গে সঙ্গে কেউ ফেরার কথা বলে না। অগত্যা আনোয়ার হাশিমের ঐন্দ্রজালিক আতিথেয়তার ফাঁদে জড়িয়ে গেলাম। মিসেস আনোয়ার হাশিম বিখ্যাত আর পি সাহার পরিবারের এক বিশাল হৃদয়ের মহৎ মহিলা, যিনি তাঁর অষ্ট ব্যঞ্জনে কদিন যাবৎ আমার রসনাতৃপ্ত করেছিলেন। জুরিখে এক চতুর চোরের কবল থেকে জেনেভায় খোদ এক রাষ্ট্রদূতের আতিথ্যে অভিষিক্ত! জীবনে কত কিছুই না ঘটতে পারে। কিন্তু তার জন্য সবাই নয়, চাই আনোয়ার হাশিমের মতো এক মহৎ উদারপ্রাণ ব্যক্তি, যাঁরা নিরন্তর এই নিষ্ঠুর পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলেন। আমি ধন্য যে এমন মানুষের মনের মণিকোঠায় আমার জন্য একটু পরিসর আছে।
লেখক : সাবেক মহারিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট।

No comments

Powered by Blogger.