চিরকুট-তাহেরের বিচার by শাহাদুজ্জামান

তখন একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আমার সঙ্গে কাজ করত নৃবিজ্ঞানে স্নাতক এক তরুণ। আমরা অফিসের একই বাসে বাড়ি ফিরতাম। তরুণটি যে স্টপেজে নামত, সেখানে ফুটপাতে শীত-বর্ষায় প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকতেন তার মা। তরুণটি বাস থেকে নামলে একটি রিকশা নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফিরতেন তাঁরা।


একজন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণকে এভাবে প্রতিদিন তার মা বাড়ি বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, চিকিত্সকের পরামর্শে। সেই মুহূর্তে তরুণটি খানিকটা মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে ছিল। চিকিত্সক বলেছিলেন, সর্বক্ষণ নজরদারির মধ্যে রাখতে। এই তরুণের নাম আবু আহসান মিশু, কর্নেল তাহেরের ছোট ছেলে। আর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন তার মা লুত্ফা তাহের। এ দৃশ্য প্রতিদিন তাড়িত করত আমাকে। মা-ছেলের ধাবমান রিকশার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার মন গিয়ে পড়ত ইতিহাসের খাদে। রাতের অন্ধকারে শিয়ালকোটের ধানখেতের কাদায় পা ফেলে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসছেন তাহের, কামালপুরের অপারেশনে শেলের আঘাতে উড়ে যাচ্ছে তাঁর পা, নভেম্বরের এক সকালে ক্রাচে ভর দিয়ে উঠছেন সেপাইদের ট্রাকে, তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর মোড় ঘুরবে বাংলাদেশের ইতিহাসের, তারপর একদিন ফাঁসির দড়ির কাছে গিয়ে বলছেন, ‘খানিকটা সময় হবে? আমি একটা কবিতা পড়ব।’ নভেম্বরের কয়েকটা দিন বাংলাদেশের ইতিহাস তাহেরের হাতের মুঠোয় ছিল। সেটি হাত থেকে না ফসকালে আমাকে নিশ্চয়ই ওই ধাবমান রিকশায় বিপর্যস্ত ওই তরুণ আর উদ্বিগ্ন ওই নারীকে দেখতে হতো না। দিনের শেষ আলোয় ছেলের জন্য ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা লুত্ফা তাহের আমার কাছে ছিলেন একটি দেশের বিপন্ন এক ইতিহাসের প্রতীকী দৃশ্যকল্প।
ক্রাচের কর্নেল নামে কর্নেল তাহেরের জীবনীভিত্তিক যে বইটি আমি লিখেছি, সেটি শুরু করেছি লুত্ফা তাহেরের ওই বাসস্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকা দৃশ্যটি দিয়ে। সহকর্মী মিশুর সুবাদে নানা ঘটনাসূত্রে তাহেরের পুরো পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে আমার। তাহেরের রাজনৈতিক জীবন বিষয়ে অল্পবিস্তর জানা থাকলেও তাঁর ব্যক্তি ও পরিবারিক জীবনের নানা অজানা খবরের পরিপ্রেক্ষিতে তাহের চরিত্রটি আমার কাছে হয়ে ওঠে আরও বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। তাঁকে নিয়ে একটি বই লেখার প্রণোদনা বোধ করি তখনই। এ বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের দীর্ঘ যাত্রা শুরু করি। বইটিতে আমি চেষ্টা করি ইতিহাসের তথ্যের আড়ালের দ্বিধা, ষড়যন্ত্র আর উত্কণ্ঠাকে তুলে আনার। কিন্তু তাহেরকে নিয়ে বই লেখার ঝুঁকি নানামুখী। তাহের কারও কাছে নায়ক, কারও কাছে খলনায়ক। আমাদের দেশের মানুষ সাধারণভাবে যে দুটি বৃহৎ দলের অন্ধভক্ত, নয়তো ঘোরবিদ্বেষী, সে দুই দলের কাছেই তাহের একজন অস্বস্তিকর, বিরাগভাজন ব্যক্তি। দেশের আরেক ক্ষমতাধর শক্তি সেনাবাহিনীর কাছেও তাহের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী এক স্পর্শকাতর চরিত্র। আবার যে দলের সদস্য হয়ে রাজনীতি করেছেন তাহের, সেই জাসদের ইতিহাস, কার্যকলাপ নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। অনেক রাজনৈতিক তাত্ত্বিকের কাছে তাহের নেহাত অত্যুত্সাহী এক রোমান্টিক বিপ্লবী। আর তাহের যে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে বিষয়ে রাষ্ট্রীয় ভাষ্য বিভ্রান্তিকর তথ্যে ঠাসা। সেই সঙ্গে তাহের যে সময় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন, সেই সময়টি এ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনায় ভরপুর। সবচেয়ে প্রতাপশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা তখন উপস্থিত। সেসব ঘটনা ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে আবার চালু রয়েছে প্রবল পরস্পরবিরোধী মনোভাব। এই প্রেক্ষাপটে তাহেরের মতো একটি অমীমাংসিত চরিত্রকে নিয়ে কোনো বই রচনা করা দুরূহ, ছিল সাহিত্যিক ঝুঁকিও। আমি মূলত একটি কথাসাহিত্য রচনা করতে চেয়েছি, আর কথাসাহিত্যে আমার মূল কাজ ছোটগল্পে, যা প্রতীকী ধাঁচের, অনেক ক্ষেত্রেই বিমূর্ত। আমার ছোটগল্পের এই ভাষা আর প্রকরণ এই বিশাল ক্যানভাস ধরার উপযোগী ছিল না। চ্যালেঞ্জ ছিল সাহিত্য ও ইতিহাসকে মেলানোরও। তা ছাড়া দূর অতীতের প্রতিষ্ঠিত কোনো চরিত্রের চেয়ে অতি নিকট অতীতের কম স্পষ্ট কোনো চরিত্র নিয়ে সাহিত্য রচনা করা অধিকতর জটিল। তবে এই বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জই লেখক হিসেবে আমার জন্য ছিল আকর্ষণের জায়গা। ক্রাচের কর্নেল আদৌ উপন্যাস হয়েছে কি না, নাকি হয়েছে ইতিহাসগ্রন্থ বা গবেষণা-সন্দর্ভ অথবা জীবনীগ্রন্থ, নাকি এটি একটি আখরাই বা হাফ আখরাই—এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ এখানে নেই। তবে বইটির একাধিক সংস্করণ হচ্ছে। আমি নিয়মিত অগণিত পাঠক-পাঠিকার কাছ থেকে চিঠিপত্র, ই-মেইল পাই, তাতে বোঝা যায়, বইটি অনেকে পড়ছেন।
আজ প্রসঙ্গটির অবতারণা করলাম কর্নেল তাহেরের বিচারপ্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে। বইটি লেখার সূত্র ধরে কর্নেল তাহেরের বিচার ও ফাঁসির পেছেনে যে সীমাহীন ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পেয়েছি, তাতে রীতিমতো শিহরিত হয়েছি। সারা পৃথিবীর আইনের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিচারের নজিরবিহীন অনিয়মের ব্যাপারে দীর্ঘদিন সোচ্চার আছেন বিদেশি সাংবাদিক লরেন্স লিফত্সুলজ। একটি অন্যায় মৃত্যুদণ্ড এ দেশের ইতিহাসের গতি যেমন পরিবর্তন করেছে, তেমনি তছনছ করে দিয়েছে একটি পরিবারকে। এলোমেলো হয়ে গেছে তাহেরের স্ত্রী, সন্তান, ভাইবোনের জীবন। শীতের সন্ধ্যায় লাইটপোস্টের নিচে একাকী যে লুত্ফা তাহেরকে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, তাঁর জীবনসংগ্রাম নিয়ে রচিত হতে পারে আরেকটি ইতিকথা। চাপিয়ে দেওয়া একটি অপসত্য কাঁধে নিয়ে একটি পরিবার যেমন ন্যুব্জ হয়ে চলতে পারে না দিনের পর দিন, তেমনি পারে না একটা দেশ। দীর্ঘদিন পর হলেও এই অপসত্যের পাথর যদি সরানো যায়, তাহলে একটি পরিবার যেমন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে, তেমনি জাতি হিসেবেও আমাদের একটি লজ্জা ঘুচবে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
Zaman567@yahoo.comy

No comments

Powered by Blogger.