বিদ্যালয়ে ভর্তি ও কোচিং-বাণিজ্য-বাড়তি টাকা নিলে ফেরত দিতে হবে

শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে হাইকোর্টের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই আদেশ বাস্তবায়ন ও রুলের জবাব দেওয়ার জন্য চার সপ্তাহ সময় চাইবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ-সংক্রান্ত সুপারিশ তৈরির জন্য একটি কমিটিও করেছে মন্ত্রণালয়। এদিকে সরকার-নির্ধারিত ভর্তি ফির বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত টাকা ও ডোনেশন আদায় করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। বাড়তি টাকা কীভাবে অভিভাবকদের


ফেরত দেওয়া যায়, সেই চিন্তা-ভাবনাও শুরু হয়েছে। গতকাল বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে কোচিং বন্ধে আদালতের রায় নিয়ে বৈঠক হয়। এ সময় ভর্তি নীতিমালা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত টাকা আদায়, ডোনেশন (অনুদান) ও উন্নয়ন ফির নামে অভিভাবকদের হয়রানি করা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়।
একপর্যায়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ক্ষুব্ধ হন। অভিযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের সামনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা রাষ্ট্র ও সরকারের চেয়ে বড় কেউ নন। ভাবছেন এত ছাত্র আছে, তাই এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) ছাড়াই চলতে পারবেন। আমরা এমপিও বাতিল ছাড়াও মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে দেব না, প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বাতিল করা হবে। এটা করতে বাধ্য করবেন না।’
শিক্ষাসচিব সভায় অভিযুক্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বলেন, ‘আপনারা নিয়ম না মানায় আজ আমরাও আসামি। তাই আপনারাই বলুন, কেন আপনারা নিয়ম মানছেন না? নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য আপনাদের কী শাস্তি হওয়া উচিত?’
গতকাল বুধবার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। তবে বেশি টাকা নেওয়া এবং কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত থাকায় অভিযুক্ত ক্যামব্রিয়ান স্কুল, শাহ আলী স্কুলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই সভায় যোগ দেয়নি।
ইতিমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান সরকার-নির্ধারিত ফির বেশি নিয়েছে। এটা ফেরত দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ ও ভিকারুননিসা নূন স্কুলসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিয়েছিল। এবারও অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতে বলা হবে। তার আগে কে, কত টাকা বেশি নিয়েছে, তা অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে।
সভায় কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়, মন্ত্রণালয়-নির্ধারিত ভর্তি ফি সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা। এটা দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। একজন অধ্যক্ষ প্রয়োজনে এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) ফেরত দেওয়ার কথা বলেন। এ সময় মন্ত্রী-সচিব ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এমপিও না নিলেও যা খুশি তাই করতে দেওয়া হবে না।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্তে কোচিংয়ের টাকা নেওয়া, ডোনেশন ও উন্নয়ন ফি নেওয়ার যুক্তি দিতে গিয়ে মন্ত্রী-সচিবের ক্ষোভের মুখে পড়েন। আইডিয়াল স্কুলের মূল শাখায় বাংলা মাধ্যমে ১৩ হাজার ৭৭৪ টাকা, ইংরেজি মাধ্যমে ২০ হাজার ৭৭৪ টাকা, বনশ্রী শাখায় অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা এবং মুগদাপাড়া শাখায় ভর্তি ফি ছাড়াও দুই লাখ টাকা ডোনেশন নেওয়ার বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়।
সভায় মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানের সভাপতি একজন সাংসদ। তিনি বিষয়টি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন।
সভায় মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সমালোচনা করা হয়। সভায় উপস্থিত একজন কর্মকর্তা জানান, ডোনেশনের টাকা পৃথক ব্যাংক হিসাবে জমা দেওয়ার আগ পর্যন্ত ওই বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যের বই দেয়নি। এ-সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জু আরা বেগম জানান, তাঁর বিদ্যালয়ে কিছু টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে এবং বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেওয়ার আগে বেশি টাকা নেওয়া উচিত হয়নি বলে জানান তিনি।
গতকালের সভায় গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয় স্কুল শিক্ষকদের কোচিং সম্পর্কে। তিনি স্বীকার করেন, কিছু শিক্ষক কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তবে স্কুলের ভেতর কোচিং নিষিদ্ধ। তিনি নিজেও কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত নন। জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘বিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে আপনি কোচিং করালেন কি না, সেটি বড় বিষয় নয়। স্কুলের পাশে বাসা ভাড়া নিয়ে শিক্ষকেরা কোচিং করছেন, এটা কারও অজানা নয়।’ ল্যাবরেটরি স্কুলের যেসব শিক্ষক কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের তালিকা দিতে প্রধান শিক্ষককে পরামর্শ দেওয়া হয়।
গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির কোচিং-বাণিজ্য নিয়ে রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে কেন কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করে সরকারি পরিপত্র জারি করা হবে না, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এরপর মন্ত্রণালয় দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের কোচিং বন্ধ করে পরিপত্র জারির উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল সভা ডাকা হয়।
সভায় অতিরিক্ত সচিব এস এম গোলাম ফারুক, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সভায় আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল সরকারি বালক বিদ্যালয়, মতিঝিল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, মতিঝিল মডেল স্কুল, ঢাকা কলেজ, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল, ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষকেরা প্রাইভেট পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন। না পড়লে পরীক্ষায় কম নম্বর দেন। আবার পড়লে প্রশ্ন বলে দেন কিংবা নম্বর বেশি দেন। আমার চিন্তায় শিশুদের প্রতি এর চেয়ে বড় অন্যায় কিছু হতে পারে না।’ ভর্তিতে ডোনেশন ও উন্নয়ন ফিসহ বাড়তি টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি অপরাধ। এ জন্য শুধু নীতিমালা নয়, আইন করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
বিনা অনুমতিতে শাখা খোলা: মতিঝিল আইডিয়াল, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শাখা খোলার বিষয়ে সভায় জানানো হয়, এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেয়নি। তা ছাড়া, একই কমিটি মূল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ তিনটি শাখা পরিচালনা করছে, এটাও বেআইনি। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা এসব অভিযোগের জবাব দিতে পারেননি। একেকটি শাখা খুলে ডোনেশন ও উন্নয়ন ফি নেওয়ার কঠোর সমালোচনা করা হয় সভায়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নোমান উর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বেসরকারি স্কুলের জন্য ভর্তি নীতিমালা করে দিলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তা মানছে না। যেসব প্রতিষ্ঠান বাড়তি ফি নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কমিটি গঠন: বৈঠকে কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে হাইকোর্টের রুলের জবাব প্রস্তুতির বিষয়ে সুপারিশ তৈরি করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক) এ এস মাহমুদকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (আইন), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রতিনিধি।
শিক্ষামন্ত্রীর ব্রিফিং: সভাশেষে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা হচ্ছে, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবে রাতারাতি এ সমস্যার সমাধান হবে না। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীরা পূর্ণ শিক্ষা পেলে কোচিং সেন্টারে যাবে না। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার শিক্ষকদের আর্থিক সমস্যা সমাধানে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেতন বাড়িয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়ানো হবে।
শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর কারণ হিসেবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘এর বড় কারণ হলো, বেতন কম। এ জন্য আমি শিক্ষামন্ত্রীকে বলেছি, শিক্ষকেরা অন্তত নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারবেন না, এমন ব্যবস্থা নিন। তাহলে নম্বর কমবেশি দেওয়ার ঘটনা কমে যাবে।’

No comments

Powered by Blogger.