স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ নূরুজ্জামান, বীর বিক্রম যুদ্ধক্ষেত্রে পিছু হটেননি এই বীর নূরুজ্জামানের দলনেতা খবর পেলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দল মুক্তাঞ্চল দখলের জন্য এগিয়ে আসছে। দলনেতা তাঁদের বললেন পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করতে। দ্রুত তাঁরা অবস্থান নিলেন মুক্তাঞ্চল থেকে তিন কিলোমিটার এগিয়ে এক সেতুর আশপাশে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রবল আর্টিলারি


শেলিংয়ে বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন। নূরুজ্জামানসহ কয়েকজন মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন। একটু পর তাঁরা দূরে দেখতে পেলেন এগিয়ে আসছে পাকিস্তানি সেনাদের বিরাট একটি দল। অগ্রবর্তী সেনারা তাঁদের অবস্থানের মধ্যে আসামাত্র গর্জে উঠল সবার অস্ত্র। গুলিবিদ্ধ কয়েকজন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বাকিরা দ্রুত পজিশন নিয়ে গুলি করতে থাকল। নূরুজ্জামান অল্প কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করতে থাকলেন। এক পর্যায়ে তিনি একা হয়ে গেলেন। এমন সময় হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। এ ঘটনা গজারিয়া সেতুতে। ১৯৭১ সালের জুন মাসের শেষ দিকে অথবা জুলাই মাসের প্রথমার্ধে।
গজারিয়া সেতু নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার অন্তর্গত। বেগমগঞ্জ থানার নান্দিয়াপাড়াসহ আশপাশের বড় একটি এলাকা ১৯৭১ সালের জুন মাসের শেষ পর্যন্ত মুক্ত ছিল। এই এলাকায় ছিল সুবেদার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা। এই দলে ছিলেন নূরুজ্জামান। দেশের ভেতরে অবস্থান করে তাঁরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। এপ্রিল মাস থেকে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। এর মধ্যে বিপুলাশ্বর স্টেশন, সোনাইমুড়ী, বগাদীয়া ফেনাকাটা, মীরগঞ্জ, মীরেরহাট, বড় কামতা উল্লেখযোগ্য। ১৩ জুন নূরুজ্জামানের দলনেতা সুবেদার লুৎফর রহমান খবর পান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল নান্দিয়াপাড়া দখলের জন্য আসছে। সেদিন তাঁরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধে গজারিয়া সেতুতে অবস্থান নেন। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের চার ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে পাঁচজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্ষতি না হলেও দুজন গ্রামবাসী পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে সেদিন চলে যায়।
এরপর পাকিস্তানি সেনারা আরও কয়েকবার নান্দিয়াপাড়া দখলের জন্য আসে। প্রতিবারই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করতে থাকেন। একদিন (সঠিক তারিখ কারও জানা নেই) পাকিস্তানি সেনারা আর্টিলারির প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে করতে এগোতে থাকে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এ সুযোগে পাকিস্তানি সেনারা দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। তখন নূরুজ্জামান কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে সাহসকিতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রবর্তী দলকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু নূরুজ্জামান ও তাঁর সহযোদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন অনেক কম। পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণে নূরুজ্জামানের সহযোদ্ধারা বিপর্যস্ত হয়ে পশ্চাদপসরণ করতে থাকেন। নূরুজ্জামান ও তাঁর আরেক সহযোদ্ধা বিচলিত না হয়ে বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করছিলেন। এ সময় তাঁরা দুই জন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। পরে মুক্তিযোদ্ধরা পুনর্গঠিত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করেন। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা চলে যায়। যাওয়ার সময় তারা শহীদ নূরুজ্জামান ও তাঁর সহযোদ্ধার মরদেহ সঙ্গে করে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের মরদেহ উদ্ধার করতে পারেননি। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের মরদেহ গোপনে কোথায় সমাহিত করে সে খবর কেউ জানতে পারেনি।
শহীদ নূরুজ্জামান চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন নিজ এলাকাতেই।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ নূরুজ্জামানকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৫৮।
শহীদ নূরুজ্জামানের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার ছয়ানী ইউনিয়নের (ডাক বাবুপুর) জাহানাবাদ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আরিফ মিয়া, মা জামিরা খাতুন। স্ত্রী শহিবী বেগম। তাঁর কোনো ছেলেমেয়ে নেই। এলাকার বর্তমান প্রজন্মের বেশির ভাগ খেতাবপ্রাপ্ত এই মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে কিছু জানেন না। তাঁর ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.