অন্য রকম সু চি!
সেই ষাটের দশকের কথা। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সাইকেলে করে ঘুরে বেড়াতেন সুন্দর এক বার্মিজ মেয়ে। ভিন্ন দেশের এমন সুন্দর একটি মুখ দেখে মুগ্ধ হন অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থী মাইকেল এরিস। আশপাশের মানুষের কাছে জানতে চান, ‘এমন সুন্দর মেয়েটা কে?’ উত্তরে জানতে পারেন, বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) কোনো জেনারেলের মেয়ে, নাম অং সান সু চি।
গল্প আর এগোনোর কথা নয়। কারণ, সু চির বাবা অং সান মিয়ানমারের বিপ্লবী নেতা ও আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নেতৃত্বেই দেশটি ব্রিটিশদের এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়, স্বাধীনতা অর্জন করে। যদিও এর ছয় মাস আগেই তাঁকে হত্যা করা হয়। এমন পরিবারের মেয়ে নিজ দেশের কাউকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেবেন, এমনটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
কিন্তু সু চির জীবনের চিত্রনাট্য এমন প্রত্যাশায় চলেনি। কিউবায় জন্ম নেওয়া ও যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা লম্বা-সুদর্শন মাইকেল এরিসের সঙ্গে ১৯৬৭ সালে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হিমালয়ান কিংডম নিয়ে গবেষণা করার বিষয়ে এরিসের ছিল ব্যাপক আগ্রহ। পরবর্তীকালে এসব বিষয় নিয়েই তিনি কাজ করেন।
সেই আগ্রহ থেকেই অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা এরিস ভুটানের রাজপরিবারের শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। তখন দুজনের মধ্যে চিঠি চালাচালি চলে। কিছু চিঠি এখন অক্সফোর্ডের এক গ্রন্থাগারে আছে। সু চির জীবনীমূলক বই ‘পারফেক্ট হোসটেজ’-এর লেখক জাস্টিন উইন্টলি জানিয়েছেন, এরিসকে লেখা এক চিঠিতে সু চি লিখেছিলেন, ‘আমার দেশের জনগণের আমাকে প্রয়োজন। এ দায়িত্ব পালনে আমাকে তোমার সহযোগিতা করতে হবে।’
১৯৭২ সালে এরিসের সঙ্গে ঘর বাঁধেন সু চি। বিয়ের এক বছর পর সু চি-এরিসের কোলে আসে প্রথম সন্তান আলেকজেন্ডার। ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় সন্তান কিমের জন্ম। এরিস পড়াশোনায় মন দিলেন। সু চি তখন ঘরের কাজ, ছেলেদের দেখাশোনা, কাপড় সেলাই, সবার আগে বন্ধুদের কাছে বড়দিনের কার্ড উপহার পাঠানো—এভাবেই দিন কাটাচ্ছিলেন। এরিস পড়াশোনা শেষ করে অক্সফোর্ডে শিক্ষকতা শুরু করেন। সু চি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগে পিএইচডির পড়াশোনা শুরু করেন।
কিন্তু ১৯৮৮ সালে তাঁদের সুখের সংসারটা নাড়িয়ে দেয় বার্মা থেকে আসা একটি ফোন। ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার’ বইয়ে এরিস লিখেছেন, ‘১৯৮৮ সালের মার্চের শেষ দিন। আমাদের দুই ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা দুজন পড়াশোনা করছিলাম। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। সু চি ফোনটা ধরল। ওই প্রান্ত থেকে জানানো হলো, সু চির মা হূদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। খবরটা শুনেই সে ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। তখনই বুঝলাম; আমাদের জীবনটা চিরদিনের মতো বদলে যাচ্ছে।’ স্বামী-সন্তানদের যুক্তরাজ্যে রেখে দেশে ফেরেন তিনি।
ওই সময় বার্মায় চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। সামরিক জান্তা ছাত্রসহ সাধারণ মানুষের ওপর চড়াও হয়। তিন হাজারের মতো লোককে হত্যা করা হয়। এ অবস্থার প্রতিবাদ জানিয়ে বাবার আদর্শকে ধারণ করে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন সু চি। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তবে সামরিক জান্তা তাঁকে সরকার গঠন করতে দেয়নি, গৃহবন্দি করে।
সেই থেকে গত দুই দশকের মধ্যে ১৫ বছর গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী সু চি গৃহবন্দি অবস্থায় থেকেছেন। ১৯৯১ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পান। তখন এরিস বিশ্ব সম্প্রদায়কে জানান, ‘পরিবারের সদস্য হিসেবে সু চির সঙ্গে আমাদের কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। তাঁর অবস্থা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। শুধু জানি, তিনি একা গৃহবন্দি আছেন। তাঁকে তাঁর বাড়িতে রাখা হয়েছে, নাকি অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে—সেটাও আমাদের জানা নেই।’
এরিসের সঙ্গে সু চির দেখা হয় সাত বছর পর, ১৯৯৫ সালের বড়দিনে। এটাই ছিল তাঁদের শেষ দেখা। ১৯৯৯ সালে এরিস ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি বারবার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য আবেদন জানালেও সামরিক জান্তা সে সুযোগ দেয়নি। জীবদ্দশায় এরিস তিব্বত ও ভুটান নিয়ে অনেক গবেষণামূলক কাজ করেছেন। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য স্ত্রী সু চির কাজের কথা সারা বিশ্বে পৌঁছে দিতেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। এরিস দুই সন্তানকে বড় করেছেন। আলেকজেন্ডার যুক্তরাষ্ট্রে দর্শন নিয়ে কাজ করছেন। আর ছোট ছেলে কিম যুক্তরাজ্যেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন বলে বলা হয়। ২০১০ সালে সু চি মুক্তি পাওয়ার ১০ দিন পর বড় ছেলে আলেকজেন্ডারের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। সেটাও মা-ছেলের ১০ বছর পর দেখা। মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য বারবার আবেদন করে তিনিও যে অনুমতি পাননি।
দ্য স্টার ডট কম অবলম্বনে তপতী বর্মন।
No comments