কতদিন যে বাবার পথ চেয়ে থেকেছি-ফিরে দেখা by এসএম সারোয়ার হাসান
বাবাকে হারানোর সবচেয়ে গভীর যে বেদনাবোধ আমার ভেতর কাজ করে তা হলো বাবা ও আরও লাখো শহীদের রক্তে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে সে দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্থান। সর্বগামী দুর্বৃত্তায়ন দেশকে গ্রাস করেছে। শিক্ষা-বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। আমি নিশ্চিত এগুলো বাবাসহ সব শহীদের বিদেহী আত্মাকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সদিচ্ছা দিয়ে এ বিষয়গুলোকে রোধ করা না হলে দেশের
স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। আমার মনে হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধে যাদের ত্যাগ রয়েছে এবং যারা অনায়াসে এটি পেয়েছে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার মূল্যবোধে অনেক পার্থক্য রয়েছে
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী আবদুল জব্বার আমার বাবা। তরুণ বয়সে (জন্ম ১৯৪১, বক্তারপুর, নওগাঁ) তাকে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিতে হয়। তিনি নওগাঁ উকিলবারে একজন তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবী ও প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ছিলেন (যুগ্ম সম্পাদক, নওগাঁ মহকুমা ন্যাপ)। বাবা আমার দাদা-দাদির একমাত্র সন্তান হওয়ায় সবার আদরের ছিলেন। মাধ্যমিক পাসের পর নিজ পছন্দে বিয়ে করেন তিনি। তিনি ছিলেন পাঁচ সন্তানের গর্বিত জনক। আমি বাবার কনিষ্ঠ সন্তান। ১৯৭১ সালে আমার বয়স মাত্র ৩ বছর। বাবার কোনো সাক্ষাৎ-স্মৃতি আমার স্মরণে নেই। বড় হয়ে মার কাছে এবং এলাকাবাসী ও সহকর্মীদের কাছে তার প্রখর ব্যক্তিত্ব ও বহুমুখী প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তিনি সংস্কৃতিবান ও অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখায় সহকর্মী, বন্ধু ও শিক্ষকরা তার এ চারিত্রিক গুণাবলির ওপর আলোকপাত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাবা ৭নং সেক্টরের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট মহকুমার বোয়ালদার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৎকালীন নওগাঁ মহকুমা ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা রিত্রুক্রটমেন্ট ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন ও প্রশিক্ষণ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের কোনো একদিন আপনজনের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ধামইরহাট সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করেন। পথে রাজাকাররা তাকে আটক করে এবং সীমান্তবর্তী ফার্সিপাড়া পাকসেনা ক্যাম্পে সোপর্দ করে। সেখানে কয়েকদিন ধরে নরপশুদের নির্যাতনে অদম্য এক তরুণ প্রাণ মৃত্যুর শীতল কোলে ঢলে পড়ে।
একটু বুঝতে শিখেছি তখন থেকে বাবার ব্যবহার্য জামাকাপড় এবং রেখে যাওয়া বইপত্র ও তার স্বহস্তে লিখিত নথিপত্র ছুঁয়ে বাবাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছি। বাবাকে হারিয়ে আমার মা এবং আমাদের পরিবারকে যে দুঃস্বপ্ন ও দুঃসময় পাড়ি দিতে হয়েছে তা আমার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিতে গাঁথা আছে।
বাবার মৃত্যুর খবর অনেকদিন মাকে দেওয়া হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকেই ঘরে ফিরছে। মা জানতেন বাবাও ফিরে আসবেন; কিন্তু বাবা আর ফেরেননি। যখন নিশ্চিত জানতে পেরেছেন বাবা চিরতরে বিদায় নিয়েছেন, তখন মা প্রায়ই শোকে মূর্ছা যেতেন। আমার যখন বোঝার সময় হয়েছে তখনও মা আমাকে বলতেন, 'তোর বাবা হয়তো কোনো কাজে আটকা পড়েছেন। কাজ শেষে দেখিস নিশ্চয় একদিন ফিরে আসবে।' আমার অবুঝ শৈশব মনে সত্যিই বিশ্বাস জন্মেছিল, বাবা হয়তো সত্যিই একদিন এসে পড়বেন। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় অনেক নির্জন দুপুর বা বিকেলে আমি একা বাবার অপেক্ষায় পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসে কাটিয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধে বাবা শহীদ হওয়ার পর আমাদের পরিবারে উপার্জনক্ষম কোনো ব্যক্তি ছিল না। আমার দাদা মুক্তিযুদ্ধের আগেই বিগত হয়েছেন। আমার বাবার একমাত্র চাচাতো ভাইও (বাসের আলী সরদার) মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের হাতে শহীদ হয়েছেন। এ অবস্থায় আমার মা পাঁচটি নাবালক সন্তান নিয়ে চরম হতাশা আর অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত। আমার সবচেয়ে বড় ভাই জাহিদ আনোয়ার (কথাসাহিত্যিক- সম্পাদক_অঞ্জলিলহ মোর) তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। মধ্যবিত্ত পরিবারের কিছু কৃষি জমি ছাড়া আর কোনো অবলম্বন ছিল না। এ অবস্থায় আমার বড় ফুফা ও ফুফু আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান।
মুক্তিযুদ্ধের পর নওগাঁ শহরের অদূরে বক্তারপুর গ্রামের বাড়িতেই এভাবে আমাদের নতুন জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। বাবাহীন কৃষিনির্ভর সংসারের টানাপড়েনে আমাদের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো ছিল স্বপ্নহীন, আনন্দহীন, ধূসর ও মলিন। বাবার তিরোধানের সঙ্গে আমাদের শৈশব-কৈশোরের মৃত্যু ঘটেছিল। গ্রামের স্কুলে বাবার পরিচয়ে অনেকের কাছে সমীহ পেয়েছি। বিশেষ করে আমি পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি বাল্য শিক্ষাগুরু মোক্তারপাড়া হাইস্কুলের আবুল কাশেম, আবদুস সালাম, খগেন্দ্রনাথ রায়, ইয়াকুব উদ্দিন এক কেডি হাইস্কুলের শামসুল হককে, যাদের অবদান আমার জীবন গঠনে অনস্বীকার্য। এ ধরনের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক পাওয়া সত্যিই জীবনে বড় আশীর্বাদ। তাদের স্নেহ, সমীহ, শিক্ষা ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সেদিনের এই পিতৃহারা বালক স্কুলের একজন কৃতী ছাত্রে পরিণত হতে পেরেছিল এবং পরে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষায়ও অনায়াসে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিল।
বাবাকে হারিয়ে আমাদের যে নতুন জীবনযুদ্ধ শুরু হয় তার কশাঘাত পরিবারের সব সদস্যকেই কমবেশি স্পর্শ করেছে। বাবার কোনো সহপাঠী বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে দেখলে দাদি কান্না সংবরণ করতে পারতেন না। একমাত্র পুত্রকে দাদি মানিক বলে ডাকতেন। মার কাছ থেকে জেনেছি, বাবাও ছিলেন তার মা-বাবার জন্য পাগলপ্রাণ। ২০০০ সালে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্তব্যরত। দাদির মৃত্যুর মাসখানেক আগে ছুটি নিয়ে সস্ত্রীক গ্রামের বাড়ি গিয়েছি। আমাকে দেখিয়ে ফুফু দাদিকে বললেন, 'বলতো মা কে এসেছে?' দাদি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, 'কে জব্বার?' এই ঘটনায় আমার বুক ফেটে কান্না এসেছিল। বুঝতে পেরেছিলাম একজন মায়ের কাছে তার সন্তান কত বড় অমূল্য ধন। প্রাণপ্রিয় সন্তানের স্মৃতি হারিয়ে যায়নি। আমৃত্যু যেন তার হৃদয়-মন বাবার আগমনের জন্য উদগ্রীব ছিল। প্রতি স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসে মার চোখ থেকে নীরবে ঝরে পড়ত বাঁধহীন অশ্রু। অল্প বয়সে স্বামী হারানোর গভীর বেদনা প্রকাশের অন্য কোনো ভাষা মার জানা ছিল না। সন্তান হিসেবে বাবাকে সবচেয়ে বেশি দেখার ও সানি্নধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার বড় ভাইয়ের। বাবা না থাকায় শৈশব ও কৈশোরে আমার অনেক ছোট ছোট সাধ ও ইচ্ছা অপূর্ণ থাকত। বড় হয়ে বুঝতে শিখলাম বাবাহীন আমাদের পথচলা কতটা বন্ধুর আর কণ্টকময়। বাবা যখন পাকসেনা ক্যাম্পে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তখন তার নাবালক শিশু সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কতই না গভীর কষ্টবোধ নিয়ে তিনি শাহাদত বরণ করেছেন। আজ নিজে সন্তানের জনক হিসেবে বিষয়টি অনুধাবন করতে গেলে বুকের গভীরে যে অসহনীয় কষ্ট অনুভূত হয় তা চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে।
বাবাকে হারানোর সবচেয়ে গভীর যে বেদনাবোধ আমার ভেতর কাজ করে তা হলো বাবা ও আরও লাখো শহীদের রক্তে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে সে দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উত্থান। সর্বগামী দুর্বৃত্তায়ন দেশকে গ্রাস করেছে। শিক্ষা-বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। আমি নিশ্চিত এগুলো বাবাসহ সব শহীদের বিদেহী আত্মাকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সদিচ্ছা দিয়ে এ বিষয়গুলোকে রোধ করা না হলে দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়বে। আমার মনে হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধে যাদের ত্যাগ রয়েছে এবং যারা অনায়াসে এটি পেয়েছে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার মূল্যবোধে অনেক পার্থক্য রয়েছে। স্বাধীনতা যদি সবার ত্যাগে অভিন্ন প্রাপ্তি হিসেবে উপলুব্ধ হতো তবে দেশ গড়ার কাজ অনেক সহজ হতো।
লে. কর্নেল এসএম সারোয়ার
হাসান : সেনাসদরে কর্মরত
No comments