বাংলাদেশে নরহত্যার বৈচিত্র্য-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা এমন দাঁড়িয়েছে যেখানে এ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। সাধারণভাবে জনগণের মধ্যেও নিরাপত্তাহীনতাসৃষ্ট এক ধরনের ত্রাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। অপরাধের বৈচিত্র্যের কথা আগে বলা হয়েছে। গুম-খুন এখন এই বৈচিত্র্য ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এদিক দিয়ে দুনিয়ার অন্যতম নিকৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানকেও বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে!
বাংলাদেশে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তগিরি এখন যেভাবে সমগ্র জনজীবনে অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে এটা হঠাৎ করে ঘটেনি। বাস্তবত পাকিস্তান রাষ্ট্রের গর্ভ থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও, পাকিস্তানের প্রত্যেকটি নেতিবাচক গুণাগুণ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গ্রাস করে আছে
বাংলাদেশে নরহত্যা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে এক নিয়মিত ব্যাপার। এমন দিন নেই যখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নরহত্যার কোনো রিপোর্ট থাকে না। দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠার ওপর চোখ রাখলেই দেখা যায় নরহত্যার রিপোর্ট। এই রিপোর্টের সঙ্গে থাকে নিহত ব্যক্তির লাশের ছিন্নভিন্ন দেহ ও বিকৃত মুখমণ্ডলের ছবি। একদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তির নানা অনুষ্ঠানের ছবি এবং অন্যদিকে দেশের দিকে দিকে নরহত্যার ছবি মিলিয়ে দেখলে মনে হয়, স্বাধীনতা জনগণের জীবনে এসেছে এক অভিশাপের মতো। এভাবে কথাটা বলার পরিবর্তে বলতে হয় যে স্বাধীনতার পরিণতি আজ এই অবস্থাতে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও এর পূর্ববর্তী সংগ্রামের দিনগুলোতে জনগণের মধ্যে এমন কোনো দুর্ভাবনাই ছিল না যা আজকের বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে দৈনন্দিন ভাবনায়।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের ফলে দেশের মানুষ দুধেভাতে থাকবে, এই ভাবনাই ছিল মানুষের মনে। কিন্তু পূর্ব বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থেকে এমন কিছু পায়নি যাতে মনে হতে পারত যে, জনগণ আসলে স্বাধীনতার কোনো সুফল পেয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক লোক কিছু সুবিধা পেলেও সাধারণভাবে জনগণের জীবনে তেমন কিছু ঘটেনি। বঞ্চিত হলেই মানুষ বঞ্চনার জীবন পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে না। তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা যায়। তারা মাঝে মধ্যে বিক্ষোভও প্রকাশ করে। কিন্তু বিক্ষোভ ও সংগ্রাম এক জিনিস নয়। মানুষ সংগ্রামে নামে তখনই যখন তার মনে শুধু বঞ্চনার ক্ষোভ থাকে না, ক্ষোভের সঙ্গে জন্ম নেয় এমন সচেতনতা যাতে তারা মনে করে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব। ১৯৪৭ সালের পর থেকে হাজারো বঞ্চনার মধ্য দিয়ে এই সচেতনতার জোরে পাকিস্তান আমলে জনগণ স্বাধীনতার সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ফলে শাসকশ্রেণীর জাতিগত চরিত্র পরিবর্তন হয়েছিল কিন্তু তার থেকে বেশি কিছুই হয়নি। শুধু তাই নয়, স্বজাতীয় শাসকশ্রেণীর কবলে পড়ে বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত জনগণের দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বজাতীয় শাসকশ্রেণীর লোকেরা লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেরা কোটি কোটি, শতকোটি, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলেও জনগণের জীবনে এমন কোনো পরিবর্তন আসেনি যাতে তাদের দুঃখ-দুর্দশার লাঘব হয়। এমনকি দুঃখ-দুর্দশা পাকিস্তান আমলের থেকে কমে আসে। বরং এর উল্টোটিই এখানে ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, মানুষ পাকিস্তান আমলের মতো অথবা তার থেকেও বেশি অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও অন্যদিক দিয়ে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। পাকিস্তানি আমলে জনজীবনে বঞ্চনা বড় রকম হলেও তখন মানুষের জীবনের, মান-সম্মানের নিরাপত্তা ছিল। সে সময় কখনো-সখনো দুই-একজন ঘটনাক্রমে নিহত হলে তাই নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় হতো। পুলিশ যে কোনো লোককে রিমান্ডে বা নিজেদের হেফাজতে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করত না, যেভাবে এখন কথায় কথায় লোকদের, এমনকি সম্পূর্ণ নিরীহ লোকদের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। অর্থাৎ খাওয়া-পরা, চিকিৎসা-শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি জনগণের জীবনে হয়ইনি, উপরন্তু আজ মানুষের শারীরিক নিরাপত্তা পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিপন্ন হচ্ছে। নরহত্যা সমাজের সর্বস্তরে যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, হত্যাকাণ্ডের বৈচিত্র্য যে আকার ধারণ করেছে, তাতে বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ শুধু দুনিয়ার সব থেকে দরিদ্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবেই নয়, সব থেকে পৎরসরহধষরুবফ বা অপরাধীকরণকৃত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে!
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা এমন দাঁড়িয়েছে যেখানে এ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। সাধারণভাবে জনগণের মধ্যেও নিরাপত্তাহীনতাসৃষ্ট এক ধরনের ত্রাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। অপরাধের বৈচিত্র্যের কথা আগে বলা হয়েছে। গুম-খুন এখন এই বৈচিত্র্য ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এদিক দিয়ে দুনিয়ার অন্যতম নিকৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানকেও বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে!
বাংলাদেশে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তগিরি এখন যেভাবে সমগ্র জনজীবনে অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে এটা হঠাৎ করে ঘটেনি। বাস্তবত পাকিস্তান রাষ্ট্রের গর্ভ থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও, পাকিস্তানের প্রত্যেকটি নেতিবাচক গুণাগুণ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গ্রাস করে আছে। বাংলাদেশে সামরিক অথবা বেসামরিক যে ধরনের শাসনেই থাকুক, জনগণের হাত-পা ও মুখ আগের থেকে অনেক শক্তভাবে বাঁধা আছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে নতুন ও স্বজাতীয় স্বৈরতন্ত্রের জন্যই বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তান আমলে সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল!
অন্য কথা বাদ দিয়ে এখানে শুধু নরহত্যার অপরাধের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে যে বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে তার কোনো তুলনা ইতিহাসে নেই। এর কারণ এই হত্যাকাণ্ড যে শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবেই হচ্ছে তাই নয়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত যেভাবে ভয়াবহ থেকে অধিকতর ভয়াবহ ব্যাপার হিসেবে দেখা দিয়েছে তার প্রভাবেই সমাজের সব ক্ষেত্র এখন পরিণত হয়েছে এক অপরাধের জগতে।
পুলিশ হেফাজতে মানুষের মৃত্যু বাংলাদেশে যেভাবে প্রথম থেকে হয়ে এসেছে এমন আর কোনো স্বাধীন দেশে হয়েছে বা হচ্ছে বলে জানা নেই। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরমুহূর্ত থেকেই এখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশ ২০০৭-০৮ সাল ছাড়া এই কুড়ি বছরে সংসদীয় সরকারের অধীনে শাসিত হচ্ছে। ১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে অগণিত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এদিক দিয়ে বিএনপি, আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিএনপির আমলে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুকে বলা হতো হার্টফেল হয়ে মৃত্যু। পরে র্যাব গঠিত হওয়ার পর থেকে পুলিশ ও র্যাবের হাতে খুন হওয়াকে বলা হয়ে থাকে ক্রসফায়ারে মৃত্যু। আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের আমলে ক্রসফায়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মূল কারণ বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর চরিত্র উত্তরোত্তর হিংস্র হচ্ছে তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। ক্রসফায়ার, হার্টফেল ইত্যাদির কঠোর সমালোচনা দেশে-বিদেশে হতে থাকার কারণে সেটা বন্ধ না হলেও কমে এসেছে, হতে পারে সাময়িকভাবে! এখন যেভাবে মানুষকে অপহরণ করে গুম-খুন করা হচ্ছে, এটা এক জনগণের বিভিন্ন স্তরে মহাআতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কারণ এই হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয়ভাবে হচ্ছে এবং সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজে এভাবে নরহত্যা ছড়িয়ে পড়ত না, যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু না হতো। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আজ বাংলাদেশে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যাতে পরিবার, বন্ধুমহল, সহকর্মী মহল ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নরহত্যা পরিণত হয়েছে এক দৈনন্দিন ব্যাপারে। বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও সমাজের অপরাধীকরণ কত ব্যাপক হয়েছে, কত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ড চলছে তার রিপোর্ট প্রতিদিনের সংবাদপত্রে দেখা যায়।
এখানে যে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার তা হলো, স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের অবস্থা এমন হলো কেন? এ নিয়ে কোনো আলোচনা বাংলাদেশে হয় না। সে চেষ্টা করলে তাকে শাসন করা হয়। এ প্রসঙ্গে যা বলা দরকার তা হলো একটি দেশে রাষ্ট্র যদি এ ক্ষেত্রে নিজেই ভূমিকা রাখে, তাহলে সরকারের বাইরে এসব অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব হয় না। এটাই আজ বাংলাদেশে ঘটছে।
১৯.১২.২০১১
বাংলাদেশে নরহত্যা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে এক নিয়মিত ব্যাপার। এমন দিন নেই যখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নরহত্যার কোনো রিপোর্ট থাকে না। দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠার ওপর চোখ রাখলেই দেখা যায় নরহত্যার রিপোর্ট। এই রিপোর্টের সঙ্গে থাকে নিহত ব্যক্তির লাশের ছিন্নভিন্ন দেহ ও বিকৃত মুখমণ্ডলের ছবি। একদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তির নানা অনুষ্ঠানের ছবি এবং অন্যদিকে দেশের দিকে দিকে নরহত্যার ছবি মিলিয়ে দেখলে মনে হয়, স্বাধীনতা জনগণের জীবনে এসেছে এক অভিশাপের মতো। এভাবে কথাটা বলার পরিবর্তে বলতে হয় যে স্বাধীনতার পরিণতি আজ এই অবস্থাতে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও এর পূর্ববর্তী সংগ্রামের দিনগুলোতে জনগণের মধ্যে এমন কোনো দুর্ভাবনাই ছিল না যা আজকের বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে দৈনন্দিন ভাবনায়।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের ফলে দেশের মানুষ দুধেভাতে থাকবে, এই ভাবনাই ছিল মানুষের মনে। কিন্তু পূর্ব বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত থেকে এমন কিছু পায়নি যাতে মনে হতে পারত যে, জনগণ আসলে স্বাধীনতার কোনো সুফল পেয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক লোক কিছু সুবিধা পেলেও সাধারণভাবে জনগণের জীবনে তেমন কিছু ঘটেনি। বঞ্চিত হলেই মানুষ বঞ্চনার জীবন পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে না। তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা যায়। তারা মাঝে মধ্যে বিক্ষোভও প্রকাশ করে। কিন্তু বিক্ষোভ ও সংগ্রাম এক জিনিস নয়। মানুষ সংগ্রামে নামে তখনই যখন তার মনে শুধু বঞ্চনার ক্ষোভ থাকে না, ক্ষোভের সঙ্গে জন্ম নেয় এমন সচেতনতা যাতে তারা মনে করে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব। ১৯৪৭ সালের পর থেকে হাজারো বঞ্চনার মধ্য দিয়ে এই সচেতনতার জোরে পাকিস্তান আমলে জনগণ স্বাধীনতার সংগ্রামে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ফলে শাসকশ্রেণীর জাতিগত চরিত্র পরিবর্তন হয়েছিল কিন্তু তার থেকে বেশি কিছুই হয়নি। শুধু তাই নয়, স্বজাতীয় শাসকশ্রেণীর কবলে পড়ে বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত জনগণের দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বজাতীয় শাসকশ্রেণীর লোকেরা লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেরা কোটি কোটি, শতকোটি, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হলেও জনগণের জীবনে এমন কোনো পরিবর্তন আসেনি যাতে তাদের দুঃখ-দুর্দশার লাঘব হয়। এমনকি দুঃখ-দুর্দশা পাকিস্তান আমলের থেকে কমে আসে। বরং এর উল্টোটিই এখানে ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, মানুষ পাকিস্তান আমলের মতো অথবা তার থেকেও বেশি অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও অন্যদিক দিয়ে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। পাকিস্তানি আমলে জনজীবনে বঞ্চনা বড় রকম হলেও তখন মানুষের জীবনের, মান-সম্মানের নিরাপত্তা ছিল। সে সময় কখনো-সখনো দুই-একজন ঘটনাক্রমে নিহত হলে তাই নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় হতো। পুলিশ যে কোনো লোককে রিমান্ডে বা নিজেদের হেফাজতে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করত না, যেভাবে এখন কথায় কথায় লোকদের, এমনকি সম্পূর্ণ নিরীহ লোকদের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। অর্থাৎ খাওয়া-পরা, চিকিৎসা-শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি জনগণের জীবনে হয়ইনি, উপরন্তু আজ মানুষের শারীরিক নিরাপত্তা পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিপন্ন হচ্ছে। নরহত্যা সমাজের সর্বস্তরে যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, হত্যাকাণ্ডের বৈচিত্র্য যে আকার ধারণ করেছে, তাতে বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ শুধু দুনিয়ার সব থেকে দরিদ্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবেই নয়, সব থেকে পৎরসরহধষরুবফ বা অপরাধীকরণকৃত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে!
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে গুপ্তহত্যা এমন দাঁড়িয়েছে যেখানে এ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। সাধারণভাবে জনগণের মধ্যেও নিরাপত্তাহীনতাসৃষ্ট এক ধরনের ত্রাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। অপরাধের বৈচিত্র্যের কথা আগে বলা হয়েছে। গুম-খুন এখন এই বৈচিত্র্য ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এদিক দিয়ে দুনিয়ার অন্যতম নিকৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানকেও বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে!
বাংলাদেশে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তগিরি এখন যেভাবে সমগ্র জনজীবনে অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে এটা হঠাৎ করে ঘটেনি। বাস্তবত পাকিস্তান রাষ্ট্রের গর্ভ থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও, পাকিস্তানের প্রত্যেকটি নেতিবাচক গুণাগুণ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গ্রাস করে আছে। বাংলাদেশে সামরিক অথবা বেসামরিক যে ধরনের শাসনেই থাকুক, জনগণের হাত-পা ও মুখ আগের থেকে অনেক শক্তভাবে বাঁধা আছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে নতুন ও স্বজাতীয় স্বৈরতন্ত্রের জন্যই বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তান আমলে সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল!
অন্য কথা বাদ দিয়ে এখানে শুধু নরহত্যার অপরাধের দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে, স্বাধীন বাংলাদেশে এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে যে বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে তার কোনো তুলনা ইতিহাসে নেই। এর কারণ এই হত্যাকাণ্ড যে শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবেই হচ্ছে তাই নয়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত যেভাবে ভয়াবহ থেকে অধিকতর ভয়াবহ ব্যাপার হিসেবে দেখা দিয়েছে তার প্রভাবেই সমাজের সব ক্ষেত্র এখন পরিণত হয়েছে এক অপরাধের জগতে।
পুলিশ হেফাজতে মানুষের মৃত্যু বাংলাদেশে যেভাবে প্রথম থেকে হয়ে এসেছে এমন আর কোনো স্বাধীন দেশে হয়েছে বা হচ্ছে বলে জানা নেই। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরমুহূর্ত থেকেই এখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশ ২০০৭-০৮ সাল ছাড়া এই কুড়ি বছরে সংসদীয় সরকারের অধীনে শাসিত হচ্ছে। ১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে অগণিত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এদিক দিয়ে বিএনপি, আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিএনপির আমলে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুকে বলা হতো হার্টফেল হয়ে মৃত্যু। পরে র্যাব গঠিত হওয়ার পর থেকে পুলিশ ও র্যাবের হাতে খুন হওয়াকে বলা হয়ে থাকে ক্রসফায়ারে মৃত্যু। আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের আমলে ক্রসফায়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মূল কারণ বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর চরিত্র উত্তরোত্তর হিংস্র হচ্ছে তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। ক্রসফায়ার, হার্টফেল ইত্যাদির কঠোর সমালোচনা দেশে-বিদেশে হতে থাকার কারণে সেটা বন্ধ না হলেও কমে এসেছে, হতে পারে সাময়িকভাবে! এখন যেভাবে মানুষকে অপহরণ করে গুম-খুন করা হচ্ছে, এটা এক জনগণের বিভিন্ন স্তরে মহাআতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কারণ এই হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রীয়ভাবে হচ্ছে এবং সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজে এভাবে নরহত্যা ছড়িয়ে পড়ত না, যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু না হতো। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আজ বাংলাদেশে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যাতে পরিবার, বন্ধুমহল, সহকর্মী মহল ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নরহত্যা পরিণত হয়েছে এক দৈনন্দিন ব্যাপারে। বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও সমাজের অপরাধীকরণ কত ব্যাপক হয়েছে, কত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ড চলছে তার রিপোর্ট প্রতিদিনের সংবাদপত্রে দেখা যায়।
এখানে যে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার তা হলো, স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের অবস্থা এমন হলো কেন? এ নিয়ে কোনো আলোচনা বাংলাদেশে হয় না। সে চেষ্টা করলে তাকে শাসন করা হয়। এ প্রসঙ্গে যা বলা দরকার তা হলো একটি দেশে রাষ্ট্র যদি এ ক্ষেত্রে নিজেই ভূমিকা রাখে, তাহলে সরকারের বাইরে এসব অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব হয় না। এটাই আজ বাংলাদেশে ঘটছে।
১৯.১২.২০১১
No comments