সোনালি রোদের ডানা by আশিক মুস্তাফা
রোদ আর জোছনা কখনও বসে না এক বেঞ্চিতে। চটপটি-ফুচকা খায় না আহ্লাদ করে। শোনে না বাদামের উতলা সুর। কাছাকাছি হয়ে একই ছাতার নিচে হেঁটে যায় না ফুটপাত ধরে। দু'জন থাকে দু'জনার মতো করে। প্রতিনিয়ত তারা দিন আর রাতের বারতা বয়ে বেড়ায়। আমাদের কাছে দুটোর গুরুত্বই সমান হওয়ার কথা! তবু আমরা কেন যেন জোছনাকেই বেশি ভালোবাসি। গভীর রাতেও নিশ্চিন্তে জোছনার গায়ে তুলে দিই আবেগি জাহাজের মাস্তুল।
মুগ্ধ হয়ে মেঠোপথে দেখি জোছনার ফুল। রাজপথ দাবড়ে বেড়াতে সহিসরা প্রিয় ঘোড়ার ক্ষুরে লাগিয়ে দেয় স্টিলের পাত। যাকে বলা হয় নাদি। এই আবেগি জোছনাটা মাঝে মধ্যে আমাদের কাছে ধরা দেয় ঘোড়ার নাদি হয়ে! তখন রোদের বাহাদুরি বেড়ে যায়। সূর্যটাকে ঘরের পোষা মনে হয়। তখন আমরা আপন করে নিই রোদ। কাছে টেনে নিই রোদের ঝলকানি। আহ্লাদ পেয়ে রোদও তখন কুমড়ো লতার মতো দিগন্ত জয়ের মিছিলে নামে। সেই মিছিলে গলা মিলিয়ে নেয় কোটি কোটি বাঙালি। তখন মিলিটারির জলপাই রঙের জিপ গাড়ির শব্দ খাদে নামতে শুরু করে। নামতে নামতে অতলে হারিয়ে যায়। যেমন করে হারিয়ে গিয়েছিল একাত্তরে। আকাশে পাকিস্তানি বিমান মরা মাছের দৃষ্টি নিয়ে চক্কর দেয়। কিছুই ধরা দেয় না বিমানের চোখে। যেমন ধরা দেয়নি সেই ডিসেম্বরের দিনগুলোতে।
ভাবনার রোদমিছিলে লাল সূর্য মেতে ওঠে কাঁচা সবুজ রঙ গায়ে মেখে। লাল-সবুজে একাকার হয়ে যাই আমরা। মেতে উঠি বিজয়ের উল্লাসে। ডিসেম্বরের সূর্য আমাদের বিজয়ের বারতা দেয়। মনে করিয়ে দেয় আত্মত্যাগী সেই মহান মুক্তিযোদ্ধাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠের কথা, তাদের স্বপ্নের কথা। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। তবু মাঝেমধ্যে হতাশা কাজ করে আমাদের ধেড়েল মনে। আমরা স্বেচ্ছায় বারবার স্লিপার থেকে পিছলে পড়ি। ভুলে যাই মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপি্নল বাংলাদেশের কথা। লজ্জাবতীর লতার মতো বারবার নিজেদের গুটিয়ে নিই। শিকড়কাটা লাউয়ের ডগার মতো মুখ থুবড়ে পড়ি। কেন যেন ভাবতে চাই না দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা। বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের জোরালো অবস্থানের কথা। আমরা বারবার ভুল করে অন্ধকারের মিছিলে স্লোগান ধরি। আলোর মিছিলটা পাশ কাটিয়ে যাই। সূর্য তখন তার রূপ হারাতে বসে। ফিকে হয়ে আসে সবুজের কাঁচা রঙ। ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলা রুগ্ণ মানুষের মতো আমাদের দিকে বিশ্ব করুণার দৃষ্টি রাখুক_ সেটা আমরা আর চাই না। চাই না সূর্যটা বারবার অসময়ে মুখের সামনে থেকে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিক।
আচ্ছা, এমন হওয়ার কথা ছিল? বলবে, অবশ্যই না। আমরা আমাদের দেশটাকে আমাদের মতো করে গড়ব। আমাদের বীর সেনাদের চেতনা বুকে নিয়ে, তাদের স্বপ্নের সোনালি বন্দরে হেঁটে হেঁটে আমরা সাগরের নীল জল পাড়ি দিয়ে আকাশ ছুঁয়ে আসব। বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠতে উঠতে আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা সাজাব নতুন করে। আমাদের ধেড়েল মনের উদার আকাশে উড়াতে পারি দেশাত্মবোধের রঙিন ফড়িং। রোদের ডালে গিয়ে বসবে ফড়িং। সোনালি রোদের পাতায় পাতায় রাজ্যের সুখ খুঁজে পাবে। নির্বিঘ্নে হেসেখেলে সময় কাটাবে ফড়িং। আর সেই ফড়িংয়ের লেজ ধরে এগিয়ে যাব আমরা। এগিয়ে যাবে আমাদের রঙিন স্বপ্ন। এগিয়ে যাবে প্রিয় দেশ, প্রিয় মাতৃভূমি।
No comments