কল্পকথার গল্প-অক্ষমতা ও ক্ষমতার পরিমাপ by আলী হাবিব
শুরুতেই পুরাণ আশ্রয় করা যাক। ভীমকে তো চেনেন। না, দেখে না থাকলে কোনো ক্ষতি নেই। বাড়ির যেকোনো শিশুকে জিজ্ঞেস করুন। সে কার্টুন সিরিজের 'ভীমা' সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ একটা বক্তৃতা দিয়ে দেবে। আর যাঁরা জানেন, তাঁরা তো জানেনই ভীম হচ্ছেন মধ্যম পাণ্ডব। অসীম শক্তির অধিকারী। শক্তির কারণে অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখতেন তিনি। বাহুযুদ্ধ, গতিবেগ বা ব্যায়ামে কেউই ভীমের সমকক্ষ ছিলেন না। অনেক হাতির শক্তি নিজের শরীরে
ধারণ করতেন ভীম। তাঁর এই ক্ষমতার কারণে তিনি দুর্যোধনদের নিগ্রহের কারণ হয়ে ওঠেন। বাল্যকালেই তাঁকে বিনাশ করতে চেয়েছিলেন দুর্যোধন। এই দুর্যোধন সম্পর্কেও আমরা জানি। দুর্বুদ্ধির অভাব ছিল না তাঁর। একবার গঙ্গাতীরে প্রামাণকোটি নামক স্থানে জলক্রীড়ার জন্য একটি জায়গা তৈরি করেছিলেন দুর্যোধন। সেখানে ভাইদের সবাইকে ডেকেছিলেন। এখানে ভীমকে বিষ মেশানো মিষ্টি খাইয়ে অজ্ঞান করে লতা-পাতা দিয়ে বেঁধে পানিতে ফেলে দিলেন দুর্যোধন। পানিতে নিমজ্জিত ভীম পতিত হলেন নাগলোকে। বিষে বিষে বিষক্ষয় বলে একটা কথা আছে। ওই নাগলোকে নাগ-দংশনে ভীমের বিষক্ষয় হয়। সেখানে নাগরাজ বাসুকি ভীমকে চিনতে পারেন। রাজার ছেলেদের চিনতে পারলে যা হয়, ভীম সমাদর পেলেন। সেখানে বাসুকি তাঁকে এক ধরনের পানীয় দিলেন। সেই পানীয় পান করে ভীম একটানা আট দিন ঘুমালেন। ঘুম ভাঙার পর তাঁর শরীরে অযুত হাতির সমান বল সঞ্চার হলো। ভীম ফিরলেন ঘরে। এর পরের খবরও সবার জানা। পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে শুরু হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে দুর্যোধন বারণাবাতে জতুগৃহ নির্মাণ করে পঞ্চপাণ্ডবসহ কুন্তিকেও জীবন্ত দগ্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এখানেও ভীম। বিদুর অবশ্য আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছিলেন। অতএব, 'যঃ পলায়তি!' পালানোর সময় ভীম কুন্তিকে কাঁধে, ছোটভাই নকুল ও সহদেবকে কোলে তুলে নিলেন। যুধিষ্ঠির ও অর্জুনের হাত ধরে সোজা গঙ্গাতীরে। নিজের শরীরী ক্ষমতার পরিচয় দিলেন এভাবেই। ভীমের ক্ষমতার গল্প আরো আছে। বক নামের এক রাক্ষস নগর রক্ষার নামে প্রতিদিন একজন করে মানুষ ভক্ষণ করত। ভীম সেই রাক্ষসকে বধ করেন। মগধরাজ জরাসন্ধকে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন ভীম। ভীমের কীর্তির অন্ত নেই। কিন্তু এই ক্ষমতার নেপথ্যেও ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতাই হচ্ছে আসল ক্ষমতা।
ক্ষমতা থাকলে সেটা দেখানো যায়। সমাজ-সংসারে ক্ষমতা ছাড়া মূল্য নেই। ক্ষমতাহীন জীবন মূল্যহীন। ক্ষমতা থাকলে দেখানো যায়। না থাকলে দেখানোর কিছু নেই। ক্ষমতা না থাকলে সব কিছু কেমন পানসে লাগে। কাজেই ক্ষমতা দরকার। ক্ষমতার জন্য সরকারে থাকতে হবে, এটা বোধ হয় এখন স্বতঃসিদ্ধ একটা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অনেকটাই নিপাতনে সিদ্ধ_সরকার না হলে ক্ষমতা থাকে না। কাজেই ক্ষমতায় থাকতে হলে সরকারে থাকতে হয়। সরকারে থাকা মানে সরকারের উপদেষ্টা-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী হওয়া নয়। হতে পারলে মন্দ নয়। তারিয়ে তারিয়ে ক্ষমতাটা উপভোগ করা যায়। যাঁদের ক্ষমতা আছে, তাঁদের বলা হয় ক্ষমতাশালী। ক্ষমতা দেখানোর জন্য ক্ষমতাশালীদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতেই হবে। ক্ষমতাশালীদের কাছাকাছি যেতে পারলে ক্ষমতা দেখানো হয়। উদাহরণসহ বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
এটা তো ডিসেম্বর মাস। ডিসেম্বর মানেই বিজয়ের মাস। বিজয়টা এল কোত্থেকে? দখিনা বাতাসে উড়ে আসেনি। আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়েনি। বিজয় কোনো গাছের ফল নয়; গাছ থেকে টুপ করে পড়ল, আর আমরা কুড়িয়ে নিজেদের ঝুড়িতে তুলে ফেললাম! বিজয় আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। কেমন করে? সে ইতিহাস ছোট করে বলার মতো নয়। স্বাধীনতার জন্য এই জাতিকে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করতে হয়েছে। অনেকের দাবি, ওয়ান ফাইন মর্নিং বাঙালি জাতি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে গেল। এর আগে নাকি জাতির সামনে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। আবার এমনও হতে পারে, ছিল। নির্দেশনা, দিকনির্দেশনা_সবই ছিল। এখন এভাবে যাঁরা কথা বলেন, তখন তাঁরাও সে নির্দেশনা ও দিকনির্দেশনা সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার বলয়ে থাকার জন্য তাঁদের এই উপলব্ধি যে একসময় বদলে যেতে পারে, এটা হয়তো তাঁদের মনে হয়নি। গিরগিটি যেমন সকাল-বিকেল রং বদলায়, তেমনটি নিজেদের বদলে নিতে অনেকেরই সময় লাগেনি। কিংবা সময় বদলে যাওয়াতে এখন বোধ হয় এটা অনেকে ভুলে থাকতে চাইছেন। ভুলে থাকলে যদি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা যায়, তাহলে তো ভুলে থাকাই উত্তম।
ক্ষমতা থাকলে হবে না, ব্যবহার করতেও জানতে হবে। ক্ষমতা ব্যবহারের কায়দা-কানুন সবার জানা নেই। ব্যবহারবিধি জানা না থাকলে ক্ষমতা অনেক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমতার জন্য তৈরি হতে হয়। কাউকে কাউকে ক্ষমতার জন্য নির্মম-নিষ্ঠুর হতে হয়। একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যেতে পারে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের গল্পটাই বলা যাক। ইতিহাস বলে, তিনি মেধাবী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। ক্ষমতায় আরোহণের পর তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁকে নিয়ে তো বাংলায় কবিতাও লেখা হয়েছে, 'সত্যই তুমি মহান-উদার বাদশাহ আলমগীর।' কিন্তু ক্ষমতার বলয় ঠিক রাখতে কতটা নিষ্ঠুর হতে হয়, তার উদাহরণও আওরঙ্গজেব সৃষ্টি করেছিলেন। কথিত আছে, তিনি তাঁর বাবা ও বোনকে কারাগারে আটকে রেখেছিলেন। এমনকি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের ভাইদের হত্যা করতে দ্বিধা করেননি তিনি। ভাইয়ের কর্তিত মস্তক পাঠিয়েছিলেন বাবার কাছে। শেঙ্পিয়ারের ম্যাকবেথ! সেখানেও তো ক্ষমতার জন্য রক্তপাত। স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকান। রাজার সেনাপতি ম্যাকবেথ। ম্যাকবেথের স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথ। ম্যাকবেথের স্ত্রীকে প্ররোচিত করে হত্যা করা হয় রাজা ডানকানকে।
আমাদের দেশেও তো ক্ষমতা দখলের জন্য, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কম রক্তপাত হয়নি। রক্তপাতের ভেতর দিয়ে যে অপরাজনীতির শুরু সেই পঁচাত্তরে, সেই অপরাজনীতির ধারাবাহিকতা কি বন্ধ হয়ে গেছে? এই রাজনীতির সঙ্গে যাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, তাঁদের সঙ্গে চষারামের তুলনা করা যেতে পারে। চষারামের গল্পটি তো অনেকেরই জানা। তবু আরেকবার গল্পটি শোনানো যাক। চষারাম নামে এককালে এক নায়েব ছিল। তার অত্যাচারে মর্ত্যবাসী অতিষ্ঠ। সব দেখেশুনে দেবরাজ ইন্দ্র একদিন ডেকে পাঠালেন যমরাজকে। যমরাজকে ডেকে ইন্দ্র বললেন, 'তুমি এত কিছু পার, আর ওই চষারামকে তুলে আনতে পারছ না?' যমরাজ বললেন, 'দেখুন আমার ওখানে তো রেজিস্টার মেইনটেইন করা হয়। সবারই একেকটা অ্যাকাউন্ট আছে। যার যেটা নির্দিষ্ট দিন, তার বাইরে যাওয়ার তো হুকুম নেই আমার।' দেবরাজ বললেন, 'সে তোমার হুকুম নেই বুঝলাম, কিন্তু মর্ত্যের মানুষ তো অতিষ্ঠ হয়ে গেল। তাদের হাহাকার তো আমার আর সহ্য হচ্ছে না। একটা কিছু করা যায় কি না ভেবে দেখো। দরকার পড়লে ওকে তুলে আনো। তোমার রেজিস্টারে কী আছে দেখো। সেটাকে এদিক-সেদিক করা যাবে না, তেমন তো নয়। তুমি ব্যবস্থা নাও। আমি ব্রহ্মাকে সামলাব।' দেবরাজের অভয় পেয়ে যমরাজ ফিরে এলেন তাঁর দপ্তরে। খাতা খুলে দেখেন, সহসা চষারামের মৃত্যু নেই। তিনি আবার গেলেন দেবরাজ ইন্দ্রের দপ্তরে। দেবরাজকে বললেন, 'দেবরাজ, আমার খাতা খুলে দেখলাম, সহসা চষারামের মৃত্যু নেই।' দেবরাজ বললেন, 'তুলে নিয়ে এসো। তুলে নিয়ে আসার পর ওটা চেঞ্জ করে ফেলো। কেউ তো আর জানতে পারছে না। তোমার কাছে কেউ কোনো কৈফিয়তও চাইছে না। ব্রহ্মা যদি কোনো প্রশ্ন তোলেন, সেটা সামলানোর দায়িত্ব আমার। আমি সামলাব। ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।' আবার ফিরে এলেন যমরাজ। ফিরে এসে তাঁর বিশ্বস্ত দুই যমদূত পাঠিয়ে দিলেন। তারা মর্ত্যে গিয়ে যখন চষারামের বাড়িতে পেঁৗছল, মর্ত্যে তখন ভোররাত। বলে নেওয়া ভালো, স্বর্গে যখন রাত, মর্ত্যে তখন দিন। আর স্বর্গে যখন দিন, মর্ত্যে তখন রাত। ভোররাতে পেঁৗছে যে খাটে চষারাম শুয়ে ছিল, সেটা ধরেই তারা তাকে স্বর্গে সোজা যমরাজের খাস কামরায় নিয়ে গেল। যখন নিয়ে গেল, তখন মর্ত্যে রাত। যমরাজ ঘুমাচ্ছিলেন। ওদিকে চষারামের গেল ঘুম ভেঙে। সে ঘুম থেকে উঠে দেখে, আরে এ তো নতুন জায়গা! সামনে আবার সিংহাসনের মতো আসন পাতা। চষারাম গিয়ে সোজা ওই চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ারটা হচ্ছে যমরাজের আসন। চেয়ারে যে বসে সে-ই তো হয়ে যায় পদাধিকারী। তো চেয়ারে বসে চষারাম হয়ে গেল যমরাজ। সেটা অবশ্য সে কখনো বুঝতে পারেনি। যা হোক, যমরাজ ঘুম থেকে জেগে খাস কামরায় ঢুকেই দেখেন তাঁর চেয়ার অন্য একজন দখল করে বসে আছে। এখন উপায়? চেয়ার না থাকলে তিনি তো আর যমরাজ নন। এখন কী হবে? যমরাজ চষারামকে অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। কোনো কাজ হলো না। চষারাম জানতে চাইল, তাকে এখানে কে এনেছে, কেন এনেছে? যমরাজ জানালেন, এটা যমের দরবার। তাকে যমের বাড়িতে তুলে আনা হয়েছে। এখন চষারাম দয়া করে ওই চেয়ারটা ছেড়ে দিলেই ভালো হয়। চষারাম বুঝল, চেয়ারটার কোনো মাজেজা আছে। সে বলল, 'অত সহজে তো আমি চেয়ার ছাড়ব না। আমাকে কেন আনা হয়েছে সেটা আগে বলো।' যমরাজ সব খুলে বলতে বাধ্য হলেন। চেয়ারটা উদ্ধার করতে হবে। চষারাম সব শুনে জানাল, সে চেয়ার ছেড়ে দিতে রাজি আছে, তবে তাকে আবার মর্ত্যে দিয়ে আসতে হবে। চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগে চষারাম ভাবল, 'যমের বাড়িতে পা রাখলামই যখন, জেনে যাই কবে মরব। সে যমরাজকে বলল, 'যাও খাতাটা নিয়ে এসো। কবে মরছি সেটা আগে জেনে যাই।' যমরাজ তাঁর খাতাটা এনে হাজির করলেন। খাতা খুলে দেখে তো চষারাম অবাক! সে দেখে তার আয়ু আর মাত্র মাস দুই। সর্বনাশ! এত তাড়াতাড়ি মরলে কেমন করে হবে? সে যমরাজকে বলল, এই দিনটা বদলে দাও ভাই। লিখে রাখো, 'চষারামের মৃত্যু আগামীকাল।' যমরাজ ভাবলেন, লোকটা আচ্ছা বোকা তো! কালই মরতে চায়। মহাখুশিতে তিনি লিখলেন, 'চষারামের মৃত্যু আগামীকাল।' যে দুই যমদূত চষারামকে নিয়ে এসেছিল, তারা এসে চষারামকে আবার আগের জায়গায় অর্থাৎ তার বাড়িতে রেখে এল। যমরাজ পরদিন মহা উৎসাহে খাতা খুললেন। আজ চষারামকে যমের বাড়ি ভালো করে চিনিয়ে দেবেন। কিন্তু খাতা খুলে দেখেন, তাঁর নিজের হাতেই লেখা, 'চষারামের মৃত্যু আগামীকাল।' তাহলে তো আজ আর হচ্ছে না। ঠিক আছে কাল দেখা যাবে। প্রতিদিনই খাতা খোলেন তিনি আর দেখেন লেখা আছে চষারামের মৃত্যু আগামীকাল। চষারামের আর মৃত্যু হয় না।
চষারাম ছেড়ে আবার ক্ষমতা নিয়ে চটকানো যাক। ক্ষমতাবান যাঁরা, তাঁরা ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। তাঁরা কি কখনো নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে থাকেন? অক্ষমতার একটি গল্প বলা যাক। সর্দারজি জোক। এক সর্দারজি গেছেন একটা খাবারের দোকানে। একটা পিৎজা কিনেছেন। প্যাকেটে নিয়ে নেবেন। পথে যেতে যেতে গাড়িতে বসে খাবেন, এমনটাই ইচ্ছে ভদ্রলোকের। দোকানের লোকটি জানতে চাইল, পিৎজা কয় টুকরা করে কাটতে হবে, ছয় টুকরা নাকি আট টুকরা! সর্দারজি বললেন, ছয় টুকরাই করে দাও, আট টুকরা খাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
ঈশপের গল্পের মতো এই গল্পের কি কোনো মোর্যাল আছে? একটা কল্পনা করা যাক। ক্ষমতার পাশাপাশি নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা থাকা সবার জন্যই মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
ক্ষমতা থাকলে সেটা দেখানো যায়। সমাজ-সংসারে ক্ষমতা ছাড়া মূল্য নেই। ক্ষমতাহীন জীবন মূল্যহীন। ক্ষমতা থাকলে দেখানো যায়। না থাকলে দেখানোর কিছু নেই। ক্ষমতা না থাকলে সব কিছু কেমন পানসে লাগে। কাজেই ক্ষমতা দরকার। ক্ষমতার জন্য সরকারে থাকতে হবে, এটা বোধ হয় এখন স্বতঃসিদ্ধ একটা ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অনেকটাই নিপাতনে সিদ্ধ_সরকার না হলে ক্ষমতা থাকে না। কাজেই ক্ষমতায় থাকতে হলে সরকারে থাকতে হয়। সরকারে থাকা মানে সরকারের উপদেষ্টা-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী হওয়া নয়। হতে পারলে মন্দ নয়। তারিয়ে তারিয়ে ক্ষমতাটা উপভোগ করা যায়। যাঁদের ক্ষমতা আছে, তাঁদের বলা হয় ক্ষমতাশালী। ক্ষমতা দেখানোর জন্য ক্ষমতাশালীদের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতেই হবে। ক্ষমতাশালীদের কাছাকাছি যেতে পারলে ক্ষমতা দেখানো হয়। উদাহরণসহ বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
এটা তো ডিসেম্বর মাস। ডিসেম্বর মানেই বিজয়ের মাস। বিজয়টা এল কোত্থেকে? দখিনা বাতাসে উড়ে আসেনি। আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়েনি। বিজয় কোনো গাছের ফল নয়; গাছ থেকে টুপ করে পড়ল, আর আমরা কুড়িয়ে নিজেদের ঝুড়িতে তুলে ফেললাম! বিজয় আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। কেমন করে? সে ইতিহাস ছোট করে বলার মতো নয়। স্বাধীনতার জন্য এই জাতিকে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করতে হয়েছে। অনেকের দাবি, ওয়ান ফাইন মর্নিং বাঙালি জাতি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে গেল। এর আগে নাকি জাতির সামনে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। আবার এমনও হতে পারে, ছিল। নির্দেশনা, দিকনির্দেশনা_সবই ছিল। এখন এভাবে যাঁরা কথা বলেন, তখন তাঁরাও সে নির্দেশনা ও দিকনির্দেশনা সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার বলয়ে থাকার জন্য তাঁদের এই উপলব্ধি যে একসময় বদলে যেতে পারে, এটা হয়তো তাঁদের মনে হয়নি। গিরগিটি যেমন সকাল-বিকেল রং বদলায়, তেমনটি নিজেদের বদলে নিতে অনেকেরই সময় লাগেনি। কিংবা সময় বদলে যাওয়াতে এখন বোধ হয় এটা অনেকে ভুলে থাকতে চাইছেন। ভুলে থাকলে যদি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা যায়, তাহলে তো ভুলে থাকাই উত্তম।
ক্ষমতা থাকলে হবে না, ব্যবহার করতেও জানতে হবে। ক্ষমতা ব্যবহারের কায়দা-কানুন সবার জানা নেই। ব্যবহারবিধি জানা না থাকলে ক্ষমতা অনেক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। ক্ষমতার জন্য তৈরি হতে হয়। কাউকে কাউকে ক্ষমতার জন্য নির্মম-নিষ্ঠুর হতে হয়। একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যেতে পারে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের গল্পটাই বলা যাক। ইতিহাস বলে, তিনি মেধাবী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। ক্ষমতায় আরোহণের পর তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁকে নিয়ে তো বাংলায় কবিতাও লেখা হয়েছে, 'সত্যই তুমি মহান-উদার বাদশাহ আলমগীর।' কিন্তু ক্ষমতার বলয় ঠিক রাখতে কতটা নিষ্ঠুর হতে হয়, তার উদাহরণও আওরঙ্গজেব সৃষ্টি করেছিলেন। কথিত আছে, তিনি তাঁর বাবা ও বোনকে কারাগারে আটকে রেখেছিলেন। এমনকি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের ভাইদের হত্যা করতে দ্বিধা করেননি তিনি। ভাইয়ের কর্তিত মস্তক পাঠিয়েছিলেন বাবার কাছে। শেঙ্পিয়ারের ম্যাকবেথ! সেখানেও তো ক্ষমতার জন্য রক্তপাত। স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকান। রাজার সেনাপতি ম্যাকবেথ। ম্যাকবেথের স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথ। ম্যাকবেথের স্ত্রীকে প্ররোচিত করে হত্যা করা হয় রাজা ডানকানকে।
আমাদের দেশেও তো ক্ষমতা দখলের জন্য, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কম রক্তপাত হয়নি। রক্তপাতের ভেতর দিয়ে যে অপরাজনীতির শুরু সেই পঁচাত্তরে, সেই অপরাজনীতির ধারাবাহিকতা কি বন্ধ হয়ে গেছে? এই রাজনীতির সঙ্গে যাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, তাঁদের সঙ্গে চষারামের তুলনা করা যেতে পারে। চষারামের গল্পটি তো অনেকেরই জানা। তবু আরেকবার গল্পটি শোনানো যাক। চষারাম নামে এককালে এক নায়েব ছিল। তার অত্যাচারে মর্ত্যবাসী অতিষ্ঠ। সব দেখেশুনে দেবরাজ ইন্দ্র একদিন ডেকে পাঠালেন যমরাজকে। যমরাজকে ডেকে ইন্দ্র বললেন, 'তুমি এত কিছু পার, আর ওই চষারামকে তুলে আনতে পারছ না?' যমরাজ বললেন, 'দেখুন আমার ওখানে তো রেজিস্টার মেইনটেইন করা হয়। সবারই একেকটা অ্যাকাউন্ট আছে। যার যেটা নির্দিষ্ট দিন, তার বাইরে যাওয়ার তো হুকুম নেই আমার।' দেবরাজ বললেন, 'সে তোমার হুকুম নেই বুঝলাম, কিন্তু মর্ত্যের মানুষ তো অতিষ্ঠ হয়ে গেল। তাদের হাহাকার তো আমার আর সহ্য হচ্ছে না। একটা কিছু করা যায় কি না ভেবে দেখো। দরকার পড়লে ওকে তুলে আনো। তোমার রেজিস্টারে কী আছে দেখো। সেটাকে এদিক-সেদিক করা যাবে না, তেমন তো নয়। তুমি ব্যবস্থা নাও। আমি ব্রহ্মাকে সামলাব।' দেবরাজের অভয় পেয়ে যমরাজ ফিরে এলেন তাঁর দপ্তরে। খাতা খুলে দেখেন, সহসা চষারামের মৃত্যু নেই। তিনি আবার গেলেন দেবরাজ ইন্দ্রের দপ্তরে। দেবরাজকে বললেন, 'দেবরাজ, আমার খাতা খুলে দেখলাম, সহসা চষারামের মৃত্যু নেই।' দেবরাজ বললেন, 'তুলে নিয়ে এসো। তুলে নিয়ে আসার পর ওটা চেঞ্জ করে ফেলো। কেউ তো আর জানতে পারছে না। তোমার কাছে কেউ কোনো কৈফিয়তও চাইছে না। ব্রহ্মা যদি কোনো প্রশ্ন তোলেন, সেটা সামলানোর দায়িত্ব আমার। আমি সামলাব। ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।' আবার ফিরে এলেন যমরাজ। ফিরে এসে তাঁর বিশ্বস্ত দুই যমদূত পাঠিয়ে দিলেন। তারা মর্ত্যে গিয়ে যখন চষারামের বাড়িতে পেঁৗছল, মর্ত্যে তখন ভোররাত। বলে নেওয়া ভালো, স্বর্গে যখন রাত, মর্ত্যে তখন দিন। আর স্বর্গে যখন দিন, মর্ত্যে তখন রাত। ভোররাতে পেঁৗছে যে খাটে চষারাম শুয়ে ছিল, সেটা ধরেই তারা তাকে স্বর্গে সোজা যমরাজের খাস কামরায় নিয়ে গেল। যখন নিয়ে গেল, তখন মর্ত্যে রাত। যমরাজ ঘুমাচ্ছিলেন। ওদিকে চষারামের গেল ঘুম ভেঙে। সে ঘুম থেকে উঠে দেখে, আরে এ তো নতুন জায়গা! সামনে আবার সিংহাসনের মতো আসন পাতা। চষারাম গিয়ে সোজা ওই চেয়ারে বসে পড়ল। চেয়ারটা হচ্ছে যমরাজের আসন। চেয়ারে যে বসে সে-ই তো হয়ে যায় পদাধিকারী। তো চেয়ারে বসে চষারাম হয়ে গেল যমরাজ। সেটা অবশ্য সে কখনো বুঝতে পারেনি। যা হোক, যমরাজ ঘুম থেকে জেগে খাস কামরায় ঢুকেই দেখেন তাঁর চেয়ার অন্য একজন দখল করে বসে আছে। এখন উপায়? চেয়ার না থাকলে তিনি তো আর যমরাজ নন। এখন কী হবে? যমরাজ চষারামকে অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। কোনো কাজ হলো না। চষারাম জানতে চাইল, তাকে এখানে কে এনেছে, কেন এনেছে? যমরাজ জানালেন, এটা যমের দরবার। তাকে যমের বাড়িতে তুলে আনা হয়েছে। এখন চষারাম দয়া করে ওই চেয়ারটা ছেড়ে দিলেই ভালো হয়। চষারাম বুঝল, চেয়ারটার কোনো মাজেজা আছে। সে বলল, 'অত সহজে তো আমি চেয়ার ছাড়ব না। আমাকে কেন আনা হয়েছে সেটা আগে বলো।' যমরাজ সব খুলে বলতে বাধ্য হলেন। চেয়ারটা উদ্ধার করতে হবে। চষারাম সব শুনে জানাল, সে চেয়ার ছেড়ে দিতে রাজি আছে, তবে তাকে আবার মর্ত্যে দিয়ে আসতে হবে। চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগে চষারাম ভাবল, 'যমের বাড়িতে পা রাখলামই যখন, জেনে যাই কবে মরব। সে যমরাজকে বলল, 'যাও খাতাটা নিয়ে এসো। কবে মরছি সেটা আগে জেনে যাই।' যমরাজ তাঁর খাতাটা এনে হাজির করলেন। খাতা খুলে দেখে তো চষারাম অবাক! সে দেখে তার আয়ু আর মাত্র মাস দুই। সর্বনাশ! এত তাড়াতাড়ি মরলে কেমন করে হবে? সে যমরাজকে বলল, এই দিনটা বদলে দাও ভাই। লিখে রাখো, 'চষারামের মৃত্যু আগামীকাল।' যমরাজ ভাবলেন, লোকটা আচ্ছা বোকা তো! কালই মরতে চায়। মহাখুশিতে তিনি লিখলেন, 'চষারামের মৃত্যু আগামীকাল।' যে দুই যমদূত চষারামকে নিয়ে এসেছিল, তারা এসে চষারামকে আবার আগের জায়গায় অর্থাৎ তার বাড়িতে রেখে এল। যমরাজ পরদিন মহা উৎসাহে খাতা খুললেন। আজ চষারামকে যমের বাড়ি ভালো করে চিনিয়ে দেবেন। কিন্তু খাতা খুলে দেখেন, তাঁর নিজের হাতেই লেখা, 'চষারামের মৃত্যু আগামীকাল।' তাহলে তো আজ আর হচ্ছে না। ঠিক আছে কাল দেখা যাবে। প্রতিদিনই খাতা খোলেন তিনি আর দেখেন লেখা আছে চষারামের মৃত্যু আগামীকাল। চষারামের আর মৃত্যু হয় না।
চষারাম ছেড়ে আবার ক্ষমতা নিয়ে চটকানো যাক। ক্ষমতাবান যাঁরা, তাঁরা ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। তাঁরা কি কখনো নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে থাকেন? অক্ষমতার একটি গল্প বলা যাক। সর্দারজি জোক। এক সর্দারজি গেছেন একটা খাবারের দোকানে। একটা পিৎজা কিনেছেন। প্যাকেটে নিয়ে নেবেন। পথে যেতে যেতে গাড়িতে বসে খাবেন, এমনটাই ইচ্ছে ভদ্রলোকের। দোকানের লোকটি জানতে চাইল, পিৎজা কয় টুকরা করে কাটতে হবে, ছয় টুকরা নাকি আট টুকরা! সর্দারজি বললেন, ছয় টুকরাই করে দাও, আট টুকরা খাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
ঈশপের গল্পের মতো এই গল্পের কি কোনো মোর্যাল আছে? একটা কল্পনা করা যাক। ক্ষমতার পাশাপাশি নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা থাকা সবার জন্যই মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments