বাড়ি ভাড়া পাগলা ঘোড়া-ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অকার্যকর ২০ বছরেও তদারককারী সংস্থা হয়নি ২২ বছরে ভাড়া বেড়েছে ৩২৫ ভাগ by হকিকত জাহান হকি ও সোহেল মামুন
লাগামহীনভাবে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিতে ভোগান্তি পোহাচ্ছে রাজধানী ঢাকার সাধারণ মানুষ। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত_ সবাই বাড়ি ভাড়ার এই পাগলা ঘোড়ার কাছে অসহায়। সীমিত আয়ের মধ্য থেকে প্রতিদিনের ব্যয় নির্বাহ করার পর প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হয়। বস্তির অতিদরিদ্র মানুষও 'ঘর' ভাড়ার জাঁতাকলে পিষ্ট। কারণে-অকারণে ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। কোথাও তাদের জবাবদিহিতা নেই।
২০ বছর ধরে অকার্যকর হয়ে পড়ে রয়েছে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন। বাড়ি ভাড়া বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে দেখা গেছে, বিষয়টি তদারকিতে নির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) বলছে,
এটি দেখার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। জেলা প্রশাসন বলছে অন্য কথা। এমন কোনো সংস্থা নেই যেখান থেকে বাড়ি
ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সরকারের এই উদাসীনতার শিকার হচ্ছে রাজধানীর লাখ লাখ মানুষ।
রাজধানীর পাশাপাশি দেশের বড় শহরগুলোতেও ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালার কাছে জিম্মি। ভুক্তভোগী ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছেন, বাড়িওয়ালারা বছরের যে কোনো সময় হঠাৎ করেই ভাড়া বাড়িয়ে দেন। প্রতিবাদ করা হলে বলা হয়_ 'ইচ্ছা হলে থাকেন, নইলে চলে যান। নতুন ভাড়াটিয়া এলে আরও বেশি ভাড়া পাওয়া যাবে।' এছাড়া ভাড়া আদায়ের রসিদ দেওয়া হয় না। করা হয় না বাড়ি ভাড়া চুক্তি। বাড়ি ছাড়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নোটিশ দেওয়া হয় না।
বাড়িওয়ালারা বলছেন, গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে। দফায় দফায় বাড়ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম। এ পরিস্থিতিতে বাড়ির মালিকরা বাধ্য হয়ে ভাড়া বৃদ্ধি করেন। ভাড়া বাড়ানোর কারণ হিসেবে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কথাও উল্লেখ করেন বাড়িওয়ালারা। তারা বলেছেন, ডিসিসির নির্ধারিত ভাড়া অযৌক্তিক। ওই হারে ভাড়া আদায় করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। ভাড়াটিয়ারা বলছেন, মালিকরা অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বাড়িয়ে দেন। লাগামহীনভাবে ভাড়া বৃদ্ধির কারণে ভাড়াটিয়াদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। মালিকদের অবিবেচক নোটিশ ভাড়াটিয়াদের জন্য 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।'
এক হিসাব থেকে জানা গেছে, গত ২২ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩২৫ ভাগ। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক জরিপে বলা হয়, রাজধানীর ৮৩ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকে। জরিপে বলা হয়, ১৯৯১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বেড়েছে শতকরা ১১৬.৯৬ ভাগ। এই সময়ে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে শতকরা ২৫৯.৪৫ ভাগ, যা দ্বিগুণেরও বেশি। এ সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ সালে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে শতকরা ১৪ দশমিক ৮৫ ভাগ।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে আইন অনুযায়ী ভাড়া দেওয়া-নেওয়া হয়। দেশটিতে বাড়িওয়ালা যেমন খুশি ভাড়া চাপিয়ে দিতে পারেন না। তেমনি ভাড়াটিয়া নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ না করলে বাড়ির মালিক আইন অনুযায়ী উচ্ছেদের নোটিশ দিতে পারেন। বাড়ির মালিক অতিরিক্ত ভাড়া চাপিয়ে দিলে এ বিষয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ভাড়াটিয়া আগের হারে ভাড়ার টাকা রেন্ট কন্ট্রোল দফতরে জমা দিতে পারেন।
জানা গেছে, নতুন বছর সামনে রেখে রাজধানীসহ সারাদেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরের বাসিন্দারা এরই মধ্যে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ পেয়েছেন। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার ভাড়াটিয়াদের এরই মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে_ জানুয়ারি থেকে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা বেশি ভাড়া দিতে হবে। হঠাৎ করে এভাবে ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দেওয়ায় ভাড়াটিয়াদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে ইপিজেড এলাকাসহ মহানগরীর শ্রমঘন এলাকায় এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ হারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বাড়ি মালিকদের এই আচরণকে স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ভাড়াটিয়ারা। বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরে বিক্ষোভও হয়েছে। রাজশাহী মহানগরে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে লাগামহীনভাবে। এখানকার ভাড়াটিয়াদের ১ হাজার টাকা করে বাড়ানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। খুলনা মহানগরীতে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে চার হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।
ডিসিসির হিসাব অনুযায়ী রাজধানীর ৯০টি ওয়ার্ডে বাড়ির সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ বাড়ির মালিক কর দেন না। অথচ ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন তারাই। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৯৯১ সালে আইন তৈরি করা হলেও দীর্ঘদিনেও এ আইন বাস্তবায়নকারী কোনো সংস্থা গঠন করা হয়নি। সরকারের কোন বিভাগের কে বা কারা বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করবে তাও নির্দিষ্ট হয়নি।
রাজধানীর বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার খোঁজে ডিসিসির প্রধান কার্যালয়ে যান এ প্রতিবেদক। সেখানে রাজস্ব বিভাগের এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের কাজ তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তারা এলাকাভিত্তিক ভাড়ার তালিকা তৈরি করেন। তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের অধীনে একটি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ শাখা আছে_ সেখান থেকেই বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সেই শাখা পাওয়া যায়নি। ডিসি অফিস থেকে বলা হয়, এ দায়িত্ব তাদের নয়। 'তৃতীয় জেলা জজ কার্যালয় থেকে এ দায়িত্ব পালন করা হয়।' অথচ জেলা জজের পক্ষে তৃতীয় জেলা জজ আদালতে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়। জেলা প্রশাসনের এ ধরনের অজ্ঞতা দেশের একটি আইনের সঙ্গে উপহাস বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।
ডিসিসির ভাড়ার হার
ঢাকা মহানগরে ১০টি জোনের মধ্যে ৩টি স্তরের বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করেছে ডিসিসি। এর মধ্যে প্রধান সড়কের পাশে, গলির ৩০০ ফুটের ভেতরে ও আশপাশে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। বাড়ির ক্ষেত্রে পাকা, সেমিপাকা ও কাঁচা_ এ তিনটি স্তর রয়েছে। প্রধান সড়কের পাশে প্রতি বর্গফুট পাকাবাড়ির ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৬.৫০ টাকা, সেমিপাকা ৫ টাকা এবং কাঁচা ৪ টাকা। গলির ৩০০ ফুটের মধ্যে পাকা বাড়ি প্রতি বর্গফুট ৬.০০ টাকা, সেমিপাকা ৪.৫০ এবং কাঁচা বাড়ি ৪.০০ টাকা। গলির ৩০০ ফুটের বাইরে পাকা বাড়ি প্রতি বর্গফুট ৫.৫০ টাকা, সেমিপাকা ৪.৫০ ও কাঁচা বাড়ির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪.০০ টাকা হারে।
জানা গেছে, ডিসিসির চার্টে গুলশান এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে আবাসিক পাকা ভবনে প্রতি বর্গমিটারে ভাড়া ১৫ টাকা। ডিসিসির চার্টে পাকা আবাসিক বাসায় প্রতি বর্গমিটারে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা। সর্বনিম্ন রেটে ভাড়ার তালিকায় রয়েছে মানিকনগর, তিলপাপাড়া, কল্যাণপুরসহ বেশ কিছু এলাকা। এসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ওই রেটে রাজধানীর কোথাও বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না।
ডিসিসি দক্ষিণের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান সমকালকে বলেন, ডিসিসির সব অঞ্চল জরিপ করে ভাড়ার চার্ট তৈরি করা হয়েছে। এ চার্টের চেয়ে অনেক বেশি রেটে হয়তো বাড়ির মালিকরা ভাড়া নিচ্ছেন। তা দেখার দায়িত্ব ডিসিসির নয়। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের এ দায়িত্ব পালন করার কথা। তিনি বলেন, ডিসিসি বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে কর আদায়ের সুবিধার্থে এ চার্ট তৈরি করেছে।
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অকার্যকর
বাড়ি ভাড়া আইন-১৯৯১-এর ১৫ ধারা অনুযায়ী, বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্ব বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের। সরকারের কোন সংস্থা এ নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দেবে_ সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। ফলে ঢাকা জেলা প্রশাসন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ডিসিসি বা সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা এ আইন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। এদিকে ডিসিসি হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের জন্য নগরীর বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করলেও ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করছে না। এ অবস্থায় আইনটি গত ২০ বছর ধরে অকার্যকর রয়েছে।
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ অনুযায়ী আলাদাভাবে আদেশ জারি করে কোনো ব্যক্তিকে এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করার কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত তা হয়নি। আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রকের একটি কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা। সে কার্যালয় থেকে ভাড়াটিয়াদের সমস্যা সমাধান করার কথা বলা হয়েছে।
আইনের ৭নং ধারায় বলা হয়, কোনো বাড়ির মালিক অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করলে এ ক্ষেত্রে বর্ধিত ভাড়া আদায়যোগ্য হবে না। আইনের ২৭নং ধারায় বলা হয়, কোনো বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে ভাড়ার টাকা গ্রহণের রসিদ দিতে অস্বীকার করলে বা ব্যর্থ হলে ভাড়াটিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ অর্থ দণ্ড দিতে হবে বাড়ির মালিককে। আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রক কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের আগে বাড়ির মালিক ও সংশ্লিষ্ট ভাড়াটিয়ার কাছে লিখিত নোটিশ পাঠাবেন। নোটিশের কপি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সামনে প্রকাশ্য স্থানে টানিয়ে রাখতে হবে।
এছাড়া ভাড়া বৃদ্ধির ওপর বাধানিষেধ, ভাড়া আদায়ের রসিদ প্রদান, কতিপয় ক্ষেত্রে ক্রোক, পরোয়ানা, কিছু ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া জমা প্রদান, অভিযোগ দায়ের, বাড়ি মালিকের ভুল নাম, ঠিকানা দেওয়ার দণ্ডসহ বিধান রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের বক্তব্য
ঢাকা জেলা প্রশাসক মুহিবুল হক বলেন, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এর একটা সমাধান হওয়া উচিত। মানুষকে জিম্মি করে লাগামহীনভাবে ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে জনমত গঠন হওয়া দরকার। তিনি বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে যে আইন তৈরি করা হয়েছে তা খুবই দুর্বল। এ আইন দ্বারা বাড়ির মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করা যাবে না। আইনটি শিগগির যুগোপযোগী করে সংশোধনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। আইনের আওতায় রাজধানীসহ সারাদেশে একই ফরমেটে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মধ্যে চুক্তি ও ভাড়ার রসিদ দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। জেলা প্রশাসক বলেন, অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা বন্ধ করতে এলাকাভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করতে হবে। জেলা প্রশাসক বলেন, আইনটি আধুনিকায়ন করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব জেলা প্রশাসককে দেওয়া হলে ভাড়া নিয়ে সৃষ্ট অরাজকতা থাকবে না।
রাজধানীর শেখেরটেক এলাকার ভাড়াটিয়ারা বলেছেন, বছর শেষ হলেই ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দেওয়া হয়। বছরের যে কোনো সময় বাড়ি বদলানো হলে নতুন ভাড়াটিয়ার কাছে বিদায়ী ভাড়াটিয়ার চেয়ে বেশিতে ভাড়া দেওয়া হয়। ভাড়া বাড়ানোর এই কৌশলটি এখন সবচেয়ে প্রচলিত। এ প্রক্রিয়ায় এখন দুই-তিন মাস অন্তর ভাড়া বাড়াচ্ছেন বাড়িওয়ালারা।
সাধারণ আবাসিক এলাকা : জানুয়ারি থেকে বাড়ি ভাড়া এক হাজার টাকা বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছেন রাজধানীর উত্তর মুগদাপাড়ার ১১৬/এফ হোল্ডিংয়ের মালিক আবুল খায়ের। চিরকুট আকারের নোটিশে বলা হয়, 'এ সিদ্ধান্তে কারও আপত্তি করা চলবে না।' গৃহকর্মী দিয়ে চিরকুটটি পাঠানো হয় ভাড়াটিয়ার কাছে। মালিবাগ বাজার রোডের ১৯২ নম্বর হোল্ডিংয়ের কাজী ভিলার মালিক ২৮ নভেম্বর নিচতলায় ভাড়াটিয়ার দরজার সামনে গিয়ে বলেন, জানুয়ারি থেকে নিচতলার ভাড়া ৬ হাজার ৭০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭ হাজার ৭০০ টাকা করা হয়েছে। আরও বলা হয়, রাজি থাকলে থাকেন, নইলে টু-লেট লাগিয়ে দেব।
সরেজমিন জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শহীদ সলিমুল্লাহ রোডের ৭/৬ নম্বর পাকা বাড়ির ৬৬০ বর্গফুটের একটি ইউনিটে মোস্তাফিজুর রহমান থাকেন ৮ হাজার টাকা ভাড়ায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলসহ প্রতি মাসে তার মোট বিল আসে কমবেশি ৯ হাজার টাকা। এ রোডে ডিসিসি প্রতি বর্গফুটের ভাড়া নির্ধারণ করেছে ৬-৭ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল বাদে ৬৬০ বর্গফুটের ভাড়া হয় ৩ হাজার ৯৬০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৬২০ টাকা। একই রোডের ১৩/৬ নম্বর বাড়ির মালিক হাজী আনিসুর রহমান জানান, তিনি ৭শ' বর্গফুটের বাড়ি গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল বাদে ভাড়া দিয়েছেন ১০ হাজার টাকায়। ডিসিসির নির্ধারিত রেট অনুযায়ী ৭শ' বর্গফুটের ভাড়া হয় ৪ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার ৯শ' টাকা। ডিসিসি এ রোডের পাকা বাড়ির প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৬-৭ টাকা নির্ধারণ করেছে।
পুরান ঢাকা : ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকায় বাসা পরিবর্তনের রেওয়াজ শহরের অন্য এলাকা থেকে বেশ কম। চানখারপুলের বাসিন্দা মধুলাল জানান, নওরোজ ভিলায় তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় থাকতেন। মার্চ মাসে বাসাটি ছেড়ে দিয়ে গ্রিনভিলায় ওঠেন। ছয় মাসের আগে বাসা ছাড়া যাবে না এমন শর্ত দেন বাড়িওয়ালা। এ বাসায় ওঠার আগে ভাড়া ছিল ২০ হাজার টাকা। এ বছরে বাসাটিতে দুই দফায় দুই হাজার টাকা ভাড়া বেড়ে গেছে। তিনি হতাশ কণ্ঠে বলেন, এসব কথা শোনার কেউ নেই।
অভিজাত এলাকা : অভিজাত এলাকায় ভাড়া বাড়ানোর হার কয়েক গুণ বেশি। বিশেষ করে ধানমণ্ডি, কলাবাগান, ইস্কাটন, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, বসুন্ধরা ও কনকর্ড আবাসিক এলাকায় বছর শেষে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়ে দেন মালিকরা। বিভিন্ন চার্জ বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাড়া বাড়ানো হয়।
গুলশানে ডিসিসির রেট অনুযায়ী সর্বোচ্চ ভাড়া ১৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা হওয়ার কথা থাকলেও এ এলাকায় ওই রেটে কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না। এ এলাকায় সর্বনিম্ন ভাড়ার হার ৩০ হাজার টাকা। শুলশান-২ এর ১৪১/৩ বাড়ির ১৪শ' বর্গফুটের একটি বাসার ভাড়া হওয়ার কথা ২১ হাজার টাকা। ভাড়াটিয়া জানান, নতুন বছরে ৫ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়ে ৪০ হাজার টাকার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ডিসিসির নির্ধারিত ভাড়া মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়।
বস্তি এলাকা : উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পাশাপাশি ঢাকায় দরিদ্র ও অতিদরিদ্র গোষ্ঠীর সিংহভাগ মানুষ ছোট বাসায় কিংবা বস্তিতে থাকেন। ঢাকার নিম্নমানের বস্তিগুলোতে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা হারে 'খাট ভাড়া' নেওয়া হয়। নাখালপাড়া রেললাইন বস্তিতে একটি খাটে রাতে গিয়ে শুধু ঘুমান আল আমিন। সেখানে কোনো টয়লেট বা গোসলখানা নেই। ওয়াসার একটি কলে গোসল আর পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। জুনে ৫০০ টাকা ভাড়ায় উঠলেও এখন তার কাছে ৬০০ টাকা ভাড়া দাবি করছেন মালিক মাকসুদা। এ বস্তির সবচেয়ে ভালো ঘরের ভাড়া ১৫০০ টাকা।
জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের বক্তব্য
জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি ডা. জালাল আহমেদ বলেন, রাজধানীসহ প্রতিটি নগরীর বাড়ির মালিকরা অযৌক্তিকভাবে ভাড়া আদায় করছেন। এ কারণে ভাড়াটিয়াদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, বাড়ির মালিকরা নানা ছুতোয় ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ পাঠান। ভাড়াটিয়ারা প্রতিবাদ জানালে সন্ত্রাসী দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। ভাড়াটিয়াদের এই দুর্দশা দেখার কেউ নেই। তিনি বলেন, তারা দীর্ঘদিন থেকে সরকারের কাছে যৌক্তিক হারে ভাড়া নির্ধারণের দাবিসহ ১৭ দফা দাবি জানিয়েছেন। এসব দাবি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। তিনি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি যুগোপযোগী করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তদারকের দাবি জানান।
বাড়ি মালিক সমিতির বক্তব্য
দক্ষিণ-পশ্চিম শেওড়াপাড়া জনকল্যাণ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম সমকালকে বলেন, ব্যাংক ও ঋণদানকারী সংস্থাগুলো গৃহ নির্মাণ ঋণের সুদের হার অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে ইট, বালি, রড, সিমেন্টসহ সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বাড়ছে দফায় দফায়। এ পরিস্থিতিতে বাড়ির মালিকরা বাধ্য হয়ে ভাড়া বৃদ্ধি করেন। তিনি বলেন, কম ভাড়া আদায় করে লোকসান গুনতে হলে ব্যাংকে দেউলিয়াদের তালিকায় বাড়ি মালিকদের নাম যুক্ত হবে। তিনি আরও বলেন, খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে হারে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে তাতে বাড়ির মালিকরাও হিমশিম খাচ্ছেন। মালিকরা কখনও ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করেন না বলে তিনি দাবি করেন।
এটি দেখার দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। জেলা প্রশাসন বলছে অন্য কথা। এমন কোনো সংস্থা নেই যেখান থেকে বাড়ি
ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সরকারের এই উদাসীনতার শিকার হচ্ছে রাজধানীর লাখ লাখ মানুষ।
রাজধানীর পাশাপাশি দেশের বড় শহরগুলোতেও ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালার কাছে জিম্মি। ভুক্তভোগী ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছেন, বাড়িওয়ালারা বছরের যে কোনো সময় হঠাৎ করেই ভাড়া বাড়িয়ে দেন। প্রতিবাদ করা হলে বলা হয়_ 'ইচ্ছা হলে থাকেন, নইলে চলে যান। নতুন ভাড়াটিয়া এলে আরও বেশি ভাড়া পাওয়া যাবে।' এছাড়া ভাড়া আদায়ের রসিদ দেওয়া হয় না। করা হয় না বাড়ি ভাড়া চুক্তি। বাড়ি ছাড়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নোটিশ দেওয়া হয় না।
বাড়িওয়ালারা বলছেন, গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে। দফায় দফায় বাড়ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম। এ পরিস্থিতিতে বাড়ির মালিকরা বাধ্য হয়ে ভাড়া বৃদ্ধি করেন। ভাড়া বাড়ানোর কারণ হিসেবে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কথাও উল্লেখ করেন বাড়িওয়ালারা। তারা বলেছেন, ডিসিসির নির্ধারিত ভাড়া অযৌক্তিক। ওই হারে ভাড়া আদায় করে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। ভাড়াটিয়ারা বলছেন, মালিকরা অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বাড়িয়ে দেন। লাগামহীনভাবে ভাড়া বৃদ্ধির কারণে ভাড়াটিয়াদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। মালিকদের অবিবেচক নোটিশ ভাড়াটিয়াদের জন্য 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।'
এক হিসাব থেকে জানা গেছে, গত ২২ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩২৫ ভাগ। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক জরিপে বলা হয়, রাজধানীর ৮৩ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকে। জরিপে বলা হয়, ১৯৯১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বেড়েছে শতকরা ১১৬.৯৬ ভাগ। এই সময়ে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে শতকরা ২৫৯.৪৫ ভাগ, যা দ্বিগুণেরও বেশি। এ সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ সালে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে শতকরা ১৪ দশমিক ৮৫ ভাগ।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে আইন অনুযায়ী ভাড়া দেওয়া-নেওয়া হয়। দেশটিতে বাড়িওয়ালা যেমন খুশি ভাড়া চাপিয়ে দিতে পারেন না। তেমনি ভাড়াটিয়া নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ না করলে বাড়ির মালিক আইন অনুযায়ী উচ্ছেদের নোটিশ দিতে পারেন। বাড়ির মালিক অতিরিক্ত ভাড়া চাপিয়ে দিলে এ বিষয়ে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ভাড়াটিয়া আগের হারে ভাড়ার টাকা রেন্ট কন্ট্রোল দফতরে জমা দিতে পারেন।
জানা গেছে, নতুন বছর সামনে রেখে রাজধানীসহ সারাদেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরের বাসিন্দারা এরই মধ্যে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ পেয়েছেন। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার ভাড়াটিয়াদের এরই মধ্যে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে_ জানুয়ারি থেকে ২ থেকে ৫ হাজার টাকা বেশি ভাড়া দিতে হবে। হঠাৎ করে এভাবে ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দেওয়ায় ভাড়াটিয়াদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে ইপিজেড এলাকাসহ মহানগরীর শ্রমঘন এলাকায় এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ হারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বাড়ি মালিকদের এই আচরণকে স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ভাড়াটিয়ারা। বাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরে বিক্ষোভও হয়েছে। রাজশাহী মহানগরে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে লাগামহীনভাবে। এখানকার ভাড়াটিয়াদের ১ হাজার টাকা করে বাড়ানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। খুলনা মহানগরীতে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে চার হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো হয়েছে।
ডিসিসির হিসাব অনুযায়ী রাজধানীর ৯০টি ওয়ার্ডে বাড়ির সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ বাড়ির মালিক কর দেন না। অথচ ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন তারাই। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৯৯১ সালে আইন তৈরি করা হলেও দীর্ঘদিনেও এ আইন বাস্তবায়নকারী কোনো সংস্থা গঠন করা হয়নি। সরকারের কোন বিভাগের কে বা কারা বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করবে তাও নির্দিষ্ট হয়নি।
রাজধানীর বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার খোঁজে ডিসিসির প্রধান কার্যালয়ে যান এ প্রতিবেদক। সেখানে রাজস্ব বিভাগের এক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের কাজ তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তারা এলাকাভিত্তিক ভাড়ার তালিকা তৈরি করেন। তিনি জানান, জেলা প্রশাসনের অধীনে একটি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ শাখা আছে_ সেখান থেকেই বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সেই শাখা পাওয়া যায়নি। ডিসি অফিস থেকে বলা হয়, এ দায়িত্ব তাদের নয়। 'তৃতীয় জেলা জজ কার্যালয় থেকে এ দায়িত্ব পালন করা হয়।' অথচ জেলা জজের পক্ষে তৃতীয় জেলা জজ আদালতে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়। জেলা প্রশাসনের এ ধরনের অজ্ঞতা দেশের একটি আইনের সঙ্গে উপহাস বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।
ডিসিসির ভাড়ার হার
ঢাকা মহানগরে ১০টি জোনের মধ্যে ৩টি স্তরের বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করেছে ডিসিসি। এর মধ্যে প্রধান সড়কের পাশে, গলির ৩০০ ফুটের ভেতরে ও আশপাশে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। বাড়ির ক্ষেত্রে পাকা, সেমিপাকা ও কাঁচা_ এ তিনটি স্তর রয়েছে। প্রধান সড়কের পাশে প্রতি বর্গফুট পাকাবাড়ির ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৬.৫০ টাকা, সেমিপাকা ৫ টাকা এবং কাঁচা ৪ টাকা। গলির ৩০০ ফুটের মধ্যে পাকা বাড়ি প্রতি বর্গফুট ৬.০০ টাকা, সেমিপাকা ৪.৫০ এবং কাঁচা বাড়ি ৪.০০ টাকা। গলির ৩০০ ফুটের বাইরে পাকা বাড়ি প্রতি বর্গফুট ৫.৫০ টাকা, সেমিপাকা ৪.৫০ ও কাঁচা বাড়ির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪.০০ টাকা হারে।
জানা গেছে, ডিসিসির চার্টে গুলশান এলাকায় প্রধান সড়কের পাশে আবাসিক পাকা ভবনে প্রতি বর্গমিটারে ভাড়া ১৫ টাকা। ডিসিসির চার্টে পাকা আবাসিক বাসায় প্রতি বর্গমিটারে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা। সর্বনিম্ন রেটে ভাড়ার তালিকায় রয়েছে মানিকনগর, তিলপাপাড়া, কল্যাণপুরসহ বেশ কিছু এলাকা। এসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ওই রেটে রাজধানীর কোথাও বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না।
ডিসিসি দক্ষিণের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান সমকালকে বলেন, ডিসিসির সব অঞ্চল জরিপ করে ভাড়ার চার্ট তৈরি করা হয়েছে। এ চার্টের চেয়ে অনেক বেশি রেটে হয়তো বাড়ির মালিকরা ভাড়া নিচ্ছেন। তা দেখার দায়িত্ব ডিসিসির নয়। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের এ দায়িত্ব পালন করার কথা। তিনি বলেন, ডিসিসি বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে কর আদায়ের সুবিধার্থে এ চার্ট তৈরি করেছে।
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অকার্যকর
বাড়ি ভাড়া আইন-১৯৯১-এর ১৫ ধারা অনুযায়ী, বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্ব বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রকের। সরকারের কোন সংস্থা এ নিয়ন্ত্রক নিয়োগ দেবে_ সে বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। ফলে ঢাকা জেলা প্রশাসন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ডিসিসি বা সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা এ আইন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। এদিকে ডিসিসি হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের জন্য নগরীর বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করলেও ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করছে না। এ অবস্থায় আইনটি গত ২০ বছর ধরে অকার্যকর রয়েছে।
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ অনুযায়ী আলাদাভাবে আদেশ জারি করে কোনো ব্যক্তিকে এলাকাভিত্তিক নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করার কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত তা হয়নি। আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রকের একটি কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা। সে কার্যালয় থেকে ভাড়াটিয়াদের সমস্যা সমাধান করার কথা বলা হয়েছে।
আইনের ৭নং ধারায় বলা হয়, কোনো বাড়ির মালিক অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করলে এ ক্ষেত্রে বর্ধিত ভাড়া আদায়যোগ্য হবে না। আইনের ২৭নং ধারায় বলা হয়, কোনো বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে ভাড়ার টাকা গ্রহণের রসিদ দিতে অস্বীকার করলে বা ব্যর্থ হলে ভাড়াটিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ অর্থ দণ্ড দিতে হবে বাড়ির মালিককে। আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রক কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের আগে বাড়ির মালিক ও সংশ্লিষ্ট ভাড়াটিয়ার কাছে লিখিত নোটিশ পাঠাবেন। নোটিশের কপি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সামনে প্রকাশ্য স্থানে টানিয়ে রাখতে হবে।
এছাড়া ভাড়া বৃদ্ধির ওপর বাধানিষেধ, ভাড়া আদায়ের রসিদ প্রদান, কতিপয় ক্ষেত্রে ক্রোক, পরোয়ানা, কিছু ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া কর্তৃক ভাড়া জমা প্রদান, অভিযোগ দায়ের, বাড়ি মালিকের ভুল নাম, ঠিকানা দেওয়ার দণ্ডসহ বিধান রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের বক্তব্য
ঢাকা জেলা প্রশাসক মুহিবুল হক বলেন, বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এর একটা সমাধান হওয়া উচিত। মানুষকে জিম্মি করে লাগামহীনভাবে ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে জনমত গঠন হওয়া দরকার। তিনি বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে যে আইন তৈরি করা হয়েছে তা খুবই দুর্বল। এ আইন দ্বারা বাড়ির মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ করা যাবে না। আইনটি শিগগির যুগোপযোগী করে সংশোধনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। আইনের আওতায় রাজধানীসহ সারাদেশে একই ফরমেটে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মধ্যে চুক্তি ও ভাড়ার রসিদ দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। জেলা প্রশাসক বলেন, অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা বন্ধ করতে এলাকাভিত্তিক ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করতে হবে। জেলা প্রশাসক বলেন, আইনটি আধুনিকায়ন করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব জেলা প্রশাসককে দেওয়া হলে ভাড়া নিয়ে সৃষ্ট অরাজকতা থাকবে না।
রাজধানীর শেখেরটেক এলাকার ভাড়াটিয়ারা বলেছেন, বছর শেষ হলেই ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দেওয়া হয়। বছরের যে কোনো সময় বাড়ি বদলানো হলে নতুন ভাড়াটিয়ার কাছে বিদায়ী ভাড়াটিয়ার চেয়ে বেশিতে ভাড়া দেওয়া হয়। ভাড়া বাড়ানোর এই কৌশলটি এখন সবচেয়ে প্রচলিত। এ প্রক্রিয়ায় এখন দুই-তিন মাস অন্তর ভাড়া বাড়াচ্ছেন বাড়িওয়ালারা।
সাধারণ আবাসিক এলাকা : জানুয়ারি থেকে বাড়ি ভাড়া এক হাজার টাকা বাড়ানোর নোটিশ দিয়েছেন রাজধানীর উত্তর মুগদাপাড়ার ১১৬/এফ হোল্ডিংয়ের মালিক আবুল খায়ের। চিরকুট আকারের নোটিশে বলা হয়, 'এ সিদ্ধান্তে কারও আপত্তি করা চলবে না।' গৃহকর্মী দিয়ে চিরকুটটি পাঠানো হয় ভাড়াটিয়ার কাছে। মালিবাগ বাজার রোডের ১৯২ নম্বর হোল্ডিংয়ের কাজী ভিলার মালিক ২৮ নভেম্বর নিচতলায় ভাড়াটিয়ার দরজার সামনে গিয়ে বলেন, জানুয়ারি থেকে নিচতলার ভাড়া ৬ হাজার ৭০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭ হাজার ৭০০ টাকা করা হয়েছে। আরও বলা হয়, রাজি থাকলে থাকেন, নইলে টু-লেট লাগিয়ে দেব।
সরেজমিন জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শহীদ সলিমুল্লাহ রোডের ৭/৬ নম্বর পাকা বাড়ির ৬৬০ বর্গফুটের একটি ইউনিটে মোস্তাফিজুর রহমান থাকেন ৮ হাজার টাকা ভাড়ায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলসহ প্রতি মাসে তার মোট বিল আসে কমবেশি ৯ হাজার টাকা। এ রোডে ডিসিসি প্রতি বর্গফুটের ভাড়া নির্ধারণ করেছে ৬-৭ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল বাদে ৬৬০ বর্গফুটের ভাড়া হয় ৩ হাজার ৯৬০ টাকা থেকে ৪ হাজার ৬২০ টাকা। একই রোডের ১৩/৬ নম্বর বাড়ির মালিক হাজী আনিসুর রহমান জানান, তিনি ৭শ' বর্গফুটের বাড়ি গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল বাদে ভাড়া দিয়েছেন ১০ হাজার টাকায়। ডিসিসির নির্ধারিত রেট অনুযায়ী ৭শ' বর্গফুটের ভাড়া হয় ৪ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার ৯শ' টাকা। ডিসিসি এ রোডের পাকা বাড়ির প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৬-৭ টাকা নির্ধারণ করেছে।
পুরান ঢাকা : ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকায় বাসা পরিবর্তনের রেওয়াজ শহরের অন্য এলাকা থেকে বেশ কম। চানখারপুলের বাসিন্দা মধুলাল জানান, নওরোজ ভিলায় তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটে ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় থাকতেন। মার্চ মাসে বাসাটি ছেড়ে দিয়ে গ্রিনভিলায় ওঠেন। ছয় মাসের আগে বাসা ছাড়া যাবে না এমন শর্ত দেন বাড়িওয়ালা। এ বাসায় ওঠার আগে ভাড়া ছিল ২০ হাজার টাকা। এ বছরে বাসাটিতে দুই দফায় দুই হাজার টাকা ভাড়া বেড়ে গেছে। তিনি হতাশ কণ্ঠে বলেন, এসব কথা শোনার কেউ নেই।
অভিজাত এলাকা : অভিজাত এলাকায় ভাড়া বাড়ানোর হার কয়েক গুণ বেশি। বিশেষ করে ধানমণ্ডি, কলাবাগান, ইস্কাটন, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, বসুন্ধরা ও কনকর্ড আবাসিক এলাকায় বছর শেষে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়ে দেন মালিকরা। বিভিন্ন চার্জ বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাড়া বাড়ানো হয়।
গুলশানে ডিসিসির রেট অনুযায়ী সর্বোচ্চ ভাড়া ১৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা হওয়ার কথা থাকলেও এ এলাকায় ওই রেটে কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া যায় না। এ এলাকায় সর্বনিম্ন ভাড়ার হার ৩০ হাজার টাকা। শুলশান-২ এর ১৪১/৩ বাড়ির ১৪শ' বর্গফুটের একটি বাসার ভাড়া হওয়ার কথা ২১ হাজার টাকা। ভাড়াটিয়া জানান, নতুন বছরে ৫ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়ে ৪০ হাজার টাকার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিক আনোয়ারুল ইসলাম জানান, ডিসিসির নির্ধারিত ভাড়া মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়।
বস্তি এলাকা : উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পাশাপাশি ঢাকায় দরিদ্র ও অতিদরিদ্র গোষ্ঠীর সিংহভাগ মানুষ ছোট বাসায় কিংবা বস্তিতে থাকেন। ঢাকার নিম্নমানের বস্তিগুলোতে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা হারে 'খাট ভাড়া' নেওয়া হয়। নাখালপাড়া রেললাইন বস্তিতে একটি খাটে রাতে গিয়ে শুধু ঘুমান আল আমিন। সেখানে কোনো টয়লেট বা গোসলখানা নেই। ওয়াসার একটি কলে গোসল আর পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। জুনে ৫০০ টাকা ভাড়ায় উঠলেও এখন তার কাছে ৬০০ টাকা ভাড়া দাবি করছেন মালিক মাকসুদা। এ বস্তির সবচেয়ে ভালো ঘরের ভাড়া ১৫০০ টাকা।
জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের বক্তব্য
জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি ডা. জালাল আহমেদ বলেন, রাজধানীসহ প্রতিটি নগরীর বাড়ির মালিকরা অযৌক্তিকভাবে ভাড়া আদায় করছেন। এ কারণে ভাড়াটিয়াদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, বাড়ির মালিকরা নানা ছুতোয় ভাড়া বৃদ্ধির নোটিশ পাঠান। ভাড়াটিয়ারা প্রতিবাদ জানালে সন্ত্রাসী দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। ভাড়াটিয়াদের এই দুর্দশা দেখার কেউ নেই। তিনি বলেন, তারা দীর্ঘদিন থেকে সরকারের কাছে যৌক্তিক হারে ভাড়া নির্ধারণের দাবিসহ ১৭ দফা দাবি জানিয়েছেন। এসব দাবি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। তিনি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি যুগোপযোগী করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তদারকের দাবি জানান।
বাড়ি মালিক সমিতির বক্তব্য
দক্ষিণ-পশ্চিম শেওড়াপাড়া জনকল্যাণ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম সমকালকে বলেন, ব্যাংক ও ঋণদানকারী সংস্থাগুলো গৃহ নির্মাণ ঋণের সুদের হার অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে ইট, বালি, রড, সিমেন্টসহ সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বাড়ছে দফায় দফায়। এ পরিস্থিতিতে বাড়ির মালিকরা বাধ্য হয়ে ভাড়া বৃদ্ধি করেন। তিনি বলেন, কম ভাড়া আদায় করে লোকসান গুনতে হলে ব্যাংকে দেউলিয়াদের তালিকায় বাড়ি মালিকদের নাম যুক্ত হবে। তিনি আরও বলেন, খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে হারে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে তাতে বাড়ির মালিকরাও হিমশিম খাচ্ছেন। মালিকরা কখনও ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করেন না বলে তিনি দাবি করেন।
No comments