রাজনৈতিক চাপে মামলা নিচ্ছে না পুলিশঃ সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
পুলিশ প্রশাসনের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চাপ বাড়ছে, বাড়ছে তদবির। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ আগ বাড়িয়ে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সুখ-সুবিধা মাথায় রেখে দায়িত্ব পালন করছে। মামলা রেকর্ড থেকে শুরু করে কাকে ধরতে হবে, ছাড়তে হবে কাকে—এসব নির্দেশনা আসছে প্রভাবশালী নেতাদের কাছ থেকে। সরকার পক্ষ থেকে পুলিশ প্রশাসনকে স্বাধীন বলা হলেও স্থানীয় নেতা ও সংসদ সদস্য, এমনকি মাঠপর্যায়ের নেতাদের চাপের মুখে দিশেহারা অবস্থা পুলিশের।
এ ধরনের বিস্তর অভিযোগ প্রায়ই ছাপা হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। সম্প্রতি এমন একটি ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে ফরিদপুরে। জানা গেছে, গত ২০ অক্টোবর রাতে ফরিদপুর শহরের সিঅ্যান্ডবি ঘাট এলাকায় চার পরিবারের একটি বসতবাড়িতে বুলডোজার চালিয়ে ৩২ শতাংশ জমি দখল করেছে ফরিদপুর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং তার অনুগত ক্যাডাররা। এর মধ্যে ওই জায়গায় ট্রাক দিয়ে মাটিও ফেলা হয়েছে। এখন বোঝা যায় না যে, ক’দিন আগেও এখানে কোনো বাড়িঘর ছিল। থানার শরণাপন্ন হলে ঘটনার চারদিন পরেও পুলিশ মামলা নেয়নি। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নিরুপায় হয়ে তারা ঘটনার প্রতিবাদে ২৩ অক্টোবর মানববন্ব্দন কর্মসূচি পালন করেন ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সামনে। মামলা না নেয়ার কারণ সম্পর্কে কোতোয়ালি থানার ওসি জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, যার যখন ক্ষমতা থাকে, সে তখন দখল করে। বিষয়টি তদন্ত করে তারপর মামলা নেয়া হবে। কিন্তু তার এই বক্তব্য কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ প্রকাশ্যে বসতবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়ার মতো জাজ্বল্যমান ঘটনায় মামলা না নিয়ে তদন্তের অজুহাত তুলে ধরার অর্থ পুলিশের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নগ্ন প্রভাব বিদ্যমান বলেই প্রমাণ করে। এর আগে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই বলেছেন, পুলিশের ওপর রাজনৈতিক চাপ আগেও ছিল, এখনও আছে। পত্রিকান্তরে জানা গেছে, সরকারদলীয় নেতার হস্তক্ষেপে র্যাব পর্যন্ত গ্রেফতারকৃত সন্ত্রাসীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পর্কিত কাউকে র্যাব বা পুলিশ গ্রেফতার করলেই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা চাপ সৃষ্টি করছেন। এ অবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও করার কিছু থাকছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আইন-শৃগ্ধখলা বাহিনীর ওপর রাজনীতিবিদদের চাপ থাকাটাই যেন নিয়মে দাঁড়িয়েছে। সব সরকারের আমলেই এমনটি হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে তা আরও প্রবল হয়েছে এবং স্বভাবতই সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। রাজনৈতিক চাপ না থাকলে পুলিশ অনেক বেশি দায়িত্বশীল আচরণ করে। আসামি গ্রেফতার থেকে শুরু করে তদন্ত পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই একটা মান অন্তত বজায় রাখার চেষ্টা করে। এতে পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থাও বৃদ্ধি পায়। কাজেই একটি আধুনিক জনবান্ব্দব পুলিশ বাহিনী পেতে হলে তাদের আইন অনুযায়ী কাজ করতে দিতে হবে। গত আগসল্ট মাসে পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির (পিআরপি) পরিচালিত জনগণের মনোভাব তথা ‘পাবলিক অ্যাটিচিউড ফলোআপ সার্ভে’ সংক্রান্ত জরিপের ফলাফলেও এসব অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজই হচ্ছে না। পুলিশের ওপর রাজনৈতিক চাপ ক্রমাগত বাড়ছেই। নানা কারণে পুলিশও দলবাজির অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জনবান্ব্দব স্বাধীন পুলিশ বাহিনী কীভাবে গড়ে উঠবে তা এখন সাধারণ মানুষেরও দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, রাহাজানি, খুনখারাবি, চুরি-ডাকাতিসহ আইন-শৃগ্ধখলার যে অবনতি ঘটেছে পুলিশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার তার একটি অন্যতম কারণ বৈকি! তারপরেও নির্যাতিত-অসহায় মানুষের প্রত্যাশা, পুলিশ যে কোনো অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়াবে, তারা ন্যায়বিচার পাবে, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে কেউ পুলিশি তত্পরতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এ ব্যাপারে সরকারকে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে রাজনৈতিক চাপ পুলিশের কাজে কোনো রকম বাধা না হয়ে দাঁড়ায় এবং পুলিশও সেই অনৈতিক সুযোগ নেয়ার প্রয়াস না পায়।
No comments