শনিবারের সুসংবাদ-জেলেপাড়ায় প্রগতির আলো by দেবদাস মজুমদার,
হাঁটতে শেখার সঙ্গে সঙ্গে নদীতে সাঁতার কাটতে শেখে ওরা। বেড়ে ওঠে নদীর সঙ্গে সখ্য গড়ে। কেউ চিংড়ির রেণুপোনা আহরণ করে, কেউ আবার বয়স্কদের নৌকায় মাছ ধরায় সহায়তা করে। এটাই জেলেপাড়ার শিশুদের বৃত্তাবদ্ধ জীবন। বিদ্যালয়ের চৌকাঠে কখনো ওদের পা পড়ে না। শিক্ষা যেন ওদের জন্য নয়। বংশপরম্পরায় এই বঞ্চিত জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে জেলেপাড়ার মানুষ। বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করা_জীবনে এটাই যেন সত্য। এভাবেই বেঁচে থাকা ওদের।
টানাপড়েনের এ স্বাভাবিকতায়ও ছেদ পড়ে। নেমে আসে বড় ধরনের বিপর্যয়। যেমনটি হয়েছিল ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। সে দিনের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর উপকূলের অন্য জেলাগুলোর মতো পিরোজপুরকেও লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল। জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের বলেশ্বর নদ তীরবর্তী কচুবাড়িয়ার জেলেরা ঘরবাড়ি, সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। এ দুর্গত অবস্থা কাটিয়ে উঠতে তাদের লেগে যায় এক বছর। ওই সময় কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তির মানবিক উদ্যোগে জেলেপাড়ার শিশুরাও পুরনো বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়। রাত পোহালেই এখন আর তারা নদীতে পোনা ধরতে ছুটে যায় না। কিংবা মাছ ধরার নৌকায় ওঠে না। ওরা এখন দলবেঁধে বিদ্যালয়ে যায়। এখন তারা বেড়ে উঠছে 'প্রগতির' আলোয়।
সিডরের পর প্রবাসী চার বন্ধুর উদ্যোগে জেলেপল্লীতে গড়ে তোলা হয় একটি বিদ্যালয়। তাঁদের এই মানবিক উদ্যোগে সারথি হন স্থানীয় একজন। কচুবাড়িয়া প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের এ বিদ্যালয়ে এখন ২৭৯টি শিশু নিয়মিত লেখাপড়া করছে। গত বছরের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় এই বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। এর মধ্যে আটজন প্রথম বিভাগ ও চারজন দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে। এ কৃতিত্বে ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্বীকৃতি যেন জানিয়ে দেয় জেলেপাড়ার দুর্গত জীবনে লেগেছে আলোর পরশ।
বৃদ্ধ জেলে ফজলুল হক হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা কোনো কালে লেহাপড়ার সুযোগ পাই নাই। সিডরের কালে এই স্কুলডা অওনে মোগো জাইল্যাপাড়ায় ভালো অইছে। এই স্কুলে মোর চাইরডা নাতি লেহাপড়া করতে আছে। এইডা দেইখা খুব আনন্দ পাইতেছি। মোরা চাই জাইল্যার পোলার যেন আর জাইল্যা না অওন লাগে।'
যেভাবে শুরু : ঘূর্ণিঝড় সিডরের কারণে হওয়া জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় কচুবাড়িয়া বেড়িবাঁধের জেলে বসতি। ঘূর্ণিঝড়ে মঠবাড়িয়ায় ২৭১ জনের প্রাণহানি ঘটে। বিধ্বস্ত হয় প্রায় ৫৮ হাজার ঘরবাড়ি। একদিন পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীরা কচুবাড়িয়ার জেলেদের পাশের এসে দাঁড়ান। তাঁরা সেখানে একটি লঙ্গরখানা খোলেন। প্রথম দিন ৮৫০ দুর্গত মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা হয় সেখানে। পরে ১৩ দিনের ওই লঙ্গরখানায় প্রতিদিন তিন হাজার ৭০০ জনের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এর পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা দিয়েছিল ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই লঙ্গরখানায় এসেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান। সে সময় আবুল কালাম নামে এক জেলে তাঁর কাছে জেলেপল্লীর শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। মনজুরুল আহসান খান ঢাকায় ফিরে ব্রিটেনপ্রবাসী পরিচিতজনদের বিষয়টি জানান। এতে সাড়া দেন ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার নগরভিত্তিক হাইড বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন।
২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল কচুবাড়িয়া ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। দ্বিতল পাকা ভবন নির্মাণ শেষ হয় গত বছর। একই সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্র ও বিদ্যালয় ভবনটির আয়তন এক হাজার ৮৬০ বর্গফুট। আছে খেলার মাঠ ও পুকুরে পানি বিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৪০ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন প্রবাসী ওই চার বন্ধু। বিদ্যালয়ের জন্য ৩৭ শতাংশ জমি দিয়েছেন স্থানীয় মৎস্যজীবী মো. নিজাম মিয়া রিপন।
৫০ জন শিক্ষার্থী দিয়ে শুরু হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৭৯ জন। পাঁচজন শিক্ষকের স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে পাঠদান। গত বছরের সমাপনী পরীক্ষার সাফল্যের খবর এখন মানুষের মুখে মুখে।
মহতী এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকা নিজাম মিয়া বলেন, 'কচুবাড়িয়া জেলেপাড়ার চার কিলোমিটারের মধ্যে স্কুল নেই। তা ছাড়া যোগাযোগও বিপর্যস্ত। এখানে ভূমিহীন জেলেদের বাস। একটা স্কুল হবে, জেলেপাড়ার শিশুদের লেখাপড়া হবে_এমন আশা ও স্বপ্ন নিয়েই জমি দিয়েছি। এটা করতে পেরে এখন খুব ভালো লাগছে।'
চার বন্ধুর এগিয়ে আসা : ব্রিটেনপ্রবাসী চার বন্ধু আবদুল মোছাবি্বর, সাংবাদিক ফারুক যোশী, রহমত উল্লাহ ও আকাদ্দস আলীর বাড়ি সিলেট। তাঁরা ম্যানচেস্টারে হাইড বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামের এই মানবিক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন। উদ্দেশ্য এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে দুর্গতদের সহায়তার জন্য উদ্যোগ নেন তাঁরা। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনজুরুল আহসান খানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কচুবাড়িয়ার চরাঞ্চলে তাঁরা ত্রাণ সহায়তা দেন। ওই ত্রাণ সহায়তা দিতে গিয়েই জেলেপাড়ার শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি তাঁদের মাথায় আসে।
স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক মো. ইকতিয়ার হোসেন পান্না বলেন, 'কচুবাড়িয়া জেলেপল্লীর শিশুরা নদীতে শ্রম দিয়ে ওদের পরিবারের আয় রোজগারে সহায়তা করে আসছিল। সিডরের সময় বিপর্যয় নেমে এসেছিলে এই শিশুদের জীবনেও। তারা লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে সেই বিপন্নতা কাটিয়ে উঠেছে। এই স্কুলটি ওদের জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছে।'
স্বেচ্ছাশ্রমে পাঠদান : সরকারি-বেসরকারি কিংবা অন্য কোনো সহায়তা নেই, তাহলে কিভাবে চলবে প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয়? উদ্যোক্তারা যখন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন, তখন এগিয়ে আসেন স্থানীয় পাঁচ শিক্ষিত বেকার। তাঁদের মধ্যে রেজাউল কবীর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন মারিয়া আকতার, জেসমীন আকতার, মো. মিলন মিয়া ও আয়শা আকতার। তাঁদের স্বেচ্ছাশ্রমেই এগিয়ে চলছে বিদ্যালয়টি। নিয়মিত দুই পালায় তাঁরা পাঠদান করেন। বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য রয়েছে ১১ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটি।
প্রধান শিক্ষক রেজাউল কবীর বলেন, 'হতদরিদ্র জেলে শিশুদের বিনাপারিশ্রমিকে পড়াতে ভালোই লাগছে। তবে বিদ্যালয়টির সার্বিক অবকাঠামো ও পাঠদানের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করে এটি রেজিস্ট্রেশনভুক্ত করলে সবার ভালো হতো।'
সহকারী শিক্ষক জেসমীন আক্তার বলেন, 'দুর্গত ও শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য শুরু থেকেই স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে আসছি। সিডরের চার বছর পরে স্কুলটি দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এটি চালু রাখতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।'
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট দিলীপ কুমার পাইক বলেন, 'মহতী উদ্যোগের এই স্কুল সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। বঞ্চিত জেলেশিশুরা শিক্ষার আলো পাচ্ছে, এটা খুব আশার কথা। আমরা সবাই মিলে আশা করছি, সরকার পাশে দাঁড়াবে। কেননা শিক্ষা কখনো সুযোগ নয়, সবার অধিকার। রাষ্ট্র এই অধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করবে। কচুবাড়িয়া জেলেপাড়ার মানুষ সেই অপেক্ষায় আছে।'
শেষ কথা : গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় মঠবাড়িয়া উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বলেশ্বর নদের নিভৃত চর এলাকা কচুবাড়িয়ার প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, খেলার মাঠে শতাধিক শিশু সারিবদ্ধ দাঁড়ানো। সামনে শুকনো বাঁশে উড়ছে জাতীয় পতাকা। শিশুরা গাইছে_'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।' জাতীয় সংগীত শেষ হতেই ওরা ছুটল শ্রেণীকক্ষে। একসময় যে যার আসনে বসল, এ নিয়ে কিছু হুড়োহুড়িও হলো। কানায় কানায় ভরে গেল শ্রেণীকক্ষগুলো।
শ্রেণীশিক্ষক মিলন মিয়া জানালেন, দুই পর্বে এখানে পাঠদান চলে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এক পালা। আর পরের পালা শুরু হয় আধাঘণ্টা পরে, চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
এ পর্যন্ত কয়েক দফা বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা। সব শেষ গত ২১ অক্টোবর বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বিদ্যালয়ে রক্ষিত মন্তব্য বইয়ে লিখেছেন, '২৭৯ জন ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি দেখা গেছে। পাঠদান সন্তোষজনক। গত বছরের সমাপনী পরীক্ষায় স্কুলটি ভালো ফল করেছে।'
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) মো. ফজলুল হক বলেন, 'আমি স্কুলটি কয়েক দফা পরিদর্শন করেছি। বলেশ্বর নদ তীরবর্তী কচুবাড়িয়ার ওই জেলেপল্লী সুবিধাবঞ্চিত একটি জনপদ। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য স্কুল করার এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এটি রেজিস্ট্রেশনভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।'
সিডরের পর প্রবাসী চার বন্ধুর উদ্যোগে জেলেপল্লীতে গড়ে তোলা হয় একটি বিদ্যালয়। তাঁদের এই মানবিক উদ্যোগে সারথি হন স্থানীয় একজন। কচুবাড়িয়া প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের এ বিদ্যালয়ে এখন ২৭৯টি শিশু নিয়মিত লেখাপড়া করছে। গত বছরের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় এই বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। এর মধ্যে আটজন প্রথম বিভাগ ও চারজন দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে। এ কৃতিত্বে ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্বীকৃতি যেন জানিয়ে দেয় জেলেপাড়ার দুর্গত জীবনে লেগেছে আলোর পরশ।
বৃদ্ধ জেলে ফজলুল হক হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা কোনো কালে লেহাপড়ার সুযোগ পাই নাই। সিডরের কালে এই স্কুলডা অওনে মোগো জাইল্যাপাড়ায় ভালো অইছে। এই স্কুলে মোর চাইরডা নাতি লেহাপড়া করতে আছে। এইডা দেইখা খুব আনন্দ পাইতেছি। মোরা চাই জাইল্যার পোলার যেন আর জাইল্যা না অওন লাগে।'
যেভাবে শুরু : ঘূর্ণিঝড় সিডরের কারণে হওয়া জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় কচুবাড়িয়া বেড়িবাঁধের জেলে বসতি। ঘূর্ণিঝড়ে মঠবাড়িয়ায় ২৭১ জনের প্রাণহানি ঘটে। বিধ্বস্ত হয় প্রায় ৫৮ হাজার ঘরবাড়ি। একদিন পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীরা কচুবাড়িয়ার জেলেদের পাশের এসে দাঁড়ান। তাঁরা সেখানে একটি লঙ্গরখানা খোলেন। প্রথম দিন ৮৫০ দুর্গত মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা হয় সেখানে। পরে ১৩ দিনের ওই লঙ্গরখানায় প্রতিদিন তিন হাজার ৭০০ জনের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এর পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা দিয়েছিল ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই লঙ্গরখানায় এসেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান। সে সময় আবুল কালাম নামে এক জেলে তাঁর কাছে জেলেপল্লীর শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। মনজুরুল আহসান খান ঢাকায় ফিরে ব্রিটেনপ্রবাসী পরিচিতজনদের বিষয়টি জানান। এতে সাড়া দেন ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার নগরভিত্তিক হাইড বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন।
২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল কচুবাড়িয়া ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। দ্বিতল পাকা ভবন নির্মাণ শেষ হয় গত বছর। একই সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্র ও বিদ্যালয় ভবনটির আয়তন এক হাজার ৮৬০ বর্গফুট। আছে খেলার মাঠ ও পুকুরে পানি বিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৪০ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছেন প্রবাসী ওই চার বন্ধু। বিদ্যালয়ের জন্য ৩৭ শতাংশ জমি দিয়েছেন স্থানীয় মৎস্যজীবী মো. নিজাম মিয়া রিপন।
৫০ জন শিক্ষার্থী দিয়ে শুরু হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৭৯ জন। পাঁচজন শিক্ষকের স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে পাঠদান। গত বছরের সমাপনী পরীক্ষার সাফল্যের খবর এখন মানুষের মুখে মুখে।
মহতী এই উদ্যোগের সঙ্গে থাকা নিজাম মিয়া বলেন, 'কচুবাড়িয়া জেলেপাড়ার চার কিলোমিটারের মধ্যে স্কুল নেই। তা ছাড়া যোগাযোগও বিপর্যস্ত। এখানে ভূমিহীন জেলেদের বাস। একটা স্কুল হবে, জেলেপাড়ার শিশুদের লেখাপড়া হবে_এমন আশা ও স্বপ্ন নিয়েই জমি দিয়েছি। এটা করতে পেরে এখন খুব ভালো লাগছে।'
চার বন্ধুর এগিয়ে আসা : ব্রিটেনপ্রবাসী চার বন্ধু আবদুল মোছাবি্বর, সাংবাদিক ফারুক যোশী, রহমত উল্লাহ ও আকাদ্দস আলীর বাড়ি সিলেট। তাঁরা ম্যানচেস্টারে হাইড বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামের এই মানবিক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন। উদ্দেশ্য এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে দুর্গতদের সহায়তার জন্য উদ্যোগ নেন তাঁরা। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনজুরুল আহসান খানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কচুবাড়িয়ার চরাঞ্চলে তাঁরা ত্রাণ সহায়তা দেন। ওই ত্রাণ সহায়তা দিতে গিয়েই জেলেপাড়ার শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি তাঁদের মাথায় আসে।
স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক মো. ইকতিয়ার হোসেন পান্না বলেন, 'কচুবাড়িয়া জেলেপল্লীর শিশুরা নদীতে শ্রম দিয়ে ওদের পরিবারের আয় রোজগারে সহায়তা করে আসছিল। সিডরের সময় বিপর্যয় নেমে এসেছিলে এই শিশুদের জীবনেও। তারা লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে সেই বিপন্নতা কাটিয়ে উঠেছে। এই স্কুলটি ওদের জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছে।'
স্বেচ্ছাশ্রমে পাঠদান : সরকারি-বেসরকারি কিংবা অন্য কোনো সহায়তা নেই, তাহলে কিভাবে চলবে প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয়? উদ্যোক্তারা যখন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন, তখন এগিয়ে আসেন স্থানীয় পাঁচ শিক্ষিত বেকার। তাঁদের মধ্যে রেজাউল কবীর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন মারিয়া আকতার, জেসমীন আকতার, মো. মিলন মিয়া ও আয়শা আকতার। তাঁদের স্বেচ্ছাশ্রমেই এগিয়ে চলছে বিদ্যালয়টি। নিয়মিত দুই পালায় তাঁরা পাঠদান করেন। বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য রয়েছে ১১ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটি।
প্রধান শিক্ষক রেজাউল কবীর বলেন, 'হতদরিদ্র জেলে শিশুদের বিনাপারিশ্রমিকে পড়াতে ভালোই লাগছে। তবে বিদ্যালয়টির সার্বিক অবকাঠামো ও পাঠদানের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করে এটি রেজিস্ট্রেশনভুক্ত করলে সবার ভালো হতো।'
সহকারী শিক্ষক জেসমীন আক্তার বলেন, 'দুর্গত ও শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য শুরু থেকেই স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে আসছি। সিডরের চার বছর পরে স্কুলটি দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এটি চালু রাখতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।'
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট দিলীপ কুমার পাইক বলেন, 'মহতী উদ্যোগের এই স্কুল সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে। বঞ্চিত জেলেশিশুরা শিক্ষার আলো পাচ্ছে, এটা খুব আশার কথা। আমরা সবাই মিলে আশা করছি, সরকার পাশে দাঁড়াবে। কেননা শিক্ষা কখনো সুযোগ নয়, সবার অধিকার। রাষ্ট্র এই অধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করবে। কচুবাড়িয়া জেলেপাড়ার মানুষ সেই অপেক্ষায় আছে।'
শেষ কথা : গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় মঠবাড়িয়া উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বলেশ্বর নদের নিভৃত চর এলাকা কচুবাড়িয়ার প্রগতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, খেলার মাঠে শতাধিক শিশু সারিবদ্ধ দাঁড়ানো। সামনে শুকনো বাঁশে উড়ছে জাতীয় পতাকা। শিশুরা গাইছে_'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।' জাতীয় সংগীত শেষ হতেই ওরা ছুটল শ্রেণীকক্ষে। একসময় যে যার আসনে বসল, এ নিয়ে কিছু হুড়োহুড়িও হলো। কানায় কানায় ভরে গেল শ্রেণীকক্ষগুলো।
শ্রেণীশিক্ষক মিলন মিয়া জানালেন, দুই পর্বে এখানে পাঠদান চলে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এক পালা। আর পরের পালা শুরু হয় আধাঘণ্টা পরে, চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
এ পর্যন্ত কয়েক দফা বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা। সব শেষ গত ২১ অক্টোবর বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বিদ্যালয়ে রক্ষিত মন্তব্য বইয়ে লিখেছেন, '২৭৯ জন ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি দেখা গেছে। পাঠদান সন্তোষজনক। গত বছরের সমাপনী পরীক্ষায় স্কুলটি ভালো ফল করেছে।'
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) মো. ফজলুল হক বলেন, 'আমি স্কুলটি কয়েক দফা পরিদর্শন করেছি। বলেশ্বর নদ তীরবর্তী কচুবাড়িয়ার ওই জেলেপল্লী সুবিধাবঞ্চিত একটি জনপদ। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য স্কুল করার এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এটি রেজিস্ট্রেশনভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।'
No comments