দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশী পণ্যের বাজার : রফতানির চেয়ে আমদানি আটগুণ বেশি

ক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশী পণ্যের বাজার ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে। এসব দেশে বাংলাদেশের রফতানি আর্থিক হিসাবে সামান্য বাড়লেও আমদানি বাড়ছে ব্যাপকহারে। সরকারি হিসাবে গত অর্থবছরে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশী পণ্য রফতানির তুলনায় এ অঞ্চল থেকে আমদানি হয়েছে প্রায় আটগুণ বেশি। এভাবে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) সুবিধা ভোগ করতে পারছে না বাংলাদেশ।


সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, কৃষি বীজ, আদা, রসুন ও শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে সব পণ্যই আসছে সার্কের সদস্য দেশগুলো থেকে। কখনও প্রয়োজনে আবার কখনও কৌশলে এসব পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে বাংলাদেশে। তবে যত সহজে এসব পণ্য আমদানি হয়ে থাকে, ভারত-পাকিস্তানসহ সার্কের বড় দেশগুলোর বাজারে তত সহজে কিন্তু রফতানি করা যায় না বাংলাদেশী কোনো পণ্যই। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলে আসায় দক্ষিণ এশিয়ার মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশ খুব একটা বাড়েনি।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশ ৬৫ কোটি ১৪ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। একই সময়ে এসব দেশ থেকে বাংলাদেশে ৫৩৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এ হিসাবে গত অর্থবছরে সার্ক অঞ্চলে রফতানির তুলনায় ৮ গুণ বেশি পণ্য আমদানি করা হয়েছে। ফলে এক বছরেই এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭০ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে
মাত্র ৪২ কোটি পাঁচ ডলার মূল্যমানের বাংলাদেশী পণ্য রফতানি হয়েছিল। একই সময়ে এসব দেশ থেকে ৩৬১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছিল। ফলে ২০০৯-১০ অর্থবছরে এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৩১৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।
ব্যাপকহারে পণ্য আমদানি করা হলেও সে তুলনায় বাংলাদেশী পণ্য রফতানি করতে না পারায় সার্ক অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। শ্রীলঙ্কা বাদে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি সব দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি ভারতের সঙ্গে।
২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫১ কোটি ২৫ লাখ ডলার মূল্যমানের পণ্য ভারতে রফতানি করা হয়েছে। বিপরীতে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ৪৫৭ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের পণ্য। ফলে গত অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৪০৬ কোটি ২৪ লাখ ডলারের। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২৯০ কোটি ৯৯ লাখ ডলার।
ভারতের পর বাংলাদেশের বেশি বাণিজ্য ঘাটতি পাকিস্তানের সঙ্গে। ২০১০-১১ অর্থবছরে পাকিস্তানে বাংলাদেশী পণ্য রফতানি হয়েছে আট কোটি ৬৭ লাখ ডলারের। বিপরীতে আমদানি হয়েছে ৬৭ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য। ফলে এ সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৫৮ কোটি ৪২ লাখ ডলারের। অথচ ২০০৯-১০ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৪ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।
ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট রফতানি বাণিজ্যের প্রায় ৩ শতাংশ হয় সার্ক অঞ্চলের সঙ্গে। এ হার গত ১২ বছর ধরেই কাছাকাছি অবস্থান করছে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে এ হার ছিল মোট রফতানির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। গত ২০০৬-০৭ অর্থবছরে তা ছিল ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
অন্যদিকে আমদানির বেলায় এ হার গত ১২ বছর ধরে ১৫ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে সার্কের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের আমদানি ছিল মোট আমদানির ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে তা দাঁড়ায় প্রায় ১৮ শতাংশের কাছাকাছি।
ভারত-পাকিস্তানের বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। সার্কের নবীন সদস্য আফগানিস্তানের সঙ্গে ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ছিল ১৯ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। এক বছরের মাথায় এ উদ্বৃত্ত ঘাটতিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
ভুটানের সঙ্গে ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল এক কোটি ৫৫ লাখ ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মালদ্বীপের সঙ্গে ঘাটতি ছিল মাত্র ১ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে এ ঘাটতি বেড়ে ৫ লাখ ৩০ হাজার ডলারে উন্নীত হয়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। গত অর্থবছরে নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারে।
সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে একমাত্র শ্রীলঙ্কার সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সরকারি পর্যায়ে বহুবারই উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু দেশটির একরোখা মনোভাবের কারণে বাণিজ্য ঘাটতি তো কমছেই না, উল্টো বাংলাদেশের বাজার দখলে রাখতে বিভিন্ন কৌশল নিয়ে থাকে দেশটি। জানা গেছে, অশুল্ক বাধার মুখে পড়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের বাজারে পণ্য রফতানি হুমকির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশী পণ্য ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না ভারতে। বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশে বাধাদানকে দেশটির অনৈতিক কর্মকাণ্ড বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অবৈধ আইন দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পণ্য ভারতের বাজারে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
এদিকে সার্ক দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য আশানুরূপ না হওয়ার পেছনে রফতানিকারকদের অনীহাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে ইপিবি’র একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ইউরোপ-আমেরিকার বাজার ধরতে যতটা মরিয়া হয়ে কাজ করেন, ততটা উত্সাহ নেই দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বাজার ধরতে।
এ ব্যাপারে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। তিনি বলেন, পোশাকনির্ভর হয়ে পড়ায় বাংলাদেশের রফতানি বাজার ইউরোপ ও আমেরিকাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। কিন্ত সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এসব অঞ্চল থেকে রফতানি আদেশ কমে আসছে আশঙ্কাজনক হারে। ঝুঁকি মোকাবিলায় বিকল্প বাজার অনুসন্ধান করা অত্যাবশ্যক বলে মনে করেন সালাম মুর্শেদী।
সূত্রমতে, সার্কের সদস্য দেশগুলোয় বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবং একটি সমতা আনতে চুক্তি করা হয় সাফটা। তবে রফতানি তালিকায় সীমিত পণ্য, স্থানীয়ভাবে পণ্য উত্পাদনে অতিরিক্ত ব্যয় আর অশুল্ক বাধাজনিত কারণে বাংলাদেশ সাফটা থেকে বেশি কিছু পাচ্ছে না। সাফটা শুল্ক ছাড় কার্যকর হওয়ায় উল্টো নিজেদের বাজার বেদখল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপালের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশে অশুল্ক বাধা তেমন নেই। আর এসব দেশ থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির হারও কম। তবে ভারত থেকেই বেশি আমদানি হয়ে থাকে। বাণিজ্য ঘাটতিও ভারতের সঙ্গেই বেশি। ভারতের বাজারে ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ ও প্যারাট্যারিফ বাধার কারণে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশের সুযোগ খুব বেশি একটা নেই।

No comments

Powered by Blogger.