শাহজাহান হতে পারেন সাদামনের মানুষ by জিয়াউল হাসান পলাশ,

দোম গায়ে মালকোঁচামারা লোকটি ময়লা-আবর্জনায় মজে যাওয়া ভরাট খালটি আবার গতিশীল করতে চান। কিন্তু ছবিটি দেখলে মনে হয় পাগল বা সাধারণ কোনো লোক ময়লা-আবর্জনার মধ্যে কিছু খুঁজছে। আবার এমনও মনে হতে পারে, কোনো ব্যক্তিকে পারিশ্রমিক দিয়ে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করানো হচ্ছে। তবে এ দুটোর কোনোটাই নয়, বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো। যিনি ঝালকাঠির সবার কাছে শাহজাহান কবির (কবি ভাই) নামে পরিচিত। একজন সাদামনের মানুষ বলা যায় তাকে। তার হৃদয় ব্যথিত শহরের ভরাট হওয়া খালগুলোর জন্য। অযত্ন-অবহেলা এবং ময়লা-আবর্জনায় ভরে যাচ্ছে এসব খাল। তার মতে খাল হচ্ছে শহরের প্রাণ।


তাই এগুলো পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন নিজেই। থকথকে আবর্জনার মধ্যে নেমে নিজ হাতে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই পরিষ্কারের কাজে নিমগ্ন তিনি। তার ধারণা এভাবে সমাজের প্রতিটি মানুষের মন থেকে ময়লাযুক্ত চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ফেলা উচিত। তাহলেই সমাজের অন্ধকার ছাপিয়ে আলো ফুটে উঠবেই।
অতি সাধারণ এক মানুষ শাহজাহান। জীবনে তার সাধ একটাই। স্বেচ্ছাশ্রমে সমাজের জন্য কিছু করা। নিজেকে বহুমুখী শ্রমিক দাবি করা এ লোকটি নিজের রিকশা বন্ধক রেখে শিশুদের পড়ার বই কিনে দেন। হোটেলে কাজের বিনিময়ে পাওয়া স্ত্রীর পারিশ্রমিক এবং নিজের টুকটাক আয় দিয়ে ছিন্নমূল নারী ও শিশুদের খাবার কিনে দেন। এ ছাড়াও সমাজের কল্যাণে এসব শিশু ও নারীকে নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন নিঃস্বার্থভাবে। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কোনো সচ্ছল
ব্যক্তির সহযোগিতা পেলে সমাজের ঝরেপড়া শিশুদের পড়ালেখা ও চলি্লশোর্ধ নারীদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।
শাহজাহান বিয়ে করেন ঝালকাঠি শেখেরহাট ইউনিয়নের বংকুরা গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন ইছানীল স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় কবিতা লিখে প্রথম হয়ে কেমি ঘড়ি পুরস্কার পান তিনি। তখন থেকেই কবিতা লেখার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এর পর ঝালকাঠিতে সাহিত্য অনুষ্ঠানে আসা কবি আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণসহ অনেকের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ পান। একপর্যায়ে ঝালকাঠির কৃতী সন্তান কবি সিকান্দার কাবিরের সানি্নধ্যে এসে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন। তাই তাকে কবিগুরু মেনে নিয়ে তার নামের সঙ্গে নিজের নাম মিলিয়ে রাখেন শাহজাহান কাবির।
স্কুলজীবন শেষ করার পর তিনি বাঁচার তাগিদে রিকশা চালিয়ে উপার্জন করেছেন। শাহজাহান বলেন, তখন অনুভব করেছি সমাজপতিদের কাছে আমাদের মতো গরিবরা নির্যাতিত হচ্ছে। এ নিয়ে একটি গান লিখি-'সকলের জ্বালা ওরা রিকশাওয়ালা, শহরের জ্বালা/রিকশাওয়ালা, কলমে করিয়া চুরি হয়ে যায় চৌধুরী, সমাজে বাহাদুরি...'। আমি ভিক্ষা পছন্দ করি না। নিজেকে একজন বহুমুখী শ্রমিক মনে করি বলেন তিনি।
বর্তমানে শহর সংলগ্ন কিস্তাকাঠি আবাসন প্রকল্পে স্ত্রী এবং মেয়ে নিয়ে থাকেন। শাহজাহান কবির মনে করেন একশ্রেণীকে না খাইয়ে রেখে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তিনিও কিছু করতে চান। তিনি বাবুর্চির কাজ করার পাশাপাশি তার স্ত্রীও হোটেলে ধোয়ামোছার কাজ করেন। লেখাপড়াবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করতে তার উৎসাহ। শাহজাহান পড়ালেখাবঞ্চিত, ছিন্নমূল হতদরিদ্র ২০ শিশু এবং ২০ নারীকে সহায়তা করার জন্য সংগ্রামে নেমেছেন। প্রায়ই তিনি এ শিশুদের নিয়ে শহীদ মিনার, টাউন হল পরিষ্কার, শহরের বিভিন্ন সড়কের গর্ত ইট-খোয়া দিয়ে ভরাট করে দেন। তার মতে তথ্যই শক্তি, তথ্যই মুক্তি। শুধু পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মী দিয়ে এত কাজ করানো সম্ভব নয়। তাই তিনি এ কাজ করে সমাজের উন্নয়নে কিছুটা হলেও অবদান রাখতে চান। এসব কাজে কেউ খুশি হয়ে কিছু পারিশ্রমিক দিলে তিনি নেন। না দিলেও তার কাজ থেমে থাকে না। নিজের শ্রম দিয়ে মানুষের একটু উপকার করার মধ্য দিয়ে পরকালে নাজাত পাবার আশা তার। তাই এসব করেন বলে জানান শাহজাহান।
তার লেখা কবিতাগুলো বই আকারে এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গানের ক্যাসেট বের করার আশা আছে। বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে তার মন্তব্য, 'অলস রাজনীতি ঘুমন্ত'। শিক্ষাবঞ্চিতদের বাদ দিয়ে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। বর্তমান বাজারদর সম্পর্কে তার ধারণা, বড় দুটি দলেরই বাজার সিন্ডিকেট আছে। মানুষকে সচেতন করতে তাদের অধিকার সম্পর্কে জানাতে হবে। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে গানের মাধ্যমে তিনি বলেন, 'জেগে ওঠো মুক্তি সেনা, বাংলার বুকে হায়না হায়না'। তিনি বলেন বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন। শেখ হাসিনা স্বাধীনতা রক্ষা করেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর ছবির পাশাপাশি শেখ হাসিনার ছবি না রেখে একটু নিচে রাখা উচিত। শাহজাহান মনে করেন, কবিতা বা লেখা সবাই পড়ে না বা বোঝে না। তবে একটি ছবির মাধ্যমে অনেক কিছু বোঝানো যায়। তাই তিনি ছবি আঁকতে শিখেছেন। তিনি সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদের প্রতি তার কাজে সহায়তাকারী এসব শিশু ও নারীকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

No comments

Powered by Blogger.