ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ
আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০’র সেইদিন পুরো উপকূলবাসীর জীবনে নেমে আসে শতাব্দীর ভয়াবহতম মহাদুর্যোগ। সেদিন উপকূলীয় জেলাগুলোর ওপর শতাব্দীর প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড় আঘাত হানে। সে ভয়াল রাতের মহাপ্রলয়ংঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিমিষেই উপকূলীয় চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় ১০/১২ ফুট পানিতে তলিয়ে যায় বাড়িঘর, ফসলের মাঠ, উঠানে স্তুপাকার করে রাখা ও গোলা ভরা পাকাধান।
স্রোতের তোড়ে হাজার হাজার মানুষ ও কয়েক লাখ গরু-মহিষ ভেসে যায়। একটিমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগে এতো প্রাণহানির ঘটনা এ দেশে আর কখনো ঘটেনি। সরকারি হিসাবে ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানির কথা বলা হলেও বে-সরকারি হিসাবে ১০ লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ওই ঘুর্ণিঝড়ে। লাখ লাখ গবাদিপশুর মৃত্যু ছাড়াও ৫কোটি মেট্রিকটন খাদ্যশস্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়। ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার কোটি কোটি টাকার অবকাঠামো ধ্বংস্তুপে পরিণত হয় মুহূর্তের মধ্যে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ১৮টি উপকূলীয় জেলা। বিরানভূমিতে পরিণত হয় সাগরবর্তী পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় জনপদ আর সজীব বনভূমি।
সেই মহাদুর্যোগের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা স্বজনহারাদের সঙ্গে কথা বলে এবং যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে বর্তমান উপকূলীয় এলাকার বাস্তবতা তুলে ধরে নোয়াখালী প্রতিনিধি জামাল হোসেন বিষাদ, পটুয়াখালী সংবাদদাদা জাকারিয়া হৃদয় ও কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) সংবাদদাতা বেলাল হোসেন জুয়েলের প্রতিবেদন
পরিবারের ২৪ জনই ভেসে যায়
চরক্লার্ক ইউনিয়নের মেম্বার ফজলুল হক (৭০) সেদিনের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে বাংলানিউজের নোয়াখালী প্রতিনিধি জামাল হোসেন বিষাদকে আবেগভরা গলায় বলেন, ‘সত্তরের গোর্কিতে চোখের সামনেই ভেসে গেছে ৬ ছেলে। কিছুই করতে পারিনি। সারারাত কোনওমতে গাছ ধরে বেঁচে থাকলেও ভোর হতেই দেখি ৩১ সদস্যের পরিবারের ২৪ জনই ভেসে গেছে বানের পানিতে। একটি লাশও পাইনি কবর দিতে। দায়িত্বের কারণে গ্রামবাসীর লাশ কবর দেওয়া আর ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে নেমে পড়তে হয়েছে তখন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষ আর গবাদি পশুর লাশ সৃষ্টি করেছিলো এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির।’
চরবাটা ইউনিয়নের বাসিন্দা ফয়েজ আহম্মেদ (৭২) জানান, সেদিন ১০ রমজান ছিলো। তার মেয়ে, ফুফু ও বোন সেদিন মারা যায়। ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে ঘরের নিচে চাপা পড়া ৬জনকে সেদিন তিনি উদ্ধার করেছিলেন। যাদের মধ্যে এখনো ৫ জন বেঁচে আছেন। তিনি বলেন, ‘৭০ এর গোর্কিতে মরেছে অর্ধলক্ষ মানুষ আর এখন যদি হয় তাহলে কয়েক লাখ মানুষ মারা যাবে। কারণ নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় যেখানে গাঢ় সবুজ বন ছিলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষের জানমাল রক্ষার প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে, সে জায়গা এখন বনহীন এক জনপদ।’
তিন লক্ষাধিক মানুষ ঝুঁকিতে
সরেজমিনে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মূলভূখ- লাগোয়া নিঝুম দ্বীপ, দমারচর, ঢালচর, মৌলভীরচর, সাহেবানিরচর, চর নূর ইসলাম, চর ইসলাম, নঙ্গলিয়ার চর, কেরিংচর, নলের চর, নামার চর ও পাতার চর, চরলক্ষ্মী, পশ্চিম উরির চর, এবং নোয়াখালীর সুবর্র্ণচর উপজেলার দক্ষিণ চরক্লার্ক, উরির চর, চর বায়জীদ, চর নোমান, চর কণক, চর মকসুমুল, চরবালুয়া ও দিয়ারা বালুয়ায় বন উজাড় করে গড়ে ওঠা মেঘনা পাড়ে এবং বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি এই অরক্ষিত জনপদে এখন ৩ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। যারা রয়েছেন সরাসরি প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত মৃত্যুঝুঁকিতে। এতদিনেও এসব চরে কোনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হয়নি। পাশাপাশি যোগাযোগ অবকাঠামো না থাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে এ চরগুলোর বাসিন্দাদের দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে সরানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।
হাতিয়া উপজেলার হাতিয়া নদীর কুল ঘেঁষে বয়ারচরে বসবাসকারী রোকেয়া খাতুন (২৮) বলেন, ‘আমরা বয়ারচরে সাত বছর ধরে থাকি। আইলার সময় পরিবারের লোকজন নিয়ে স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে পারলেও ঘর-বাড়ি, পরিবারের জিনিসপত্র, গবাদিপশু নিতে পারিনি। তিনদিন পরে এসে দেখি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। নদীতে একবার সব নিয়ে গেছে, পরে আইলা ভাসিয়েছে। এখন আতঙ্কাবস্থায় থাকি কখন আবার নতুন কোনেও দুর্যোগ সব ভাসিয়ে নেয়।’
সুবর্ণচরের দক্ষিণ চরমজিদের ভূমিহীন ছালেমা খাতুন (৩৮) থাকেন বেড়ির পাশের ঝুপড়ি ঘরে। বন কেটে উজাড় ও বসতি হলেও অবশিষ্ট বনের ভেতর থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে জীবন চালান। তিনি বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় বন থাকার কারণে ৯১ সালের তুফানের সময় ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। কিন্তু সেই বন উজাড় করে ফেলায় এখন যদি বান-তুফান হয় তাহলে কেউই রক্ষা পাবো না। তাই চরম আতঙ্কের ভেতরই থাকি।’
ছালেমা জানান, তার বাড়ির সামনে একসময় বিশাল বন ছিলো। এখন তা সাফ-সুতরো করে ফেলা হয়েছে প্রায়।
এদিকে, নোয়াখালী রেডক্রিসেন্টের সিবিডিআরআর প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আজরু উদ্দিন সাফদার বলেন, ‘এ অঞ্চলে রেডক্রিসেন্টের ১৪টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রেই অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তাছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে ঘিরে সচেতনা বৃদ্ধি, দুর্যোগকালীন সময়ে উদ্ধারকার্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে; দুর্গম চরাঞ্চলগুলোতে কোনও যোগাযোগ অবকাঠামো না থাকায় সমস্যা হয়।’
সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল আনম সেলিম বলেন, ‘১২ নভেম্বরের দুঃসহ স্মৃতি সহজে ভোলা যায় না। রমজান মাসের ওই দিন আসরের সময় থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ও বাতাস বইতে শুরু করে। রাত ১০টার পর থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অনেক মানুষ, সম্পদ, গবাদিপশু প্রবল জোয়ারে ভেসে যায়। সকালে দেখি লাশ আর লাশ। তখন আমি চাকসুর সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম। সাবেক স্পিকার মরহুম মালেক উকিল, সহিদ উদ্দিন এস্কেন্দার কচিসহ একটি টিম চরাঞ্চলে নিহতদের সৎকার করে। রিলিফ টিম করে এক মাসেরও বেশি সময় আমরা অসহায় মানুষদের মধ্যে রিলিফ বিতরণ করি।’
ক্ষয়ক্ষতি সত্তর সালের মত হবে না!
তবে তিনি বলেন, ‘এখন অবশ্য উপকূলের বেশিরভাগ এলাকাই অরক্ষিত, বনাঞ্চল কাটা হয়েছে, বেড়ি নেই, গড়ে উঠেছে হাজার হাজার মানুষের বসতি। সেরকম কিছু হলে ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য হবে, তবে সত্তর সালের মত হবে না। কারণ তখন এতটা প্রযুক্তি ছিলো না, তথ্য আদান প্রদানে জটিলতা ছিলো, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো দুর্বল।’
জেলা প্রশাসন, উপকূলীয় চরাঞ্চলে বসবাসকারী বয়োবৃদ্ধ, ভূমিহীন ও উন্নয়ন সংগঠনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭০’র ১২ নভেম্বরের ভয়াল গোর্কিতে নোয়াখালী উপকূলের অর্ধলক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পরবর্তীতে উপকূলীয় এলাকায় বনায়নের ফলে সুন্দরবনের মতো সবুজ ঢাল তৈরি হয় গোটা উপকূল জুড়ে। যার ফলে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এখানে জানমালের ক্ষতি ছিলো খুবই কম।
সাধারণের মত ভিন্ন
তবে, এ বিষয়ে সাধারণের মত ভিন্ন। উপকূলীয় এলাকার ৭০হাজার একর জমির বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুনে। দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় দ্রুত চরগুলোতে জানমাল রক্ষায় স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে বেড়িবাঁধ ও আশ্রয় কেন্দ্র এবং গবাদিপশু রক্ষায় কিল্লা নির্মাণের দাবি তাদের। একই সাথে বিচ্ছিন্ন চরগুলোতে ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণকেন্দ্র এবং দুর্যোগ হ্রাসকল্পে স্থাপিত তথ্যকেন্দ্র এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন নোয়াখালী উপকূলের মানুষ।
পটুয়াখালী সংবাদদাতা জাকারিয়া হৃদয় জানান, সত্তরের ১২ নভেম্বর সকাল থেকেই কালো মেঘে পুরো আকাশ ঢাকা ছিল। দুপুরের দিকে ২৫/৩০ ফুট উঁচু বিধ্বংসী ঢেউ উপকূলে আছড়ে পরে ধ্বংসলীলা চালায়। বিকালের মধ্যে ৭/৮ ফুট পানির নীচে তলিয়ে যায় পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা, দশমিনা, কলাপাড়া ও বাউফল উপজেলার দক্ষিণাঞ্চল। ভোলা জেলার চরফ্যাশন, লালমোহন, দৌলতখান, মনপুরা, বোরহানউদ্দিন ও তজুমদ্দিন উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাসহ নোয়াখালী জেলার হাতিয়া, রামগতি ও সোনাগাজী উপজেলা। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, সন্দীপ, আনোয়ারাসহ বিভিন্ন চরাঞ্চল ও দ্বীপ সমূহ একই দুর্যোগের শিকার হয়।
সেদিন রেডিওতে বারবার ১০নম্বর মহাবিপদ সংকেতের ঘোষণা দেয়া হলেও উপকূলীয় এলাকায় রেডিও না থাকায় সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে সতর্কবাণী জানতে পারেনি। রমজান মাসের ওইদিন অধিকাংশ মানুষই তারাবি নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত ৮টায় ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেনের রূপ ধারণ করে উপকূলে আঘাত হানে। প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলা প্রায় ২ঘণ্টাব্যাপী চলে। ১৫০ মাইল বেগে বয়ে যাওয়া এ ঝড়ের সাথে ১৮৭৬ সালের সাইক্লোনের ধ্বংসলীলার তুলনা করেছেন অনেকেই।
১২ নভেম্বরের ওই মহাদুর্যোগে শুধুমাত্র পটুয়াখালীর গলাচিপায় মারা যায় সর্বাধিক ২৮ হাজার ৭৮ জন নর-নারী।
বোনটি হাত ফসকে মুহূর্তে হারিয়ে যায়
ঝড়ের তাণ্ডবে পরিবারের সবাইকে হারানো রাঙ্গাবালির আবদুর রাজ্জাক বর্তমানে পটুয়াখালী শহরের বাসিন্দা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা রাতেও বুঝতে পারিনি ঝড়ের তাণ্ডব এত বেশি হবে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে ঝড়ের হিংস্রতা। চোখের নিমেষে বাড়ির উঠান তলিয়ে যায় জোয়ারের পানিতে। দেখতে দেখতে দোতালা টিনের ঘর ডুবে যায়। বাঁচার জন্য ঘরের সবাই আশ্রয় নিই উঠোনের একটি শিমুল গাছে। হঠাৎ বাতাসের সাথে ঢেউয়ের একটি ঝাপটা এসে মা-বাবাসহ দু’ভাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখনও শক্ত করে হাত ধরে আছে ছোট বোন। গাছের আরো একটু উপরে ওঠার চেষ্টা করতেই বোনটি হাত ফসকে পানিতে পড়ে মুহূর্তে হারিয়ে যায় ঢেউয়ের তোড়ে। তারপর আর কিছুই মনে নেই...’ ছল-ছল চোখে রাজ্জাকের করুণ অভিব্যক্তি এতকাল পরেও শ্রোতাদের চোখ ছল ছল করে দিয়ে।
রাজ্জাক বলেন, ‘আমাকে কারা যেন ভাসমান পেয়ে উদ্ধার করেছিল। স্বজনদের আর কাউকে আজও খুঁজে পাইনি।’
তিনি জানান, তার মত অনেকেই আছেন যারা পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একা বেঁচে আছেন।
১২ নভেম্বরের সেই ভয়াল স্মৃতিচারণ করে আজো উপকূলীয় এলাকার মানুষ আঁতকে ওঠে। আজো অশ্রু ঝরে স্বজন হারানোর বেদনায়।
আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর : এই দিনে আজও ‘আঁতকে’ ওঠে উপকূলবাসী
কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) সংবাদদাতা বেলাল হোসেন জুয়েল জানান, ভয়াল ১২ নভেম্বর কালরাতে প্রাণ হারানো ১০ লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতি দু’উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ ছিলেন। গৃহহারা হয়েছিলো কয়েক লাখ লোক। সেদিনের ভয়াবহ দুর্যোগের কথা মনে পড়লে আজও উপকূলীয় এলাকার মানুষের মন ও পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। চার দশক আগের স্মৃতি এখনো যেনো তাদের চোখের সামনে ভাসছে।
ভয়াল সে রাতে স্বজন হারানোরা জানান, রেডিওতে ৮নম্বর ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো বারবার। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলে রেডিও না থাকায় সাধারণ মানুষ জানতে পারেননি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আগাম বার্তা। গভীর রাতে ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার (১৩৮ মাইল) বেগে ঝড়ো হাওয়ার সাথে পাহাড় সমান পানির স্রোতে পুরো উপকূলীয় জনপদ ভেসে যায়।
লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গোটা উপকূল। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ, লাশের গন্ধে মানুষ লাশের কাছে পর্যন্ত যেতে পারেননি। দুর্যোগের পরও অধিকাংশ এলাকা ৩ থেকে ১০ ফুট পানিতে তলিয়ে থাকার কারণে অনেক এলাকায় লাশও মাটি দেয়া যায়নি।
স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এ দুর্যোগে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক হিসেব বের করা না গেলেও বেসরকারি হিসেবে ১০ লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে সরকারি হিসেবে প্রাণহানির সংখ্যা বলা হয়েছে ৫ লাখ, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে ৪ লাখ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির মৃত্যু ৭ লাখ ৮ হাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়েছে ৩ হাজার পাঁচশ’টি।
ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়- লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, চট্রগ্রাম, ভোলা, বরিশাল, কক্সবাজার ও পিরোজপুর জেলাকে।
সেদিনের সেই ভয়ানক স্মৃতির কথা স্মরণ করে উপজেলার রামগতিরহাট এলাকার বৃদ্ধা ছিদ্দিকা খাতুন (৭৭) বাংলানিউজকে জানান, ওই দিন জলোচ্ছ্বাসে তার মা-বাবা, স্বামী ও চার ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সবাই ভেসে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ আর ফিরে আসেননি। ওই জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিলেন তিনি নিজেও। দু’দিন পানিতে ভেসে থাকার পর হোসেন সরদার নামে এক ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করেছেন। তারপর থেকে এ বাড়ি, সে বাড়ি ঝি’র কাজ করে ৪০ বছর কেটে গেছে তার ।
স্মরণ
বিষাদ আর বিয়োগের স্মৃতি ভারাক্রান্ত এদিনটিকে উপকূলবাসী হারানো স্বজনদের জন্য দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও কুরআন খানিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে স্মরণ করছেন।
ভয়াল ১২ নভেম্বরকে ‘দুর্যোগ দিবস’ ঘোষণার দাবি করে প্রতি বছর বেসরকারি সংস্থা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পুয়র-‘ডর্প’ বিভিন্ন স্থানে সভা সমাবেশ করে আসছে। প্রতি বছরের মতো এবারো ডর্প ও গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার রামগতি কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠন জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনা সভা ও নিহতদের স্মরণে স্মৃতিচারণের আয়োজন করেছে।
সেই মহাদুর্যোগের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা স্বজনহারাদের সঙ্গে কথা বলে এবং যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে বর্তমান উপকূলীয় এলাকার বাস্তবতা তুলে ধরে নোয়াখালী প্রতিনিধি জামাল হোসেন বিষাদ, পটুয়াখালী সংবাদদাদা জাকারিয়া হৃদয় ও কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) সংবাদদাতা বেলাল হোসেন জুয়েলের প্রতিবেদন
পরিবারের ২৪ জনই ভেসে যায়
চরক্লার্ক ইউনিয়নের মেম্বার ফজলুল হক (৭০) সেদিনের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে বাংলানিউজের নোয়াখালী প্রতিনিধি জামাল হোসেন বিষাদকে আবেগভরা গলায় বলেন, ‘সত্তরের গোর্কিতে চোখের সামনেই ভেসে গেছে ৬ ছেলে। কিছুই করতে পারিনি। সারারাত কোনওমতে গাছ ধরে বেঁচে থাকলেও ভোর হতেই দেখি ৩১ সদস্যের পরিবারের ২৪ জনই ভেসে গেছে বানের পানিতে। একটি লাশও পাইনি কবর দিতে। দায়িত্বের কারণে গ্রামবাসীর লাশ কবর দেওয়া আর ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে নেমে পড়তে হয়েছে তখন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষ আর গবাদি পশুর লাশ সৃষ্টি করেছিলো এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির।’
চরবাটা ইউনিয়নের বাসিন্দা ফয়েজ আহম্মেদ (৭২) জানান, সেদিন ১০ রমজান ছিলো। তার মেয়ে, ফুফু ও বোন সেদিন মারা যায়। ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে ঘরের নিচে চাপা পড়া ৬জনকে সেদিন তিনি উদ্ধার করেছিলেন। যাদের মধ্যে এখনো ৫ জন বেঁচে আছেন। তিনি বলেন, ‘৭০ এর গোর্কিতে মরেছে অর্ধলক্ষ মানুষ আর এখন যদি হয় তাহলে কয়েক লাখ মানুষ মারা যাবে। কারণ নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় যেখানে গাঢ় সবুজ বন ছিলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষের জানমাল রক্ষার প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে, সে জায়গা এখন বনহীন এক জনপদ।’
তিন লক্ষাধিক মানুষ ঝুঁকিতে
সরেজমিনে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মূলভূখ- লাগোয়া নিঝুম দ্বীপ, দমারচর, ঢালচর, মৌলভীরচর, সাহেবানিরচর, চর নূর ইসলাম, চর ইসলাম, নঙ্গলিয়ার চর, কেরিংচর, নলের চর, নামার চর ও পাতার চর, চরলক্ষ্মী, পশ্চিম উরির চর, এবং নোয়াখালীর সুবর্র্ণচর উপজেলার দক্ষিণ চরক্লার্ক, উরির চর, চর বায়জীদ, চর নোমান, চর কণক, চর মকসুমুল, চরবালুয়া ও দিয়ারা বালুয়ায় বন উজাড় করে গড়ে ওঠা মেঘনা পাড়ে এবং বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি এই অরক্ষিত জনপদে এখন ৩ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। যারা রয়েছেন সরাসরি প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত মৃত্যুঝুঁকিতে। এতদিনেও এসব চরে কোনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হয়নি। পাশাপাশি যোগাযোগ অবকাঠামো না থাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে এ চরগুলোর বাসিন্দাদের দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে সরানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।
হাতিয়া উপজেলার হাতিয়া নদীর কুল ঘেঁষে বয়ারচরে বসবাসকারী রোকেয়া খাতুন (২৮) বলেন, ‘আমরা বয়ারচরে সাত বছর ধরে থাকি। আইলার সময় পরিবারের লোকজন নিয়ে স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে পারলেও ঘর-বাড়ি, পরিবারের জিনিসপত্র, গবাদিপশু নিতে পারিনি। তিনদিন পরে এসে দেখি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। নদীতে একবার সব নিয়ে গেছে, পরে আইলা ভাসিয়েছে। এখন আতঙ্কাবস্থায় থাকি কখন আবার নতুন কোনেও দুর্যোগ সব ভাসিয়ে নেয়।’
সুবর্ণচরের দক্ষিণ চরমজিদের ভূমিহীন ছালেমা খাতুন (৩৮) থাকেন বেড়ির পাশের ঝুপড়ি ঘরে। বন কেটে উজাড় ও বসতি হলেও অবশিষ্ট বনের ভেতর থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে জীবন চালান। তিনি বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় বন থাকার কারণে ৯১ সালের তুফানের সময় ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। কিন্তু সেই বন উজাড় করে ফেলায় এখন যদি বান-তুফান হয় তাহলে কেউই রক্ষা পাবো না। তাই চরম আতঙ্কের ভেতরই থাকি।’
ছালেমা জানান, তার বাড়ির সামনে একসময় বিশাল বন ছিলো। এখন তা সাফ-সুতরো করে ফেলা হয়েছে প্রায়।
এদিকে, নোয়াখালী রেডক্রিসেন্টের সিবিডিআরআর প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আজরু উদ্দিন সাফদার বলেন, ‘এ অঞ্চলে রেডক্রিসেন্টের ১৪টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রেই অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তাছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে ঘিরে সচেতনা বৃদ্ধি, দুর্যোগকালীন সময়ে উদ্ধারকার্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে; দুর্গম চরাঞ্চলগুলোতে কোনও যোগাযোগ অবকাঠামো না থাকায় সমস্যা হয়।’
সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল আনম সেলিম বলেন, ‘১২ নভেম্বরের দুঃসহ স্মৃতি সহজে ভোলা যায় না। রমজান মাসের ওই দিন আসরের সময় থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ও বাতাস বইতে শুরু করে। রাত ১০টার পর থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অনেক মানুষ, সম্পদ, গবাদিপশু প্রবল জোয়ারে ভেসে যায়। সকালে দেখি লাশ আর লাশ। তখন আমি চাকসুর সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম। সাবেক স্পিকার মরহুম মালেক উকিল, সহিদ উদ্দিন এস্কেন্দার কচিসহ একটি টিম চরাঞ্চলে নিহতদের সৎকার করে। রিলিফ টিম করে এক মাসেরও বেশি সময় আমরা অসহায় মানুষদের মধ্যে রিলিফ বিতরণ করি।’
ক্ষয়ক্ষতি সত্তর সালের মত হবে না!
তবে তিনি বলেন, ‘এখন অবশ্য উপকূলের বেশিরভাগ এলাকাই অরক্ষিত, বনাঞ্চল কাটা হয়েছে, বেড়ি নেই, গড়ে উঠেছে হাজার হাজার মানুষের বসতি। সেরকম কিছু হলে ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য হবে, তবে সত্তর সালের মত হবে না। কারণ তখন এতটা প্রযুক্তি ছিলো না, তথ্য আদান প্রদানে জটিলতা ছিলো, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো দুর্বল।’
জেলা প্রশাসন, উপকূলীয় চরাঞ্চলে বসবাসকারী বয়োবৃদ্ধ, ভূমিহীন ও উন্নয়ন সংগঠনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭০’র ১২ নভেম্বরের ভয়াল গোর্কিতে নোয়াখালী উপকূলের অর্ধলক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পরবর্তীতে উপকূলীয় এলাকায় বনায়নের ফলে সুন্দরবনের মতো সবুজ ঢাল তৈরি হয় গোটা উপকূল জুড়ে। যার ফলে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এখানে জানমালের ক্ষতি ছিলো খুবই কম।
সাধারণের মত ভিন্ন
তবে, এ বিষয়ে সাধারণের মত ভিন্ন। উপকূলীয় এলাকার ৭০হাজার একর জমির বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুনে। দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় দ্রুত চরগুলোতে জানমাল রক্ষায় স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে বেড়িবাঁধ ও আশ্রয় কেন্দ্র এবং গবাদিপশু রক্ষায় কিল্লা নির্মাণের দাবি তাদের। একই সাথে বিচ্ছিন্ন চরগুলোতে ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণকেন্দ্র এবং দুর্যোগ হ্রাসকল্পে স্থাপিত তথ্যকেন্দ্র এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন নোয়াখালী উপকূলের মানুষ।
পটুয়াখালী সংবাদদাতা জাকারিয়া হৃদয় জানান, সত্তরের ১২ নভেম্বর সকাল থেকেই কালো মেঘে পুরো আকাশ ঢাকা ছিল। দুপুরের দিকে ২৫/৩০ ফুট উঁচু বিধ্বংসী ঢেউ উপকূলে আছড়ে পরে ধ্বংসলীলা চালায়। বিকালের মধ্যে ৭/৮ ফুট পানির নীচে তলিয়ে যায় পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা, দশমিনা, কলাপাড়া ও বাউফল উপজেলার দক্ষিণাঞ্চল। ভোলা জেলার চরফ্যাশন, লালমোহন, দৌলতখান, মনপুরা, বোরহানউদ্দিন ও তজুমদ্দিন উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাসহ নোয়াখালী জেলার হাতিয়া, রামগতি ও সোনাগাজী উপজেলা। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, সন্দীপ, আনোয়ারাসহ বিভিন্ন চরাঞ্চল ও দ্বীপ সমূহ একই দুর্যোগের শিকার হয়।
সেদিন রেডিওতে বারবার ১০নম্বর মহাবিপদ সংকেতের ঘোষণা দেয়া হলেও উপকূলীয় এলাকায় রেডিও না থাকায় সাধারণ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে সতর্কবাণী জানতে পারেনি। রমজান মাসের ওইদিন অধিকাংশ মানুষই তারাবি নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত ৮টায় ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেনের রূপ ধারণ করে উপকূলে আঘাত হানে। প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলা প্রায় ২ঘণ্টাব্যাপী চলে। ১৫০ মাইল বেগে বয়ে যাওয়া এ ঝড়ের সাথে ১৮৭৬ সালের সাইক্লোনের ধ্বংসলীলার তুলনা করেছেন অনেকেই।
১২ নভেম্বরের ওই মহাদুর্যোগে শুধুমাত্র পটুয়াখালীর গলাচিপায় মারা যায় সর্বাধিক ২৮ হাজার ৭৮ জন নর-নারী।
বোনটি হাত ফসকে মুহূর্তে হারিয়ে যায়
ঝড়ের তাণ্ডবে পরিবারের সবাইকে হারানো রাঙ্গাবালির আবদুর রাজ্জাক বর্তমানে পটুয়াখালী শহরের বাসিন্দা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা রাতেও বুঝতে পারিনি ঝড়ের তাণ্ডব এত বেশি হবে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে ঝড়ের হিংস্রতা। চোখের নিমেষে বাড়ির উঠান তলিয়ে যায় জোয়ারের পানিতে। দেখতে দেখতে দোতালা টিনের ঘর ডুবে যায়। বাঁচার জন্য ঘরের সবাই আশ্রয় নিই উঠোনের একটি শিমুল গাছে। হঠাৎ বাতাসের সাথে ঢেউয়ের একটি ঝাপটা এসে মা-বাবাসহ দু’ভাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখনও শক্ত করে হাত ধরে আছে ছোট বোন। গাছের আরো একটু উপরে ওঠার চেষ্টা করতেই বোনটি হাত ফসকে পানিতে পড়ে মুহূর্তে হারিয়ে যায় ঢেউয়ের তোড়ে। তারপর আর কিছুই মনে নেই...’ ছল-ছল চোখে রাজ্জাকের করুণ অভিব্যক্তি এতকাল পরেও শ্রোতাদের চোখ ছল ছল করে দিয়ে।
রাজ্জাক বলেন, ‘আমাকে কারা যেন ভাসমান পেয়ে উদ্ধার করেছিল। স্বজনদের আর কাউকে আজও খুঁজে পাইনি।’
তিনি জানান, তার মত অনেকেই আছেন যারা পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একা বেঁচে আছেন।
১২ নভেম্বরের সেই ভয়াল স্মৃতিচারণ করে আজো উপকূলীয় এলাকার মানুষ আঁতকে ওঠে। আজো অশ্রু ঝরে স্বজন হারানোর বেদনায়।
আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর : এই দিনে আজও ‘আঁতকে’ ওঠে উপকূলবাসী
কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) সংবাদদাতা বেলাল হোসেন জুয়েল জানান, ভয়াল ১২ নভেম্বর কালরাতে প্রাণ হারানো ১০ লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর ও রামগতি দু’উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ ছিলেন। গৃহহারা হয়েছিলো কয়েক লাখ লোক। সেদিনের ভয়াবহ দুর্যোগের কথা মনে পড়লে আজও উপকূলীয় এলাকার মানুষের মন ও পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। চার দশক আগের স্মৃতি এখনো যেনো তাদের চোখের সামনে ভাসছে।
ভয়াল সে রাতে স্বজন হারানোরা জানান, রেডিওতে ৮নম্বর ও ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো বারবার। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলে রেডিও না থাকায় সাধারণ মানুষ জানতে পারেননি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আগাম বার্তা। গভীর রাতে ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার (১৩৮ মাইল) বেগে ঝড়ো হাওয়ার সাথে পাহাড় সমান পানির স্রোতে পুরো উপকূলীয় জনপদ ভেসে যায়।
লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গোটা উপকূল। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ, লাশের গন্ধে মানুষ লাশের কাছে পর্যন্ত যেতে পারেননি। দুর্যোগের পরও অধিকাংশ এলাকা ৩ থেকে ১০ ফুট পানিতে তলিয়ে থাকার কারণে অনেক এলাকায় লাশও মাটি দেয়া যায়নি।
স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এ দুর্যোগে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক হিসেব বের করা না গেলেও বেসরকারি হিসেবে ১০ লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে সরকারি হিসেবে প্রাণহানির সংখ্যা বলা হয়েছে ৫ লাখ, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে ৪ লাখ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির মৃত্যু ৭ লাখ ৮ হাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হয়েছে ৩ হাজার পাঁচশ’টি।
ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়- লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, চট্রগ্রাম, ভোলা, বরিশাল, কক্সবাজার ও পিরোজপুর জেলাকে।
সেদিনের সেই ভয়ানক স্মৃতির কথা স্মরণ করে উপজেলার রামগতিরহাট এলাকার বৃদ্ধা ছিদ্দিকা খাতুন (৭৭) বাংলানিউজকে জানান, ওই দিন জলোচ্ছ্বাসে তার মা-বাবা, স্বামী ও চার ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সবাই ভেসে গেছেন। তাদের মধ্যে কেউ আর ফিরে আসেননি। ওই জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিলেন তিনি নিজেও। দু’দিন পানিতে ভেসে থাকার পর হোসেন সরদার নামে এক ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করেছেন। তারপর থেকে এ বাড়ি, সে বাড়ি ঝি’র কাজ করে ৪০ বছর কেটে গেছে তার ।
স্মরণ
বিষাদ আর বিয়োগের স্মৃতি ভারাক্রান্ত এদিনটিকে উপকূলবাসী হারানো স্বজনদের জন্য দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও কুরআন খানিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে স্মরণ করছেন।
ভয়াল ১২ নভেম্বরকে ‘দুর্যোগ দিবস’ ঘোষণার দাবি করে প্রতি বছর বেসরকারি সংস্থা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পুয়র-‘ডর্প’ বিভিন্ন স্থানে সভা সমাবেশ করে আসছে। প্রতি বছরের মতো এবারো ডর্প ও গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার রামগতি কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠন জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনা সভা ও নিহতদের স্মরণে স্মৃতিচারণের আয়োজন করেছে।
No comments