৬ মাসে ৩ দফা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি : জীবনযাত্রা অসহনীয় : আগামী মাসে সিএনজি ও বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ছে by জাকির হোসেন
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরেক দফা বাড়তে শুরু করেছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব এরই মধ্যে পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে। যানবাহন মালিকরা প্রস্তুতি নিয়েছেন ভাড়া বৃদ্ধির। যানবাহন মালিকদের কেউ কেউ ভাড়া বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত রাস্তায় যানবাহন না নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর গতকাল রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার খবরে বেড়ে গেছে ভোগ্যপণ্যের দাম। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছে খোদ সরকারি দল।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের গতকাল ফেনীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব দ্রব্যমূল্য এবং
পরিবহনসহ সামগ্রিকভাবে শিল্পকারখানার ওপর পড়বে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। দেশে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হতে পারে। আর বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে এর জন্য অর্থমন্ত্রীই দায়ী থাকবেন।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীবিদ এবং বাজার বিশ্লেষকরা গতকাল পৃথক প্রতিক্রিয়ায় দৈনিক আমার দেশকে বলেছেন, সরকার কয়েকদিন পর পর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে মানুষের দুর্ভোগ নানাভাবে বাড়িয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে সরকার জনগণের সঙ্গে তামাশায় মেতেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি না পাওয়া সত্ত্বেও সরকার ভর্তুকি কমানোর দোহাই দিয়ে আরেক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু ভর্তুকি বেড়েছে সরকারের ভুল নীতির কারণে। তেল ভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট প্রতিষ্ঠা করায় তেলের আমদানি বেড়েছে । সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত বাংলাদেশের জনগণ দিতে পারে না। তারা আরও বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে জনজীবনের ওপর বহুমাত্রিক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এর ফলে কৃষি এবং শিল্পখাতে উত্পাদন ব্যয় বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে পরিবহন ব্যয়। ফলে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে শুধু জ্বালানি তেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বাড়বে তা নয়— বাড়িভাড়াও বাড়বে। ফলে মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় আরও একধাপ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব। ফলে বর্তমান বিশ্ব মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি তেলের এই মূল্য বৃদ্ধি দেশকে একটি নাজুক অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেবে।
হঠাত্ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর মাঝরাতে পাম্পগুলোতে তেল নিতে আসা গাড়ির চালকরা দারুণ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অন্যান্য পণ্যের ওপরও পড়বে। এর ফলে জনজীবনে অস্থিরতা তৈরি হবে। বৃহস্পতিবার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিন ৫৬ টাকা, পেট্রল ৮৫ টাকা ও অকটেন ৮৯ টাকা হয়। এছাড়া ফার্নেস ওয়েলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে লিটারপ্রতি ৫৫ টাকা। এ নিয়ে গত ৬ মাসে তিন বাড়ার জ্বালানি তেলের দাঁড়ালো সরকার। আগামী মাসে আবারও বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুত্ এবং সিএনজির দাম। সরকারের জ্বালানি বিভাগ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক বৈঠকে অনেকটা চুপিসারেই আবারও সব ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত নেয়। এ যাত্রায় মাত্র পৌনে দু’মাসের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের দাম আরও এক দফা বাড়ানো হলো। এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। তখন ফার্নেস ওয়েল ৪২ টাকা থেকে ৮ টাকা বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা হয়। ডিজেল ও কেরোসিন ৪৬ টাকা থেকে ৫ টাকা করে বাড়িয়ে ৫১ টাকা, পেট্রল ৭৫ টাকা থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা ও অকটেন ৭৯ টাকা থেকে ৪ টাকা বাড়িয়ে ৮৪ টাকা করা হয়। আগের মতো এবারও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) উপেক্ষা করা হয়েছে। বিইআরসি আইন ২০০৩ অনুযায়ী, বিদ্যুত্ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো-কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বিইআরসির। সংশ্লিষ্ট সংস্থা এ বিষয়ে আবেদন করলে বিইআরসি নির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে—আইনে এ রকমই বিধান রাখা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কমিশন সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, আইন হওয়ার আগে মন্ত্রণালয় থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হতো। কিন্তু আইন হলেও সব প্রক্রিয়া এখনও আমরা সম্পন্ন করতে পারিনি। ফলে মন্ত্রণালয় এখনও কাজটি করছে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। তার ওপর দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সব পণ্যের দাম। এতে মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। গত গতকাল রাত থেকেই জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে।
রাজধানীর হাতিরপুল বাজারের ক্রেতা এজাজ আহমেদ জানান, সরকার আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে নিত্যপণ্যের বাজার আরও বেসামাল করে তুলল। এর প্রভাবে সব পণ্যের দাম আরও বেড়ে গেছে। আয়-রোজগারের সবটাই দিতে হবে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে।
রাজধানীর অন্যতম প্রধান পাইকারি ও খুচরা বাজার কারওয়ান বাজারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী জানান, ‘বাজারে এখন যেসব চাল রয়েছে তার দাম বৃদ্ধির কথা নয়। কারণ এগুলো আগেই চলে এসেছে বাজারে। তারপরও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে বাজারের সব ব্যবসায়ী কেজিতে এক থেকে দুই টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাবুবাজারের চাল ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, দূরত্ব অনুযায়ী চাল বহনকারী ট্রাকভাড়া তেলের দাম বাড়ার আগে ছিল ৯ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। গতকাল থেকে প্রতিটি রুটেই ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা।
এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরপরই খুচরা বাজারে সবজির দাম বেড়েছে। কারওয়ান বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা আনিসুর রহমান জানান, ‘পাইকারি বাজারে পণ্য কিনতে গিয়ে দেখি ব্যবসায়ীরা সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তেলের দাম বাড়ার কারণে নাকি সবজির দামও বেড়েছে।
শুধু চাল এবং সবজিই নয়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, প্রসাধনী পণ্য, বেকারি পণ্য, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে সব পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
জ্বালানি তেলে দাম বৃদ্ধি সম্পর্কে বিশিষ্ট আইনজীবী সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, সরকার কয়েকদিন পর পর জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে মানুষের দুর্ভোগ নানাভাবে বাড়িয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে সরকার জনগণের সঙ্গে তামাশায় মেতেছেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবেই কৃষি ও শিল্পখাতে উত্পাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে সব ধরনের পরিবহনের ভাড়া। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যে আরেক দফা বৃদ্ধি পাবে এ ব্যাপারে নতুন করে বলার কিছু নেই। শুধু তেলের দাম না বাড়িয়ে সরকারের উচিত অর্থনীতির আরও যেসব ক্ষেত্রে অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলো সংশোধন করা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি না পাওয়া সত্ত্বেও সরকার ভর্তুকি কমানোর দোহাই দিয়ে আরেক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো সরকারের একটি রুটিন কাজ। কিন্তু এ খাতে সরকারের চুরিচামারি যেহেতু কোনোদিন বন্ধ হবে না সেহেতু দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো যাবে না। তাই ভর্তুকি কমাতে হলে এ খাতের চুরিচামারি বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আইএমএফের পরামর্শ মোতাবেক সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও একধাপ বৃদ্ধি পাবে। নিম্ন এবং মধ্যআয়ের মানুষের অবস্থা এমনিতেই বেহাল। এখন তারা মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি বেড়েছে, তা নয়। ভর্তুকি বেড়েছে সরকারের ভুল নীতির কারণে। তেলভিত্তিক পাওয়ারপ্লান্ট প্রতিষ্ঠা করায় তেলের আমদানি বেড়েছে। সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তেলের আমদানি বৃদ্ধি পেল, তেলের পেছনে ভর্তুকি বৃদ্ধি পেল, সেটার খেসারত বাংলাদেশের জনগণ দিতে পারে না।’ এছাড়া দাম বাড়ানোর পেছনে তেল চোরাচালান রোধে ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার যুক্তি পুরোপুরি অযৌক্তিক বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে জনজীবনের ওপর বহুমাত্রিক বিরুপ প্রভাব ফেলবে। এর ফলে কৃষি এবং শিল্পখাতের উত্পাদন ব্যয় বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে পরিবহন ব্যয়। ফলে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে শুধু জ্বালানি তেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বাড়বে তা নয়—বাড়িভাড়াও বাড়বে। ফলে মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় আরও একধাপ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব। ফলে বর্তমান বিশ্বমন্দার পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি দেশকে একটি নাজুক অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দাম বাড়ার ফলে বিশেষ করে স্থির ও নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের ওপর একটা চাপ পড়বে। এর ফলে আমরা জানি যে ভোক্তা পর্যায়ে, উত্পাদক পর্যায়ে পরিবহনের ব্যয় এবং সেটা আবার আলটিমেটলি ভোক্তার ওপর পড়বে। সামগ্রিকভাবে এটা ভোক্তার জন্য একটা মূল্যস্ফীতি চাপও সৃষ্টি করবে।
পরিবহনসহ সামগ্রিকভাবে শিল্পকারখানার ওপর পড়বে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। দেশে বিশৃঙ্খলাও সৃষ্টি হতে পারে। আর বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে এর জন্য অর্থমন্ত্রীই দায়ী থাকবেন।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীবিদ এবং বাজার বিশ্লেষকরা গতকাল পৃথক প্রতিক্রিয়ায় দৈনিক আমার দেশকে বলেছেন, সরকার কয়েকদিন পর পর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে মানুষের দুর্ভোগ নানাভাবে বাড়িয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে সরকার জনগণের সঙ্গে তামাশায় মেতেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি না পাওয়া সত্ত্বেও সরকার ভর্তুকি কমানোর দোহাই দিয়ে আরেক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু ভর্তুকি বেড়েছে সরকারের ভুল নীতির কারণে। তেল ভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট প্রতিষ্ঠা করায় তেলের আমদানি বেড়েছে । সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত বাংলাদেশের জনগণ দিতে পারে না। তারা আরও বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে জনজীবনের ওপর বহুমাত্রিক বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এর ফলে কৃষি এবং শিল্পখাতে উত্পাদন ব্যয় বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে পরিবহন ব্যয়। ফলে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে শুধু জ্বালানি তেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বাড়বে তা নয়— বাড়িভাড়াও বাড়বে। ফলে মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় আরও একধাপ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব। ফলে বর্তমান বিশ্ব মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি তেলের এই মূল্য বৃদ্ধি দেশকে একটি নাজুক অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেবে।
হঠাত্ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর মাঝরাতে পাম্পগুলোতে তেল নিতে আসা গাড়ির চালকরা দারুণ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অন্যান্য পণ্যের ওপরও পড়বে। এর ফলে জনজীবনে অস্থিরতা তৈরি হবে। বৃহস্পতিবার সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিন ৫৬ টাকা, পেট্রল ৮৫ টাকা ও অকটেন ৮৯ টাকা হয়। এছাড়া ফার্নেস ওয়েলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে লিটারপ্রতি ৫৫ টাকা। এ নিয়ে গত ৬ মাসে তিন বাড়ার জ্বালানি তেলের দাঁড়ালো সরকার। আগামী মাসে আবারও বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুত্ এবং সিএনজির দাম। সরকারের জ্বালানি বিভাগ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক বৈঠকে অনেকটা চুপিসারেই আবারও সব ধরনের জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্ত নেয়। এ যাত্রায় মাত্র পৌনে দু’মাসের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের দাম আরও এক দফা বাড়ানো হলো। এর আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। তখন ফার্নেস ওয়েল ৪২ টাকা থেকে ৮ টাকা বাড়িয়ে ৫০ টাকা করা হয়। ডিজেল ও কেরোসিন ৪৬ টাকা থেকে ৫ টাকা করে বাড়িয়ে ৫১ টাকা, পেট্রল ৭৫ টাকা থেকে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা ও অকটেন ৭৯ টাকা থেকে ৪ টাকা বাড়িয়ে ৮৪ টাকা করা হয়। আগের মতো এবারও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) উপেক্ষা করা হয়েছে। বিইআরসি আইন ২০০৩ অনুযায়ী, বিদ্যুত্ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো-কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বিইআরসির। সংশ্লিষ্ট সংস্থা এ বিষয়ে আবেদন করলে বিইআরসি নির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে—আইনে এ রকমই বিধান রাখা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে কমিশন সদস্য ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, আইন হওয়ার আগে মন্ত্রণালয় থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হতো। কিন্তু আইন হলেও সব প্রক্রিয়া এখনও আমরা সম্পন্ন করতে পারিনি। ফলে মন্ত্রণালয় এখনও কাজটি করছে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। তার ওপর দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সব পণ্যের দাম। এতে মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। গত গতকাল রাত থেকেই জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে।
রাজধানীর হাতিরপুল বাজারের ক্রেতা এজাজ আহমেদ জানান, সরকার আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে নিত্যপণ্যের বাজার আরও বেসামাল করে তুলল। এর প্রভাবে সব পণ্যের দাম আরও বেড়ে গেছে। আয়-রোজগারের সবটাই দিতে হবে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে।
রাজধানীর অন্যতম প্রধান পাইকারি ও খুচরা বাজার কারওয়ান বাজারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী জানান, ‘বাজারে এখন যেসব চাল রয়েছে তার দাম বৃদ্ধির কথা নয়। কারণ এগুলো আগেই চলে এসেছে বাজারে। তারপরও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে বাজারের সব ব্যবসায়ী কেজিতে এক থেকে দুই টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাবুবাজারের চাল ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, দূরত্ব অনুযায়ী চাল বহনকারী ট্রাকভাড়া তেলের দাম বাড়ার আগে ছিল ৯ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। গতকাল থেকে প্রতিটি রুটেই ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা।
এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরপরই খুচরা বাজারে সবজির দাম বেড়েছে। কারওয়ান বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা আনিসুর রহমান জানান, ‘পাইকারি বাজারে পণ্য কিনতে গিয়ে দেখি ব্যবসায়ীরা সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তেলের দাম বাড়ার কারণে নাকি সবজির দামও বেড়েছে।
শুধু চাল এবং সবজিই নয়, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, প্রসাধনী পণ্য, বেকারি পণ্য, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে সব পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
জ্বালানি তেলে দাম বৃদ্ধি সম্পর্কে বিশিষ্ট আইনজীবী সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, সরকার কয়েকদিন পর পর জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে মানুষের দুর্ভোগ নানাভাবে বাড়িয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে সরকার জনগণের সঙ্গে তামাশায় মেতেছেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবেই কৃষি ও শিল্পখাতে উত্পাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে সব ধরনের পরিবহনের ভাড়া। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যে আরেক দফা বৃদ্ধি পাবে এ ব্যাপারে নতুন করে বলার কিছু নেই। শুধু তেলের দাম না বাড়িয়ে সরকারের উচিত অর্থনীতির আরও যেসব ক্ষেত্রে অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলো সংশোধন করা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি না পাওয়া সত্ত্বেও সরকার ভর্তুকি কমানোর দোহাই দিয়ে আরেক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো সরকারের একটি রুটিন কাজ। কিন্তু এ খাতে সরকারের চুরিচামারি যেহেতু কোনোদিন বন্ধ হবে না সেহেতু দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো যাবে না। তাই ভর্তুকি কমাতে হলে এ খাতের চুরিচামারি বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আইএমএফের পরামর্শ মোতাবেক সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও একধাপ বৃদ্ধি পাবে। নিম্ন এবং মধ্যআয়ের মানুষের অবস্থা এমনিতেই বেহাল। এখন তারা মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি বেড়েছে, তা নয়। ভর্তুকি বেড়েছে সরকারের ভুল নীতির কারণে। তেলভিত্তিক পাওয়ারপ্লান্ট প্রতিষ্ঠা করায় তেলের আমদানি বেড়েছে। সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তেলের আমদানি বৃদ্ধি পেল, তেলের পেছনে ভর্তুকি বৃদ্ধি পেল, সেটার খেসারত বাংলাদেশের জনগণ দিতে পারে না।’ এছাড়া দাম বাড়ানোর পেছনে তেল চোরাচালান রোধে ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার যুক্তি পুরোপুরি অযৌক্তিক বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে জনজীবনের ওপর বহুমাত্রিক বিরুপ প্রভাব ফেলবে। এর ফলে কৃষি এবং শিল্পখাতের উত্পাদন ব্যয় বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে পরিবহন ব্যয়। ফলে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বাড়বে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে শুধু জ্বালানি তেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের দাম বাড়বে তা নয়—বাড়িভাড়াও বাড়বে। ফলে মানুষের সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় আরও একধাপ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব। ফলে বর্তমান বিশ্বমন্দার পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি দেশকে একটি নাজুক অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দাম বাড়ার ফলে বিশেষ করে স্থির ও নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের ওপর একটা চাপ পড়বে। এর ফলে আমরা জানি যে ভোক্তা পর্যায়ে, উত্পাদক পর্যায়ে পরিবহনের ব্যয় এবং সেটা আবার আলটিমেটলি ভোক্তার ওপর পড়বে। সামগ্রিকভাবে এটা ভোক্তার জন্য একটা মূল্যস্ফীতি চাপও সৃষ্টি করবে।
No comments