গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার
তখন আধেক সকাল। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার টুটা-ফাটা হয়ে যাচ্ছে। গায়ে ফোস্কা পড়ার মত এক-আধটুকু আলো ফুটি-ফুটি করে ফুটেই বেরুচ্ছে। আর সাথে সাথে ঘুটঘুট্টিতে টোল পড়ে যাচ্ছে, অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে।
এ বেলাতেই তো মোরগ ডাকার সময়। তা মোরগ ডেকেই উঠল। বাজার-গঞ্জ। মহাজনি খাঁচা ছাড়া আর কোথাও মোরগ-মুরগি নেই। তাদেরও বাস অন্ধকারে- সেখানে কুপ্পি না জ্বালালে আলো চোখ মেলে না।
তাহলে মোরগটা এল কোন্ গেরস্থের বাড়ি থেকে? তা গেরস্থের ঘরের সেয়ানা মোরগ বাজার-গঞ্জে ছুটে আসে; বেশ্যাবাড়ির চারপাশে ঘুর-ঘুর করে। মোরগ ডাকে বিয়ান বেলায় আলো ফুটায়। বানুর ঘুম ভাঙ্গে তারও আগে। রাতভর বাঁধা মরদ চড়িয়েও ঘুমটা কেন জানি আজ ভাল হয় না।
ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন সে ঘরের পাশের পুস্করিনী থেকে গোছল সেরে নেয়। আজ ঘর-লাগোয়া টিউবওয়েলেই শরীর ভিজিয়ে নিল। জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের সেজদায় গেল। এমনি সময় ঘরের দেউড়িতে মোরগ-ডাক। প্রথমে একটা হয়েই চুপ। দুই মিনিট পর আরেকটা। শেষে পর-পর কয়েকবার।
ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন সে ঘরের পাশের পুস্করিনী থেকে গোছল সেরে নেয়। আজ ঘর-লাগোয়া টিউবওয়েলেই শরীর ভিজিয়ে নিল। জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের সেজদায় গেল। এমনি সময় ঘরের দেউড়িতে মোরগ-ডাক। প্রথমে একটা হয়েই চুপ। দুই মিনিট পর আরেকটা। শেষে পর-পর কয়েকবার।
বানুর বিছানায় মড়ার মত ঘুমোচ্ছিল কালু ব্যাপারি। বারবার কুক্কুর তার ডান হাতটাকে সজাগ করল। বিছানার যে পাশটায় বানু শুয়েছিল, সে তার হাত সেদিকে বাড়িয়ে দিল। কোন নরম স্পর্শ না পেয়ে হাতটা ধপাস পড়ে গেল খটখটে বিছানায়। ঘুমের খোয়ারি কেটে গেল। চোখ মেলে দেখল, পাশে বানু সেজদায়। সে উঠে বসে চোখ রগ্ড়াল। হাই তুলতে তুলতে নেমে এল বিছানা থেকে। দরজা খুলে এসে দাঁড়াল টানা বারান্দায়। কালু ব্যাপারীর সাড়া পেয়ে মোরগ তখন পগার পার।
কাল হাট-বার ছিল। কালু ব্যাপারীর ট্যাঁকে তাই কাঁচা টাকা। আজ সকাল সকাল দোকান খোলার তাড়া নেই। তাই সকালের খানিকটা বেলা বানুর বাড়িতে কাটিয়ে যেতে মানা নেই। বাড়িতে বউ জানে, তার ব্যাপারী সোয়ামী দিনভর রাতভর বিক্রি-বাট্টা সেরে দোকানেই কাত হয়েছে। তার খাটুয়া স্বামীর বরাতে সংসার ভর-ভরন্ত। আজ সারাদিন দোকানে কাটিয়ে সাঁঝবেলায় ঘরে ফিরবে বড়সড় মাছ নিয়ে। পরনের শাড়ি না হয় হাল-ফ্যাশনের থ্রী-পিছ নিয়ে।
তাই কালু ব্যাপারী নিশ্চিন্ত। বানু খুব ভাল মেয়ে। বাজারে অন্য মাগীদের মত ঘর-সংসার করার জন্য চাপ দেয় না। বুদ্ধিমতী। আবার সেয়ানাও। ভয়টা এখানেই। হাতছাড়া না হয়ে যায়। অন্য মানুষকে নিয়ে দরজায় খিল দিয়েছে শুনলে হিংসেও হয়।
বারান্দায় মোড়া পেতে বসে এসবই ভাবছিল সে। বাজারের একপাশে বানুর ঘর। ঘর থেকে খানিক দূরেই একটা খাল। খাল পেরিয়ে উত্তরে একক্রোশ এগুলেই গ্রাম। দিনের আলো ছলকাচ্ছে। একজন-দুজন লোকেরও আনাগোনা শুরু হয়েছে। ওরা সবাই কালু ব্যাপারীকে দেখছে বানুর ঘরের বারান্দায় তাকে বসে থাকতে। এ নিয়ে পরোয়া নেই। বরং এটাই যেন তার অহংকার। বাজারের সবচাইতে দামি মাগী তার কব্জায়।
খানিক আগে নাস্তা সেরেছে। বানুর পানদানি থেকে এক টুকরো পান নিয়ে মুখেও পুরেছে। গৃহস্থ বৌয়ের মত বানু এল হুঁকো সাজিয়ে। নিজেই টান দিল গুড়-ক গুড়-ক। তারপর হুঁকোটা এগিয়ে দিল ব্যাপারীর দিকে। বলল:ন্যাও, ধুইমে ছাড়ো, আর আমারে লয়্যা চিন্তে করো।
ব্যাপারী হাত বাড়িয়ে হুঁকো নিল। বলল: ভারী ঠ্যাকা পড়ছে আমার।
বানু রহস্যময় হাসিতে ভরিয়ে তুলল তার মুখ। বলল: ঠ্যাকা কার, সময়েই বুঝান যাইবো।
একটা জলচৌকি টেনে বসল কালু ব্যাপারীর পাশে।
এসময়ই তারা দেখতে পেল নয়াপাড়ার সোরাব মিয়াকে। বিশ-বাইশ বছরের ছোকরা। বাজার ফুঁড়ে বেরিয়েছে। সম্ভবত শহর থেকে ফিরছে। মুখে গুনগুন গান। ফূর্তি-ফূর্তি ভাব। কখনো অকারণ শিস্ দিয়ে উঠছে। হাঁটছে ধপধপ করে কখনো লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তার দু'পাশের গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ছে। বোধহয় বাড়িতে ফিরছে। তার মনের পুলক-ভাবটি বেশ বোঝা যাচ্ছে।
খালের পাশে এসে সে কিন্তু থমকে দাঁড়াল না। লাফিয়ে লাফিয়ে পার হল খাল। ছুটন্ত গতিতে এগিয়ে যেতে লাগল গাঁয়ের দিকে। বানু খুব মনোযোগ দিয়ে সোরাবের ফূর্তি-ফূর্তি
ছুটে চলা দেখছিল। কালু ব্যাপারী ভুরু কুঁচকে তাকে দেখল। বিরক্ত হয়ে বলল: নাক টিপলে দুধ বারোয়, ঐ পোলাডারে কি দেহোস। হেরেও টোপ বিইন্ধ্যা তর ঘরে তুইন্যা টুপ কইর্যা গিলবি নাহি?
বানু চোখ নাচিয়ে বলল: তুমার কুনো আপিত্তি আছে নাহি?
তয় পোলাডারে গিলনের কুনো নিয়ত নাই। হের চাল-চলন বলল দেইখ্যা একডা কতা ভাবতেছিলাম।
ব্যাপারী বলল: ঐ পোলার মইদ্দে আবার ভাবনের কি পাইলি?
বানু বলল: দেইখো, পোলাডার পহেটে ট্যাহা আছে।
তুই জানলি ক্যামনে? ক্যামনে ট্যাহার কতা কইলি?
বানু রহস্যময় হাসল। হাতের তুড়ি বাজিয়ে সগর্বে বলল:হুঁ-হুঁ। আমি কইতে পারি। কার কাছে কি থাহে না থাহে, আমার সব জানা।
কালু ব্যাপারী ধমকে বলল:চুপ যা মাগী। তোগো মাইয়া লোকের কতা-এই আমার বিশ্বাস যায় না।
উঠে দাঁড়াল বানু। বলল: ঠিক আছে। এক সুময় তোমারে দেহামু।
সে ঢুকে যায় ঘরের ভেতরে।
।। ২ ।।
বোঁচার মনে বেজায় ফূর্তি। তার পকেটে এখন কচকচে টাকা। হাতের মুঠোয় আর পকেটে টাকা থাকলে মনের ভেতরটাও ভর-ভরান্তি থাকে ফূতি-ফার্তি আর ঠাট-বাট দিয়ে। যেন সে বিশ্ব জয় করেছে, এখন গতিতেই লাফিয়ে লাফিয়ে খাল পার হল। ওসময়েই আড় চোখে দেখতে পেয়েছিল বাজারের শেষ কোণায় দহলিজে বেশ্যা মাগীটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে আর ঠারে-ঠুরে কি যেন বলছে। তার এখন সময় নেই। না হলে ওর ঘরেও খানিক সময় কাটিয়ে যেত। ঠারে-ঠুরের একটা সদ্গতিই করে যেত।
ক'দিন আগেও বোঁচার অবস্থা ছিল শোচনীয়। মন-ভরতি ছিল দুঃখ-বেদনার কচালি।
বোঁচারা তিন ভাই। সেই সবার ছোট। ছোট বলেই কিনা কে জানে, বাবা-মার মৃতু্যর পর সে জমি-জিরেতের তলানিটুকু পেয়েছে ঐদিয়ে তার দিন চলে না। ভাই-ভাবীদের ঘরে ঘরে দাওয়াত খেয়ে তার দিন কাটে।
তাই বলে ভাই-ভাবীদের দিয়ে তো আর পুরোটা জীবন কাটে না। ভাই আছে। ভাবী আছে। আছে গাঁওয়ালি দোস্তরা। তারপরও কেন জানি একা-একা মনে হয়। রাতটায় দেখা দেয় বেজায় ছট-ফটানি।
তাই দেখে ভাবীরা হাসাহাসি রঙ্গ-তামাসা করে। দোস্তরাও খোঁচা-খাচি দেয়। কিন্তু একলা একলা ভাবটা যেন কাটতেই চায় না।
বোঁচা একদিন শরমের মাথা খেয়ে ভাবীদের কাছে হাজির হয়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
বড় ভাবী বলে: দেবর সাব, মনে হয় কিছু সাধ জাগছে। কয়া ফেলাও, তুমার কি চাই।
ছোট ভাবীর মুখে ফস্কা গেঁরো। কোন কথাই আটকায় না। দেবরের দশা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে বলে: আমাগের ছোডো দেওরের নাকের প্যাটা বুধয় এহন উপর বাদ দিয়া নিচ দিয়া গড়াইতেছে। হেইডা মুছনের কাম তো আমরা পারুম না।
বোঁচা শরমের মাথা খেয়ে অগত্যা বলেই ফেলল তার মনের খায়েশ: হ, হেইডাই তো কইতে আইছি। আমারে বিয়া করাইবা না?
ভাবীরা অবাক আট্টাশ মারার ভান করে। বড় ভাবী গালে হাত দিয়ে বলে: ওমা ছোডো নাগরের এইডা কী কতা!
আমাগোরে দিয়া বুঝি চলতাছে না!
তারপর দুই ভাবীতে মিলে সেই খিলখিল হাসি।
বোঁচা লাজুক-লাজুক জেদ নিয়ে বলল: ঠাট্টা না, আমার বিয়া লাগবোই!
ছোট ভাবী বোঁচার পেটে খোঁচা দিয়ে বলে: তর বুঝি সইতাছে না!
বোঁচা গোস্বা দেখিয়ে বলল:কইলাম ঠাট্টা না। তোমরা ব্যবস্তা দ্যাহো।
বড় ভাবী দেবরকে ঠান্ডা করতে বলে: আচ্ছা, তুমার ভাইরে কমুনে।
দুপুরে খাওয়ার পিড়ায় প্রসঙ্গটা তুলতেই দুই ভাই-ই খেঁচ করে ওঠে: বিয়া করামু। অর নাই চাল-চুলা। অর ট্যাহা-পয়সা কই। বউরে খাওয়াবো কি? ট্যাহা রুজি কইরা আনতে ক ও, তারপর দ্যাহা যাইবোনি।
দেবরকা সে-কথাই জানান ভাবীরা। বলল:আগে তুমি ট্যাহা আনো। তারপর তুমারে বিয়া করামু।
টাকার কথা শুনেই বোঁচা ভড়কে যায়। মাথা-চুলকে জিজ্ঞেস করে:কতো ট্যাহা লাগবো ভাবী?
ছোট ভাবী বলল: পাঁচ হাজার ট্যাহা। হ, পাঁচ হাজার ট্যাহা আনলেই চলবো
বোঁচা বুকে সাহস ফিরিয়ে আনে। আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বলে: আচ্ছা, কাইলকাই আমি বাইত থাইক্যা বাইরামু। দেহি, ট্যাহা আনবার পারি কি না।
সেই পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বোঁচা এখন বাড়িতে ফিরছে।
ফূর্তিটা এজন্যেই। মনের ভেতর গুণ-গুণাচ্ছে অনেক স্বপ্ন। আঙ্গিনা জুড়ে হেঁটে ছুটে লাফালাফি করে এক্কাদোক্কা খেলে সূর্যের রশ্মি চাঁদের আলো ফিরি করে বেড়াচ্ছে একটা টুকটুকি মেয়ে। মেয়েটার মুখ দেখা যায় কি যায় না। কিন্তু খুব মিষ্টি মুখ এটা অনুভব করা যায়। শহরে এসে বোঁচা প্রথমে বেদিশা হয়ে গিয়েছিল। এরপরই দেখা তাদের গাঁয়ের এক লোকের সাথে। সে তখন শহরের বড় মহাজন হয়ে উঠেছে। ধান-চালের বিশাল আড়ত। সেখানেই তার আশ্রয় ও চাকরি। বছর খানেকের মধ্যেই সে হাজার পাঁচেক টাকা খেয়ে-না-খেয়ে জমিয়ে ফেলে। মনে মনে বলে: ফাইকগা, মামার কাছে এসে বিয়ার ট্যাহা হয়্যা গ্যাছে।
খুব খুশি মনে এখন সে বাড়ি ফিরছে।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার মনে হল, এতগুলো টাকা নিয়ে সে যদি বাড়িতে ফেরে। টাকা রাখার জন্য ভাই-ভাবীকে দিতে হবে। আর তার ভাইরা যেমন, নগদ টাকা পেয়ে এই টাকা লাগবে ঘর-গেরস্থালির কাজে। তার বিয়ে করাটা আবার যাবে পিছিয়ে। তাই সে ঠিক করল।, এ টাকাটা সে জিম্মা রেখে যাবে গাঁয়ের মাতবরের কাছে।
মাতবরের বাড়ির সামনে এসেই তার এই বোধটি হল। যা ভাবা, সাথে সাথেই কাজ। মাতবরের বাড়ির বার-আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে সে হেঁকে ডাক দিল: মাতবর সাব, বাইত আছেন নাহি?
বাড়ির ভেতর থেকে মাতবর সাড়া দিল: কেডায়?
বোঁচা জাবাব দিল:আমি বোঁচা।
মাতবর বলল: কিয়ের লাইগা আইছো? কি দরকার? বোঁচা বলল: একডু কাম আছে। বাইরে আইবেন নাহি?
মাতবর বলল: খাড়াও। আইতাছি।
একটু পরেই মাতবর বেরিয়ে এলে বোঁচা বিনয়ের সাথে বলল: চাচা, আপনের কাছে একডা জরুরী প্রয়োজনে আইছি। আপনে বেয়াদবি নিয়েন না।
মাতবর বিরক্ত হয়ে বলল: কইয়া ফেলাও। তা আগেই কয়া রাহি, ট্যাহা-পয়সা কিছুই হাওলাত দিবার পারমুনা। দিতে দিতে ফতুর হয়্যা গেছি। ঘরে এহন ধাইন-চাইলও নাই। হেইডাও দিবার পারমুনা।
বোঁচা জিভ কেটে বলল: আপনেরে ঐ গুলা লইয়্যা জ্বালামু না।
মাতবর বলল: তাইলে কিসের সমস্যা? ভায়েগরে নামে নালিশ করতে আইছো?
বোঁচা বলল: তাও না। ভাইরা আমার ভালো মানুষ।
মাতবর বিরক্ত হয়ে বলল: তাইলে এই অসময়ে আমার কাছে আইছো কিয়ের লাইগ্যা?
বোঁচা আমতা আমতা করে বলল: চাচা, আমি শহর থাইক্যা ফিরতাছি। কাকাই রুজি কিছু করছি। হাতে আছে এহন পাঁচ হাজার ট্যাহা। এই ট্যাহা আপনার কাছে রাইখ্যা যাইবার চাই। কাইল, পরশু আবার নিয়া যামু।
টাকার গন্ধে চোখ দু'টো চকচকে হয়ে উঠল মাতবরের। কিন্তু মুখটা পঁ্যাচার মত করে বলল: না না। আমি ট্যাহা-পয়সা রাখবার পরমু না। এই এক জ্বালাতন। কত মানুষ কত ট্যাহা, পয়সা আমার কাছে রাইখ্যা যায়। আমি কই, এইসব ট্যাহা আমি রাখবার পরমু না। কিন্তু কেউ শোনে না। জুর-জারি কইর্যা খালি রাইখ্যা যায়। মাতবর কোমরের চাবির পোহা দেখিয়ে বলে: এই দেহো বাপু, আমার কোমরে কত সিন্দুকের চাবি। খালি খালি ঝামেলা। বোঁচা মাতবরের হাত জড়িয়ে ধরে। বলে: আমার ট্যাহা আপনার রাখতেই হইবো।
মাতবর নিরাসক্ত ভঙ্গি নিয়ে বলে: ট্যাহা যহন লয়্যা আইছো, এহন তুমারে যদি ফিরায়্যা দেই। তুমিও মনে পাইবা দুখখু। আনছো যহন, থুইয়া যাও।
বোঁচা মাতবরের হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে বাড়িতে আসে।
বছর খানেক বাদে বোঁচাকে বাড়িতে পেয়ে ভায়েরা খুশি। ভাবীরাও খুশি। তার চাইতেও বেশি খুশি ভাস্তে ভাস্তিরা।
বোঁচা অবসর মত বড় ভাবীকে চুপি-চুপি জানায়: ভাবী, বিয়ার ট্যাহা লয়্যা আইছি।
বড় ভাবী মুখ টিপে হেসে বলে: বিয়া তাইনে করবাই
বোঁচা আনন্দে গদগদ হয়ে বলে: বিয়ার লাইগাই তো টাউন বাড়িতে গিয়ে এত কষ্ট করছি। ট্যাহা কামাইছি।
বড় ভাবী বলে: ভাল। কাইলকাই তুমার বিয়া ঠিক করুম। ট্যাহা তুমার বড় ভাইয়ের কাছে রাইখ্যা দ্যাও। বোঁচা বলে: আইজক্যা দিতে পরমু না। কাইলকা আইন্যা দিমুনে।
রাতে ভাল ঘুম হয় না বোঁচার। বিয়ের কল্পনা করতে করতে আর স্বপ্ন দেখতে দেখতেই সকালের পাখি ডেকে ওঠে।
ঘুম থেকে উঠেই বোঁচা হাত-মুখ ধুয়ে কোনরকমে নাস্তা খেয়ে চুট লাগায় মাতবরের বাড়ির দিকে। যেন টাকাটা এহন দিলেই নগদ-নগদ বিয়ে নতুন বউ তার বাড়ির দহনিকে খাড়া রয়েছে।
বোঁচা মাতবরের বাড়ির বার-আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে হেঁকে ওঠে: মাতবর চাচা, বাইত আছেন নাহি?
মাতবর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। বোঁচার দিকে তাকায় ভুরুকুচকে। বলে: কোন্ শালারে, চিলস্নায়ে চিন্নায়ে আমারে ডাহাডাহি করে?
বোঁচা বলে: চাচা, আমি।
মাতবর জিজ্ঞেস করে: তুমি কে?
বোঁচা বলল: আমারে চিনলেন না চাচা, আমি বুঁচা। আমি কাইলকা আপনার কাছে যে পাঁচ হাজার ট্যাহা থুয়ে গেছিলাম, হেই ট্যাহাডার লাইগ্যা আইছি।
মাতবর গর্জে উঠল: কি! হারামজাদা, তুই আমার কাছে ট্যাহা থুইয়া গ্যাছোস? গপেস্না মারার আর জায়গা পাস না। টাউটারি করতে আইছোস আমার সাথে!
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় বোঁচা। মাতববের চার-পাঁচজন পালোয়ান ছাইজের কামলা এসে দাঁড়ায় বোঁচার পেছনে। তাদেরকে দেখে বোঁচা আর কথা বলার সাহস পায় না। তার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। অধোবদলে সে ফিলে চলে।
।। ৩ ।।
সেদিনও বানু তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথার ভেজা চুল ঝাড়ছিল। তার পাশেই কোসায় বসেছিল কানু ব্যাপারী। যথারীতি হুঁকো টানছিল। বানুর নজর রাস্তার দিকে। সেই রাস্তা ধরে শহরের দিকে যাচ্ছে বোঁচা। মুখটা মাটির দিকে নামানো। হাঁটছে ধীর লয়ে। অপরিসীম দুঃখে যেন সে ভেঙ্গে পড়েছে। যানটা পেরুল হেঁটে হেঁটে। ভিজে গেল তার পরণের লুঙ্গি। সেদিকে খেয়াল নেই কোন। গভীর কোন চিন্তায় সে মগ্ন।
বানু কানু ব্যাপারীকে বলল: ঐ দ্যাহো, আইজো পোলাডা যায়। বুধয় শহর থনে আইছিল। এহন শহরে ফিরতাছে।
কানু ব্যাপারী বিরক্ত হয়ে বলল: কত মানুষই তো রাস্তা দিয়া যায় আর আহে। দেহনের কি হইলো?
বানু বলল: অনেক কিছু দেহনের আছে। আমি ঐ দিনকা কইছিলাম, এই পোলাডার কাছে কিছু ট্যাহা আছে। আইজকা ঐ ট্যাহাডা অর নষ্ট হয়্যা গ্যাছে।
কানু ব্যাপারী জিজ্ঞেস করল: তুমি বুঝনা ক্যামনে?
বানু রহস্যময় হাসিতে বলল: আমি সব বুঝি। বুঝি এমনে এমনে। তুমার যদি বিশ্বাস না যায়, পোলাডারে ডাক দ্যাও। হেরে জিগাও।
কানু ব্যাপারীর এমন কৌতূহল হল। ঘরের পাশের রাস্তা দিয়ে বোঁচা এগুতে ধরলেই সে হেঁকে উঠল: ঐ মিয়া, তুমারে ডাহে। এই দিক আহো।
বোঁচা যন্ত্রচালিতের মত বানুদের সামনে এসে দাঁড়ান। তাকে বানু জিজ্ঞেস করল: আচ্চা, তুমি হাছা কতা কওদেছি, তুমি যে কাইল এই রাস্তা দিয়ে গেছিলা, তহন তুমার কাছে ট্যাহা আছিল কিনা।
বোঁচা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল: হ. আছিল।
বানু বলল: আইজকা পাইলে ট্যাহাটা নষ্ট হয়্যা গ্যাছে? বোঁচা বলল। হ। আপনে জানলেন ক্যামনে?
বানু বলল: আমি কইলাম তুমার কাইল আর আইজের হাঁটাচলার গতি দেইখ্যা। কাইল তুমার হাঁটার মইদ্ধে গরম আছিল। আইজ তুমি খান দিয়া কাপড় ভিজায়া নাইম্যা আইলা, হুঁশই নাই। এই জনে মনে হইলো, আইজ তুমার কাছে ট্যাহা নাই, ট্যাহার গরমও নাই। ঘটনাডা কি, খুইল্যা কও দেহি।
বোঁচা বানুর ঘরের বারান্দার উপর ধপাস করে বসে পড়ল। আদ্যোপান্ত খুলে বলল তার টাকা উপার্জন ও হারানোর কাহিনী।
সব শুনে বানু বলল: আমি যদি তুমার ট্যাহা উডায়ে দিতে পারি, আমারে কি দিবা?
বোঁচা বলল: আপনারে অর্ধেক ট্যাহা দিমু।
বানু বলল: দূর বোকা! আমারে অর্ধেক ট্যাহা দিবে, তুমি বিয়া করবা কি দিয়া?
বোঁচা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল: তাইলে কয় ট্যাহা দিমু আপনারে?
বানু বলল: তুমার পাঁচ হাজার ট্যাহা। তুমি আমারে শতকে দশ ট্যাহা দিবা। আর কিছু ট্যাহা আয়োজনে খরচ করবা। পারবা?
বোঁচা বলল: কয়ডা ট্যাহা এহনো আমার কাছে আছে। হ. পারমু।
বানু বলল: তাইলে পাঁচজনের লাইগ্যা পাঁচটা ইস্পিশাল টুপি বানাও। আমার লাইগ্যা একডা পাল্কি ঠিক কর। একদল বাইদ্যো-বাজনা নিবা।
বোঁচা সব আয়োজন সম্পন্ন করে। বানু পাঁচজন লোককে ভাল মত সাজিয়ে সবার মাথায় একটা করে টুপি পরিয়ে দেয়।
বানুও নিজে কাওয়ালিনী সেজে গয়না-গাটি, চুড়ি-বালা, টিকলি পরে পালকিতে গিয়ে বসে। এরপর পাঁচজনকে বলে: তুমরা রাস্তা দিয়্যা যাইবা আর কইবা, হায় হায়রে! এমুন সোন্দর এই কইন্যা, ঈমানদার ছাড়া হে বিয়া বইবো না। এই কথা কইতে কইতে মাতববের বাড়ির দরজায় গিয়া পালকি নামাবি। মাতবর যদি পালকির কাছে আছে, তহন তরা জোর গলায় কবি, এই দেশে ঈমানদার নাই। এই মাইয়া ঈমানদার ছাড়া বিয়া বইবো না। তারপর যদি মাতবর এই পোলাডার ট্যাহা দিয়া দ্যায় তাইলে আমি পালকি থন লাইম্যা ড্যান্স দিতে থাকমু।
বানুর নির্দেশ মত পালকি রওনা দেয়। লোকগুলো পুরো রাস্তায় বলতে বলতে যায়; এমুন সোন্দর মাইয়া ঈমানদার ছাড়া বিয়া বইবো না।
যথারীতি মাতবরের বাড়ির দরজায় গিয়ে পালকি নামে। বানু পালকির দরজা খুলে তার রূপের ঝিলিক দেখায়। আর লোকগুলো জোরে জোরে বলতে থাকে; হায় হায়! এই দেশে ঈমানদার নাই। এই মাইয়া ঈমানদার ছাড়া বিয়া বইবো না।
বার-আঙ্গিনায় এধরনের কোলাহলের আওয়াজ পেয়ে মাতবর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে: কি হইছে? লোকগুলো জবাব দেয়; এই মাইয়ারে বিয়া দিতে আনছি। হে আবার ঈমানদার ছাড়া আর কাউরে বিয়া করবো না।
মাতবর পালকির ভেতর সুন্দরী বানুকে দেখে। সাথে বোঁচাকেও। সে আর অপেক্ষা করে না। এক দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়। সাথে সাথে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ফেরে। এসে জড়িয়ে ধরে বোঁচার হাত। পাঁচ হাজার টাকা গুজে দিয়ে বলে: এই নে বাবা, তর ট্যাহা। তর হে ট্যাহার জন্য আমার ঘুম আহে না। এমন ভেজাল মাইনষে রাহে?
টাকা দেয়ার সাথে সাথে বানু পালকি থেকে নেমে বাওয়ালি ড্যান্স দিতে থাকে। বোঁচাও নাচতে থাকে। দেখাদেখি মাতবরও নাচতে থাকে। বাজতে থাকে বাদ্য-বাজনা।
লোকজনের ভীড় জমে যায়। তারা বলাবলি করতে থাকে: এই সুন্দরী মেয়েটা নিচে ক্যান্?
বানু বলে: শতকে পাইয়া দশ।
: বোঁচা নাচে ক্যান?
: ট্যাহার পাইয়া কচকচ।
: মাতবর চাচা নাচে ক্যান?
: এই নাচে হুদা যা ফসাফচ।
বলতে বলতে বানু পালকিতে গিয়ে ওঠে। মুহূর্তে তার লোকজন পালকি উঠিয়ে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যায়। লোকজন ঘিরে ধরে নৃত্যরত মাতবরকে।
(শ্রীনগর. ঢাকার উপকথা অবলম্বনে)
==========================
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ আতা সরকার
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি) গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন গল্প- 'সুচ' by জাফর তালুকদার গল্প- 'বাসস্ট্যান্ডে যে দাঁড়িয়েছিল' by ঝর্না রহমান গল্প- 'গন্না' by তিলোত্তমা মজুমদার গল্প- 'ঘুড়িয়াল' by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় গল্প- 'প্রক্ষেপণ' by মোহিত কামাল গল্প- 'গন্তব্য বদল' by রফিকুর রশীদ গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী গল্প- 'হার্মাদ ও চাঁদ' by কিন্নর রায় গল্প- 'মাটির গন্ধ' by স্বপ্নময় চক্রবর্তী সাহিত্যালোচনা- 'কবি ওলগা ফিওদোরোভনা বার্গলজ' গল্পিতিহাস- 'বালিয়াটি জমিদারবাড়ির রূপগল্প' by আসাদুজ্জামান ফিচার- ‘কাপ্তাই লেক:ক্রমেই পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে' by আজিজুর রহমান
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ আতা সরকার
এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
No comments