আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ‘কাজ’ কী by মশিউল আলম
আগামী সংসদ নির্বাচন এখনো অনেক দূরে। সরকারের দ্বিতীয় বছরই এখনো পেরোয়নি। তিন বছরেরও বেশি সময় হাতে আছে। এত আগে সাধারণত নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে শোনা যায় না। বিশেষত যাঁরা সরকারে থাকেন, তাঁরা নির্বাচন নিয়ে ভাবতে ও কথা বলতে শুরু করেন তৃতীয় বা চতুর্থ বছরে গিয়ে। দিন যতই গড়াতে থাকে, ততই নির্বাচন নিয়ে তাঁদের শঙ্কা-উদ্বেগ বাড়ে। বিগত সরকারের শেষ বছরে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর দলীয় জনসভাগুলোতে বক্তব্যে এমন সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে শোনা যেত, ‘আগামী নির্বাচনে জিততেই হবে, হেরে গেলে আমাদের পিঠের চামড়া থাকবে না।’
বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সরকারের দুই বছর না পেরোতেই নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক করার প্রয়াস পেলেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের প্রচার-প্রকাশনা ও তথ্য-গবেষণা সম্পাদকদের এক কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানের বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডের ওপর আগামী নির্বাচনে দলের ভাগ্য নির্ভর করবে। আমাদের কার্যক্রমের কারণে যদি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় আসে, তাহলে আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।’ তিনি তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে দিয়ে আরও বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ দুর্নীতিকে ঘৃণা করে এবং আইনের শাসনে বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগের নামে কেউ দুর্নীতিতে যুক্ত হলে এবং আইন ভাঙলে মানুষের বিশ্বাসে আঘাত আসে। তাই কারও সামান্য স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করা যাবে না। আওয়ামী লীগের আদর্শের সঙ্গে দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস জড়িত। আওয়ামী লীগের ওপর মানুষ আস্থা হারালে বা আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলে যাঁরা পাকিস্তানের ভাবধারার জঙ্গিবাদী, অকার্যকর ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানাতে চান, সে ধরনের দেশ প্রতিষ্ঠা হবে। দেশের ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করে। আওয়ামী লীগ এই দায়িত্ব নিতে চায়। দলের নেতা-কর্মীদেরও সেভাবেই তৈরি হতে হবে।’
দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে যে বক্তব্যে সৈয়দ আশরাফ এতগুলো সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, সেখানেই তিনি বলেছেন, ‘আমরা সঠিক পথেই যাচ্ছি। সে পথ থেকে বিচ্যুত না হতে এলাকায় গিয়ে নেতা-কর্মীদের বোঝাতে হবে।’ তাঁর এই কথাগুলো সমস্ত সতর্কবাণীকে অর্থহীন করে দিতে পারে। মানুষ যখন বিশ্বাস করে যে সে সঠিক পথেই চলছে, তখন ওই পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা তার মনে জাগে না; বারবার স্মরণ করিয়ে দিলেও সে তা আমলে নেয় না। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, ভিজিএফ কার্ড বিতরণে অনিয়ম, কাবিখা-কাবিটার গম-চাল নিয়ে নয়-ছয় এবং ‘ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ’ করার লড়াইয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি—এসব যদি ‘সঠিক পথ’ চলা হয়, তাহলে এই পথ আওয়ামী লীগকে কোথায় নিয়ে যাবে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য যেদিন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, সেদিন পত্রপত্রিকার খবরগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরালেই আমরা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের কিছু ‘কাজ’-এর নমুনা পেতে পারি। ১. পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় খুন হয়েছেন ৮২ নম্বর ওয়ার্ডের সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দীন ইসলাম ওরফে দিলা; এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে একই সংগঠনের সভাপতি শরিফউদ্দিনকে। ২. গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সরাফত হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তার কার্যালয় ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছেন, লাঞ্ছিত করেছেন যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সায়াদ উদ্দিনকে। এই হামলার কারণ: প্রতি পরিবারে একজনকে চাকরি দেওয়াবিষয়ক সরকারি প্রকল্প ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’-এর প্রশিক্ষণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার পছন্দের লোকেরা সুযোগ পাননি। ৩. সিলেটের বিয়ানীবাজারে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, গোলাগুলিতে ছাত্রলীগের চার কর্মী, এক ব্যবসায়ী ও এক পথচারী আহত। ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা এক ফটোসাংবাদিককে প্রহার করে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেন। ৪. তার আগের দিনের সংবাদপত্রের খবর, চট্টগ্রামে যোগাযোগমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিংয়ের পর রেলওয়ে শ্রমিকলীগের নেতা-কর্মীরা সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেছেন।
সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের জবরদস্তিমূলক আচরণ এখন এক সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। চাকরির জন্য ভর্তি পরীক্ষায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের হাঙ্গামা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলা করা, যার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে পাবনার ঘটনা স্মরণ করা যায়, এবং নিজেদের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনি—এগুলো যে সঠিক পথ নয়, তা সবাই বোঝেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের ‘কাজ’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন আমরা জানি না, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এগুলোই হচ্ছে তাঁদের কাজ; এবং সত্যিই এসব কাজের প্রভাব খুব ভালোভাবেই পড়বে আগামী নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ আইনের শাসনে বিশ্বাসী—সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই দাবি যদি সত্য হতো, তাহলে সরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তাদের ওপর দলটি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের জবরদস্তিমূলক আচরণ দেখা যেত না। আমার দলের লোকেরাই চাকরি পাবে, টেন্ডার পাবে, ব্যবসা পাবে, ভালো পদ পাবে—আওয়ামী লীগ মনে মনে এই অবস্থান স্থির করে নিয়েছে বলে সন্দেহ হয়। এবং এই সন্দেহ যদি অমূলক না হয়, তবে তো আইনের শাসনের কথা অবান্তর হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কত হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেসবের মধ্যে কতগুলো আসলেই হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা, আর কতগুলো গুরুতর অপরাধের অভিযোগের মামলা—তা বিচার করা হয়েছে কি না সন্দেহ। এবং এই মামলা প্রত্যাহারের সুবিধাটি পেয়েছেন শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই, বিরোধী দলের কেউই এ সুযোগ পাননি। বরং বিরোধী দলের অভিযোগ, তাঁদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
আইনের শাসনের কথা মুখে বললেই মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের আস্থা আপনা-আপনিই অর্জিত হয়। কিন্তু বাস্তবে উল্টো হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ধারণা হয়ে গেছে এ রকম যে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ ঘটানো হয় না। ক্ষমতাসীনরা নিজেরাও হয়তো ভাবেন, আইন তাঁদের জন্য নয়, তাঁরা আইনের ঊর্ধ্বে। সরকার ও সরকারি দলের দায়িত্ব ও এখতিয়ারের মধ্যকার পার্থক্যও তাঁরা মানতে চান না। সরকারের প্রশাসন আইনানুগভাবে খাল উদ্ধার করতে গেছে, সরকারি দলের সাংসদ এসে ম্যাজিস্ট্রেটদের ভাগিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, কাউকে উচ্ছেদ করতে হলে আমিই করব। আইনপ্রণেতা সরকারের কাজ করবেন, সরকারি দলের নেতা জেলা প্রশাসককে ধমকাবেন—এভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, সরকারি প্রশাসনের যেটুকু কর্মদক্ষতা ও মনোবল এখনো আছে, তাও আর বেশি দিন থাকবে না।
‘আওয়ামী লীগের আদর্শের সঙ্গে দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস জড়িত।’ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই বক্তব্য জনগোষ্ঠীর অন্তত অর্ধেকের জন্য সত্য। ‘দেশের ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করে।’ তাঁর এই বক্তব্যও একই রকম সত্য। এবং তিনি যে বললেন, আওয়ামী লীগ দেশের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিতে চায়—এই ঘোষণাও একটি দৃঢ় রাজনৈতিক ঘোষণা। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? আওয়ামী লীগ আসলে নিজেকে কীভাবে দেখে? কীভাবে নিরূপণ করে নেতা-কর্মীদের? তাঁদের ‘কাজ’ আসলে কী? এবং তাঁদের অধিকাংশই এখন যেসব ‘কাজ’ করছেন, তা কেন করছেন? কেন নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি হচ্ছে? কেন তাঁরা সরকারি কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করছেন? কেন সরকারি দপ্তরে, পরীক্ষাকেন্দ্রে, টেন্ডারবাক্সে হামলা করছেন? সোজা উত্তর: ব্যক্তিগত বৈষয়িক স্বার্থে। একই সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পরস্পরকে খুন করতে উদ্যত হচ্ছেন, খুন করে ফেলছেন! সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থবোধ কতটা উদগ্র হয়ে উঠলে এমনটি ঘটতে পারে?
দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাদের পেছনে থেকে সাত বছর ধরে ‘দলের কাজ’ করেছেন যেসব তরুণ-যুবক, দল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাঁদের মনে অনেক অধিকারবোধ তৈরি হয়েছে। সাত বছর রুটি-রুজির সংকটে ছিলেন তাঁরা, এখন দল ক্ষমতায়, এখনো কি সেভাবেই চলতে হবে? নিজের নেতা এখন সাংসদ, বা সাংসদ না হলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতা। নেতার নিজের, তাঁর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের ভাগ্যোন্নয়ন হচ্ছে, ঘরবাড়ির চেহারা বদলে যাচ্ছে, সয়সম্পত্তি বাড়ছে। তাহলে কর্মীদের কেন রুটি-রুজির সংকট চলতেই থাকবে? কিছু টাকা-পয়সা কেন আসবে না তাদেরও ঘরে?
কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? সরকার তো তাদের সবার জন্য বৈধ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না। দেশে যত চাকরিপ্রার্থী শিক্ষিত বেকার; তত চাকরি তো নেই। সে জন্যই বলা হচ্ছে: দলের লোক ছাড়া কেউ চাকরি পাবে না। কিন্তু এভাবে আর কয়জনের কর্মসংস্থান করা সম্ভব? তাহলে উপায় কী? আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা উপায় বের করে নিয়েছেন: দেশজুড়ে নানা ‘অর্থকরী কর্মকাণ্ডে’ লিপ্ত হয়েছেন। এসবই তাঁদের ‘কাজ’। এই দল কী করে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেবে?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সরকারের দুই বছর না পেরোতেই নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক করার প্রয়াস পেলেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের প্রচার-প্রকাশনা ও তথ্য-গবেষণা সম্পাদকদের এক কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানের বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডের ওপর আগামী নির্বাচনে দলের ভাগ্য নির্ভর করবে। আমাদের কার্যক্রমের কারণে যদি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় আসে, তাহলে আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।’ তিনি তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে দিয়ে আরও বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ দুর্নীতিকে ঘৃণা করে এবং আইনের শাসনে বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগের নামে কেউ দুর্নীতিতে যুক্ত হলে এবং আইন ভাঙলে মানুষের বিশ্বাসে আঘাত আসে। তাই কারও সামান্য স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করা যাবে না। আওয়ামী লীগের আদর্শের সঙ্গে দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস জড়িত। আওয়ামী লীগের ওপর মানুষ আস্থা হারালে বা আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলে যাঁরা পাকিস্তানের ভাবধারার জঙ্গিবাদী, অকার্যকর ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানাতে চান, সে ধরনের দেশ প্রতিষ্ঠা হবে। দেশের ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করে। আওয়ামী লীগ এই দায়িত্ব নিতে চায়। দলের নেতা-কর্মীদেরও সেভাবেই তৈরি হতে হবে।’
দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে যে বক্তব্যে সৈয়দ আশরাফ এতগুলো সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, সেখানেই তিনি বলেছেন, ‘আমরা সঠিক পথেই যাচ্ছি। সে পথ থেকে বিচ্যুত না হতে এলাকায় গিয়ে নেতা-কর্মীদের বোঝাতে হবে।’ তাঁর এই কথাগুলো সমস্ত সতর্কবাণীকে অর্থহীন করে দিতে পারে। মানুষ যখন বিশ্বাস করে যে সে সঠিক পথেই চলছে, তখন ওই পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা তার মনে জাগে না; বারবার স্মরণ করিয়ে দিলেও সে তা আমলে নেয় না। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, ভিজিএফ কার্ড বিতরণে অনিয়ম, কাবিখা-কাবিটার গম-চাল নিয়ে নয়-ছয় এবং ‘ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ’ করার লড়াইয়ে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি—এসব যদি ‘সঠিক পথ’ চলা হয়, তাহলে এই পথ আওয়ামী লীগকে কোথায় নিয়ে যাবে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য যেদিন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, সেদিন পত্রপত্রিকার খবরগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরালেই আমরা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের কিছু ‘কাজ’-এর নমুনা পেতে পারি। ১. পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় খুন হয়েছেন ৮২ নম্বর ওয়ার্ডের সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দীন ইসলাম ওরফে দিলা; এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে একই সংগঠনের সভাপতি শরিফউদ্দিনকে। ২. গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সরাফত হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তার কার্যালয় ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছেন, লাঞ্ছিত করেছেন যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সায়াদ উদ্দিনকে। এই হামলার কারণ: প্রতি পরিবারে একজনকে চাকরি দেওয়াবিষয়ক সরকারি প্রকল্প ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’-এর প্রশিক্ষণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার পছন্দের লোকেরা সুযোগ পাননি। ৩. সিলেটের বিয়ানীবাজারে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, গোলাগুলিতে ছাত্রলীগের চার কর্মী, এক ব্যবসায়ী ও এক পথচারী আহত। ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা এক ফটোসাংবাদিককে প্রহার করে ক্যামেরা ছিনিয়ে নেন। ৪. তার আগের দিনের সংবাদপত্রের খবর, চট্টগ্রামে যোগাযোগমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিংয়ের পর রেলওয়ে শ্রমিকলীগের নেতা-কর্মীরা সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেছেন।
সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের জবরদস্তিমূলক আচরণ এখন এক সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। চাকরির জন্য ভর্তি পরীক্ষায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের হাঙ্গামা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলা করা, যার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে পাবনার ঘটনা স্মরণ করা যায়, এবং নিজেদের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনি—এগুলো যে সঠিক পথ নয়, তা সবাই বোঝেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের ‘কাজ’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন আমরা জানি না, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এগুলোই হচ্ছে তাঁদের কাজ; এবং সত্যিই এসব কাজের প্রভাব খুব ভালোভাবেই পড়বে আগামী নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ আইনের শাসনে বিশ্বাসী—সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই দাবি যদি সত্য হতো, তাহলে সরকারি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তাদের ওপর দলটি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের জবরদস্তিমূলক আচরণ দেখা যেত না। আমার দলের লোকেরাই চাকরি পাবে, টেন্ডার পাবে, ব্যবসা পাবে, ভালো পদ পাবে—আওয়ামী লীগ মনে মনে এই অবস্থান স্থির করে নিয়েছে বলে সন্দেহ হয়। এবং এই সন্দেহ যদি অমূলক না হয়, তবে তো আইনের শাসনের কথা অবান্তর হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কত হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেসবের মধ্যে কতগুলো আসলেই হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা, আর কতগুলো গুরুতর অপরাধের অভিযোগের মামলা—তা বিচার করা হয়েছে কি না সন্দেহ। এবং এই মামলা প্রত্যাহারের সুবিধাটি পেয়েছেন শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই, বিরোধী দলের কেউই এ সুযোগ পাননি। বরং বিরোধী দলের অভিযোগ, তাঁদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন নতুন মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
আইনের শাসনের কথা মুখে বললেই মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের আস্থা আপনা-আপনিই অর্জিত হয়। কিন্তু বাস্তবে উল্টো হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ধারণা হয়ে গেছে এ রকম যে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ ঘটানো হয় না। ক্ষমতাসীনরা নিজেরাও হয়তো ভাবেন, আইন তাঁদের জন্য নয়, তাঁরা আইনের ঊর্ধ্বে। সরকার ও সরকারি দলের দায়িত্ব ও এখতিয়ারের মধ্যকার পার্থক্যও তাঁরা মানতে চান না। সরকারের প্রশাসন আইনানুগভাবে খাল উদ্ধার করতে গেছে, সরকারি দলের সাংসদ এসে ম্যাজিস্ট্রেটদের ভাগিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, কাউকে উচ্ছেদ করতে হলে আমিই করব। আইনপ্রণেতা সরকারের কাজ করবেন, সরকারি দলের নেতা জেলা প্রশাসককে ধমকাবেন—এভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা দূরে থাক, সরকারি প্রশাসনের যেটুকু কর্মদক্ষতা ও মনোবল এখনো আছে, তাও আর বেশি দিন থাকবে না।
‘আওয়ামী লীগের আদর্শের সঙ্গে দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস জড়িত।’ সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই বক্তব্য জনগোষ্ঠীর অন্তত অর্ধেকের জন্য সত্য। ‘দেশের ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভর করে।’ তাঁর এই বক্তব্যও একই রকম সত্য। এবং তিনি যে বললেন, আওয়ামী লীগ দেশের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিতে চায়—এই ঘোষণাও একটি দৃঢ় রাজনৈতিক ঘোষণা। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? আওয়ামী লীগ আসলে নিজেকে কীভাবে দেখে? কীভাবে নিরূপণ করে নেতা-কর্মীদের? তাঁদের ‘কাজ’ আসলে কী? এবং তাঁদের অধিকাংশই এখন যেসব ‘কাজ’ করছেন, তা কেন করছেন? কেন নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি হচ্ছে? কেন তাঁরা সরকারি কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করছেন? কেন সরকারি দপ্তরে, পরীক্ষাকেন্দ্রে, টেন্ডারবাক্সে হামলা করছেন? সোজা উত্তর: ব্যক্তিগত বৈষয়িক স্বার্থে। একই সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পরস্পরকে খুন করতে উদ্যত হচ্ছেন, খুন করে ফেলছেন! সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থবোধ কতটা উদগ্র হয়ে উঠলে এমনটি ঘটতে পারে?
দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাদের পেছনে থেকে সাত বছর ধরে ‘দলের কাজ’ করেছেন যেসব তরুণ-যুবক, দল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাঁদের মনে অনেক অধিকারবোধ তৈরি হয়েছে। সাত বছর রুটি-রুজির সংকটে ছিলেন তাঁরা, এখন দল ক্ষমতায়, এখনো কি সেভাবেই চলতে হবে? নিজের নেতা এখন সাংসদ, বা সাংসদ না হলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতা। নেতার নিজের, তাঁর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের ভাগ্যোন্নয়ন হচ্ছে, ঘরবাড়ির চেহারা বদলে যাচ্ছে, সয়সম্পত্তি বাড়ছে। তাহলে কর্মীদের কেন রুটি-রুজির সংকট চলতেই থাকবে? কিছু টাকা-পয়সা কেন আসবে না তাদেরও ঘরে?
কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? সরকার তো তাদের সবার জন্য বৈধ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না। দেশে যত চাকরিপ্রার্থী শিক্ষিত বেকার; তত চাকরি তো নেই। সে জন্যই বলা হচ্ছে: দলের লোক ছাড়া কেউ চাকরি পাবে না। কিন্তু এভাবে আর কয়জনের কর্মসংস্থান করা সম্ভব? তাহলে উপায় কী? আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা উপায় বের করে নিয়েছেন: দেশজুড়ে নানা ‘অর্থকরী কর্মকাণ্ডে’ লিপ্ত হয়েছেন। এসবই তাঁদের ‘কাজ’। এই দল কী করে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেবে?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments