আলোচনা- ''স্বর্ণকণা শোভে শত শত' মদির গন্ধভরা কণ্টকফল' by মুহম্মদ সবুর
"কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর" চেষ্টা কম করা হয়নি। ক্ষুধার্ত মুখগুলো পাহাড়ী গাছ থেকে হলুদ হবার অনেক আগেই সবুজ কাঁঠাল পেড়ে এনেছিল। কিন্তু কাঁচা কাঁঠাল আর যাই হোক গলাধঃকরণ সহজ নয়।
এমনিতেই সময় ছিল কাঁঠাল পেকে ওঠার। অর্ধপাকা কাঁঠাল সাবাড় প্রায়। কারো মাথায় যে কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া যাবে সে উপায়ও ছিল না। ১৩৭৮ বাংলা সনের জ্যৈষ্ঠ অর্থাৎ ১৯৭১-এর মে মাসে ত্রিপুরার পালটানায় প্রশিক্ষণার্থী হবার অপেক্ষায় এসে ক্যাম্পে ঘাঁটি গেড়ে বসা সেইসব যুবক। কাঁঠাল কিলিয়ে হতাশ হয়েছিল মনে আছে আজো। একাত্তরে রামগড় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে এপ্রিলের শেষদিক থেকে শরণার্থীর ঢল নামে। পার্বত্য অঞ্চল। জনমনিষ্যি কম। খাবার সংকট তীব্র।
পানীয় জলও বটে। পাহাড়ী এলাকা জুড়ে বিস্তীর্ণ কাঁঠাল, আমসহ অন্যান্য ফলের গাছ। গাছপাকা কাঁঠাল প্রথম দফায় সাবাড় হয়ে যায়। কাঁঠালে কখনো আসক্তি নেই এমন জনকেও সেদিন গোগ্রাসে গিলতে দেখা গেছে কাঁঠালের কোয়া। পাহাড়ী মানুষরাও বুঝি অবাক কিংবা বিস্মিত হয়েছিল। কাঁঠালের কী কদর আর ভাতের বিকল্প যে কাঁঠাল হতে পারে সেদিনের সেসব শরণার্থী বুঝেছিল।
পানীয় জলও বটে। পাহাড়ী এলাকা জুড়ে বিস্তীর্ণ কাঁঠাল, আমসহ অন্যান্য ফলের গাছ। গাছপাকা কাঁঠাল প্রথম দফায় সাবাড় হয়ে যায়। কাঁঠালে কখনো আসক্তি নেই এমন জনকেও সেদিন গোগ্রাসে গিলতে দেখা গেছে কাঁঠালের কোয়া। পাহাড়ী মানুষরাও বুঝি অবাক কিংবা বিস্মিত হয়েছিল। কাঁঠালের কী কদর আর ভাতের বিকল্প যে কাঁঠাল হতে পারে সেদিনের সেসব শরণার্থী বুঝেছিল।
পাক-হানাদারের নির্যাতন এড়িয়ে নিরাপদ স্থানে পাড়ি দেয়া মানুষগুলোকে ক্ষুধার সাথে লড়াই করতে হয়েছিল গোড়াতেই। সহায়-সম্বলহীন শরণার্থী জীবনে ভাতের বিকল্প হয়ে উঠেছিল কাঁঠাল। কিন্তু সব কাঁঠালই সাফ হয়ে গিয়েছিল সেবার মে মাসেই। জ্যৈষ্ঠের খরতাপে ক্ষুধার্ত বাঙ্গালি কাঁঠালকে সমাদর করেছিল কীভাবে ভুক্তভোগী জানে। আধপাকা কাঁঠাল পরিপাকতন্ত্রকে জটিল করেছিল অনেকের বৈকি। সেই কাঁঠাল স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় ফল হিসেবে স্থান ও স্বীকৃতি পেল, মনে হয়েছিল যথার্থই। ফলের রাজা আমকে ডিঙ্গিয়ে কাঁঠালের এই অবস্থান পুরো জাতিসত্তার বিচারে সঠিক প্রতীয়মান হয়েছিল সে সময়েই। বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা কাঁঠালের মর্ম বুঝেছিল সেদিন। কাঁঠালের মানব হিতৈষণা ও গণমুখী বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি হয়েছিল।
সারাদেশ জুড়ে যার সাম্রাজ্য; সেই কাঁঠাল ছিল, আছে চিরকালের সাধারণ বাঙ্গালির পরমপ্রিয় খাবার হিসেবেই। দারিদ্র্যপীড়িত বাঙ্গালী পরিপক্ব ফল হিসেবে কাঁঠালকে গুরুত্ব দিয়েছে। ভাতের বিকল্প হিসেবে কাঁঠালের অবস্থান মধ্যযুগেও ছিল। পাহাড়ী অঞ্চলের মানুষের কাছেও কাঁঠাল অতি আদরণীয়। কিন্তু কাঁঠাল কখনো অভিজাত চরিত্র পায়নি। আমের যে আদর কদর তার সিকিভাগও কাঁঠালের কপালে জোটেনি। অতিকায় এবং রসময় কাঁঠাল জাতীয় ফল হলেও জাতীয় আয়োজনে উপস্থিতি দেখা যায় না। কাঁঠালের হলুদ কোয়া মুখে পুরে রসে টগবগে হওয়ার সুবিধে থাকলেও অভিজাত অঞ্চলে কাঁঠালের 'এন্ট্রেন্স' বা প্রবেশাধিকার সহজ নয়। গরীব, মেহনতী মজুর, চাষাভুষো, কুলি-কামিন, নিম্নবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্তের আদর-যত্ন কাড়ার কাঁঠাল উচ্চবিত্তের দরবারে অস্পৃশ্য। এমনই কপাল জাতীয় ফলের। তবে থমকে যেতে হয়েছিল, যখন উদ্ভিদচর্চাকারী কাঁঠালে অনাসক্ত বন্ধুবর প্রয়াত কথা-সাহিত্যিক শহিদুল জহির বলেছিল, কাঁঠাল কোন ফল নয়। কাঁঠাল হচ্ছে ফুলসমষ্টি। কিংবা বলা যায় বিচিত্র ফল। কাঁঠালের কোয়া আসলে ফলের অংশ নয়। এটা হচ্ছে পুষ্পাংশ। উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষায় পুষ্পপুট। এই পুষ্পাংশের ভেতরে যে বিচি, তা হচ্ছে কাঁঠালের বীজ। শহিদুল আরো বলেছিল; পরিপক্ব অবস্থায় গোঁা অবয়ব নিয়ে তবে সামগ্রিক ফল হচ্ছে কাঁঠাল। আর কাঁচা অবস্থায় তরকারি। উদ্ভিদবিজ্ঞান কাঁঠালকে যৌগিক ফল হিসেবে বিবেচনা করে। সম্বিত ফিরে এলে উল্টো তাকেই বোঝানোর চেষ্টা করা গেল, কাঁঠাল তো আর আম, জাম, জামরুলমার্কা ফল নয় যে, সরাসরি কামড়ে খাওয়া যাবে। সুতরাং কাঁঠাল হতে পারে মহাফল। শহিদুল যুক্তি মেনেছিল।
বাঙ্গালির জীবনে গ্রীষ্মে আম ও কাঁঠালের যে মাহাত্ম্য জেগে ওঠে অন্য কোন ফলে আর তা হয় না। আমের প্রবেশাধিকার সর্বত্র। তবে আমগাছ সুমিষ্ট হয় না সর্বত্র। আর কাঁঠাল তো যেখানে-সেখানেই বেড়ে ওঠে। সহজলভ্য বলেই কাঁঠাল নিয়ে অতো মাতামাতি নেই। আমের যতো জাত-পাত, কাঁঠালের তা নেই। সাধারণত কাঁঠাল বেশ মিষ্টিরস সমৃদ্ধ হলেও পানসে কাঁঠাল মিলে পাহাড়ী অঞ্চলে। গলা জাতের কাঁঠাল স্বাদে-গন্ধে সেরা। এর কোয়া হয় নরম। খাজা কাঁঠালের কোয়া শক্ত। আরেক জাত আছে শক্ত-নরমের মিশ্রিত। আগরতলার পালটানায় কাঁঠাল খেতে দেখে, 'তোমভি কাঁঠাল খায়ার' গল্প মনে পড়েছিল। সত্তর সালে ঢাকা কলেজে ক্লাসে গল্পটি বলেছিলেন বাংলার অধ্যাপক রওশন আরা। কাবুলিওয়ালা ঢাকায় এসে কাঁঠাল দেখে বিস্মিত ও অবাক। খাবার বাসনা তীব্র। কিন্তু কাঁঠাল খেতে গিয়ে দেখা গেল, দাঁড়ি আর গোঁফ বেশ ঝামেলা করছে। কাঁঠালের আঠা লেগে দাড়ি-গোঁফ জট বেঁধেছে। সেলুনে গিয়ে সব সাফসুতরো করেই হাঁক দিলেন, 'লে অাঁও কাঁঠাল'। একদিন পরে মুন্ডিতমস্তক, নামাবলী শোভিত তিলকচক্রিত বৈষ্ণব দাস বাবাজীর সঙ্গে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে দেখা। কাবুলিওয়ালার সঙ্গে সঙ্গে সহাস্য অভিবাদন, 'আরে, ভাই তোম ভি কাঁঠাল খায়া, হামভি কাঁঠাল খায়া'! খুব যে সুখপ্রদ হয়েছিল যুদ্ধকালীন কাঁঠাল ভক্ষণ, এমনটা কেউ না বললেও জীবনধারণ ও বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট অবদান রেখেছিল বৈকি।
চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের কাঁঠালের স্বাদ আর টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ অঞ্চলের কাঁঠালের স্বাদে যে তফাৎ আছে এমনটা যিনি বলেছিলেন, তিনি চাখিয়েছিলেন বৈকি। বাঙ্গালি জামাতার গ্রীষ্মে শ্বশুরালয়ে কাঁঠালবিহীন আপ্যায়নের সুযোগ ছিল না। গত শতকের সত্তর দশকে পুরো একাই কাঁঠাল কোয়া গিলে ফেলা সাহিত্যিক এফাজউদ্দিন মলিস্নক, শ্বশুর হিসেবে জামাতাকে কাঁঠাল ভক্ষণে আকৃষ্ট করার পরামর্শও দিয়েছিলেন, বুঝলে, কাঁঠাল খাবে 'হোলসেল'। 'হোলসেল কাঁঠাল' ব্যাপারটা বুঝতে সময় নেয়নি অবশ্য। বললেন, এক কোয়া, দু'কোয়া নয়, সাহস করে মরিয়া হয়ে শেয়ালের মতো গোঁই মেরে দাও। সব কাঁঠালেই একটি 'হজমী কোয়া' ঘাপটি মেরে আছে। চেনা দায়। একবারে 'এনজাইম প্যাক'। তাতে গোঁা কাঁঠাল হজম করা সহজ। যতোঁা শ্বশুর মহোদয়ের পরিপাকযন্ত্র কাঁঠালের আধার হতে পারে, জামাতার জন্য যেন তা বিষময়। কারণ সব জাতের কাঁঠালের কোয়া পরিপূর্ণ ভাবে চর্বণ করা সম্ভব হয় না, অর্ধেক চিবিয়ে গিলতে হয়। আর তাতেই পরিপাক জটিলতা।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাহাড়, নদী ঘেরা চন্দনাইশে বালকবেলায় বড় বড় সাম্পান যোগে কাঁঠাল আনার দৃশ্য বেশ আনন্দ দিলেও কাঁঠালের কোয়াসক্ত হওয়ার আগ্রহ জাগেনি। পাহাড় থেকে কাঁঠাল আসতো। মহাসড়কে ট্রাকে চড়ে চলে যেতো গঞ্জে, শহরে। নদী পাড়ে কাঁঠালের আড়তও দেখা যেতো। এমনিতেই বাড়ির নানা স্থানে কাঁঠাল গাছের ছড়াছড়ি। কিন্তু কাঁঠালের ইঁচোড় বা এঁচোড় টেনে নিতো। কাঁঠালের কঁচি অবস্থায় লবণ ঝালে মিশিয়ে ভর্তা কিংবা টেংরা মাছের সাথে তরকারি হিসেবে এঁচোড়ের স্বাদই ছিল ভিন্ন। তবে কাঁঠালের বীজ বা বিচির অবস্থান এখনও আছে খাদ্য তালিকায়। বালকবেলায় কাঁঠাল-মুড়ি, দুধ-কাঁঠাল আর কাঁঠাল বড়া, কাঁঠাল চিতোই, কাঁঠাল তেলপিঠার স্বাদ পাবার সুযোগ হয়েছিল। এখন যা স্মৃতি কেবল।
আকার, আয়তন, ওজন, কাঁঠালের বিভিন্ন রকম। কাঁঠালের জাত চেনা বা কাঁঠালের ভেতরের কোয়ার ধরন বুঝতে আর যাই হোক জহুরির প্রয়োজন আবশ্যিক। বালকবেলায় দেখা যেতো পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে কাঁঠাল খামার। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে ও পাহারায় থাকতেন যিনি সেখানেই তাকে ঘর বেঁধে দেয়া হয়েছিল। সপরিবারে থাকার ব্যবস্থাও। তাকে ডাকা হতো আবদুইয়্যা খামারি। তার কাছে শুনেছিলাম, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুরু হলেই কাঁঠাল পাকাও শুরু হয়। তবে ফলন সব বছর সমান হয় না। যে বছর গাছে বেশি কাঁঠাল ধরে, সে বছর ঝড়-বাদল বেশি হয়। তেমনি বাদল বেশি হলে কাঁঠাল তাড়াতাড়ি পাকে। কিন্তু কোষ শক্ত হয়ে যায়। চন্দনাইশের পাহাড়ী এলাকায় এক ধরনের কাঁঠাল দেখা যেতো। কবিরাজ ও বৈদ্যরা এসব কাঁঠাল প্রক্রিয়া করে ঔষধ বানাতো। নামও হয়েছিল তাই কবিরাজি কাঁঠাল। এসব গাছে কাঁঠাল ধরে ডালের ডগা থেকে গোড়া পর্যন্ত। এমনকি কখনো কখনো মাটির নীচের শেকড়েও কাঁঠাল ধরে। সে সব কাঁঠাল বড় হলে মাটি ফেটে বের হতো। জাতপাতের ধার কমই ধারলেও কাঁঠালের গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য, ধরন-ধারণ দেখে কাঁঠালের নামকরণ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম। কাঁঠালের মতো এতো শক্ত ও লম্বা বেঁাঁা আর কোন ফলে হয় না। একটা বেঁাঁা দুই মণ ওজনের একটা কাঁঠালকে কী শক্তিমত্তায় গাছে ঝুলিয়ে রাখে, বিস্ময়কর বৈকি। টাঙ্গাইলের পাহাড়ী অঞ্চলে আধা ফুট লম্বা কাঁঠালের সাড়ে তিন ফুট বেঁাঁ দৃষ্টি টেনেছিল। একটা বেঁাঁায় ২৫টা পর্যন্ত কাঁঠাল ধরে আছে- এমন দৃশ্য চোখে পড়েছিল কুতুবপালং পাহাড়ে। ছোঁজাতের ছোঁ ছোঁ ডাবের মতো কাঁঠাল ধরে আছে গাছে। এগুলোকে হাজারি কাঁঠাল বলে। একটা গাছে হাজারটা কাঁঠাল ধরে ছিল, কবে কে জানে, সেই থেকে নাকি এই নামকরণ। গাজীপুর অঞ্চলের কোনো কোনো গাছের কাঁঠাল মিছরির মত মিষ্টি এবং কচকচে। এর নাম হচ্ছে মিছরি কাঁঠাল। এফাজউদ্দিন মলিস্নক নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া সিরাজগঞ্জে তাঁর পিতৃভূমিতে মধু কাঁঠাল, চুষনি কাঁঠাল ও রসিয়া কাঁঠালের স্বাদের বর্ণনা দিতেন। সেসব কাঁঠাল চেনা হয়নি কখনো। বৈশাখে যেসব কাঁঠাল পাকে, এমনকি বাজারে আসে, সেগুলো বেশ সুস্বাদু ও সুমিষ্ট। আগে পাকে বলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগুনতি কাঁঠাল আর গাজীপুরে বৈশাখী কাঁঠাল বলে। এই কাঁঠালগুলো আকারে খুব বড় হয় না অবশ্য। কোন কোন অঞ্চলের গাছে অসময়েও কাঁঠাল ধরে। চৈত্র বা ভাদ্র মাসেও কাঁঠাল দেখা যায়। কৃষি প্রযুক্তির কল্যাণে বার মাসই কাঁঠালের দেখা মেলে এগুলো বার মাস্যা কাঁঠাল। স্বাদ তেমন হয় না। গ্রীষ্মে আনা কাঁঠাল বিদায় নেবে বর্ষার সেই শ্রাবণে। বর্ষায় কাঁঠালের স্বাদ গ্রীষ্মের চেয়ে ভিন্ন। কাঁঠাল গ্রীষ্মে যতো উপাদেয়, বর্ষায় হয়তো ততো নয়। এফাজউদ্দিন মলিস্নক ষাটের দশক থেকেই ব্যাংকার হিসেবে জীবিকা শুরু করেছিলেন; ঢাকায় নিজ বাড়ীতে কাঁঠাল গাছ রোপণ করে, তার ফলও খেয়েছেন। বলতেন, আমের মতো কাঁঠালের অতো জাতপাত না থাকলে কি হবে, কাঁঠালের স্বাদের জাতপাত আছে। এমনিতে কোন কাঁঠাল গোল, কোনটা লম্বা, কোনটা ডিমাকৃতির। অধিকাংশই বেঢক আকারের। সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল বা গাজীপুরের রসা, আধারসা খাজা বা চাউলা এই তিন জাতের কাঁঠালই মেলে।
এতো স্বাদ, এতো গুণ, তবু কাঁঠাল পায়নি সমাদর উচ্চমহলে। আমের তুলনায় কাঁঠালের মযর্াদা অনেক হীন-বৈভবহীন। রাজা, বাদশা, জমিদার, নবাব এমনকি কবি-সাহিত্যিক কারো কাছেই সম্মান পায়নি কাঁঠাল। তবে ইউরোপীয় পর্যটক যারা এসেছিলেন এদেশে; সহস্র বছরেরও আগে কিংবা বিজয়ী রাজা বাদশারা কাঁঠালের কথা বলেছেন। তবে আমাকে তারা যতো মযর্াদা দিয়েছেন, কাঁঠালকে তেমন নয়। অথচ এই দেশে সেই প্রাচীনকাল থেকেই কাঁঠাল ক্ষুণ্নবৃত্তির সঙ্গী। কাঁঠালের আদিনিবাসও এই ভারতবর্ষে, পশ্চিমঘাঁ পর্বতমালায়। সেখান থেকে বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া এমনকি সুদূর ব্রাজিল, কলম্বিয়ায় কাঁঠাল পেঁৗছেছে।
চীনা ও ইউরোপীয় পর্যটকরা কাঁঠাল দেখে বিস্মিত হয়েছেন। ফলের আকার, আয়তন, বৃক্ষে ঝুলে থাকা, বহিরাঙ্গে কন্টক, ফলের কোয়া, বীজ বা বিচি সবই আকর্ষণ করেছে। তবে এই ফল যে পরিপাকতন্ত্র বান্ধব নয়, সেটাও ভোলেননি কেউ। আবার এই ফলের আয়তন চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকে নিজ নিজ দেশের জীবজন্তুর সঙ্গে তুলনাও করেছেন। অন্য কোন ফলে তাদের বিস্মিত করেনি সেভাবে, কাঁঠাল যতোঁা আকর্ষণ করেছিল। তাঁদের বিবরণ থেকে কাঁঠালের আরেকটি নাম পাওয়া যায়, 'পনস'। সংস্কৃত শব্দজাত। সংস্কৃত ভাষায় কাঁঠালকে কন্টকফল অভিধা দেয়া হয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় এমনকি বিশ শতকের গোড়ায় কাঁঠাল উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে 'কাঁটাল' অভিধা পেতো। ভারতের দাক্ষিণাত্যে মালাবারে বিভিন্ন ভাষায় কাঁঠাল জাকা, শাকা, চাকা নামে পরিচিত। কাঁঠালের পতর্ুগীজ নাম জাকা বা জাক্স এর উৎপত্তি এখান থেকেই। পতর্ুগীজদের এই উচ্চারণই ইংরেজিতে এসে জ্যাকফ্রুট নাম ধারণ করেছে। অবশ্য সম্রাঁ বাবরের আত্মজীবনী 'বাবরনামা'য় কাঁঠালকে 'কাডিল' উলেস্নখ করা হয়েছে।
গ্রীকবীর আলেকজান্ডার দেশের পর দেশ জয় করে যেখানে এসে থেমেছিলেন, ভারতবর্ষের গঙ্গারিডিই অঞ্চলে। একপাশে বিপাশা নদী। এই এলাকায় আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাঁঠাল খেয়ে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেনাদের কাছে ফলটা বেশ উপাদেয় ছিল। কিন্তু আমাশয়সহ পরিপাকতন্ত্র জটিলতায় আক্রান্ত হবার ঘটনায় আলেকজান্ডার তার সেনাশিবিরে কাঁঠালের প্রবেশ নিষেধ শুধু নয়, এই ফল না খাওয়ার জন্য হুকুম জারি করেছিলেন। কাঁঠাল নিষিদ্ধ হবার ঘটনা বোধহয় ওই প্রথম। দ্বিগিজয়কালে আলেকজান্ডারের সঙ্গে অনেক পর্যটক, বিজ্ঞানীও ছিলেন। তারা কাঠালের প্রশংসা করলেও এর হজম শক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এই একটি কারণেই কেবল কাঁঠাল যে অভিজাত্যহীন তা নয়, এই কাঁঠাল খাবার জন্য নিতে হয় প্রস্তুতি। সে এক ঝকমারি ব্যাপার। এসব ঝকমারিত্ব ডিঙ্গিয়েও কাঁঠাল ভক্ষণ বা কাঁঠালের অভিজাত হয়ে ওঠায় ওই 'হজম' ব্যাপারটাই গলাটিপে দিয়েছে। তাই সাধারণে সাধারণই থেকে গেল কাঁঠাল।
ইতালির বিখ্যাত প্রকৃতি বিজ্ঞানী পিস্ননি এসেছিলেন এদেশে সেই খ্রীষ্টজন্মেরও আগে। কাঁঠালের কোষ বা কোয়াকে স্বর্ণের রঙের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ভারতীয় ঋষি এবং দার্শনিকরা, যারা পোশাক পরিধান বাহুল্য মনে করেন, তারা এই মনোহর, রসালো ও স্বর্ণালী ফলরাশির ওপর নির্ভর করে পুরো একটা মৌসুম অনায়াসে পাড়ি দিতে পারে। ফলের এই মৌসুমে তাদের আর অন্য খাবারের সংগ্রহে ঘুরতে হয় না। অরণ্যচারী ঋষিদের প্রধান খাদ্য এই ফল। এই ফলের পাতা পোশাকের বিকল্প হিসেবে শরীরে জড়িয়ে রাখে। দেখতে সুন্দর না হলেও পরিপক্ব অবস্থায় এই ফল অত্যন্ত সুরভিত এবং একটিমাত্র ফলেই মহাতৃপ্তির সঙ্গে চারজনের পেট ভরে যায়। পিস্ননি গঙ্গারিডিই অঞ্চলে কাঁঠাল গাছ দেখেছেন। কাঁঠাল ভক্ষণ করেছেন। বলেছেন, বিশালাকায়, অদৃষ্টপূর্ব এবং ইউরোপীয় রসনায় অনাস্বাদিত এক অতীব রসালো ফলের গাছ এ অঞ্চলে প্রচুর। ভারতীয়রা ফলটিকে পলা বলে। আশ্চর্য যে এই ফলের মধ্যেই কিন্তু আসল ফল কিংবা ফলরাশির দেখা মেলে। ভারতীয়রা সেই অনন্য ফলগুলোকে বলে 'অরিয়েনা'। বিশেস্নষকদের মতে, ল্যাটিন উচ্চারণ জটিলতায় পিস্ননি যাকে পলা বলেছেন, তা হলো আসলে ফল এবং অরিয়েনা হচ্ছে সংস্কৃত শব্দ 'হিরণ'। অর্থ যার স্বর্ণ। অর্থাৎ সোনালী বা স্বর্ণালী ফল। পিস্ননি ফলের বর্ণনায় বলেছেন, ভারতবর্ষের এই অপূর্ব ফলের গাছটি নিজে যেমন বড়, গাছের ফলগুলোও তেমনি বড়। রোমানদের কোন ফলের সঙ্গে এই ফলের বিশালত্ব তুলনা করা অসম্ভব বলে উলেস্নখ করেছেন পিস্ননি। লিখেছেন ফলগুলো বিশালাকার হলেও বক্রাকৃতির। কিন্তু স্বাদে অপূর্ব। অবশ্য আপেল, আঙ্গুরের দেশের মানুষ পিস্ননির কাছে বিশ্বের বৃহত্তম ফল কাঁঠাল বেশ বিস্ময়ই জাগিয়েছে। শুধু পিস্ননি কেন, অন্য পর্যটকদের ক্ষেত্রেও তাই দেখা যায়।
হিউয়েন সাং চীনা পর্যটক। বাংলায় এসেছিলেন সপ্তম শতকে, ৬৩৯ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে। পুন্ড্রবর্ধন ভ্রমণকালে কাঁঠাল দেখে অবাক হয়েছিলেন। বঙ্গ দেশের চারটি স্থানে তিনি ঘুরেছেন। সবখানেই কাঁঠাল দেখেছেন। তাই আর অন্য কোন ফলের দেখা মেলে না তাঁর বিবরণে। পন্ডিতদের কাছে জেনেছিলেন ফলটির নাম 'পনস'; সংস্কৃত শব্দ। তবে বাঙলায় যে কাঁঠাল সেটাও অজ্ঞাত ছিল না। লিখেছেন, এই অঞ্চলে প্রচুর কাঁঠাল গাছ। ফলের কদর এদেশে খুবই বেশী। মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে ফল মেলে। বিস্ময়কর এই ফল গাছের ডালেই গুচ্ছের মতো ঝুলে থাকে। শুধু তাই নয়, গাছের গুঁড়ির চারপাশেও হয়ে থাকে, অনেক সময় শেকড়েও ফলে। মাটি খুঁড়ে এই ফলকে ঠাঁই দিতে হয়। আকারে কুমড়োর চেয়ে অনেক বড় এই ফল। বহিরঙ্গ কন্টকাবৃত। পাকলে সবুজ কাঁঠাল হলদে লাল রঙে রূপান্তর হয়। ভাঙলে এর মধ্যে মিলে লালচে হলুদ ছোঁ ছোঁ অসংখ্য ফল। ডিম্বাকৃতির। এর মধ্যে রয়েছে সুমিষ্ট সুস্বাদু রস। আবার ফলের মধ্যেও ফল। তবে তা বেশ শক্ত। কাঁচা অবস্থায় স্বাদ সামান্য কষ। তবে ভাজা হলে অপূর্ব। হিউয়েন সাং ফলের ভেতর ফল বলতে কাঁঠালের বিচিকে বুঝিয়েছেন। পুরো কাঁঠালই তাকে বিমুগ্ধ করেছে।
ত্রিশ বছর আগেও দেখা যেতো, গ্রামীণ কাঁচা রাস্তার ধারে কাঁঠাল চারা রোপণ করতে। কাঁঠাল চাষে জড়িতরা নিজেরাই ভালো জাতের কাঁঠাল বীজ থেকে চারা তৈরী করে রোপণ করতো। তবে কাঁঠালের ক্ষেত্রে কলমের চারা লাগাতে সে সময় দেখা যায়নি। বীজের চারা হলে অবশ্য চার-পাঁচ বছর বয়সেই গাছে ফল ধরা শুরু হয়। কোন কোন কাঁঠাল গাছ তো শতায়ু এবং ফলদানে কার্পণ্য নেই। এমনিতে অবশ্য ৪০/৫০ বছর বয়সের পর ফলের সংখ্যা কমতে থাকে। অনেক পারিবারিক কবরস্থানে কাঁঠাল গাছ দেখা যায়। এসব গাছের কাঁঠাল ভক্ষণ নিয়ে অবশ্য এক ধরনের সংস্কার রয়েছে।
গার্সিয়া ডি ওরটা পতর্ুগীজ প্রকৃতিবিজ্ঞানী ও পর্যটক। ত্রয়োদশ শতকে এসেছিলেন বঙ্গ দেশে। কাঁঠাল তাকেও টেনেছিল রসময়তায়। রসালো আবেদনে। গোগ্রাসে গিলেছিলেন কাঁঠাল। কিন্তু পরিপাকতন্ত্র সেই রসে বাগড়া দিয়ে তাকে শারীরিকভাবে কাবু করেছিল। সে নিয়ে পরিতাপের কমতি ছিল না। লিখেছেন, কাঁঠাল সব সময় হজম করা কষ্টসাধ্য। পাকা কাঁঠালের সোনালি ফলের মদির গন্ধ মধুকরের মতোই আকৃষ্ট করে। মূল বীজফলের সোনালি আবরণ- যা অতি রসময়, সেটাই মূলত খাদ্য। আর একবার খেতে শুরু করলে বিরাম দেবার সুযোগ থাকেনা, স্বাদের টানেই। তারপর এক সময় দেখা যাবে খাদকের বেসামাল অবস্থা। দেখা যাবে খাদকের জঠর তার গলধাকরণকৃত সমুদয় আবরণ অবিকৃত অবস্থায় পরিত্যাগ করতে শুরু করেছে। এই অবস্থাঁা বেশ দুঃসহ। গার্সিয়া কাঁঠাল নিয়ে পাকে-বিপাকে পড়ে গেলেও বুঝেছেন যে, শুধু কাঁঠাল কেন, পরিমাণ ছাড়িয়ে গেলে যে কোন ফলও পরিপাকতন্ত্রে নানা ব্যাঘাত ঘটায়।
পর্যটক ইবনে বতুতা কাঁঠাল চিনেছেন অনায়াসেই। কাঁঠালের গুণাগুণ, খারাপ-ভালো তুল্যমূল্য করতে পেরেছিলেন। ভারতবর্ষে এসে পতর্ুগীজদের কাঁঠালাসক্তি তাকে মুগ্ধ করেছিল। পতর্ুগীজদের কাছ থেকে জেনেছিলেন এ অঞ্চলে কাঁঠালের নাম শাকি, বার্কি, জাকা। চতুর্দশ শতকের গোড়ায় বাংলায় এসেছিলেন জাত পর্যটক ইবনে বতুতা। বর্ণনা করেছেন যে, একই ফলের দুটো নাম শাকি এবং বার্কি। ফলের গাছগুলো বেশ বড় এবং দীর্ঘজীবী। গাছের পাতা দেখতে আখরোটের পাতার মতো। অধিকাংশ ফলই ধরে মূল, কাণ্ড ও গুঁড়ির গায়ে। গুঁড়ির ফলগুলো প্রায় মাটি পর্যন্ত নেমে যায়। এই ফলগুলোর নাম বার্কি এবং যেগুলো ডালে ধরে সেগুলোকে বলা হয় শার্কি। বার্কির ঘ্রাণ অতিশয় মনোলোভা; স্বাদও মনোহর এবং মধুর। শার্কি ততোঁা নয়। ইবনে বতুতা আসলে কাঁঠাল গাছের ডালে এবং গোড়ায় জন্মানো কাঁঠালের স্বাদও মিষ্টতার তফাতের কারণে এই বিভাজন এনেছিলেন সম্ভবত।
চতর্ুদশ শতকের ইউরোপীয় পর্যটক ফ্রায়ার অডোরিকের কাঁঠালাসক্তি তীব্র হয়েছিল। নিরাপদে কাঁঠাল ভক্ষণের যাবতীয় আঞ্জাম তার জানা হয়ে গিয়েছিল। লিখেছেন, একটি প্রমাণ সাইজের কাঁঠাল নিদেনপক্ষে পাঁচজনের ভোজনোপযোগী। আর একেকটা কাঁঠাল আকারে এতো বড় যে, একজন বলিষ্ঠ ইউরোপীয় এরকম দুটো কাঁঠাল একসঙ্গে বহন করতে গেলে তার ঘাম ছুটে যাবে। কাঁঠাল সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান কিংবা ধারণা নেই এমন ভোজনগ্রাহীকে সাবধান করে দিয়ে ফ্রায়ার বলেছেন, 'কাঁঠাল খাওয়ার আগে হাতে-মুখে তেল মেখে নিতে হয়। তেলের সাহায্য ছাড়া কাঁঠালের আঠা ছাড়ানোর আর কোন উপায় নেই এবং অন্য কোন চেষ্টা না করাই উত্তম। ইতালির আরেক পর্যটক মানুচ্চিও কাঁঠালের বিচির স্বাদ পেয়েছিলেন। তাই পোড়া কাঁঠাল বিচির সঙ্গে ইউরোপের ভাজা চেস্টনাটের স্বাদ ও গন্ধের সাদৃশ্যের কথা উলেস্নখ করেছেন।
১৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে চীনের মিঙ সম্রাঁ ইয়াংলো দূত হিসেবে বাংলায় পাঠিয়েছিলেন হু হিয়েনকে। বাংলায় স্বাধীন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের রাজধানী গৌড়ে এসেছিলেন। বাংলার ফলমূলের বর্ণনায় তিনি প্রথমেই উলেস্নখ করেছেন কাঁঠাল প্রসঙ্গ। কাঁঠাল তার দৃষ্টি ও রসনাকে তৃপ্ত করেছিল বৈকি। লিখেছেন, কাঁঠাল দেখতে ধামার মতো বড় আর খেতে খুব মিষ্টি। সুলতান দরবারে তাদের আম-কাঁঠালসহ অন্যান্য গ্রীষ্মকালীন ফল দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। বাংলায় শাসকরা গ্রীষ্মকালে মৌসুমী ফল দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন শুধু নয়, উপঢৌকন হিসেবে ফল পেতেন আবার নিজেরাও পাঠাতেন উপহার। ফল-ফলাদি সহজলভ্য বলে ফলাহার ছিল বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের অংশ বা অংগ। চীনা দূত হু হিয়েন লিখেছেন, কাঁঠালের কাঠ কুচিকুচি করে সেদ্ধ করলে গেরুয়া রং পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাষায় এই কাঁঠালের রংয়ে রঞ্জিত হতো।
নিকোলো ডি কন্টি পর্যটনে এসেছিলেন রোম থেকে, বঙ্গসহ ভারতবর্ষে পঞ্চদশ শতকে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বঙ্গদেশেও। কাঁঠাল ফল তাকে তীব্রভাবে টেনেছিল। কাঁঠালকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। কাঁঠালের এঁচোর-মোচা থেকে কাঁচা কাঁঠাল এবং পরিপক্ক হবার অবস্থা তিনি বেশ যত্নসহকারেই দেখেছেন। লিখেছেন, কাঁঠাল দেখতে অনেকটা পাইন ফলের মতো। তবে তা আকারে নয়। একটি বড় কাঁঠাল কাঁধে তুলতে একজন বলিষ্ঠ লোককেও হিমশিম খেতে হয়। কাঁঠালের ভেতর যে কয়েকশ' অনুপম ফল, সেগুলোকে হয়তো ডুমুরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তবে ডুমুরের আকার তার তুলনায় নেহাতই তুচ্ছ। মানুষের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে কাঁঠালের বাকি অংশ যে উৎকৃষ্ট পশু খাদ্য এবং গরু গোগ্রাসে তা খায় - সেসবের বর্ণনাও দিয়েছেন ডি কন্টি। বর্ণনা করেছেন আরো, পাকা কাঁঠালের গন্ধ কী রকম। কাঁচা কাঁঠালের গায়ে হাত চেপে ধরলে রক্তবিন্দু কী রকম প্রস্ফুটিত হয়। পাকা কাঁঠাল গাছে দীর্ঘ সময় থাকলে কীভাবে ফেটে কোষ বা কোয়া খসে পড়ে - সেসবও দৃষ্টি এড়ায়নি কন্টির। কাঁঠালের উপকারিতা যথেষ্ট, অপকারিতার চেয়ে - এমনটাই বলেছেন ডি কন্টি। কাঁঠালের পাতার প্রতি ছাগল সমপ্রদায়ের তীব্র আসক্তি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। ডি কন্টি লিখেছেন আরো, কর্তিত কাঁঠাল গাছ দিয়ে ভালো কাঠ বা তক্তা হয় এবং এই কাঠ বা তক্তা দিয়ে চমৎকার আসবাবপত্র বানানো হয়।
ইতালির আরেক পর্যটক জন ডি মারি গনলিস্ন। ১৩৫০ খ্রীস্টাব্দে ফ্লোরেন্স থেকে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। বঙ্গদেশেও ঘুরেছেন। কাঁঠাল দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। শুধু কি বিস্ময়! শেষতক কাঁঠালের আঠায় মজেছিলেন বলা যায়। কাঁঠালসহ কাঁঠাল গাছের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। বেশ চমৎকার বিবরণই বলা যায়। লিখেছেন, ''ঃবিস্ময়কর এক বৃক্ষ পরিদৃষ্ট হয়। বৃক্ষটির নাম চাকে। লম্বায় প্রায় ইতালীর ওক গাছের মতো। বৃক্ষটি তার দৈর্ঘ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশাল বিশাল ফল দেয়। কেউ যদি ফলের সময়ে দূর থেকে এই বিচিত্র ফলের গাছটি দেখতে পান, প্রথম দর্শনে প্রতীয়মান হবে গাছটির ডালে ডালে এবং গুঁড়ির গায়ে ঝুলে আছে বিভিন্ন বয়সের ভেড়া। কিন্তু ভেড়া গাছে ঝোলেনা কখনো। আসলে ওগুলো ওই গাছেরই ফল।"
কাঁঠাল সম্পর্কে এমন প্রাণীসর্বস্ব উপমা দেখি মোঘল সম্রাঁ বাবরের আত্মজীবনীতে। কাঁঠাল গাছ তিনি দেখেছেন হিন্দুস্থানে। বর্ণনা করেছেন, কাঁঠাল এর চেহারা হচ্ছে ভেড়ার ভরাপেটের কিংবা পাকস্থলির মতো। আর গাছটি দেখলে মনে হবে চারদিকে যেন ভেড়ার পেট ঝুলছে। ভারতবর্ষের আর কোন ফল পছন্দ না হলেও ভেড়া সাদৃশ্য কাঁঠালের মিষ্টতার জন্য প্রশংসা করেছেন। কাঁঠালের ঘ্রাণ তাকে টেনে না নিলেও কাঁঠাল খাওয়ার আগে মুখে ও হাতে তেল মেখে নিতে হয়, নতুবা বিপত্তি ঘটে; বাবরনামায় তার উলেস্নখ আছে। যেখানে বাবর কাঁঠালকে ডেকেছেন 'কাডিল' হিসেবে।
ফ্লোরেন্সের পর্যটক জন ডি মারিগনলিস্ন এই ভেড়া দৃশ্যের আরো একধাপ এগিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, ''ঃঅবশ্য কারও মনে হতে পারে ভেড়া নয়, এক থেকে তিনবছর বয়সী অনেকগুলো শিশু গাছটিতে ঝুলে আছে। ফলটির আবরণ বেশ পুরু, অনেকটা পাইন ফলের আবরণের মতো। বড় আকারের ছুরি দিয়ে মূল ফলটি উন্মুক্ত করতে হয়, তারপরেই বেরিয়ে আসে কয়েকশ' নতুন ফল। এ ফলের রসে রয়েছে মধুর মিষ্টতা, অনেক সময় মধুর চেয়েও বেশি। ইতালির যাচাই করা শ্রেষ্ঠ তরমুজের চেয়েও এর স্বাদ উৎকৃষ্টতম। এই ফলের মধ্যে আবার ফল। দেখতে প্রায় চেস্টনাটের মতো। এ ফলগুলো মানুষ ভেজে খায়। তরিবত করে ভাজলে এর স্বাদ দারুণ।"
কাঁঠালের দোষ হজম না হওয়া শুধু নয়, কাঁঠালের আঠাও দোষের আকর। সম্রাঁ বাবর কাঁঠাল খাবার আগে হাত মুখে তেল মেখে নেবার কথা বলেছেন বেশ বিরক্তির সঙ্গেই। কারণ এই আঠা তার বিরক্তি উৎপাদনে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। আর এই কাঁঠালের আঠা নিয়ে আছে লোক গান। 'পীরিতি কাঁঠালের আঠা, লাগলে পরে ছাড়েনা।' দীনবন্ধু মিত্র লিখেছেন, 'পিরিতিতুল্য কাঁঠাল কোষ/বিচ্ছেদ আঠা লেগেছে দোষ।' এই আঠা মধ্যযুগে ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহূত হতো।
রাজা-বাদশাহ-সুলতান-সম্রাঁ, বিদেশী পর্যটকদের কাছে কাঁঠাল যে মূল্যই পাক না কেন, মধ্যযুগের বাঙালি কবির কাছে গুরুত্ব পেয়েছে সর্বাধিক। সম্পন্ন কিংবা সাধারণ বাঙ্গালীর ঘরের খাবার দাবারের তালিকায় কাঁঠাল এবং তার বিচির অবস্থান ছিল সমাদরপূর্ণ। মঙ্গলকাব্যের রন্ধননিপুণা নায়িকারা কাঁঠালের এঁচোর, মোচা এবং বিচি রান্না করতেন বেশ আগ্রহ সহকারেই। বরিশালের আগৈল ঝাড়ার মঙ্গল কাব্যের খ্যাতিমান কবি বিজয়গুপ্তের কাব্যে সওদাগরের স্ত্রী সনকা স্বামীর জন্য ষোল ব্যঞ্জন আমিষ-নিরামিষ রেঁধেছিল তাতে ছিল 'বেতাক বেগুন কাটি থুইল বাটি বাটি/ ঝিঙ্গা পোলা কড়ি ভাজে আর কাঁটাল অাঁটি।/" আবার দ্বিজ বংশীদাসের ষোড়শ শতকের (১৫৭৫) মনসামঙ্গল কাব্যে দেখা যায়, চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যযাত্রা উপলক্ষে সনকা ত্রিশ ব্যঞ্জন নিরামিষ রেঁধেছেন। যাতে ছিল, 'কাঁঠালের বীজগুলো ভাজিলেক ঘৃতে তুলি।' কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবতর্ীর চন্ডীমঙ্গলে আছে, খুলস্ননা 'চিংড়ি কাঁঠাল বিচী দিয়া' রাঁধা তরকারিতে অতিথি আপ্যায়ন করেছিল। খাবারও ছিল সুস্বাদু। রায়গুণাকর কবি ভারত চন্দে র অন্নদামঙ্গলে পদ্মমুখীর রান্নার তালিকায় রয়েছে, 'কাঁঠালের বীজ রান্ধে চিনি রসে গুড়া।' শুধু তাই নয়, আরো অন্যান্য পদ রান্নার মধ্যে ছিল 'কাতলা ভেটুক কই কাল ভাজা কোল/ শিক পোড়া ঝুড়ি কাঁঠালের বীজে ঝোল।'
বাংলা কবিতা, গান, সাহিত্য, চিত্রশিল্পে কাঁঠাল তেমন সমাদর পায়নি। অন্য ফল আবেদন নিয়ে এলেও কাঁঠালের গুণপনার কদর হয়নি। ফলে বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে জাতীয় ফল অনাদর থেকেছে। স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ নাথের কাঁঠাল নিয়ে আগ্রহটা তেমন ছিল না। যতোঁা আম, আতা, পেয়ারা, খেজুর ছিল। অবশ্য কাঁঠালে একেবারে আকর্ষণ ছিল না তা নয়। 'পলস্নীর মানুষ রবীন্দ নাথ' গ্রন্থে দেখি শিলাইদহের জমিদারিতে খাজনা ফাঁকি দেওয়া এক প্রজা কবির সামনে একটা গাছ পাকা কাঁঠাল রেখেই সব বকেয়া খাজনা মওকুফ পেয়েছিল। এমনিতে রবীন্দ নাথ বঙ্গদেশকে তুলনা করেছিলেন 'গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের দেশ।' সেই কবির কবিতায় কাঁঠালের গন্ধ আর মাছির ভনভন একাকার যেন। সানাই কাব্যের 'অনসূয়া' কবিতার চারটি লাইন ''কাঁঠালের ভূতি-পচা, আমারি,মাছের যত অাঁশ/রান্নাঘরের পাশ,/মরা বিড়ালের দেহ, পোঁকা নর্দমায়/বীভৎস মাছির দল ঐকতান-বাদন জমায়।" কিনু গোয়ালার গলির এক কোণায় মরা বেড়ালের ছানার পাশে কাঁঠালের এই ঠাঁই - অত্যন্ত সকরুণ বৈকি। রবীন্দ নাথ কাঁঠালকে গুরুত্ব দিয়েছেন কতোঁা, বোঝা যায় এই বাক্যে 'জবড়জং কাঁঠালে আছে বাহুল্য, নেই সৌষ্ঠব।' কাঁঠালের জন্য এমন ভর্ৎসনা আর মেলেনি। 'কাছের মানুষ রবীন্দ নাথ' গ্রন্থে নন্দগোপাল সেন গুপ্ত লিখেছেন, ''ফলের মধ্যে আমই ছিল তার প্রিয়, তার পরেই কমলা- প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন এই দুটি ফল সম্পর্কে। কাঁঠালের কথা তুলেছিলাম একদিন, বললেন, "ঘন দুধে খাজা কাঁঠাল যেন'অমিত্তির' আর কত বড় সালসা! খেয়ো হে; খেয়ে পাটি পড়ে শুয়ে থেকো- শরীলে আরাম পাবে।" এতেই স্পষ্ট হয় কাঁঠাল সম্পর্কে রবীন্দ অভিজ্ঞতা। এখানেও সেই পরিপাকতন্ত্র ও কাঁঠালের রসক্রিয়ার জটিলতা।
দ্বাদশ শতকের সংস্কৃত ভাষার কবি উমাপতি ধর, ছিলেন যিনি সেনবংশীয় রাজাদের মহামন্ত্রী। বাংলার সাধারণ মানুষের অতীব প্রয়োজনীয় ফল কাঁঠালকে অবহেলা করেননি। তবে কাঠালের পরিপাক নিয়ে তাঁর দুঃখের কমতি ছিল না। কবিতায় কাঁঠালকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, যার অর্থ দাঁড়ায়, "বড় আকার বলে, সুগন্ধ বলে, অত্যন্ত সুমিষ্ট বলে ক্ষুধাপীড়িত লোকেরা ছুটে এসে পেট ভরাবার জন্য এদেশে তোমার সেবা করেছিল। তারপর থেকে হে কাঁঠাল অত্যন্ত বোকা আমরা দিনের পর দিনেও তোমার অস্বাস্থ্যকর পরিপাক দুঃখ লক্ষ্য করিনি।" উমাপতির এই দুঃখ সব কাঁঠাল ভক্ষকদেরই বলা যায়।
রবীন্দ নাথের আগে কবি ইশ্বরগুপ্তও কাঁঠালকে গুরুত্ব দেননি। তার কাব্যে আম, আনারসসহ বাংলার ফল, ফুল, মাছ, পাখি ঠাঁই পেলেও কাঁঠাল তুচ্ছতায় পূর্ণ। বেদানা, আঙ্গুর, আনারসকে বেশ মযর্াদাই দিয়েছেন। কাঁঠাল গাছ তাকে আকর্ষণ করেনি। লিখেছেন,"কতর্াদের গালগুল্প গুড়-ক টানিয়া/ কাঁটালের গুঁড়ি প্রায় ভুঁড়ি এলাইয়া।/" এই ইশ্বরগুপ্ত আরো তুচ্ছতায় বলেছেন, "আসে রাঁড়ি যত বাড়ি হাতে পাখা মাথায় কাঁটাল।" কবির খেদ ছিল বেদানা ফলের বিচি বাদ যাওয়া নিয়ে। যত খেয়েছেন, তাতে স্বাদ মিটে না। বেদানার বিচির জন্য দুঃখ পাওয়া কবির কাঁঠাল বিচি নিয়ে আগ্রহটা ছিল, "নির্ধনের ধন মাণিক্য কাঁঠালের বড়ি/ প্রাণ চায় কাঁশি সুদ্ধ ঝোলের মধ্যে পড়ি।" কাঁঠাল ও তার বিচিকে হিন্দু বিধবাদের জন্যই রেখেছেন তিনি।
মহাকাব্যের কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কাঁঠালকে মযর্াদা দিয়েছেন অবশ্যই। লিখেছেন 'কাঁঠাল, যার ফলে স্বর্ণকণা শোভে শত শত, ধনদের গৃহে যেন।" ইশ্বরগুপ্ত 'কাঁটাল' ব্যবহার করলেও যশোরের মধুকবি তা করেননি মধু ফলের ক্ষেত্রে।
স্বামী বিবেকানন্দ ফলপ্রিয় ছিলেন। যে কারণে দেখি গুরুদক্ষিণা হিসেবে একাধিক ভক্তকে কাঁঠাল কিংবা লিচু দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিদেশিনী শিষ্যাকে কাঁঠালের বিস্তৃত প্রশস্তি্ত গেয়ে কখনো সখনো পত্র লিখেছেন। ভগিনী নিবেদিতাও কাঁঠাল পছন্দ করতেন। মধ্যযুগে এমনকি গত বিশ শতকেও কাঁঠালের একটা ভিন্ন মযর্াদা ছিল। 'কোলভরা অগুণতি সন্তান কামনার' প্রতীক হিসেবে হিন্দু সমপ্রদায়ের মধ্যে ষষ্ঠীব্রতে বা জামাই ষষ্ঠীতে কাঁঠাল ছিল অবশ্য প্রদেয়। শ্বশুরবাড়ি থেকে অন্যান্য ফলের সাথে গ্রীষ্মের মধুমাসে জামাতাকে ফলফলাদি পাঠানো হতো। তবে জ্যৈষ্ঠে জামাতাকে ফলাহার করানো মোক্ষম পার্বণ এখনো বিদ্যমান; সামাজিক কদর কাঁঠালের কমে গেলেও। পরিকল্পিত পরিবার যুগে অগুণতি সন্তান কামনা আর করা হয় না। ফলে কাঁঠাল এই ক্ষেত্রে গৌরবহারা। উপঢৌকন মযর্াদা বাড়ায় না আর।
কাঁঠালকে বেশ মযর্াদা দিয়েছিলেন লেখক পরশুরাম। তার বিশ্বাস বাঙালির শত উপেক্ষা অবহেলা সয়েও কাঁঠাল পূর্ণ মযর্াদা পাবেই। কিন্তু বহু সময় পেরিয়ে গেলেও কাঁঠাল সমাজমনস্ক হতে পারেনি। বরং প্রতি পদে পদে জুটছে অবমূল্যায়ন। পরশুরামের বিখ্যাত 'রাতারাতি' গল্পের চরিত্র কেদার চট্টোপাধ্যায়ের সংলাপের মধ্য দিয়ে কাঁঠালের গরিমা তুলে ধরা হয়েছে, "তারপর ধরুন কাঁঠাল। ফলের রাজা হচ্ছে কাঁঠাল, দু'মণ পর্যন্ত ওজন হয়। এক একটি কোয়া এক এক পো, কাঁচা সোনার বর্ণ ভাইটামিনে টইটম্বুর। গালে দিয়ে এদিক-ওদিক করে রস অনুভব করুন। তারপর চোখ বুঝে একটি চাপ দিন, অবলীলাক্রমে গন্তব্যস্থানে পেঁৗছে যাবে। কোথা লাগে আপনাদের কালিয়া-কোপ্তা-কোমর্া। হেন বস্তু নেই; যা কাঁঠালে পাবেন না। গুঁড়ি চিরুন-তক্তা হবে। পাতা পাকিয়ে নিন হুকো পরাবার উত্তম নল হবে। ফলের তো কথাই নেই। কাঁচার কালিয়া খান, যেন পাঁঠা। কোলে তুলে নিয়ে বাজান, পাখওয়াজের কাজ করবে। বিচি পুড়িয়ে খান; যেন কাবুলি মেওয়া।" বাঙ্গালী একমাত্র লেখক, যিনি কাঁঠালতত্ব তুলে ধরেছেন। পরিপাকতন্ত্রের দোহাই দিয়ে কাঁঠালকে দূরে সরিয়ে দেননি। বরং বাঙালি গৃহস্থের সহস্র বছরের প্রাচীন ফলটিকে আরো আদরণীয়, আরো সমাজমনস্ক করতে চেয়েছিলেন।
রবীন্দ পরবতর্ী যুগে ফল কাঁঠাল আর সমাদর পায়নি বাঙালি কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীদের কাছে। গল্প উপন্যাসেও কাঁঠালের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। তাইতো দেখি বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, নরেন্দ নাথ মিত্র, তারাশংকরের রচনায় কাঁঠালেরা গরহাজির। কাঁঠাল বৃক্ষের কথা আছে প্রসঙ্গক্রমে। কিন্তু কাঁঠাল আর আসেনি।
ফল কাঁঠাল তেমন গুরুত্ব পায়নি, রূপসী বাংলার কবির কাছে। ঘুর্ণাক্ষরে কাঁঠাল ভাঙ্গেননি। বাংলার সব ফলফলাদি তাঁর কবিতায় মযর্াদা পেলেও ফল কাঁঠাল তা পায়নি। বরং অনেক বেশি মর্যাদা দিয়েছেন কাঁঠাল গাছকে। রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে কাঁঠাল গাছ, কাঠাল পাতারা বেশ ভালো স্থানই জুড়েছে। "তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও"- রূপসী বাংলার একনম্বর কবিতায় জীবনানন্দ দাশ থেকে যেতে চেয়েছেন এই বাংলার পারে। অনেক কিছুর জন্যই তার এই থেকে যাওয়া। কিন্তু থেকে করবেন কী? "দেখিবো কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে।" বাংলার রূপ দেখা কবির চোখে ভাসে "চারদিকে চেয়ে দেখি পলস্নবের সতূপ/ জাম-বট-কাঁঠাল-হিজলের-অশ্বত্থের করে আছে চুপ;/" একই কাব্য গ্রন্থের ২নং কবিতায় এই সব গাছেরা হাজির। পঞ্চম কবিতায় দেখি আবার "অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত।" আবার একাদশ কবিতায় অন্য ফলের সঙ্গে কাঁঠালও এসেছে "-পাঁচশো বছর আগে হয়তো বা সাতশো বছর/ কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে।/" যত বছরই কাুঁক, জীবনানন্দ মৃতু্যর ঘুমে শুয়ে থাকতে চেয়েছেন আম, জাম, হিজল, তমাল, অশ্বত্থ, বটগাছের নীচে নয়, "যখন মৃতু্যর ঘুমে শুয়ে রবো-অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে/ কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে/ দিনমানে কোন মুখ হয়তো সে শ্মশানের কাছে নাহি আসে-/ তবুও কাঁঠাল জাম বাংলার-তাহাদের ছায়া যে পড়িছে/ আমার বুকের 'পরে-/" কিন্তু জীবনানন্দ কেন কাঁঠাল গাছ বেছে নিলেন? কাঁঠাল গাছের ছায়ায় মৃতু্যর ঘুমে থাকা কবি আবার ফিরে আসতে চান এই বাংলায়। ১৪নং কবিতায় দেখি "কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিবো এ কাঁঠাল ছায়ায়।/" কিন্তু না। জীবনানন্দ আবার চলে যেতে চান অন্য কোথাও। ১৮নং কবিতায় এই একদিন চলে গেলে তারপর কি হবে? "কাঁঠাল শাখার থেকে নামি/ পাখনা ডলিবে পেঁচা এই ঘাসে-/" ২২নং কবিতায়ও এসেছে কাঁঠাল। "-বউ কথা কও আর রাঙা বউটিকে/ ডাকে নাকো- হলুদ পাখনা তার কোন যেন কাঁঠালে পলাশে/ হারায়েছে।/"
কাঁঠাল বৃক্ষ প্রসঙ্গ 'রূপসী বাংলা'য় আরো আছে, "এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে-সবচেয়ে সুন্দর করুণ/ সেখানে সবুজ ডাঙ্গা ভ'রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল/ সেখানে গাছের নাম; কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল/"। একই গ্রন্থের ২৯নং কবিতায় ফলের বনকে পাওয়া যায় "রৌদ্রের দুপুর ভরে-বারবার রোদ তার চিকন সোনালি চুল/ কাঁঠাল জামের বুকে নিঙরায়- দহে বিলে চঞ্চল আঙ্গুল/ কুলায়ে-কুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন।/" ৩৯নং কবিতায় কাঁঠাল গাছ প্রসঙ্গ দেখি "--রাত্রি ভরে এই লক্ষ্মীপেঁচা কথা কবে/ কাঁঠালের ডাল থেকে হিজলের ডালে গিয়ে করিবে আহবান / সামপানী পোকাটিরে--/" কাঁঠাল গাছ নয়, এবার শাখাকেও পাই ৬৩নং কবিতায় "ঘুম নাই-চোখে ক্লান্তি নাই/ কাঠমলিস্নকায়/ কাঁঠালি শাখায়/ করবীর বনে/"।
পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে দেখেছি, বৃষ্টি কম হলে কাঁঠাল ধরেও কম। এমনকি আকারও হয় ছোঁ। আর বৃষ্টি হলে কাঁঠাল পাকেও দ্রুত। তেমনি বড়ও হয় এবং রস নামে কোয়া বা কোষে। কাঁচা থাকতে যে কাঁঠালের ওজন দাঁড়ায় ৪০ বা ৫০ কেজি; পরিপক্ক হবার পর ওজন দাঁড়ায় ৬০ বা ৭০ কেজি আর কোষ হয়ে ওঠে রসে টইটম্বুর। বান্দরবানের আলীকদম-রুমায়, এমনকি কক্সবাজারের চকরিয়ায় ৮০ কেজি ওজনের কাঁঠাল ধরে এমন গাছও ছিল। একটি মাত্র বেঁাঁায় এতো ওজনের কাঁঠাল বেশ বিস্ময়কর। কাঁঠালের রাজ্য গাজীপুরে গাছের মগডালে ৪০ কেজি ওজনের কাঁঠাল অনেকদিন ঝুলে থাকে। ডালের ডগায়ও ঢাউস আকারের কাঁঠাল ধরে। গাজীপুরেই বিশাল বিশাল আকারের ও ওজনের কাঁঠাল ধরে এমন গাছ অনেক। টাঙ্গাইলে শতবর্ষ পুরনো কাঁঠাল গাছে প্রচুর পরিমাণে কাঁঠাল ধরার গল্প শোনা হয়েছে।
একুশ শতকের গোড়ায় কানাডাতে কাঁঠাল চেখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ বা ভারতীয় নয়; খোদ ব্রাজিল থেকে আসা। পতর্ুগীজদের কল্যাণে বাংলা থেকে কাঁঠাল ব্রাজিলে পেঁৗছলে সেখানে ব্যাপক চাষাবাদ হয়েছে। তাই রপ্তানিও হয় উত্তর আমেরিকাতেও। এই কাঁঠালকে দেখি বলা হয় 'হানি জ্যাকফ্রুট'। অনেকটা বাংলাদেশের স্বাদে-গন্ধে নরম গলা কাঁঠাল। পরিকল্পিতভাবে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেখানে কাঁঠাল উৎপাদন হয়। কাঁঠালের ইংরেজি নাম 'কাঁঠাল' করা যেতো। কিন্তু ইংরেজরা একে 'জ্যাকফ্রুট'-এ পরিণত করেছে। এর পেছনে পতর্ুগীজরাও জড়িত। তারা কাঁঠালকে জাকা বা জাকস নামকরণ করেছিল। এই নাম থেকেই কাঁঠালের কপালে জুটে গেলো 'জ্যাকফ্রুট'। বাংলাদেশে কাঁঠাল বাণিজ্য চলে নানা নিয়মে। কোথাও কাঁঠাল বন কিনে নেয় বেপারিরা। তারা সেসব কাঁঠাল বিক্রি করে আড়তে। অনেক হাত, অনেক ঘাঁ হয়ে তবে কাঁঠাল আসে শহরে। গ্রামবাংলার গৃহস্থরা নিজের গাছের কাঁঠাল পেরে বাজারে বিক্রি করে হয়তো আম কিংবা চাল ডাল কেনে এখনো।
কাঁঠালের উৎপাদন খরচ বলে কিছু নেই। বৃক্ষের রক্ষণাবেক্ষণের তেমন প্রয়োজনও হয় না। যদিও কাঁঠাল বৃক্ষে মড়ক লাগে। আবার বয়সী কাঁঠাল বৃক্ষও বিক্রি হয়ে চলে যায় করাতকলে। কাঁঠাল এবং কাঁঠাল বৃক্ষ যে হিতকর তা জানে গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষটিও। ঘরের খুঁটি হয়ে কাঁঠাল বৃক্ষটি কী নিভর্ার দাঁড়িয়ে থাকে। কাঁঠালের গুণাগুণ বর্ণনা অতীত হলেও তা থেকে নিত্যনতুন খাবার যে তৈরি হচ্ছে না, তা নয়। ৩২ পদের খাবারই তৈরি করা যায়। কচি মুছি বা এঁচোরের ভতর্া, পাকা কাঁঠালে তৈরি কাঁঠালসত্ত্ব, কাঁঠাল বড়া, পাতা পোড়া পিঠা, বিচিসিদ্ধ, বিচি ভতর্া সে তো পুরনো দিনের খাদ্য। এ যুগে কাঁঠাল দিয়ে খেজুরের গুড়ের মতো গুঁড় বানানো হয়। কাঁঠাল দিয়ে নিত্যনতুন খাবার তৈরির প্রতি আগ্রহটা বাঙ্গালীর তেমন নেই যদিও। কাঁঠালের কোষ দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা না গেলেও কাঁঠালের বিচির স্থায়িত্ব সীমের বিচির চেয়ে কম নয়। মাংসে কাঁঠালের বিচির আধিক্য নগরজীবনে বেশ জাঁকালো হলেও কাঁঠালের কোষের আবেদন নেই। মেহমানদারিতে কাঁঠাল 'নৈব নৈব চঃ'।
কিলিয়ে কাঁঠাল পাকার সেইসব সংগ্রামী লড়াকু দিন পাড়ি দেয়া হয়ে গেছে, তাও চার দশকের কাছাকাছি। আর এখনতো যুগটাই 'পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবার'। বাংলা বাগধারায় বা প্রবচন-প্রবাদে কাঁঠাল খুব মযর্াদা পায়নি। তাই কাঁঠালের চোঁড় থেকে 'ইঁচড়ে পাকা'র মতো পাকামো কাজটি হয়েছে। 'কাঁঠালের আমসত্ত্ব' বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কম হয়নি। এমনকি লোকগানেও বলা হয়েছে "না বুঝে পরমতত্ত্ব, কাঁঠালে আমসত্ত্ব, মেয়ে হয়ে ধেনু কি চরায় রে'। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের গানে দেখি 'সাধা কাঁঠাল ন খায় জামাই-বোথা লই করে টানাঁানি।' কাঁঠাল নিয়ে যেসব চুটকি জাতীয় গল্প আছে, তাতেও কাঁঠালের কদর্যতাকেই টানা হয়েছে। বাঙালীর জাতীয় ফল কাঁঠাল এতো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, হেনস্তা, উপেক্ষা, অবহেলা সয়েও বৃন্তচু্যত হয়নি। স্বমহিমায়, স্বস্থানেই আছে। তবে উপহার, উপঢৌকনের তালিকায় কাঁঠালের ঠাঁই না পাওয়া সে যে আকার আকৃতি ওজনই মুখ্য সে বলা বাহুল্য। বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে বাড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়ার ঝকমারি অনেক।
প্রশস্তি রচিত বা গীত হোক আর না হোক, কাঁঠাল জানে, তাকে গ্রীষ্মের মধুমাসে মধুরসে পূর্ণ হয়ে আসতেই হবে বাংলায়। তারপর পুরো বর্ষায় ক্ষুণি্নবৃত্তি মিটাতেই হবে তাকে, সেসব মানুষের জন্য, যাদের কাছে কাঁঠাল ধরা-ছোঁয়া থেকে দূরে নয়। কাঁঠালের গরিমা থাকুক আর না-ই থাকুক, দীর্ঘ দীর্ঘতর জীবনজুড়ে আরো সহস্র সহস্র বছর বাঙালির খাদ্য হয়ে জেগে থাকবে। কাঁঠালতলায় তখনো কুয়াশায় ভেসে এসে কবিতা লিখবেন সে সময়ের কবিরা। এ যুগের কবিদের অবহেলা মেনে নিয়ে কাঁঠাল গাছ প্রজননের গান গাইবেই। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে আবারো স্মরি 'স্বর্ণকণা শোভে শত শত'।
=======================
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ মুহম্মদ সবুর
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
বিশেষ রচনা :ওমর খৈয়াম by ড. শামসুল আলম সাঈদ নাটক- 'বিম্বিত স্বপ্নের বুদ্বুদ' by মোজাম্মেল হক নিয়োগী গল্প- 'জয়া তোমাকে একটি কথা বলবো' by জাহিদুল হক গল্প- 'নতুন বন্ধু' by আশরাফুল আলম পিনটু গল্প- 'টপকে গেল টাপ্পু' by ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ গল্প- 'নাচে বানু নাচায়রে' by আতা সরকার গল্প- 'রূপকথার মতো' by নাসির আহমেদ গল্প- 'বিয়ে' by আর্নল্ড বেনেট গল্প- 'মাদকাসক্ত' by আলী ইদ্রিস গল্প- 'বেঁটে খাটো ভালোবাসা' by রেজানুর রহমান কবর by জসীম উদ্দীন (পল্লীকবি) গল্প- 'নদীর নাম চিলমারী' by নীলু দাস গল্প- 'লাউয়ের ডগা' by নূর কামরুন নাহার গল্প- 'অপূর্ব সৃষ্টি' by পারভীন সুলতানা গল্প- 'ঊনচলিস্নশ বছর আগে' by জামাল উদ্দীন গল্প- 'সুচ' by জাফর তালুকদার গল্প- 'বাসস্ট্যান্ডে যে দাঁড়িয়েছিল' by ঝর্না রহমান গল্প- 'গন্না' by তিলোত্তমা মজুমদার গল্প- 'ঘুড়িয়াল' by শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় গল্প- 'প্রক্ষেপণ' by মোহিত কামাল গল্প- 'গন্তব্য বদল' by রফিকুর রশীদ গল্প- 'ঝড়ের রাতে' by প্রচেত গুপ্ত গল্প- 'শুধু একটি রাত' by সাইপ্রিয়েন এক্ওয়েন্সি। অনুবাদ বিপ্রদাশ বড়ুয়া গল্প- 'পিতা ও কুকুর ছানা' by হরিপদ দত্ত স্মরণ- 'শওকত ভাই : কিছু স্মৃতি' by কবীর চৌধুরী সাহিত্যালোচনা- 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পালাকারের নাটক স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ : কবি ও প্রাবন্ধিক' by রাজু আলাউদ্দিন স্মরণ- 'সিদ্ধার্থ শংকর রায়: মহৎ মানুষের মহাপ্রস্থানে by ফারুক চৌধুরী গল্প- 'ফাইভ স্টার' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গল্প- 'নূরে হাফসা কোথায় যাচ্ছে?' by আন্দালিব রাশদী
দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ মুহম্মদ সবুর
এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
No comments