রাজনৈতিক আলোচনা- 'বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি' by ফজলুল বারী

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন বাস্তুহারা! ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মঈনুল রোডের ঠিকানাটি তাঁর আর নেই। ৯ বিঘা জমির ওপর বিশাল সেই বাড়ি এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত। যদিও সরকার থেকে পাওয়া তাঁর আরেকটি বাড়ি আছে গুলশানে। পৃথক দুটি বাড়ি আছে সাভার-খিলগাঁওয়ে। শ্বশুরবাড়ির বসতভিটা আছে বগুড়ায়। পিত্রালয় আছে দিনাজপুর-ফেনীতে। ২৯ মিন্টো রোডে আছে বিরোধীদলের নেত্রীর সরকারি বাড়ি। তবু তিনি বাস্তুহারা! ঢাকা সেনানিবাসের বাড়িটি অবশ্য কখনো নিজের টাকায় কেনেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু দিন আগে মহাজোট নেতা এরশাদকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, 'স্বামী হত্যাকারীর কাছ থেকে তিনি বাড়িটি নিয়েছেন।' এর সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন উস্কে দিয়ে রাখলেন শেখ হাসিনা। এর জন্যই কি কখনো জিয়া হত্যার বিচারে উৎসাহ দেখাননি খালেদা জিয়া?
আরেকটি সত্য খবর। সেনানিবাসের বাড়িটি স্বেচ্ছায় তিনি ছাড়েনওনি। হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের কথা বলে তাঁকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করেছে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, তথা সরকার। বাড়ি হারানোর পর মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসে কেঁদেছেন খালেদা জিয়া। বিরল তাঁর এমন কান্নার ছবি। অভিযোগ করে বলেছেন, তাঁকে এক কাপড়ে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আইএসপিআর দাবি করেছে, মিথ্যা বলেছেন বিরোধীদলের নেত্রী। তাঁকে তারা জোর করে বাড়ি ছাড়া করেনি।
পাশাপাশি প্রকাশ-প্রচার করা হয়েছে ৬১ জন স্টাফ নিয়ে বিশেষ একটি বিলাসী জীবনের কথা। সাংবাদিকদের বাড়ির ভেতর নিয়ে গিয়ে তাঁর দামি সব আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বাথরুমের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে। আইএসপিআর বলেছে, বাড়ি ছাড়ার আগে সেনা সদস্যদের হুমকি দিয়ে গেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। আবার ক্ষমতায় গেলে 'লাথি মেরে তাদের চাকরি থেকে বের করে দেওয়ার' হুমকি। এসব ঘটনায় রেগেমেগে ঈদের আগ মুহূর্তে দেশে অভাবিত একটি হরতালও করে ফেলেছে বিএনপি। এগুলো এখন অবশ্য পুরনো-বাসি খবর।
নতুন খবরগুলো হচ্ছে, খালেদা জিয়া দাবি করেছেন তিনি এখন একজন বাস্তুহারা! একাধিক বাড়ি থাকা সত্ত্বেও বিএনপি চেয়ারপারসন যদি হন বাস্তুহারা, তাহলে ঢাকার বস্তিবাসী, দেশের লাখ লাখ নদীভাঙা মানুষরা কি? বিএনপি হুঁশিয়ার করে বলেছে, ভবিষ্যতে তারা এমন আন্দোলন করবে, যাতে পড়ে যাবে সরকার! যে সরকার বিরোধী দলের চেয়ারপারসনকে বাড়ি ছাড়া করে তাদের আর কোনো অবস্থাতে তারা ক্ষমতায় থাকতে দেবে না! স্বয়ং খালেদা জিয়া বলেছেন, এ সরকার আর ক্ষমতায় থাকলে ৪০ বছর পিছিয়ে যাবে দেশ। এর মানে দাঁড়ায় পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত একটি সংসদীয় সরকারকে দুই বছরের মাথায় গদি ছাড়া করে দেবে বিএনপি! কিন্তু এ সরকার এখন ক্ষমতা থেকে পড়ে গেলে খালেদা জিয়া বাড়িটি আবার ফেরত পাবেন কি না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কি হবে_এসব সাফ করে তারা বলেনি। মুখে বলা যায় না সব কথা!
সেই থার্টিন আনলাকি!
খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়া করতে সেই আনলাকি পরিচিত ১৩ অর্থাৎ থার্টিন নম্বরটিকেই বেছে নিল সরকার! নভেম্বরের ১৩ তারিখ। অবশ্য সরকারের তরফে বলার চেষ্টা হয়েছে, এ বাড়ি ছাড়ানোর বিষয়ে তারা একদম জড়িত না। রায় দিয়েছে কোর্ট। কোর্টের আদেশ বাস্তবায়ন করেছে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড!
রায়ে ৩০ দিন সময়ের মধ্যে 'অবৈধ দখলদার'কে বাড়ি ছাড়া, এর দখল বুঝে নেওয়ার কথা বলেছে হাইকোর্ট। কোর্টের রায় বলে কথা! সরকার-ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড সব সময় আইন মেনে চলে অক্ষরে অক্ষরে! সে কারণে আদালত অবমাননা হয়ে যেতে পারে বলে খালেদাকে তারা একদিন বেশি সময় দিতে চায়নি! এর জন্য আনলাকি ১৩ তারিখ দিনটিকে পর্যন্ত তারা পরোয়া করেনি! আইনের প্রতি সরকারের এমন অবিচল আস্থা (!) দেখে অনেকে মজা করে বলেছেন, আহা সব কাজেই যদি এমন নীতি-নিষ্ঠা দেখাত সরকার! অথবা সরকার কি আসলেই এমন ইমানদার!
তাড়াহুড়ায় ১২টা!
কারো কারো মতে বাড়িটি নিয়ে একটু তাড়াহুড়া দেখাতে গিয়ে গুঁতোগুঁতির পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দিয়েছে সরকার নিজে। সরকারকে একটু রয়েসয়ে চলতে হয় ধীরস্থির। কেন সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইল না সরকার! ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ বিএনপির আইনজ্ঞ নেতারা, 'কোর্টে যাই হোক, বাড়ির বিষয়টি ফয়সালা হবে রাজপথে' বলাতে কি জেদ চেপেছিল সরকারি নেতাদের মনে? সরকারের কি জেদ করা চলে? সরকারি জেদাজেদির ফল কি কখনো ভালো হয়?
অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের ক্ষেত্রেও এমন তাড়াহুড়া ছিল না শেখ হাসিনার সরকারের। জজ আদালত থেকে শুরু করে আইনের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে গেছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। এর জন্য জাতির পিতা হত্যা মামলার বিচার নিয়ে সমালোচনা-বদনামও হয়নি সরকারের। এমন কি সেই মওদুদ আহমদ, যিনি খালেদা জিয়ার হয়ে আইনমন্ত্রী হিসেবে বিচার কার্যক্রম আটকে রেখেছিলেন পাঁচ বছর, রায়ের পর তিনিও বলেছেন বা বলতে বাধ্য হয়েছেন, 'আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা'র কথা। প্রশ্ন উঠেছে সেনানিবাসের বাড়ির ক্ষেত্রেও সরকার কি তা করতে পারত না?
পাবলিক কি বিশ্বাস করেছে?
এর কারণে অনেকেরই মনে হয়েছে, বাড়িটির ক্ষেত্রে সরকার যাই বলুক পাবলিক তথা আমজনতা তা কি হান্ড্রেড পার্সেন্ট বিশ্বাস করেছে? এর সরল জবাবটি হচ্ছে, 'না'। সেনাবাহিনী, ক্যান্টনমেন্ট, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড_এসবও সরকারের বাইরের কিছু না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আল্লাহর হুকুম ছাড়া যেমন গাছের পাতা নড়ে না, তেমনি শেখ হাসিনার ইচ্ছা-পরিকল্পনা ছাড়া কি ঘটনাটি ঘটেছে? ঘটনা নিয়ে যত অসুন্দর, এর দায়দায়িত্ব কি কোনোভাবে এড়াতে পারে সরকার? বাড়ি ছাড়ানোর বিষয় নিয়ে অবশ্য ঘটনার পর থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি প্রধানমন্ত্রীর।
বন্দুক কোর্টের ঘাড়ে!
শহীদ মঈনুল রোডের বাড়িটি নিয়ে সর্বশেষ যা ঘটেছে তা অনেকের কাছে কোর্টের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার মনে হতে পারে। দোষটা কার ছিল? তা নিয়ে দুই পক্ষই দোষাদুষি করছে পরস্পরকে। সর্বশেষ তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন বিএনপির ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা! অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দাবি করেছেন, সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে হাইকোর্টের রায়ের স্থগিতাদেশ চাননি খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। তাঁদের স্থ্থগিতাদেশ না চাওয়ার বিষয়টিকে তিনি 'রহস্য-ষড়যন্ত্রমূলক' বলেছেন।
খালেদা জিয়ার পক্ষ দাবি করছে সুপ্রিম কোর্টে কোনো একটি বিষয় শুনানি শুরু হওয়া মানে হাইকোর্টের রায় স্থগিত হয়ে গেছে, এর জন্য আলাদা স্থগিতাদেশ চাওয়া লাগে না। সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টির পরবর্তী শুনানি হওয়ার কথা ২৯ নভেম্বর। এর আগে বাড়ি থেকে খালেদাকে উচ্ছেদের বিষয়টিকে তাঁরা বলেছেন আদালত অবমাননা। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতের বাইরে বিষয়টি ফয়সালার কথা বলেছেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন রাজপথে ফয়সালার কথা। সেগুলো কি আদালতের উদ্দেশে সম্মাননার ছিল?
হাইকোর্টের রায়ের স্থগিতাদেশ কেন খালেদার আইনজীবীরা চাননি? হাইকোর্টের রায়ের মেসেজ দেখে তাঁরা কি সুপ্রিম কোর্টে কি হবে বা হতে পারে, তা বুঝে গিয়েছিলেন আগেভাগে? বা সুপ্রিম কোর্টে স্থগিতাদেশ চেয়ে ব্যর্থ হতে পারার ভয় ঢুকেছিল মনে? ব্যারিস্টারের দল বিএনপির অন্যতম মুখর ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা প্রশ্নটি তোলায় তা আরো সামনে চলে এসেছে।
ব্যারিস্টার হুদা দুষেছেন খালেদার আইনজীবীদের। বলেছেন, আইনজীবীদের অপরিপক্বতার কারণে খালেদা জিয়া হারিয়েছেন ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি। ঘটনায় বেগম জিয়ার প্রতি যে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, ঈদের আগ মূহূর্তে হরতাল দিয়ে সেটি আবার নষ্ট-ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।
পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে, বাড়ি হারানোর ঘটনায় খালেদা জিয়া তাঁর আইনজীবীদের ওপর খেপেছেন। উচ্ছেদের পর গুলশানের অফিসে গিয়ে ম্যাডামের নজর পাচ্ছিলেন না মওদুদ আহমদ। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার ওপরও নাখোশ হয়েছেন খালেদা জিয়া। আর ফলশ্রুতিতে বিএনপি থেকে বহিস্কৃত হলেন এই নেতা।
কী বলেছেন প্রধান বিচারপতি?
এরপর ঘটেছে আরেক ঘটনা। ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড যখন খালেদাকে উচ্ছেদ করতে মঈনুল রোডের বাড়িতে গেছে তখন বিচারপতি টিএইচ খানের নেতৃত্বে বিএনপির আইনজীবীরা গেছেন প্রধান বিচারপতির বাড়িতে। সেখানে তাদের কী কথা হয়েছে? বা প্রধান বিচারপতি তাঁদের কী বলেছেন? ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, 'মনে হয়েছে প্রধান বিচারপতি এমন বলেছেন।' ব্যারিস্টার মওদুদ দাবি করেছেন, প্রধান বিচারপতি বলেছেন, সরকার এটা করতে পারে না। তাহলে কার কথা ঠিক? প্রধান বিচারপতির পক্ষে এ ব্যাপারে একটি বক্তব্য এলে ভালো হতো। বিএনপি এ নিয়ে আর বলাবলিতে যায়নি বা উল্টো অ্যাটর্নি জেনারেলকে 'ষড়যন্ত্রের হোতা' বলে আক্রমণ করাতে অনেকের ধারণা হয়েছে প্রধান বিচারপতি তাঁদের সে রকম কিছু বলেননি। আরেকটি বিষয়। প্রধান বিচারপতির বাড়িটিই একটি কোর্ট। বিএনপির বিজ্ঞ আইনজীবীরাই কেন সেখানে কোর্ট বসিয়ে তাঁর কাছে একটি আদেশ চাইলেন না?
মনে পড়ে?
প্রধান বিচারপতির কাছে বিএনপির লোকজনের ছুটে যাওয়া দেখে অনেকের মনে পড়েছে 'পুরনো ভয়ের দিনের কিছু কথা'। জেনারেল জিয়া তখন চূড়ান্ত করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আয়োজন। তাঁর প্রাণ বাঁচাতে বুদ্ধিজীবীরা তখন চলে যান প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন আহমদের কাছে। অবৈধ, অসাংবিধানিক সামরিক আদালতের গোপন বিচার বাতিল করতে পারতেন প্রধান বিচারপতি। সেটা ছিল একটি প্রাণ রক্ষার বিষয়। শুধু একটা বাড়ি না। কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তা করেননি বা করতে পারেননি।
আইএসপিআর : ক্যাথলিক মোর দ্যান পোপ!
আইএসপিআর। আন্তবাহিনী জনসংযোগ অধিদপ্তর। সেনাবাহিনী বা নৌসহ অন্য বাহিনীর রিপোর্ট যাঁরা করেন তাঁরা এই প্রতিষ্ঠানটিকে শুধু ভালো জানেন বললে বোধহয় কম বলা হবে। যে দিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা ধরতে তারা সিদ্ধহস্ত! কমিউনিস্টদের ব্যাপারে এক সময় এমন বলা হতো। মস্কো বা পিকিংয়ে বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরে! সাবেক বিএনপি-জামায়াত আমলের একটা অভিজ্ঞতা বলি। জাতিসংঘ বাহিনীতে থাকা বাংলাদেশ বাহিনীর রিপোর্ট করানোর জন্য একটার পর একটা মিডিয়া টিম নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বড় পত্রিকা মাঝারি পত্রিকা তো বটেই, এমনকি ফুটপাতে লাগানো থাকা সার্কুলেশন বিহীন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার রিপোর্টারও যাচ্ছিলেন। কিন্তু জনকণ্ঠে কাজ করার অপরাধে পথ বন্ধ। আওয়ামী লীগের গন্ধ জনকণ্ঠের গায়ে! কালো তালিকাভুক্ত তাই! এর পর সরকার বদলের পর সে সমস্যা আর
থাকেনি।
খালেদা জিয়ার বাড়ি ছাড়ার ঘটনা নিয়ে সেই আইএসপিআর করলটা কি! চেহারা-সুরত-আচরণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন! মিডিয়াকে রিপোর্ট দেওয়ার জন্যে অস্থায়ী মিডিয়া সেন্টার করা হয়েছে জাহাঙ্গীর গেটে! ঘণ্টায় ঘণ্টায় সেখানে হয় মিডিয়া ব্রিফিং! প্রথমে জানানো হলো আদালতের রায় মেনে নিয়ে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছেন বিরোধী দলের
নেত্রী!
সেনানিবাসের বাড়ি থেকে মালামাল সরিয়ে নিতে শুরু করার রিপোর্টও বেরোয় পত্রিকায়। বিএনপির পক্ষে রিপোর্টটি অসত্য দাবি করার পর জানানো হয়, আদালতের রায় বাস্তবায়নের অর্থাৎ বাড়ি বুঝে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগের ভোর থেকে বাড়ির চার পাশে বসানো হয় কড়া নিরাপত্তা প্রহরা। বাড়ির টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বিএনপির পক্ষে দাবি করে বলা হয়, এক রকম গৃহবন্দি তাদের নেত্রী! এর পর বাড়ির ত্রি-সীমানায় বসানো হয় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক জ্যামার। বাড়ির ৬১ জন স্টাফকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ গাড়িতে। এমন একটার পর একটা ঘটনা চলেছে রূদ্ধশ্বাস!
এরপর বাড়িচ্যুত খালেদা জিয়া চললেন গুলশানের অফিসে। সেখানে গিয়ে মিডিয়ার সামনে কাঁদলেন বিরোধী দলের নেত্রী! বললেন, তাঁকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলের নেত্রী অভিযোগ করে বলেন, প্রথমে লোহার গেট কেটে তারা ভেতরে ঢোকে। এরপর দরজা ভেঙে তাঁকে বের করে আনা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বাড়ির লোকজনের গায়ে হাত তোলা, প্রয়োজনে কোলে করে নিয়ে যাওয়ারও কথা নাকি বলেছে দখল নিতে যাওয়া লোকজন! বাড়িটি নিয়ে তাঁর ৪০ বছরের স্মৃতির কথা বলেও কাঁদলেন বিরোধী দলের নেত্রী। সেখানে কেঁদেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরাও। এরশাদের মায়ের মৃত্যু পর কাজী জাফরের কান্নার কথা মনে করেছেন কেউ কেউ।
এর পর আবার খালেদার বক্তব্যের প্রতিবাদ করল আইএসপিআর। শুধু প্রতিবাদ নয়। খালেদাকে মিথ্যাবাদীও তারা বলেছে! আইএসপিআর বলেছে, বিরোধী দলের নেত্রীকে জোর করে বের করে দেওয়ার অভিযোগটি সঠিক নয়। তাঁর সম্মান ও মর্যাদা বহাল রেখেই তারা বাস্তবায়ন করেছে আদালতের রায়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের লোকজন বাড়ির দখল নিতে গেছে সকাল আটটায়। খালেদা জিয়া বাড়ি ছেড়েছেন বিকেল তিনটার পর। জোর করা হলে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই তারা বাড়ির দখল বুঝে নিতে পারত।
উল্টো খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ এনে আইএসপিআর বলেছে, তিনি তাদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, সবার চেহারা তিনি চিনে রাখছেন। ক্ষমতায় গেলে তাদের চাকরি থেকে লাথি মেরে বের করে দেবেন বলেছেন। আইএসপিআরের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছে বিএনপি।
এরপর চূড়ান্ত বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে আইএসপিআর! খালেদার বক্তব্যের জবাব দিতে রিপোর্টারদের নিয়ে গেছে মঈনুল রোডের বাড়ির ভেতরে। তুলে ধরা হয়েছে বিরোধী দলের নেত্রীর বিলাসবহুল জীবনচিত্র। তাঁর দামি সব আসবাব, বসার ঘর, রিডিংরুম, শয়নকক্ষ, টয়লেট-বাথরুম কিছুই বাদ যায়নি। ছবিগুলো আসলেই ছিল সুন্দর। বিরোধী দলের নেত্রীর রুচির পরিচয়বাহী। বিদেশের বাড়িঘরের অনেক কিছুই প্রায় এক রকম। কিন্তু বাংলাদেশ গরিব দেশ তো। তাই বিষয়টি ইস্যু হয়েছে। এসব প্রচার নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ধানমণ্ডির বাড়িটি কি করে বানালেন বা শেখ হাসিনার পরমাণুবিজ্ঞানী প্রয়াত স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া কি করে সুধা সদন বানালেন, এসবের তথ্য-উপাত্ত প্রকাশেরও দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন।
কাঁদলেন যে খালেদা জিয়া!
একটি বাড়ির জন্যে কেঁদেছেন খালেদা জিয়া! তাঁর এই ছবিটি অনেক দিন অনেকের মনে থাকবে। বাড়িটা নিয়ে তাঁর ৪০ বছরের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে খুব স্বাভাবিক তিনি আবেগ সামাল দিতে পারেননি। কিন্তু এর সঙ্গে আরো যে প্রশ্ন চলে আসবে তা কি অবজ্ঞা করা যাবে? শেখ হাসিনাও তো বরাদ্দ নিয়েছিলেন গণভবনের। কিন্তু এ নিয়ে সমালোচনা ওঠায় নির্বাচনের আগেভাগে মান-সম্মান অটুট থাকতে সেটি ছেড়ে চলে গেছেন স্বামীর বাড়ি সুধা সদনে। এর পর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে সেটির বরাদ্দ বাতিল করেন। আওয়ামী লীগ এবার ক্ষমতায় এসে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির বরাদ্দ বাতিলের পরপর সেটি ছেড়ে যাওয়াটা কি তাঁর জন্য সম্মানজনক হতো না! বিশেষ কারো ভরসায় কি তিনি বহাল রাখতে চেয়েছিলেন বাড়ির দখল?
আরেকটি কথা। বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তা একই সরকারি বাড়িতে থাকতে থাকতে চাকরি থেকে বিদায় নেন। অথবা তাঁর বা তাঁদের চাকরিতে থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে সংশ্লিষ্ট বাড়িটি নিয়ে পরিবারগুলো স্মৃতিকাতর হয়। এমন কোনো স্ত্রী বা সন্তান যদি তেমন একটি বাড়ি কি রাষ্ট্রের কাছে চাইতে পারেন? বা তাঁদের বাড়িটায় বড়জোর কয় দিন থাকতে দেওয়া হয়? খালেদা জিয়ার মতো ভাগ্যবতীই বা কয় জন দেশে আছেন? যাঁরা একাধিক সরকারি বাড়ি বরাদ্দ পেয়েছেন বিনামূল্যে?
বাড়িটির এখন কি হবে?
শহীদ মঈনুল রোডের বাড়িটি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের আগে বলা হয়েছিল, সেখানে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত অফিসারদের পরিবারগুলোকে ফ্ল্যাট তৈরি করে দেওয়া হবে। মামলাটি কোর্টে চলার সময় অ্যাটর্নি জেনারেলও এমন কথা বলেছেন। এখন বলা হচ্ছে, সেখানে ফ্ল্যাট তৈরি করা হবে সেনা অফিসারদের জন্য। অনেকে বলা শুরু করেছেন, হাইকোর্টের রায়ের পর সরকারি বক্তব্য-চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, এ ধরনের বাড়ি যেগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি তা রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান বা কেউ কাউকে দিতে পারেন না। এ যুক্তিতে লিজ আবেদনটিকেই অবৈধ বলেছে হাইকোর্ট।
ডেটলাইন ২৯ নভেম্বর!
আগামী ২৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে কী হবে তা নিয়েও জল্পনা আছে। এর মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট খালেদার পক্ষে রায় দিলে তিনি ফেরত পাবেন বাড়ি। এমনই যদি হয় তাহলে সরকার তো সুপ্রিম কোর্টের শুনানি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত! রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এভাবেই কথা বলে যাবেন নিরন্তর! বা সরকার যেটি করে ফেলেছে এর বিরুদ্ধে কি সাংঘর্ষিক পথে যাবে সুপ্রিমকোর্ট? এমন বিশ্বাস করার লোক বুঝি খুব বেশি পাওয়া যাবে না। এমন নানা ভালোমন্দের ভেতর একটি সান্ত্বনা পুরস্কার নিতে পারে বিএনপি। তাহলো অতঃপর ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এসেছেন তাঁদের নেত্রী। এখন তারা তাঁর কাছ থেকে আরো বেশি সময় পাবেন। গত ২৭ বছরে তারা যা পায়নি।
=========================
আলোচনা- 'খাদ্যনিরাপত্তা ও পশুসম্পদ' by ড. মো. সিদ আলোচনা- 'আমি বাস্তুহারা'_এ কথার মানে কী?' by এ এন রাশেদা  গল্পালোচনা- 'বাংলাদেশকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র' by মোস্তফা কামাল  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের যন্ত্রণা এবং নতুন মুক্তিযোদ্ধা সনদ' by হারুন হাবীব  খবর ও ফিচার- কয়েন-কাহিনী  প্রকৃতি- 'বৈরিতায় বিপন্ন বাঘ' by বিপ্লব রহমান  প্রকৃতি- 'সুন্দরবন ঘেঁষে রেললাইন!' by পার্থ সারথি দাস  খবর- কোরীয় সীমান্তে ব্যাপক গোলাবিনিময়ে নিহত ২  শিল্প-অর্থনীতি 'চামড়াশিল্প শিগগিরই সরছে না' by আলী আসিফ  ফিচার- ‘র‌্যাগিং : পৌষ মাস না সর্বনাশ?' by সমুদ্র সৈকত  ভর্তি এবার লটারিতে! by হাবিবুর রহমান তারেক ও তমাল আবদুল কাইয়ুম  আলোচনা- 'পেট্রোবাংলার ভূমিকা এবং কিছু প্রশ্ন' by ড. এম শামসুল আলম  আন্তর্জাতিক- 'যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকনীতি ইরানকে বিজয়ী করছে' by ফয়সাল আমিন ইস্ত্রাবাদি  আলোচনা- 'ইভ টিজিং : দায়ী কে?' by ফখরে আলম  কল্প গল্প- '...আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে!' by আলী আলী হাবিব  রাজনৈতিক আলোচনা- ''উচিত কথায় ননদ বেজার, গরম ভাতে ভাতে বিলাই (বিড়াল)' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী  প্রকৃতি- 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষশত্রু' by মেহেদী উল্লাহ  ইতিহাস- 'ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর আসন' by সৈয়দ আবুল মকসুদ



কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ফজলুল বারী


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.