আলোচনা- 'খাদ্যনিরাপত্তা ও পশুসম্পদ' by ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান

মানবসভ্যতার সূচনা হয়েছিল কৃষিকাজের মাধ্যমে। বর্তমানেও কৃষির উন্নয়ন ছাড়া বিশ্বের সিংহভাগ দেশেরই উন্নয়ন কোনোভাবে সম্ভব নয়। কৃষি একদিকে যেমন জনগণের খাদ্য জোগায়, অন্যদিকে শিল্পকারখানার চাকা সচল রাখতে শিল্পের কাঁচামালেরও জোগান দেয়। কৃষির মাধ্যমে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, শিল্পের বাজার সৃষ্টি, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, পরনির্ভরশীলতা হ্রাস, জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, খাদ্য সরবরাহসহ আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি বৃদ্ধি পায়।
আর কৃষি বললে শুধু জমিতে চাষাবাদ ও ফসল উৎপাদনই বোঝায় না_গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ পালন, হাঁস-মুরগির খামার ও লালন-পালন ইত্যাদিসহ প্রকৃতির সরাসরি সহযোগিতায় মানুষের কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে এমন নানা কাজ সম্পাদনকে বোঝায়। বাংলাদেশের জনগণের প্রায় ৮০ শতাংশের কর্মসংস্থান হয় কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজের মাধ্যমে এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের মাধ্যমে আমাদের ক্ষুনি্নবৃত্তি করে এ কৃষি এবং এর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত। কিন্তু এই যে কৃষি, যা আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখছে, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করছে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, শিল্পের কাঁচামালের জোগান দিয়ে দেশকে শিল্পসমৃদ্ধ করছে, সর্বোপরি আমাদের জীবনের দৈনন্দিন চাহিদা মিটিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করছে, এর রক্ষণাবেক্ষণ বা নিরাপত্তায় আমরা কতটুকু সচেতন?
খাদ্যনিরাপত্তা বলতে আমরা বুঝি ক্ষুধার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি মানুষের পুষ্টির জোগান দেয় এমন প্রতিটি উপাদানের সুষ্ঠু উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, সব সময় সব মানুষের কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যচাহিদার বিপরীতে পছন্দমতো পর্যাপ্ত নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যপ্রাপ্তির বাস্তব ও আর্থিক ক্ষমতা থাকার নাম খাদ্যনিরাপত্তা।
খাদ্যনিরাপত্তা অর্জিত হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো জাতীয় পর্যায়ে খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং সময় ও অঞ্চলভেদে সরবরাহের স্থিতিশীলতা, যাতে প্রত্যেক মানুষের খাদ্য সংগ্রহের সুযোগ থাকবে এবং পরিবারের সব সদস্যের পুষ্টি চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের নিশ্চয়তা থাকবে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘি্নত হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তবতা এবং অভিঘাত হবে নানামুখী ও সুুদূরপ্রসারী, এটি আজ সর্বজনবিদিত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিঘাতের মুখোমুখি হচ্ছে যেসব দেশ, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম এবং এর ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প ইত্যাদির প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধির ফলে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি এবং বিভিন্ন ফসল বেশি বেশি রোগাক্রান্ত হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। এতে কৃষি, বন ও মৎস্যসম্পদের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে এবং খাদ্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, নদীভাঙন ইত্যাদি নানা কারণে প্রতিবছরই চাষযোগ্য জমি কমছে। বর্তমানে দেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৮২.৯০ লাখ হেক্টর। উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততার কারণে কমছে ২২০ হেক্টর জমি। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩২ শতাংশ। জন্মহার এ অনুপাতে অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে এ দেশের জনসংখ্যা হবে ২৮ কোটি। কমছে জমি, বাড়ছে মানুষ, ফলে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনে বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে।
কৃষি খাতের অন্যতম খাত হচ্ছে পশুসম্পদ। বাংলাদেশসহ বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার লক্ষ্যে এ পশুসম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ প্রত্যেক মানুষের ছয়টি পুষ্টিজাতীয় উপাদানের (যথা_শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও পানি) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আমিষ। FAO-এর মতে, একজন মানুষের প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য আমিষের প্রয়োজন হয় এক গ্রাম এবং দৈহিক চাহিদা অনুযায়ী মোট আমিষের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ করা অতীব প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে প্রসূতি মা ও শিশুদের খাদ্যের অর্ধেক বা দুই-তৃতীয়াংশ আমিষ প্রাণিজ উৎস থেকে হওয়া বাঞ্ছনীয়। উন্নত বিশ্বে জনপ্রতি আমিষের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ প্রাণিজ আমিষ থেকে সরবরাহ করা হয় অথচ বাংলাদেশে এর পরিমাণ মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রতি চারজন মানুষের মধ্যে একজন খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী দেশের ৫০ শতাংশ পরিবার বছরের প্রায় সময়ই খাদ্য সংকটে থাকে, ২৫ শতাংশ পরিবার সব সময় খাদ্য সংকটে থাকে, ১৫ শতাংশ পরিবার পরবর্তী বেলার খাবার নিয়ে চিন্তিত থাকে এবং সাত শতাংশ মানুষ কখনোই তিন বেলা খেতে পায় না। সব ধরনের খাদ্য প্রয়োজনের তুলনায় কমে যাওয়ায় আমাদের দেশের জনগণের বেশির ভাগই অপুষ্টির শিকারে পরিণত হচ্ছে। এই প্রাণিজ আমিষের বেশির ভাগ চাহিদা মেটানো হয় গবাদিপশু থেকে উৎপাদিত (দুধ, মাংস) পণ্য থেকে। এ আমিষের অভাবের ফলে খাদ্যের উপাদানের নিরাপত্তা ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে মানুষ অপুষ্টির শিকার হয়, শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়, পুষ্টিহীনতার ফলে রোগব্যাধির প্রকোপ বেশি হয় এবং মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়, মেধা ও মনের বিকাশ অসম্পূর্ণ থাকে। বিশ্বের অন্যান্য গরিব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে এ সমস্যা প্রকট।
খাদ্যনিরাপত্তা অর্জিত হওয়ার অন্যতম একটি শর্ত হলো পুষ্টির চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের নিশ্চয়তা। গবাদিপশু থেকে উৎপাদিত ও প্রাপ্ত প্রাণিজ আমিষের সহজলভ্যতা ও পুষ্টির সঠিক মানের ওপরও খাদ্যের নিরাপত্তা বিশেষভাবে জড়িত। এ নিরাপত্তা বিঘি্নত হয় গবাদিপশুর রোগবালাই ও অব্যবস্থাপনার ওপর। কিছু রোগ শুধু উৎপাদনই ব্যাহত করে না, পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে মানুষের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তাও বিনষ্ট করে। এসব রোগের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ হলো গবাদিপশুর ব্রুসেলোসিস রোগ। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ এবং Brucella abortus দিয়ে সাধারণত গরু, Brucella mutitensis দিয়ে ছাগল ও ভেঁড়া, Brucella suis দিয়ে শূকর এবং Brucella canis দিয়ে কুকুর আক্রান্ত হয়। এ রোগ গরু, ছাগল, ভেড়া ও শূকরের গর্ভাবস্থার শেষের দিকে গর্ভপাত ঘটায়। এ ছাড়া দুধ উৎপাদন হ্রাস, বাচ্চার মৃত্যু, প্রজননে সমস্যা, গর্ভফুল আটকে যাওয়া, জরায়ু প্রদাহ ও প্রজনন অক্ষমতা প্রভৃতি উপসর্গ প্রকাশের মাধ্যমে এ রোগটি প্রতিবছর বাংলাদেশে ৬০ মিলিয়ন টাকা আর্থিক ক্ষতিসাধন করে খাদ্যনিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো কখনো ব্রুসেলোসিস রোগে আক্রান্ত গাভির জীবিত বাচ্চা হয়, তবে বেশির ভাগ বাচ্চা হয় দুর্বল, অপরিপক্ব এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জীবাণুর জটিলতায় তীব্র প্রকৃতির জরায়ু প্রদাহ হয় বলে সেপ্টিসেমিয়া হয়ে গাভির মৃত্যু হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্ব দেখা দেয়। ষাঁড়ের ক্ষেত্রে এ জীবাণুর সংক্রমণে অর্কাইটিস, এপিডিডাইমাইটিস ও অন্যান্য জনন অঙ্গের প্রদাহে এসব অঙ্গ স্ফীত ও ব্যথাপূর্ণ হয়। আক্রান্ত পশুর কাঁচা দুধ, অল্প তাপে দুধ খাওয়ার মাধ্যমে অথবা নির্গত পদার্থ বা আক্রান্ত প্রাণীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংস্পর্শে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ও শিশুদের এ রোগ হতে পারে। ব্রুসেলোসিস রোগের উল্লেখযোগ্য খারাপ দিকটি হলো, এ রোগের জীবাণু কোষের একেবারে ভেতরে থাকায় এন্টিবায়োটিক দিয়েও চিকিৎসায় তেমন ফল পাওয়া যায় না এবং একবার কোনো খামার ব্রুসেলোসিস রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে একসময় সম্পূর্ণ খামারটি আক্রান্ত হতে পারে।
বাংলাদেশে রক্ত থেকে সেরোলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে ১৯৭০ সালে গরুতে, ১৯৮৩ সালে মানুষে, ১৯৮৮ সালে ছাগলে এবং ১৯৯৭ সালে মহিষে ব্রুসেলোসিস শনাক্ত করা হয়েছে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্রুসেলোসিসের ওপর গবেষণা করে এ দেশের বিভিন্ন জেলায় গরু, ভেড়া ও ছাগলের ব্রুসেলোসিস শনাক্ত করেছি। আমাদের দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ মানুষের খুবই সংস্পর্শে থাকে এবং তাঁর মতে, পশুসম্পদের উল্লেখযোগ্য ক্ষতির পাশাপাশি গ্রামীণ মহিলা, ক্ষুদ্র কৃষক, কসাই, গোয়াল, ভেটেরিনারিয়ানদেরও এ রোগে আক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। তাই খাদ্য ও মানুষের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিঘি্নতকারী এ রোগের ওপর আরো বেশি গবেষণা ও রোগের প্রকোপ হ্রাসের ব্যবস্থার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি অতীব জরুরি এবং কিছু বড় ধরনের অবকাঠামোগত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে, যার মাধ্যমে পশুসম্পদসহ কৃষির উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। ফলে আমাদের দেশ হবে আরো বেশি সমৃদ্ধিশালী ও কৃষিসম্পদে উন্নত।
========================
আলোচনা- 'আমি বাস্তুহারা'_এ কথার মানে কী?' by এ এন রাশেদা  গল্পালোচনা- 'বাংলাদেশকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র' by মোস্তফা কামাল  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের যন্ত্রণা এবং নতুন মুক্তিযোদ্ধা সনদ' by হারুন হাবীব  খবর ও ফিচার- কয়েন-কাহিনী  প্রকৃতি- 'বৈরিতায় বিপন্ন বাঘ' by বিপ্লব রহমান  প্রকৃতি- 'সুন্দরবন ঘেঁষে রেললাইন!' by পার্থ সারথি দাস  খবর- কোরীয় সীমান্তে ব্যাপক গোলাবিনিময়ে নিহত ২  শিল্প-অর্থনীতি 'চামড়াশিল্প শিগগিরই সরছে না' by আলী আসিফ  ফিচার- ‘র‌্যাগিং : পৌষ মাস না সর্বনাশ?' by সমুদ্র সৈকত  ভর্তি এবার লটারিতে! by হাবিবুর রহমান তারেক ও তমাল আবদুল কাইয়ুম  আলোচনা- 'পেট্রোবাংলার ভূমিকা এবং কিছু প্রশ্ন' by ড. এম শামসুল আলম  আন্তর্জাতিক- 'যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকনীতি ইরানকে বিজয়ী করছে' by ফয়সাল আমিন ইস্ত্রাবাদি  আলোচনা- 'ইভ টিজিং : দায়ী কে?' by ফখরে আলম  কল্প গল্প- '...আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে!' by আলী আলী হাবিব  রাজনৈতিক আলোচনা- ''উচিত কথায় ননদ বেজার, গরম ভাতে ভাতে বিলাই (বিড়াল)' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী  প্রকৃতি- 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষশত্রু' by মেহেদী উল্লাহ  ইতিহাস- 'ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর আসন' by সৈয়দ আবুল মকসুদ


কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান
বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.