প্রকৃতি- 'সুন্দরবন ঘেঁষে রেললাইন!' by পার্থ সারথি দাস

বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন ঘেঁষে রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যশোরের নাভারণ থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এ রেললাইন যাবে সুন্দরবনসংলগ্ন মুন্সীগঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত। বন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ লাইন বসাতে বনাঞ্চলের অনেক গাছ কাটতে হবে, অসংখ্য চিংড়ি ঘেরও ধ্বংস হয়ে যাবে। নিয়মিত রেল চলাচলের শব্দে বন্য প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়ও ব্যাঘাত ঘটবে। বিপন্ন হবে বনের পরিবেশ-প্রতিবেশ। দেশের পরিবেশবিদরা এ উদ্যোগে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। নজরকাড়া এ বনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় চলছে সরকারি-বেসরকারি জোর তৎপরতা। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে ভোট দেওয়ার উন্মাদনাও এখন দেশজুড়ে। এ অবস্থায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে এ রেলপথ তৈরির উদ্দেশ্যে একাধিক বৈঠক হয়েছে। এ বিষয়ে সর্বশেষ গত ১১ নভেম্বর বৈঠক করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, সড়ক ও রেলপথের অন্যান্য জরুরি উন্নয়ন প্রকল্পে যখন গতি নেই, তখন সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমানের চাপে এ কাজ গতি পাচ্ছে। তবে শেখ মুজিবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, এ রেললাইন নির্মাণ করা হলে সুন্দরবনে বছরে আরো ৩০ থেকে ৫০ হাজার পর্যটক বেড়ে যাবে। লাইনটি নির্মিত হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ট্রেনের শব্দে বন্য প্রাণীর আচরণে ব্যাঘাত ঘটবে কেন? তিনি বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনেক অর্থ প্রয়োজন হবে। এ জন্য বিদেশি সহায়তার প্রয়োজন।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, নিরপেক্ষভাবে পরিবেশের প্রভাব নিরূপণ করে এবং নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর মতামত নিয়েই এ প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। কোনো বনের মধ্য দিয়ে রেললাইন হতে পারে না। সিলেট অঞ্চলের লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে রেললাইন বসানোর কারণে দুর্লভ প্রাণীরা এখন বহুদূরে সরে গেছে। বনের পরিবেশ থাকবে নীরব ও শান্ত। এ পরিবেশই প্রাণীরা ভালোবাসে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান দিলীপ কুমার দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, এ এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। তবে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ঠিক রেখে তা করতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক আবু নাছের খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বন ধ্বংস করার জন্য একটি রাস্তা তৈরি করাই যথেষ্ট। রেললাইনটি কেন বনের ধারে নির্মাণ করতে হবে, তা বুঝতে পারছি না। বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্য সুন্দবনের পাশে এ লাইন নির্মাণ করা উচিত নয়।
পরিবেশবিদ পাভেল পার্থ কালের কণ্ঠকে বলেন, বন্য প্রাণীবিষয়ক আইনে বলা হয়েছে, প্রাণীদের বিরক্ত করা যাবে না। মূল বন থেকে একটু দূরে হলেও রেললাইনটি দিয়ে কী ধরনের ট্রেন চলবে এবং কী ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করা হবে, এর ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। জ্বালানি ও বর্জ্যের কারণে সুন্দরবনের নদীগুলো দূষিত হয়ে যাবে। ট্রেনের শব্দও প্রাণীদের বিরক্ত করবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, যশোরের শার্শা উপজেলার নাভারণ থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত এ রেললাইনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি শুরু হবে যশোরের নাভারণ থেকে, শেষ হবে মুন্সীগঞ্জে। মুন্সীগঞ্জের এ অংশ থেকে মূল সুন্দরবন যাওয়া যায় একটি নদী পাড়ি দিলেই। মুন্সীগঞ্জ হচ্ছে সুন্দরবনেরই একটি পয়েন্ট। মুন্সীগঞ্জের চুনা নদীর ওপারেই গভীর বনাঞ্চল। দেশের রেলপথহীন ২০ জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রস্তাব তোলা হয়েছে।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবটি আসে চলতি বছরের প্রথম দিকে। সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান এ জন্য একটি ডিও লেটারও দেন। এর পরই প্রস্তাবটি সামনে রেখে গত ১৬ মে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে সভা হয়। সভায় এ নতুন রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এতে খরচ ধরা হয় প্রায় দুই কোটি টাকা (১৯৮ দশমিক ৭৫ লাখ টাকা)। ১ জুলাই থেকে শুরু করে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সমীক্ষাটি শেষ করার প্রস্তাব করা হয়। এর পরই এটিকে একটি বিনিয়োগ প্রকল্প হিসেবে গ্রহণের কথা বলা হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে এই সম্ভাব্যতা যাচাই
শুরু হয়নি। বিষয়টির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব জানান, নতুন রেলপথ নির্মাণের এ প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এরপর গত ২০ সেপ্টেম্বর যোগাযোগসচিব মোজাম্মেল হক খানের সভাপতিত্বে এ-সংক্রান্ত সভা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, রেলপথ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। সভায় আন্তর্জাতিক ও দেশি পরামর্শকদের নিয়োগ দিয়ে সমীক্ষাটি করার প্রস্তাব করা হয়।
সভায় সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রসঙ্গে উপস্থিত বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, এ বনে দুর্লভ জীববৈচিত্র্য বিদ্যমান। সমীক্ষা করতে হবে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি না করে। তবে এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ লাইন নির্মাণ করতে রেলপথ বরাবর ৫০ ফুট প্রশস্ত বন কাটতে হবে। এ ছাড়া নিয়মিত রেল চলাচলে পশু-পাখির জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটবে।
সভায় একজন প্রতিনিধি জানান, স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে সংগৃহীত চিত্র অনুযায়ী প্রস্তাবিত রেলরুটে গভীর বন রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য চিংড়ি ঘের। রেললাইন নির্মাণ করা হলে এসব বন ও ঘের নষ্ট হবে।
জানা গেছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরামর্শকদের সমন্বয়ে টার্মস অব রেফারেন্স তৈরি করে এ সমীক্ষা করতে হবে। এর আগে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে লিখিত মতামত চাওয়া হয়েছে। ২০ সেপ্টেম্বরের সভার দুই সপ্তাহের মধ্যে কোনো মতামত না পাওয়ায় কাজের অগ্রগতি হচ্ছে না_এ অভিযোগ করে গত ৫ অক্টোবর রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন পরিকল্পনা কর্মকর্তা-২ নাজনীন আরা কেয়া যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় মতামত দেওয়ার তাগিদ দিয়ে এখন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠাবে বলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এখনো কোনো মতামত না দেওয়ায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প ছক (ডিপিপি) তৈরি করতে পারছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১১ নভেম্বর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বন অধিদপ্তর ও রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা করেছে। সভায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের একাধিক প্রতিনিধি সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য হওয়ায় এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করার পরামর্শ দেন। সভায় অংশ নেওয়া মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে গতকাল সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রস্তাবিত রেললাইনের মুন্সীগঞ্জ পয়েন্টের পাশেই সুন্দরবন এলাকা। এ রেললাইন স্থাপন করা হলে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, রেলপথ না করে এখানে নৌপথ সম্প্রসারণ করা যায়। সরকার খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেললাইনের একটি প্রকল্পও নিচ্ছে। এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সুন্দরবনের পর্যটক বাড়ানো সম্ভব। এসব দিকে নজর না দিয়ে এ রেলপথ নির্মাণের ব্যাপারে ওপর থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
ওই সভায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও একাধিক কর্মকর্তা আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকার জীববৈচিত্র্য, বন্য প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষা_এই তিন বিষয়ে বিশেষ নজর রাখার সুপারিশ করা হয়।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, এত বড় বিষয় নিয়ে স্বল্প সময়ে লিখিত মতামত তৈরি করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই তাঁরা দুই সপ্তাহের মধ্যে কোনো মতামত জানাননি। ওই কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা মতামত জানতে বন অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি। তারা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর মতামত তৈরি করে আমাদের কাছে পাঠাবে। এর পরই আমরা সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।'
রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন পরিকল্পনা কর্মকর্তা-২ নাজনীন আরা কেয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সুন্দরবনে পর্যটক বাড়াতে ও তাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য এ রেললাইনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সুন্দরবন থেকে একটু দূরে এ রেললাইন স্থাপনের ব্যাপারে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোনো লিখিত মতামত আসেনি। আমরা এ মতামতের অপেক্ষায় আছি।'
=========================
খবর- কোরীয় সীমান্তে ব্যাপক গোলাবিনিময়ে নিহত ২  শিল্প-অর্থনীতি 'চামড়াশিল্প শিগগিরই সরছে না' by আলী আসিফ  ফিচার- ‘র‌্যাগিং : পৌষ মাস না সর্বনাশ?' by সমুদ্র সৈকত  ভর্তি এবার লটারিতে! by হাবিবুর রহমান তারেক ও তমাল আবদুল কাইয়ুম  আলোচনা- 'পেট্রোবাংলার ভূমিকা এবং কিছু প্রশ্ন' by ড. এম শামসুল আলম  আন্তর্জাতিক- 'যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকনীতি ইরানকে বিজয়ী করছে' by ফয়সাল আমিন ইস্ত্রাবাদি  আলোচনা- 'ইভ টিজিং : দায়ী কে?' by ফখরে আলম  কল্প গল্প- '...আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে!' by আলী আলী হাবিব  রাজনৈতিক আলোচনা- ''উচিত কথায় ননদ বেজার, গরম ভাতে ভাতে বিলাই (বিড়াল)' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী  প্রকৃতি- 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষশত্রু' by মেহেদী উল্লাহ  ইতিহাস- 'ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর আসন' by সৈয়দ আবুল মকসুদ  ইতিহাস- 'টিকে থাকুক ‘টেগর লজ’' by আশীষ-উর-রহমান  আলোচনা- 'কর্মশক্তি ও টাকার অপচয়!' by রোজিনা ইসলাম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আশির দশকে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন' by আবুল কাসেম ফজলুল হক  আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব আকাশচুম্বী' by ড. নিয়াজ আহম্মেদ  ইতিহাস- 'প্রত্যন্ত জনপদে ইতিহাস-সঙ্গী হয়ে' by সাযযাদ কাদির  আন্তর্জাতিক- 'জাতিসংঘ বনাম যুক্তরাষ্ট্র' by শহিদুল শহিদুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ?' by মহসীন মহসীন হাবিব  স্বাস্থ্য আলোচনা- 'প্রসূতিসেবায় পিছিয়ে দেশ' by শেখ সাবিহা আলম


কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ পার্থ সারথি দাস


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.