আলোচনা- 'আমি বাস্তুহারা'_এ কথার মানে কী?' by এ এন রাশেদা

'বাস্তু' মানে বহুকালের বসতভূমি বা পুরুষানুক্রমে যে বাড়িতে বাস করা হয়; অভিধান সে কথাই বলে। বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির সভানেত্রী খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের বলেছেন, 'আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি আজ বাস্তুহারা।' কোনো এক পত্রিকায় দেখলাম গৃহহারা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে এ দেশের এক কোটি মানুষ প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে সীমান্তের ওপারে বাস্তুহারা হয়ে যে কী পরিমাণ দুঃখকষ্টের মধ্যে দিন যাপন করেছেন, কখনো-বা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বসবাস করে কলেরায় শিশু-সন্তানহারা হয়েছেন, কেউ মাতৃহারা-পিতৃহারা হয়েছেন, কেউবা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে চলে গেছেন_খালেদা জিয়া মনে হয় তা কখনোই জানার চেষ্টা করেননি।
তিনি জানার চেষ্টা করেননি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় কত লাখ মানুষ সব কিছু হারিয়ে বাস্তুহারা হয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশে এসেছিল আবার বাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু থেকে কত লাখ মানুষ ভারতে গিয়েছিল, কত লাখ তাজা প্রাণ বলি হয়েছিল, মানুষ কত সহায়সম্পদহীন হয়েছিল, কত অবর্ণনীয় যন্ত্রণার সাগর পাড়ি দিয়েছিল_এ সবই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। তিনি তা পাঠের সময় হয়তো কখনো পাননি। তিনি হতভাগ্য উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের ইতিহাসও হয়তো পড়েননি। ৬০ বছর ধরে তারা কী মানবেতর জীবনযাপন করে চলেছে। অথচ বিরোধীদলীয় নেতা যখন বলেন, আমি বাস্তুহারা বা গৃহহারা তখন মনে হয় এ দেশে আজও যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে লাখ লাখ বা হাজারো মানুষ গৃহহারা হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে অশেষ কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে, তাদের উপহাস করা হচ্ছে। গৃহহারার যে কী যন্ত্রণা তা তিনি বুঝবেন না। কারণ ঢাকা শহরেই তাঁর আছে আরো একটি অট্টালিকা, যাকে প্রাসাদোপম বলাই ভালো। আছে সরকারি বাসভবনও। তাহলে তিনি গৃহহারা হন কিভাবে? গৃহ তো আছেই। তবে যেখানে ছিলেন সেখানে নেই_এটি হলো বাস্তবতা।
তিনি একটি সস্তা সেন্টিমেন্ট কাজ করাতে চান_এ দেশে অনেকেই সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। যেমন ধরুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, কৃষি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর। এখানে অনেকেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ থেকে ৪০ বছর বসবাস করেন। কত স্মৃতিই তো তাদের গড়ে ওঠে। আবার একসময় সবাইকে চলে যেতে হয়। এটাই নিয়ম। কেউ কেউ ওইসব কোয়ার্টারে চাকরি থাকা অবস্থায়ই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা যিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সরকারের নিয়মকানুন তাঁর জানা থাকার কথা বা তাঁর আইনজীবীদের। যেমন সরকারি প্লট বরাদ্দের সময় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কিছু নীতিমালা, যা তাঁরা প্লট কেনায় আগ্রহীদের দিয়ে থাকে। '...এই মর্মে হলফনামা প্রদান করিতে হইবে যে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এলাকার কোথায়ও আপনার নিজের নামে, স্ত্রী/স্বামী, নির্ভরশীল ছেলেমেয়ে অথবা পোষ্যের নামে কোনো আবাসিক জমি বা বাড়ি খরিদ কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে নাই অথবা সরকার বা কোনো সংস্থা কর্তৃক কোনো আবাসিক জমি অথবা বাড়ি বরাদ্দ/লিজ প্রদান করা হয় নাই।'_এই হলো সরকারি নিয়ম, যা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। তাহলে এসব নিয়ম কি শুধু সাধারণ জনগণের জন্য? দেশকে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়ে সুখী-সমৃদ্ধরূপে গড়ে তোলার আশ্বাসবাণী জনগণকে শোনান_তাঁদের জন্য কি নয়?
আবার প্রশ্ন_যাঁরা সরকারি সম্পত্তিকে নিজের বলে দাবি করে হরতালের নামে জনগণের ভোগান্তি বাড়ান, অশেষ ক্লেশ ও দৈন্যের মধ্যে নিপতিত করেন, তাঁরা কী করে রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক দলের চালিকাশক্তি হন? মানুষের কোনো সংজ্ঞার মধ্যে তাঁরা পড়েন? মানুষের থাকবে নীতি-নৈতিকতা, বিবেকবোধ, মনুষ্যত্ব, লোভ-ক্রোধ সংবরণের ক্ষমতা ইত্যাদি। অথচ দেখা গেল, একটি বাড়ির লোভসংবরণ করতে না পেরে কর্মীদের উন্মত্ত করা হলো, রাস্তার যানবাহন, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ভস্মীভূত করা হলো, ঈদের ছুটিতে ঘরমুখো লাখো মানুষকে বর্ণনাতীত দুর্দশার মধ্যে ফেলা হলো। আবার হরতাল ডাকা হলো। অন্যদিকে একটি সরকারি বাড়ি নিজের দখলে রাখতে না পারার কারণে সংবাদ সম্মেলন করে চোখের পানি মুছে কোন মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটানো হলো? অথচ তাঁরই শাসনামলে ২০০৫ সালে লক্ষাধিক মানুষ যখন সেই পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি, ফসলি জমি রক্ষার জন্য আন্দোলন করছিলেন ফুলবাড়িয়ায়, প্রাণও দিয়েছিলেন, আদমজীর মতো হাজার হাজার মানুষের ৫০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা থেকে শ্রকিদের চাকরিচ্যুত করে স্কুল-কলেজ, দোকানপাটসহ কয়েক লাখ মানুষের রুটি-রুজি বন্ধ করে দেওয়ার ফলে কাঁদতে কাঁদতে স্কুল-ছাত্রীরা, আহাজারি করতে করতে শ্রমিক ও তাঁদের স্ত্রীরা অনির্দিষ্টের পথে পা বাড়িয়েছিল_তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং আজকের বিরোধীদলীয় নেতার চোখে কোনো পানি জমেছিল কি? ২০০৪ সালে বন্যার তাণ্ডবে যখন মানুষ গৃহহারা, দিশেহারা তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সঠিক সময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন কি? ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফের বুদ্ধি শুনে বিএডিসির হাজারো কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হলে তাদের আর্তনাদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে নাড়া দিয়েছিল কি? এমন শত শত উদাহরণ দেওয়া যায়। জোর যার মল্লুক তার_বাগধারাকে বাস্তবায়নের জন্য রাস্তায় এর ফয়সলার হুংকার দিয়েছেন। দিয়েছেন সরকার পতনের আন্দোলনেরও। রাজনীতি করার কারণ আজ সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। 'আমি বাস্তুহারা'_বলার কারণও।
============================
গল্পালোচনা- 'বাংলাদেশকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র' by মোস্তফা কামাল  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের যন্ত্রণা এবং নতুন মুক্তিযোদ্ধা সনদ' by হারুন হাবীব  খবর ও ফিচার- কয়েন-কাহিনী  প্রকৃতি- 'বৈরিতায় বিপন্ন বাঘ' by বিপ্লব রহমান  প্রকৃতি- 'সুন্দরবন ঘেঁষে রেললাইন!' by পার্থ সারথি দাস  খবর- কোরীয় সীমান্তে ব্যাপক গোলাবিনিময়ে নিহত ২  শিল্প-অর্থনীতি 'চামড়াশিল্প শিগগিরই সরছে না' by আলী আসিফ  ফিচার- ‘র‌্যাগিং : পৌষ মাস না সর্বনাশ?' by সমুদ্র সৈকত  ভর্তি এবার লটারিতে! by হাবিবুর রহমান তারেক ও তমাল আবদুল কাইয়ুম  আলোচনা- 'পেট্রোবাংলার ভূমিকা এবং কিছু প্রশ্ন' by ড. এম শামসুল আলম  আন্তর্জাতিক- 'যুক্তরাষ্ট্রের ইরাকনীতি ইরানকে বিজয়ী করছে' by ফয়সাল আমিন ইস্ত্রাবাদি  আলোচনা- 'ইভ টিজিং : দায়ী কে?' by ফখরে আলম  কল্প গল্প- '...আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে!' by আলী আলী হাবিব  রাজনৈতিক আলোচনা- ''উচিত কথায় ননদ বেজার, গরম ভাতে ভাতে বিলাই (বিড়াল)' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী  প্রকৃতি- 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষশত্রু' by মেহেদী উল্লাহ  ইতিহাস- 'ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর আসন' by সৈয়দ আবুল মকসুদ  ইতিহাস- 'টিকে থাকুক ‘টেগর লজ’' by আশীষ-উর-রহমান  আলোচনা- 'কর্মশক্তি ও টাকার অপচয়!' by রোজিনা ইসলাম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আশির দশকে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন' by আবুল কাসেম ফজলুল হক  আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব আকাশচুম্বী' by ড. নিয়াজ আহম্মেদ  ইতিহাস- 'প্রত্যন্ত জনপদে ইতিহাস-সঙ্গী হয়ে' by সাযযাদ কাদির


কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ এ এন রাশেদা
শিক্ষা গবেষক


এই গল্পালোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.