পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার দায়িত্ব কার by মো. জামাত খান
দেশের একটি জনপদ রাজশাহী, সবুজ ছায়াঘেরা বনবীথিকায় সাজানো। বাংলার প্রাচীনতম সভ্যতার পীঠস্থান, আউলিয়া-দরবেশ, সাধু-সন্ত, রাজা শাহ-সুলতানদের আবাসভূমি এই জেলা। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন রাজবংশ-শাসিত পুন্ড্রবর্ধনভুক্তি আজ নেই। সুলতানি আমল আজ বিস্মৃতির কোঠায়। কিন্তু এখনো রয়েছে বরেন্দ্রীয় প্রাণকেন্দ্র পদ্মা, মহানন্দা, আত্রাই, বড়াল, বারনই, কর্ণহার বড়বিলা, ফকিরনি, মুসা খাঁ, ছোটবড় খালবিলসহ বিধৌত নিশ্চিত একটি শান্তির ঠিকানা—বিভাগীয় শহর রাজশাহী।
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থেকে বাঘা পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কিলোমিটার এলাকায় পদ্মা নদীবিধৌত ২০ লাখ লোকের বাস। এসব মানুষ সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জীবন-অর্থনীতি, ধর্ম-সংস্কৃতি—সবকিছুর সঙ্গেই পদ্মার নিবিড় সম্পর্ক। কালের বিবর্তনে পদ্মার সেই রূপ-প্রাচুর্য আর নেই। প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পদ্মা এখন মরা নদীতে পরিণত হতে চলেছে।
১৯৭৪ সালের আগ পর্যন্ত পদ্মা ছিল খরস্রোতা। পানির কোনো অভাব ছিল না। নদীতে নৌকা-স্টিমারসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচল করত। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে রাজশাহীর ব্যবসা-বাণিজ্য ত্বরান্বিত হয়েছে। একসময় পদ্মা নদী ছিল শুধুই নদী। ‘নদীটা ছোট থাকলেও ভাঙতে ভাঙতে বড় হয়ে গেছে। ৩০ বছর আগেও বর্ষাকালে নদীর গর্জন ছিল ভয়ংকর, এক কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যেত পদ্মার সেই গর্জন। শুষ্ক মৌসুমেও ছিল প্রচণ্ড স্রোত। বড় বড় নৌকা-স্টিমার চলত। বিভিন্ন স্থান থেকে নানা জাতের পণ্য আনা-নেওয়া হতো। রাজশাহী মহানগরের পাচানিমাঠ ও দরগাপাড়ায় স্টিমার-লঞ্চ এসে ভিড়ত। ওই সময় তালাইমারী জাহাজঘাট জমজমাট থাকত। এখন তা শুধুই স্মৃতি। ওই সময় পদ্মার গর্জন নদী তীরবর্তী মানুষকে ভীত করত আর এখন ভীত করছে নদী শুকিয়ে যাওয়া।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে সংগৃহীত ২০ বছরের (১৯৮৩-২০০২) উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমে পানিতলের উচ্চতা ১৭-২০ মিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির গভীরতা ৭-১০ মিটার। পানিতলের এই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উচ্চতার অনুপাত ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রায় একই থাকলেও পরবর্তী সময়ে এই অনুপাতের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এতে প্রতীয়মান হয় যে পদ্মা নদীতে সঞ্চিত অতিরিক্ত পলি নদীতলের উচ্চতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানির পরিমাণ কম থাকলেও এর উচ্চতা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের ‘রেকর্ডস অব দ্য জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ’-এর ভলিউম-৬ পার্ট-১-এর ‘জিওলজিক্যাল ম্যাপ অ্যান্ড রিপোর্ট অব দ্য ওয়েস্টার্ন পার্ট অব রাজশাহী ডিস্ট্রিক্ট বাংলাদেশ’-এ বলা হয়েছে, পদ্মা নদী তীরবর্তী এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা পদ্মা নদীর পানির উচ্চতার ওপর নির্ভরশীল। বর্ষাকালে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সংলগ্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা যেমন বাড়ে, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানির উচ্চতা হ্রাস পেলে এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যায়। এর ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের খাল, বিল, পুকুর, ডোবা, খাড়ি ইত্যাদি পানিশূন্য হয়ে পড়ে। দেখা দেয় খাবার পানির তীব্র সংকট।
বর্তমান সরকার দেশের ১৯টি নদী সংস্কারের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে রাজশাহীর পদ্মা নদী ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পদ্মা নদীসংলগ্ন রাজশাহীর লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এবং এই অঞ্চলকে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য রাজশাহীসংলগ্ন পদ্মা নদী সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি। সামনে আসছে খরা মৌসুম। পদ্মা নদীতে জেগে উঠেছে বড় বড় বালুর চর। এতে পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাবে। এ অঞ্চলের মানুষ আশ্রয়ের জন্য খুঁজবে শীতল পরিবেশ। শহর ও গ্রামে তখন থাকবে না পানির লেয়ার। মানুষের খাবার ও প্রয়োজনীয় কাজে দেখা দেবে পানির সংকট আর কৃষকদের আবাদি জমিতে সেচের জন্য সময়মতো পাওয়া যাবে না পানি। বাড়বে প্রচণ্ড রোদের দাবদাহ। এই সমস্যা সমাধানের প্রতিকার চেয়ে ‘পদ্মা বাঁচাও, রাজশাহী বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ ২২ জুলাই ২০০৯ সব রাজনৈতিক দল, সাংসদ, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে রাজশাহীতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। গত ২০ ডিসেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রীকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। এমনকি এ বিষয়টি নিয়ে মহান জাতীয় সংসদে রাজশাহী-২ আসনের সাংসদ সরকারের কাছে পদ্মা নদীর ড্রেজিংয়ের আবেদন করেছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত রাজশাহীর পদ্মা নদীর নাব্যতা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কি না—এ অঞ্চলের মানুষ তা অবগত নয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজশাহীর মানুষের অনেক প্রত্যাশা ছিল, দেশ পরিচালনার জন্য দায়িত্ব নেওয়ার পর বঞ্চিত রাজশাহীবাসীর উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করবে। এ অঞ্চলের উন্নয়ন করে নদী, খাল-বিল ও কৃষিপ্রধান অঞ্চলকে মরূকরণের হাত থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু সরকারের এক বছর সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও সুষম উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে রাজশাহী।
রাজশাহীবিধৌত পদ্মা নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এ অঞ্চলের মানুষের তা প্রাণের দাবি।
মো. জামাত খাঁন: আহ্বায়ক, রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ।
রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থেকে বাঘা পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কিলোমিটার এলাকায় পদ্মা নদীবিধৌত ২০ লাখ লোকের বাস। এসব মানুষ সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জীবন-অর্থনীতি, ধর্ম-সংস্কৃতি—সবকিছুর সঙ্গেই পদ্মার নিবিড় সম্পর্ক। কালের বিবর্তনে পদ্মার সেই রূপ-প্রাচুর্য আর নেই। প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পদ্মা এখন মরা নদীতে পরিণত হতে চলেছে।
১৯৭৪ সালের আগ পর্যন্ত পদ্মা ছিল খরস্রোতা। পানির কোনো অভাব ছিল না। নদীতে নৌকা-স্টিমারসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচল করত। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে রাজশাহীর ব্যবসা-বাণিজ্য ত্বরান্বিত হয়েছে। একসময় পদ্মা নদী ছিল শুধুই নদী। ‘নদীটা ছোট থাকলেও ভাঙতে ভাঙতে বড় হয়ে গেছে। ৩০ বছর আগেও বর্ষাকালে নদীর গর্জন ছিল ভয়ংকর, এক কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যেত পদ্মার সেই গর্জন। শুষ্ক মৌসুমেও ছিল প্রচণ্ড স্রোত। বড় বড় নৌকা-স্টিমার চলত। বিভিন্ন স্থান থেকে নানা জাতের পণ্য আনা-নেওয়া হতো। রাজশাহী মহানগরের পাচানিমাঠ ও দরগাপাড়ায় স্টিমার-লঞ্চ এসে ভিড়ত। ওই সময় তালাইমারী জাহাজঘাট জমজমাট থাকত। এখন তা শুধুই স্মৃতি। ওই সময় পদ্মার গর্জন নদী তীরবর্তী মানুষকে ভীত করত আর এখন ভীত করছে নদী শুকিয়ে যাওয়া।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে সংগৃহীত ২০ বছরের (১৯৮৩-২০০২) উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমে পানিতলের উচ্চতা ১৭-২০ মিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির গভীরতা ৭-১০ মিটার। পানিতলের এই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উচ্চতার অনুপাত ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রায় একই থাকলেও পরবর্তী সময়ে এই অনুপাতের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এতে প্রতীয়মান হয় যে পদ্মা নদীতে সঞ্চিত অতিরিক্ত পলি নদীতলের উচ্চতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানির পরিমাণ কম থাকলেও এর উচ্চতা বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের ‘রেকর্ডস অব দ্য জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ’-এর ভলিউম-৬ পার্ট-১-এর ‘জিওলজিক্যাল ম্যাপ অ্যান্ড রিপোর্ট অব দ্য ওয়েস্টার্ন পার্ট অব রাজশাহী ডিস্ট্রিক্ট বাংলাদেশ’-এ বলা হয়েছে, পদ্মা নদী তীরবর্তী এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা পদ্মা নদীর পানির উচ্চতার ওপর নির্ভরশীল। বর্ষাকালে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সংলগ্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা যেমন বাড়ে, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে পদ্মায় পানির উচ্চতা হ্রাস পেলে এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যায়। এর ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের খাল, বিল, পুকুর, ডোবা, খাড়ি ইত্যাদি পানিশূন্য হয়ে পড়ে। দেখা দেয় খাবার পানির তীব্র সংকট।
বর্তমান সরকার দেশের ১৯টি নদী সংস্কারের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে রাজশাহীর পদ্মা নদী ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পদ্মা নদীসংলগ্ন রাজশাহীর লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এবং এই অঞ্চলকে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য রাজশাহীসংলগ্ন পদ্মা নদী সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি। সামনে আসছে খরা মৌসুম। পদ্মা নদীতে জেগে উঠেছে বড় বড় বালুর চর। এতে পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাবে। এ অঞ্চলের মানুষ আশ্রয়ের জন্য খুঁজবে শীতল পরিবেশ। শহর ও গ্রামে তখন থাকবে না পানির লেয়ার। মানুষের খাবার ও প্রয়োজনীয় কাজে দেখা দেবে পানির সংকট আর কৃষকদের আবাদি জমিতে সেচের জন্য সময়মতো পাওয়া যাবে না পানি। বাড়বে প্রচণ্ড রোদের দাবদাহ। এই সমস্যা সমাধানের প্রতিকার চেয়ে ‘পদ্মা বাঁচাও, রাজশাহী বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ ২২ জুলাই ২০০৯ সব রাজনৈতিক দল, সাংসদ, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে রাজশাহীতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। গত ২০ ডিসেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রীকে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। এমনকি এ বিষয়টি নিয়ে মহান জাতীয় সংসদে রাজশাহী-২ আসনের সাংসদ সরকারের কাছে পদ্মা নদীর ড্রেজিংয়ের আবেদন করেছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এখন পর্যন্ত রাজশাহীর পদ্মা নদীর নাব্যতা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে কি না—এ অঞ্চলের মানুষ তা অবগত নয়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজশাহীর মানুষের অনেক প্রত্যাশা ছিল, দেশ পরিচালনার জন্য দায়িত্ব নেওয়ার পর বঞ্চিত রাজশাহীবাসীর উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করবে। এ অঞ্চলের উন্নয়ন করে নদী, খাল-বিল ও কৃষিপ্রধান অঞ্চলকে মরূকরণের হাত থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু সরকারের এক বছর সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও সুষম উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে রাজশাহী।
রাজশাহীবিধৌত পদ্মা নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এ অঞ্চলের মানুষের তা প্রাণের দাবি।
মো. জামাত খাঁন: আহ্বায়ক, রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ।
No comments