সব পক্ষ মিলেমিশে দুর্নীতি করে -বিলুপ্ত ট্রুথ কমিশন by মনজুর রশীদ খান
দেশের তৃণমূল পর্যায়ে জনসেবা-সংশ্লিষ্ট সরকারের অনেক বিভাগ রয়েছে, তার একটি জমি রেজিস্ট্রেশন বিভাগ। উপজেলা স্তরে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দুর্নীতির কথা সুবিদিত হলেও তা নিয়ে তেমন কথা ওঠে না। সাব-রেজিস্ট্রাররা তাঁদের কর্মক্ষেত্রের দুর্নীতি বিস্তৃতির কথা স্বীকার করেন। যে কয়জন অনুকম্পাপ্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ অনেক। সরকার-নির্ধারিত ফির বাইরে তাঁরা যা নেন, তা ঘুষ হিসেবে মনে করেন না। এর আদায়-প্রক্রিয়া নিখুঁত এবং এমন সুন্দরভাবে বণ্টন করা হয় যে তাতে সবাই তৃপ্ত থাকেন। তাঁরা যথেষ্ট কৌশলে অর্থবিত্তের আইনি সংরক্ষণ করে থাকেন, যা বের করা কঠিন। বাড়তি ফির বাইরে আরও সুযোগ আছে, যেমন একজনের জমি আরেকজনের নামে দলিল করে দিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ কামাই করা। দেশের কতগুলো বিশেষ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের চাকরি সোনার খনি হাতে পাওয়ার মতো (ঢাকার তেজগাঁও অন্যতম)। তাদের বদলি-বাণিজ্য যে কী বড় মাত্রায় ঘটে থাকে তার কিছু চিত্র বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রকাশ পেলে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য, একজন সাবেক উপদেষ্টা (যিনি সাবেক বিচারপতি) ও তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দুদকে মামলা হয়। বদলি-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত কয়েকজন সাব-রেজিস্ট্রারের অবৈধ অর্থ উপার্জনের কীর্তিকাহিনি শোনার সুযোগ হয়েছিল। সেই বাণিজ্যের এক হোতাও এসেছিলেন অনুকম্পাপ্রার্থী হয়ে। তাঁর আইনজীবী তাঁকে এমনভাবে উপস্থিত করান যে তিনি যেন মানসিক ভারসাম্যহীন ও স্মৃতিশক্তি লোপপ্রাপ্ত, তাই অনুকম্পাযোগ্য। (তিনি অনুকম্পা পাননি, মামলাটি দুদকে ফেরত পাঠানো হয়)। দেশের উপজেলা ও জেলা শহরের যে সাব-রেজিস্ট্রাররা অনুকম্পাপ্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগের স্বীকৃত অর্থ-সম্পদের পরিমাণ কোটি টাকার ওপর ছিল। ভেবে দেখুন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এসব অফিসে চাকরি করে অবৈধ উপার্জনের কী চমত্কার সুযোগ বিদ্যমান। কেমন নিয়ন্ত্রণহীন, কৈফিয়তহীন, শৃঙ্খলাহীন পরিবেশ থাকলে কোনো সরকারি দপ্তরে এসব চলতে পারে। এমনই অবস্থা বিরাজ করছে বন বিভাগে। এঁদের অধিকাংশ ব্যক্তিই বিপুল অর্থবিত্তের অধিকারী হতে বেশি সময় লাগে না।
স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আসা আত্মস্বীকৃত ব্যক্তিদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের কাহিনি শুনতে বসে দেখলাম, অতি দ্রুত ধনী হওয়ার মোহে আকৃষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে যেমন রয়েছেন সুশিক্ষিত, সুমার্জিত, মেধাবান, দায়িত্ববান কর্মকর্তা তেমনি রয়েছেন স্বল্পশিক্ষিত, আধাশিক্ষিত, অতি চতুর (কিছু অতি বোকাও) শ্রেণীর কর্মচারী। অবৈধ অর্জন বা উপরি নেওয়ার প্রতি তাঁরা একদিনে ঝুঁকে পড়েননি। তাঁদের মহলে যে সংস্কৃতি চালু আছে, তাতে কারও মনে অপরাধবোধ জাগার অবকাশ নেই। বরং দ্রুত বিত্তশালী হওয়ার প্রবল প্রতিযোগিতা রয়েছে। স্ত্রীদের মনে কোনো সন্দেহই স্থান পায় না যে অবৈধ উপার্জন চলছে। পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে স্ত্রীরা অবৈধ অর্জনে অনেক ক্ষেত্রেই সহায়ক ছিলেন। একজন মধ্যম স্তরের কর্মকর্তা সোজাসুজি বলেই ফেললেন যে স্ত্রীর চাপে পড়ে তিনি ঘুষ নিতেন। (উল্লেখ্য, অবৈধ সম্পদের মালিকানায় নাম ছিল বলে কমিশনে অনেক অনুকম্পাপ্রার্থীর স্ত্রীরাও উপস্থিত হন)। লোভ-লালসা যে মানুষকে অন্ধ করে ফেলে, তার একটি নজির উল্লেখ করছি। এক কর্মকর্তা তাঁর অসত্ভাবে উপার্জিত টাকার একটি অংশ শাশুড়ির নামে তাঁর অজান্তে ব্যাংকে রেখেছিলেন। শিক্ষিত পর্দানশিন মহিলা এক স্কুলের প্রধান শিক্ষিক। মামলা হওয়ার আগে তিনি জানতেন না। মানসম্মান হারিয়ে আবেগ ও লজ্জায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। জামাতা স্বীকার করেন যে ঘুষের টাকা শাশুড়িকে না জানিয়ে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেখে তাঁকে জেল খাটার ব্যবস্থা করেছেন। মামলায় পড়েছেন এমন কয়েকজন ঠিকাদার স্বীকার করেন যে অস্বচ্ছ-অসাধু ব্যবস্থার মধ্যে সব মেনেই তাঁরা কাজ করে আসছেন। বোধগম্য কারণ নিম্নমানের কাজ করে বেশি লাভ করার সুযোগ। তবে এমনও একজন ছিলেন যিনি ইতিমধ্যেই ঠিকাদারি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। জোর দিয়ে বললেন যে এমন ব্যবসা আর কখনো করবেন না, যেখানে ঘুষ দিতে হয়, যা দেওয়াটাও হারাম। তিনি সেবার হজে গেলেন।
যে ৪৫২ জন অনুকম্পাপ্রার্থী কমিশনে হাজির হয়েছিলেন, তার এক-চতুর্থাংশ ছিলেন স্বল্পবেতনের চাকরিজীবী, শিক্ষক, ছোটখাটো ব্যবসা বা কৃষিজীবী নিম্নআয়ের লোক। সরকারের উচ্চ ও মধ্যম পদধারী কর্মকর্তা এবং কিছু ছোট চাকরিজীবী হয়েও অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে বিত্তশালী হয়েছেন এমন প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি ছিল। যে এক-চতুর্থাংশের কথা বলছি, তাঁদের বেশির ভাগের ঘুষ বা অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ সার্বিক বিবেচনায় সামান্যই ধরা যায়। অনেকেই অবস্থানের বা অবস্থার শিকার হয়েছেন, কেউ লোভে পড়ে অসত্ পথে টাকা কামাইয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। গ্রাম্য দলাদলির শিকার হওয়া লোকও আছেন। তাঁরা পুলিশ, র্যাব বা যৌথ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মামলায় পড়েছেন। তাঁদের অভিযোগগুলোর বেশির ভাগই মামুলি প্রকৃতির। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে যে শাস্তি পেতেন, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি শাস্তি এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন। দুই থেকে ১২ মাস হাজতবাস হয়ে গেছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। এক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ চেক জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। প্রায় বছরখানেক জেলে ছিলেন। তাঁর দাবি, এক উপজেলা কর্মকর্তাকে মাদ্রাসার উন্নয়নকাজে কমিশন না দেওয়ায় জাল স্বাক্ষরে চেক ভাঙানোর চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে আটক করা হয়। তিনি ট্রুথ কমিশনে যখন আসেন, তখন মামলার প্রায় ১১ বছর পার হয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে ১০ জন আইও তদন্তকাজে বদলি হলেও কেউই শেষ করেননি। শেষমেশ মামলা দুদকে গেলে এই কমিশনে আসার আবেদন করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও কিছু অনুকম্পাপ্রার্থী এসেছেন, যাঁরা দরিদ্র ও নিরীহ শ্রেণীর। আমরা দেখেছি, যাঁরা ট্রুথ কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছেন, তাঁদের সবাই যে দুর্নীতিবাজ তা নয়। অনেকেই পুলিশের হয়রানি, গ্রেপ্তার হওয়া, দিনের পর দিন আদালতে যাওয়া-আসা, আইনজীবীদের পেছনে ঘোরা প্রভৃতির মতো শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে অপরাধ না করেও স্বীকার করে অর্থদণ্ড দিয়ে ভোগান্তির অবসান করতে চেয়েছেন। এক কর্মকর্তা জানান, তিনি কোনো অপরাধ করেননি, তবু অপরাধ স্বীকার করে অনুকম্পা পেতে এসেছেন। চার বছর আগে দুর্নীতি দমন ব্যুরো তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করলে তিনি সাময়িক বরখাস্ত হন। তারপর কোনো তদন্ত হয়নি, তাঁকে কখনো ডাকাও হয়নি। দুবার তিনি প্রমোশন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এবার অনুকম্পা পেলে প্রমোশন পেতে পারেন। দুটি গ্যাস কোম্পানির শতাধিক কর্মচারী অনুকম্পাপ্রার্থী হয়েছেন। মিটাররিডার ও সমশ্রেণীর কর্মচারীদের দুই-একজন ছাড়া বাকি ব্যক্তিরা যেভাবে যে পরিমাণে উপরি নিয়েছেন, তা অন্য ব্যক্তিদের তুলনায় নগণ্যই বলা যায়। এসব লোক গ্রাহকদের হয়রানির কথা স্বীকার করেন না, তবে সেবা দিয়ে সন্তুষ্ট করে উপরিটা নেন বলে দাবি করেন। স্বীকার করেছেন যে গ্যাসের কানেকশন বা বিল কমানোর জন্য টাকা নিতেন। একজন এমনই অনুতপ্ত যে তিনি যে পরিমাণ সম্পত্তি জমা দেবেন বলে টাস্কফোর্সের কাছে লিখে দিয়েছেন, এখন তিনি তার চেয়েও বেশি দেবেন। কেন এখন বেশি দেবেন কারণ জানতে চাইলে বলেন, তিনি মাসে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা নিতেন। সে হিসাবে ১৬/১৭ বছরের আট লাখ টাকা হয়। তাঁর দেওয়া অঙ্গীকারনামা মতে ছয় লাখ টাকা দিলেই হবে বললেও তিনি সম্মত হননি। শেষমেশ সাত লাখ টাকা দিলেন। এক লাখ কম এ জন্য যে সে টাকা তিনি ধার নিয়েছেন। যে বাড়ি করেছিলেন তা ছয় লাখ টাকায় এরই মধ্যে বিক্রি করেছেন। এ ব্যক্তি দায়মুক্ত হয়ে সেবার হজে যান।
মনজুর রশীদ খান: অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল; সদস্য, বিলুপ্ত সত্য ও জবাবদিহি কমিশন।
স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আসা আত্মস্বীকৃত ব্যক্তিদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের কাহিনি শুনতে বসে দেখলাম, অতি দ্রুত ধনী হওয়ার মোহে আকৃষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে যেমন রয়েছেন সুশিক্ষিত, সুমার্জিত, মেধাবান, দায়িত্ববান কর্মকর্তা তেমনি রয়েছেন স্বল্পশিক্ষিত, আধাশিক্ষিত, অতি চতুর (কিছু অতি বোকাও) শ্রেণীর কর্মচারী। অবৈধ অর্জন বা উপরি নেওয়ার প্রতি তাঁরা একদিনে ঝুঁকে পড়েননি। তাঁদের মহলে যে সংস্কৃতি চালু আছে, তাতে কারও মনে অপরাধবোধ জাগার অবকাশ নেই। বরং দ্রুত বিত্তশালী হওয়ার প্রবল প্রতিযোগিতা রয়েছে। স্ত্রীদের মনে কোনো সন্দেহই স্থান পায় না যে অবৈধ উপার্জন চলছে। পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে স্ত্রীরা অবৈধ অর্জনে অনেক ক্ষেত্রেই সহায়ক ছিলেন। একজন মধ্যম স্তরের কর্মকর্তা সোজাসুজি বলেই ফেললেন যে স্ত্রীর চাপে পড়ে তিনি ঘুষ নিতেন। (উল্লেখ্য, অবৈধ সম্পদের মালিকানায় নাম ছিল বলে কমিশনে অনেক অনুকম্পাপ্রার্থীর স্ত্রীরাও উপস্থিত হন)। লোভ-লালসা যে মানুষকে অন্ধ করে ফেলে, তার একটি নজির উল্লেখ করছি। এক কর্মকর্তা তাঁর অসত্ভাবে উপার্জিত টাকার একটি অংশ শাশুড়ির নামে তাঁর অজান্তে ব্যাংকে রেখেছিলেন। শিক্ষিত পর্দানশিন মহিলা এক স্কুলের প্রধান শিক্ষিক। মামলা হওয়ার আগে তিনি জানতেন না। মানসম্মান হারিয়ে আবেগ ও লজ্জায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। জামাতা স্বীকার করেন যে ঘুষের টাকা শাশুড়িকে না জানিয়ে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেখে তাঁকে জেল খাটার ব্যবস্থা করেছেন। মামলায় পড়েছেন এমন কয়েকজন ঠিকাদার স্বীকার করেন যে অস্বচ্ছ-অসাধু ব্যবস্থার মধ্যে সব মেনেই তাঁরা কাজ করে আসছেন। বোধগম্য কারণ নিম্নমানের কাজ করে বেশি লাভ করার সুযোগ। তবে এমনও একজন ছিলেন যিনি ইতিমধ্যেই ঠিকাদারি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। জোর দিয়ে বললেন যে এমন ব্যবসা আর কখনো করবেন না, যেখানে ঘুষ দিতে হয়, যা দেওয়াটাও হারাম। তিনি সেবার হজে গেলেন।
যে ৪৫২ জন অনুকম্পাপ্রার্থী কমিশনে হাজির হয়েছিলেন, তার এক-চতুর্থাংশ ছিলেন স্বল্পবেতনের চাকরিজীবী, শিক্ষক, ছোটখাটো ব্যবসা বা কৃষিজীবী নিম্নআয়ের লোক। সরকারের উচ্চ ও মধ্যম পদধারী কর্মকর্তা এবং কিছু ছোট চাকরিজীবী হয়েও অবৈধ উপার্জনের মাধ্যমে বিত্তশালী হয়েছেন এমন প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি ছিল। যে এক-চতুর্থাংশের কথা বলছি, তাঁদের বেশির ভাগের ঘুষ বা অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ সার্বিক বিবেচনায় সামান্যই ধরা যায়। অনেকেই অবস্থানের বা অবস্থার শিকার হয়েছেন, কেউ লোভে পড়ে অসত্ পথে টাকা কামাইয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। গ্রাম্য দলাদলির শিকার হওয়া লোকও আছেন। তাঁরা পুলিশ, র্যাব বা যৌথ বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে মামলায় পড়েছেন। তাঁদের অভিযোগগুলোর বেশির ভাগই মামুলি প্রকৃতির। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে যে শাস্তি পেতেন, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি শাস্তি এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন। দুই থেকে ১২ মাস হাজতবাস হয়ে গেছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা অনেক। এক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ চেক জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। প্রায় বছরখানেক জেলে ছিলেন। তাঁর দাবি, এক উপজেলা কর্মকর্তাকে মাদ্রাসার উন্নয়নকাজে কমিশন না দেওয়ায় জাল স্বাক্ষরে চেক ভাঙানোর চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে আটক করা হয়। তিনি ট্রুথ কমিশনে যখন আসেন, তখন মামলার প্রায় ১১ বছর পার হয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে ১০ জন আইও তদন্তকাজে বদলি হলেও কেউই শেষ করেননি। শেষমেশ মামলা দুদকে গেলে এই কমিশনে আসার আবেদন করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও কিছু অনুকম্পাপ্রার্থী এসেছেন, যাঁরা দরিদ্র ও নিরীহ শ্রেণীর। আমরা দেখেছি, যাঁরা ট্রুথ কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছেন, তাঁদের সবাই যে দুর্নীতিবাজ তা নয়। অনেকেই পুলিশের হয়রানি, গ্রেপ্তার হওয়া, দিনের পর দিন আদালতে যাওয়া-আসা, আইনজীবীদের পেছনে ঘোরা প্রভৃতির মতো শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে অপরাধ না করেও স্বীকার করে অর্থদণ্ড দিয়ে ভোগান্তির অবসান করতে চেয়েছেন। এক কর্মকর্তা জানান, তিনি কোনো অপরাধ করেননি, তবু অপরাধ স্বীকার করে অনুকম্পা পেতে এসেছেন। চার বছর আগে দুর্নীতি দমন ব্যুরো তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করলে তিনি সাময়িক বরখাস্ত হন। তারপর কোনো তদন্ত হয়নি, তাঁকে কখনো ডাকাও হয়নি। দুবার তিনি প্রমোশন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এবার অনুকম্পা পেলে প্রমোশন পেতে পারেন। দুটি গ্যাস কোম্পানির শতাধিক কর্মচারী অনুকম্পাপ্রার্থী হয়েছেন। মিটাররিডার ও সমশ্রেণীর কর্মচারীদের দুই-একজন ছাড়া বাকি ব্যক্তিরা যেভাবে যে পরিমাণে উপরি নিয়েছেন, তা অন্য ব্যক্তিদের তুলনায় নগণ্যই বলা যায়। এসব লোক গ্রাহকদের হয়রানির কথা স্বীকার করেন না, তবে সেবা দিয়ে সন্তুষ্ট করে উপরিটা নেন বলে দাবি করেন। স্বীকার করেছেন যে গ্যাসের কানেকশন বা বিল কমানোর জন্য টাকা নিতেন। একজন এমনই অনুতপ্ত যে তিনি যে পরিমাণ সম্পত্তি জমা দেবেন বলে টাস্কফোর্সের কাছে লিখে দিয়েছেন, এখন তিনি তার চেয়েও বেশি দেবেন। কেন এখন বেশি দেবেন কারণ জানতে চাইলে বলেন, তিনি মাসে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা নিতেন। সে হিসাবে ১৬/১৭ বছরের আট লাখ টাকা হয়। তাঁর দেওয়া অঙ্গীকারনামা মতে ছয় লাখ টাকা দিলেই হবে বললেও তিনি সম্মত হননি। শেষমেশ সাত লাখ টাকা দিলেন। এক লাখ কম এ জন্য যে সে টাকা তিনি ধার নিয়েছেন। যে বাড়ি করেছিলেন তা ছয় লাখ টাকায় এরই মধ্যে বিক্রি করেছেন। এ ব্যক্তি দায়মুক্ত হয়ে সেবার হজে যান।
মনজুর রশীদ খান: অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল; সদস্য, বিলুপ্ত সত্য ও জবাবদিহি কমিশন।
No comments