দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো -ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা by আশীষ-উর-রহমান
গগনচুম্বী অপচয়
বিমানে নাকি হিড়িক পড়েছে উড়োজাহাজ ভাড়া করার। কোনো বাণিজ্যিক পরিকল্পনা ছাড়াই তারা উদ্যত ১১টি হাওয়াই জাহাজ ভাড়া নিতে। আমাদের বিমান গত ১৭ বছরে শুধু মেরামতি ও ক্রয়কাজে মাত্র ৭০০ কোটি টাকা অপচয় করছে। দেশবাসীকে এ তথ্য পরিবেশন করছেন জাতীয় সংসদের সংসদীয় উপকমিটি। যা হোক, তবু দেশবাসী এই উচ্চমার্গীয় ব্যাপারস্যাপার জেনে ধন্য হলেন। সাধারণ লোকের পক্ষে এক জমিজিরাত বেচে বিদেশে গতর খাটতে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে চিরকালই উড়োজাহাজ তাদের ধরাছোঁয়ার বহু বাইরে মুখ তুলে আকাশে তাকিয়ে উড়ে যেতে দেখার জিনিস। এমন উচ্চমার্গগামী বস্তুর কোনকাটা মেরামতিতে তো এমন অঙ্কই উপযুক্ত। তবে অঙ্কটি চলে গেছে অপচয়ের খাতে এই যা। আকাশচারীর গগনচুম্বী অপচয় হবে না তো কি ঠেলাগাড়ির মতো জিনিসের হবে? বছরে গড়পড়তা ৪২ কেটি টাকার কাছাকছি। প্রতিমাসে কোটির ওপরে। অপচয়ের অঙ্কই বলে দিচ্ছে এ অবস্থায় কোনো প্রতিষ্ঠানের লাভের মুখ দেখার আশা করা আহাম্মকি। অবশ্য আমাদের বিমানের উদ্দেশ্য মহত্। তারা দেশবাসীকে সেবা দিচ্ছে (বিদেশিরা নিতান্ত দায়ে না ঠেকলে বিমানে চড়েন না), লাভের মতো বাণিজ্যস্বার্থকে তারা সে কারণেই হয়তো পরিত্যাজ্য জ্ঞান করেছে। হাওয়াই জাহাজ বলে কথা। হাওয়া মার্গের বিষয় পায়ে হাঁটা লোকের মোটা মগজে না ঢোকারই কথা। অপিচ তারা না বুঝে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে বসবেন বলেই হয়তো এ ধরনের হিসাবপত্র সব সময় সাধারণ্যে প্রকাশ করা হয় না। নয়তো ১৭ বছর ধরে যে অপচয়ের তুঘলকি চলছিল, তা প্রথম চোটেই বন্ধ করা হলো না কেন? পানির পাত্র ফুটো হলে লোকে তো আগে পাত্রের ফুটো বন্ধ করেন; এরপর সেখানে পানি ভরেন। অথচ আমাদের উচ্চপর্যায়ের কর্তারা ফুটো কলসিতেই ১৭ বছর ৭০০ কোটি টাকা ঢেলে তারপর সেই তথ্য জানালেন দেশবাসীকে। হ্যাঁ, বিষয়টি যে আদপেই উচ্চমার্গীয় অন্তত অপচয়ের অঙ্ক দেখে এবার তা হূদয়ঙ্গম করতে পারবেন গরিব দেশের নুন আনতে পান্তা ফুরোনো আমজনতা। এখন দেখা যাক হাওয়াই জাহাজ ভাড়ার ক্ষেত্রে কী চমক উপহার দেয় তারা।
শালা-দুলাভাই রসায়ন
শ্যালক-ভগ্নিপতির সম্পর্ক বাংলায় বড়ই মধুরতর। ছানার গোল্লার সঙ্গে যেমন চিনির সিরার রসায়ন। কাজেই দুলাভাই সুযোগ পেলে শালার নাম ভাঙাতেই পারেন। নিজের শালা তাতে গোস্সা না হলে অন্যের গাত্রদাহ কেন? অন্তত হাওয়া অনুচিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় কলেজ অধ্যক্ষ দুলাভাই তার সাংসদ শ্যালকের নাম ভাঙিয়েছেন। ভাঙানোর মতো নাম কি সবার থাকে নাকি? যাদের আছে তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। ভাগ্য যখন সহায়তা দিয়েই রেখেছে, তখন তাকে সদ্ব্যবহার করতে বিরত থাকবেন এত নির্বোদ্ধা নয় এ যুগের বাঙালি। অতএব দুলাভাই শ্যালকের নাম-মাহাত্ম্যের কল্যাণে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে একটু সচেষ্ট হয়েছেন মাত্র। কী-ই বা এমন জগচ্ছাড়া কাজ! মাত্র তো আড়াই কোটি টাকার দরপত্র। এলজিইডির। অন্য প্রতিযোগীদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিজের করে নিয়েছেন। সমঝোতা তো খুবই ভালো জিনিস। সেই সমঝোতার পথেই তিনি কাজটি নিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে। যারা সমঝোতায় আসতে চায়নি, তাদের একটু ধমক-ধামক দিতে হয়েছে বটে। এটুকু তো দিতেই হয়। ভালো কাজে কি সবার মন থাকে নাকি! জগতের এই এক মুসিবত। তখন বেয়াড়াদের দিকে একটু চোখ গরম করে তাকাতে হয়। এটা তো জগতেরই নিয়ম। অতএব সবকিছু নিয়মমাফিকই হয়েছে। অথচ এ নিয়ে পত্রপত্রিকাওয়ালারা অযথাই পানি ঘোলা করছে। প্রথম আলো দুই কলাম জুড়ে প্রতিবেদন করে দিল! সাধে কি আর নাম-মাহাত্ম্য যাদের আছে, তারা পত্রপত্রিকাওয়ালাদের ওপর রুষ্ট হন। দুলাভাই যে এত করে বলছেন তার কোনো কসুর নেই, সব নিয়মমাফিক হয়েছে, কিন্তু সে কথায় কান দিলে তো! কান নিয়েছে চিলে, অমনি সবাই ছুটছে চিলের পিছু পিছু। না, দেশটার এ কারণেই উন্নতি হচ্ছে না!
অন্তিম আশা
বিশ্ব প্রশমন দিবস এবার পালিত হলো আমাদের দেশে। বিষয়টি নতুন বিধায় অনেকেই সম্মক অবগত নন। চিকিত্সকেরা ঢাকায় সম্প্রতি এ নিয়ে এক সেমিনারে বলেছেন, এটি বিশেষ এক ধরনের চিকিত্সা। ক্যান্সার বা এমন দুরারোগ্য ব্যাধিতে যারা আক্রান্ত, তাদের অন্তিম দিনগুলো অত্যন্ত যন্ত্রণাময় হয়ে ওঠে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে এই দুঃসহ যন্ত্রণার উপশম দেওয়ার জন্যই এই প্রশমন বিষয়ের চিকিত্সা। এতে শুধু চিকিত্সকেরাই নন, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটির যন্ত্রণা লাঘবে রোগীর স্বজনদেরও সহমর্মিতা নিয়ে সহায়তা দিতে আসা উচিত। প্রশমন বিভাগ নামের একটি বিভাগও খোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
যাপিত জীবনের দিনগুলো পাড়ি দিতে মানুষের বহু ঝক্কি-ঝামেলা, কষ্ট-ক্লান্তি সহ্য করে এগিয়ে আসতে হয়। খুশি-আনন্দ থাকে না তা নয়। তবে এমনি বলা হয়েছিল যে ‘সংসার পথ সংকট অতি কণ্টকময় হে।’ তো সেই কণ্টকময় পথ পাড়ি দিয়ে জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে বিদায়ের দিনগুলো যেন একটু স্বস্তিতে শান্তিতে কাটে, এই তো মানুষের চিরকালের চাওয়া। প্রশমনের বিষয়টি সেই চাওয়াটুকু পূরণের একটি সহায়ক উদ্যোগ।
আমাদের অনেক ভালো উদ্যোগই শেষাবধি খাপছাড়াভাবে সম্পন্ন হয়। এই উদ্যোগটি অন্তত তার উদ্দেশ্য ঠিক ঠিক পূরণ করুক। তাতে যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুপথযাত্রী কিছু মানুষ অন্তত শান্তিতে চোখ বুজতে পারবেন। শান্তিময় মৃত্যুর চেয়ে প্রগাঢ় প্রত্যাশা আর কী আছে মানুষের!
হেমন্তের দিন
মৌসুম বদলাচ্ছে। রোদের আঁচে তার আভাসটি আছে, তবে এখনো তা খুব মৃদু। দিনের দৈর্ঘ্য কমছে, সেও এমন নয় যে বেলা গড়াতেই সন্ধ্যার আবছায়া নেমে আসছে। এখনো সে মাপজোক আমলে আনা সতর্ক পর্যবেক্ষণের বিষয়। কাঁচাবাজারে নতুন সবজির আগমন। বদলের লক্ষণ হিসেবে একে ধরতে চাইলে ধরা যেতে পারে, তবে কৃষিতে যে আধুনিক প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে, এতে এখন ভরবছরই নানা জাতের শাকসবজি দুর্মূল্য সত্ত্বেও সুপ্রচুর। ফলে সবজির ওপর নির্ভর করে ঋতু বদলের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা পুরোপুরি এড়ানো যায় না। এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার উপায় হলো ঢাকা শহরের ফুটপাতের দিকে তাকানো। পথের পাশে বেশ কয়েক দিন থেকেই বিকোচ্ছে গুড়-নারকেল দেওয়া ভাপা আর গরম গরম চিতই। আরা যা কিছুই চাই না হোক, বাংলায় শীতের আগমনীর দূত হিসেবে পিঠার মতো কিছু হয় না। সেই পিঠাই প্রমাণ, বদলে যাচ্ছে মৌসুম। দরজায় কড়া নাড়ছে শীত।
নিসর্গের এ শহরে কুণ্ঠিত, দ্বিধাজড়িত। তার শ্যামল স্নিগ্ধতা, ঋতুতে ঋতুতে তার রূপ বদলের যে বৈচিত্র্য, এর প্রকাশ এখানে সুলভ নয়। চরমভাপাপন্ন দু-একটি ঋতু বাদ দিলে বাদবাকি ঋতুগুলো কখন আসে আর কখন যায়, দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টায় ছত্রিশ রকমের কাজে ব্যস্ত নাগরিকের পক্ষে তা ঠাহর করাই মুশকিল। কিন্তু আমাদের এই ঢাকা মহানগরের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যও আছে। এখানে বহু মানুষই এসেছে গ্রাম থেকে। মাটির কাছাকাছি তাদের অবস্থান। ঋতুর বদল তারাই টের পায় আগে। পিঠাপুলির পসরা সাজিয়ে হেমন্তের শুরুতেই ঋতু বদলের বার্তা নিয়ে এসেছে তারাই। বিকোচ্ছেও প্রচুর। ভাপা পাঁচ ও দশ, চিতই তিন টাকা। দুর্মূল্যের বাজারেও পিঠার দাম বাড়েনি, গতবারের মতোই আছে জানালেন বিক্রেতারা। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’—বাঙালির চিরকালের প্রত্যাশার কথাটা উঠে এসেছিল মধ্যযুগের কবির পঙিক্ততে। দুধভাত সব বঙ্গসন্তানের কাছে এখনো অস্পৃশ্য দূরত্বেই রয়ে গেছে। বছরের একটি মৌসুমে অন্তত কিছু পিঠাপুলি তার নাগালে থাকুক।
দুর্বলেরে রক্ষা করো
দুটি ছবি। ফুলদানিতে সাজানো ফুল নিয়ে দাঁড়ানো পাশাপাশি তাঁরা। ফুলের মতোই স্নিগ্ধ সুন্দর দুই বোন। অন্য ছবিটি বড়ই মর্মান্তিক। তাঁরাই দুই বোন। হাসপাতালের বিছানায় শায়িত। এসিডে ঝলসে গেছে তাঁদের ফুলের মতো কোমল মুখ। প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে তাঁদের ছবি। কুষ্টিয়ার খোকশার কমলাপুরের শিলা ও নিলুফা। বড় নিলুফা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি এসেছিলেন ছোট বোন শিলার বিয়েতে। বিয়ের আগের রাতেই ঘুমিয়ে থাকা তাঁদের ওপর জানালা দিয়ে এসিড ছুড়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ওঁদের বাবা মামলা করেছেন থানায়।
কয়েক দিন আগে আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল বগুড়ার শেরপুরে। এক বীরপুঙ্গব এসিডে ঝলসে দিয়েছে মৌ নামের স্কুলে পড়া এক কিশোরীকে। তারপর যা সচরাচর হয়ে থাকে আমাদের এখানে, ঘটনা তা-ই। যন্ত্রণাকাতর মেয়েকে নিয়ে তার পরিবার ঢাকায় এসেছে চিকিত্সা করাতে। আর ওই দুরাত্মা পালিয়ে গেছে। থানায় মামলাও হয়েছে। তবে পুলিশ নাকি তাকে খুঁজেই পাচ্ছে না। শিলা-নিলুফার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দুর্বৃত্তরা উধাও কর্পূরের মতো একবোরে নিঃশেষে উবে যাওয়া তো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, আছে তারা কোথাও ঘাপটি মেরে। পরিস্থিতি বুঝে কিছুদিন পর বেরিয়ে আসবে নিশ্চয়ই। এবং অবধারিতভাবে এসে হুমকি-ধমকি দেবে মামলা তুলে নিতে। না হলে...। একপর্যায়ে অভিভাবকেরা হাল ছেড়ে দেবেন। এক জীবনযন্ত্রণা নিয়ে কাটবে ফুলের মতো কোমল এই মেয়েদের পরমায়ু। এই তো হয় আমাদের এখানে।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ১,৮০৫ জন নারী ও ৭১৪ জন শিশু এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। এসিড নিয়ন্ত্রণে সরকার একটি আইন করছে বটে কিন্তু বাস্ততার প্রয়োগ নেই। ফলে যত্রতত্র এসিড পাওয়া যাচ্ছে এবং তা ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে প্রধানত নারী ও শিশুদের ওপর। ২০০২ সালে শাস্তির আইন হয়েছে। সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। তবে এখনো কেউ সেই সাজা ভোগ করেনি। ফলে শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়নি, অপরাধের দৃষ্টান্তই শুধু বাড়ছে।
আসলে আমাদের সবগুলো ব্যাপারই কেমন যেন এক ধরনের গোলমেলে হয়ে পড়ে। যা হওয়ার তা না হয়ে অন্য রকম হয়ে যায়। দুনিয়াজোড়াই বিশেষ সম্মান আর প্রযত্ন দেওয়া হয় নারী ও শিশুদের প্রতি। অথচ আমাদের এখানে তাদের ওপরই ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে এসিডের মতো দাহ্য পদার্থ। প্রতিকারহীন ঘটনাপরম্পরা। আমাদের কী করণীয় তা বলে গিয়েছিলেন কবি—‘দুর্বলেরে রক্ষা করো দুর্জনেরে হানো...।’ আমরা গানটি গেয়েছি শুধু, কাজে তা পরিণত করিনি কখনো।
আশীষ-উর-রহমান: সাংবাদিক।
বিমানে নাকি হিড়িক পড়েছে উড়োজাহাজ ভাড়া করার। কোনো বাণিজ্যিক পরিকল্পনা ছাড়াই তারা উদ্যত ১১টি হাওয়াই জাহাজ ভাড়া নিতে। আমাদের বিমান গত ১৭ বছরে শুধু মেরামতি ও ক্রয়কাজে মাত্র ৭০০ কোটি টাকা অপচয় করছে। দেশবাসীকে এ তথ্য পরিবেশন করছেন জাতীয় সংসদের সংসদীয় উপকমিটি। যা হোক, তবু দেশবাসী এই উচ্চমার্গীয় ব্যাপারস্যাপার জেনে ধন্য হলেন। সাধারণ লোকের পক্ষে এক জমিজিরাত বেচে বিদেশে গতর খাটতে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে চিরকালই উড়োজাহাজ তাদের ধরাছোঁয়ার বহু বাইরে মুখ তুলে আকাশে তাকিয়ে উড়ে যেতে দেখার জিনিস। এমন উচ্চমার্গগামী বস্তুর কোনকাটা মেরামতিতে তো এমন অঙ্কই উপযুক্ত। তবে অঙ্কটি চলে গেছে অপচয়ের খাতে এই যা। আকাশচারীর গগনচুম্বী অপচয় হবে না তো কি ঠেলাগাড়ির মতো জিনিসের হবে? বছরে গড়পড়তা ৪২ কেটি টাকার কাছাকছি। প্রতিমাসে কোটির ওপরে। অপচয়ের অঙ্কই বলে দিচ্ছে এ অবস্থায় কোনো প্রতিষ্ঠানের লাভের মুখ দেখার আশা করা আহাম্মকি। অবশ্য আমাদের বিমানের উদ্দেশ্য মহত্। তারা দেশবাসীকে সেবা দিচ্ছে (বিদেশিরা নিতান্ত দায়ে না ঠেকলে বিমানে চড়েন না), লাভের মতো বাণিজ্যস্বার্থকে তারা সে কারণেই হয়তো পরিত্যাজ্য জ্ঞান করেছে। হাওয়াই জাহাজ বলে কথা। হাওয়া মার্গের বিষয় পায়ে হাঁটা লোকের মোটা মগজে না ঢোকারই কথা। অপিচ তারা না বুঝে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে বসবেন বলেই হয়তো এ ধরনের হিসাবপত্র সব সময় সাধারণ্যে প্রকাশ করা হয় না। নয়তো ১৭ বছর ধরে যে অপচয়ের তুঘলকি চলছিল, তা প্রথম চোটেই বন্ধ করা হলো না কেন? পানির পাত্র ফুটো হলে লোকে তো আগে পাত্রের ফুটো বন্ধ করেন; এরপর সেখানে পানি ভরেন। অথচ আমাদের উচ্চপর্যায়ের কর্তারা ফুটো কলসিতেই ১৭ বছর ৭০০ কোটি টাকা ঢেলে তারপর সেই তথ্য জানালেন দেশবাসীকে। হ্যাঁ, বিষয়টি যে আদপেই উচ্চমার্গীয় অন্তত অপচয়ের অঙ্ক দেখে এবার তা হূদয়ঙ্গম করতে পারবেন গরিব দেশের নুন আনতে পান্তা ফুরোনো আমজনতা। এখন দেখা যাক হাওয়াই জাহাজ ভাড়ার ক্ষেত্রে কী চমক উপহার দেয় তারা।
শালা-দুলাভাই রসায়ন
শ্যালক-ভগ্নিপতির সম্পর্ক বাংলায় বড়ই মধুরতর। ছানার গোল্লার সঙ্গে যেমন চিনির সিরার রসায়ন। কাজেই দুলাভাই সুযোগ পেলে শালার নাম ভাঙাতেই পারেন। নিজের শালা তাতে গোস্সা না হলে অন্যের গাত্রদাহ কেন? অন্তত হাওয়া অনুচিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় কলেজ অধ্যক্ষ দুলাভাই তার সাংসদ শ্যালকের নাম ভাঙিয়েছেন। ভাঙানোর মতো নাম কি সবার থাকে নাকি? যাদের আছে তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। ভাগ্য যখন সহায়তা দিয়েই রেখেছে, তখন তাকে সদ্ব্যবহার করতে বিরত থাকবেন এত নির্বোদ্ধা নয় এ যুগের বাঙালি। অতএব দুলাভাই শ্যালকের নাম-মাহাত্ম্যের কল্যাণে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে একটু সচেষ্ট হয়েছেন মাত্র। কী-ই বা এমন জগচ্ছাড়া কাজ! মাত্র তো আড়াই কোটি টাকার দরপত্র। এলজিইডির। অন্য প্রতিযোগীদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে নিজের করে নিয়েছেন। সমঝোতা তো খুবই ভালো জিনিস। সেই সমঝোতার পথেই তিনি কাজটি নিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে। যারা সমঝোতায় আসতে চায়নি, তাদের একটু ধমক-ধামক দিতে হয়েছে বটে। এটুকু তো দিতেই হয়। ভালো কাজে কি সবার মন থাকে নাকি! জগতের এই এক মুসিবত। তখন বেয়াড়াদের দিকে একটু চোখ গরম করে তাকাতে হয়। এটা তো জগতেরই নিয়ম। অতএব সবকিছু নিয়মমাফিকই হয়েছে। অথচ এ নিয়ে পত্রপত্রিকাওয়ালারা অযথাই পানি ঘোলা করছে। প্রথম আলো দুই কলাম জুড়ে প্রতিবেদন করে দিল! সাধে কি আর নাম-মাহাত্ম্য যাদের আছে, তারা পত্রপত্রিকাওয়ালাদের ওপর রুষ্ট হন। দুলাভাই যে এত করে বলছেন তার কোনো কসুর নেই, সব নিয়মমাফিক হয়েছে, কিন্তু সে কথায় কান দিলে তো! কান নিয়েছে চিলে, অমনি সবাই ছুটছে চিলের পিছু পিছু। না, দেশটার এ কারণেই উন্নতি হচ্ছে না!
অন্তিম আশা
বিশ্ব প্রশমন দিবস এবার পালিত হলো আমাদের দেশে। বিষয়টি নতুন বিধায় অনেকেই সম্মক অবগত নন। চিকিত্সকেরা ঢাকায় সম্প্রতি এ নিয়ে এক সেমিনারে বলেছেন, এটি বিশেষ এক ধরনের চিকিত্সা। ক্যান্সার বা এমন দুরারোগ্য ব্যাধিতে যারা আক্রান্ত, তাদের অন্তিম দিনগুলো অত্যন্ত যন্ত্রণাময় হয়ে ওঠে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে এই দুঃসহ যন্ত্রণার উপশম দেওয়ার জন্যই এই প্রশমন বিষয়ের চিকিত্সা। এতে শুধু চিকিত্সকেরাই নন, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটির যন্ত্রণা লাঘবে রোগীর স্বজনদেরও সহমর্মিতা নিয়ে সহায়তা দিতে আসা উচিত। প্রশমন বিভাগ নামের একটি বিভাগও খোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
যাপিত জীবনের দিনগুলো পাড়ি দিতে মানুষের বহু ঝক্কি-ঝামেলা, কষ্ট-ক্লান্তি সহ্য করে এগিয়ে আসতে হয়। খুশি-আনন্দ থাকে না তা নয়। তবে এমনি বলা হয়েছিল যে ‘সংসার পথ সংকট অতি কণ্টকময় হে।’ তো সেই কণ্টকময় পথ পাড়ি দিয়ে জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে বিদায়ের দিনগুলো যেন একটু স্বস্তিতে শান্তিতে কাটে, এই তো মানুষের চিরকালের চাওয়া। প্রশমনের বিষয়টি সেই চাওয়াটুকু পূরণের একটি সহায়ক উদ্যোগ।
আমাদের অনেক ভালো উদ্যোগই শেষাবধি খাপছাড়াভাবে সম্পন্ন হয়। এই উদ্যোগটি অন্তত তার উদ্দেশ্য ঠিক ঠিক পূরণ করুক। তাতে যন্ত্রণাকাতর মৃত্যুপথযাত্রী কিছু মানুষ অন্তত শান্তিতে চোখ বুজতে পারবেন। শান্তিময় মৃত্যুর চেয়ে প্রগাঢ় প্রত্যাশা আর কী আছে মানুষের!
হেমন্তের দিন
মৌসুম বদলাচ্ছে। রোদের আঁচে তার আভাসটি আছে, তবে এখনো তা খুব মৃদু। দিনের দৈর্ঘ্য কমছে, সেও এমন নয় যে বেলা গড়াতেই সন্ধ্যার আবছায়া নেমে আসছে। এখনো সে মাপজোক আমলে আনা সতর্ক পর্যবেক্ষণের বিষয়। কাঁচাবাজারে নতুন সবজির আগমন। বদলের লক্ষণ হিসেবে একে ধরতে চাইলে ধরা যেতে পারে, তবে কৃষিতে যে আধুনিক প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটেছে, এতে এখন ভরবছরই নানা জাতের শাকসবজি দুর্মূল্য সত্ত্বেও সুপ্রচুর। ফলে সবজির ওপর নির্ভর করে ঋতু বদলের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা পুরোপুরি এড়ানো যায় না। এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার উপায় হলো ঢাকা শহরের ফুটপাতের দিকে তাকানো। পথের পাশে বেশ কয়েক দিন থেকেই বিকোচ্ছে গুড়-নারকেল দেওয়া ভাপা আর গরম গরম চিতই। আরা যা কিছুই চাই না হোক, বাংলায় শীতের আগমনীর দূত হিসেবে পিঠার মতো কিছু হয় না। সেই পিঠাই প্রমাণ, বদলে যাচ্ছে মৌসুম। দরজায় কড়া নাড়ছে শীত।
নিসর্গের এ শহরে কুণ্ঠিত, দ্বিধাজড়িত। তার শ্যামল স্নিগ্ধতা, ঋতুতে ঋতুতে তার রূপ বদলের যে বৈচিত্র্য, এর প্রকাশ এখানে সুলভ নয়। চরমভাপাপন্ন দু-একটি ঋতু বাদ দিলে বাদবাকি ঋতুগুলো কখন আসে আর কখন যায়, দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টায় ছত্রিশ রকমের কাজে ব্যস্ত নাগরিকের পক্ষে তা ঠাহর করাই মুশকিল। কিন্তু আমাদের এই ঢাকা মহানগরের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যও আছে। এখানে বহু মানুষই এসেছে গ্রাম থেকে। মাটির কাছাকাছি তাদের অবস্থান। ঋতুর বদল তারাই টের পায় আগে। পিঠাপুলির পসরা সাজিয়ে হেমন্তের শুরুতেই ঋতু বদলের বার্তা নিয়ে এসেছে তারাই। বিকোচ্ছেও প্রচুর। ভাপা পাঁচ ও দশ, চিতই তিন টাকা। দুর্মূল্যের বাজারেও পিঠার দাম বাড়েনি, গতবারের মতোই আছে জানালেন বিক্রেতারা। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’—বাঙালির চিরকালের প্রত্যাশার কথাটা উঠে এসেছিল মধ্যযুগের কবির পঙিক্ততে। দুধভাত সব বঙ্গসন্তানের কাছে এখনো অস্পৃশ্য দূরত্বেই রয়ে গেছে। বছরের একটি মৌসুমে অন্তত কিছু পিঠাপুলি তার নাগালে থাকুক।
দুর্বলেরে রক্ষা করো
দুটি ছবি। ফুলদানিতে সাজানো ফুল নিয়ে দাঁড়ানো পাশাপাশি তাঁরা। ফুলের মতোই স্নিগ্ধ সুন্দর দুই বোন। অন্য ছবিটি বড়ই মর্মান্তিক। তাঁরাই দুই বোন। হাসপাতালের বিছানায় শায়িত। এসিডে ঝলসে গেছে তাঁদের ফুলের মতো কোমল মুখ। প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে তাঁদের ছবি। কুষ্টিয়ার খোকশার কমলাপুরের শিলা ও নিলুফা। বড় নিলুফা শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি এসেছিলেন ছোট বোন শিলার বিয়েতে। বিয়ের আগের রাতেই ঘুমিয়ে থাকা তাঁদের ওপর জানালা দিয়ে এসিড ছুড়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ওঁদের বাবা মামলা করেছেন থানায়।
কয়েক দিন আগে আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল বগুড়ার শেরপুরে। এক বীরপুঙ্গব এসিডে ঝলসে দিয়েছে মৌ নামের স্কুলে পড়া এক কিশোরীকে। তারপর যা সচরাচর হয়ে থাকে আমাদের এখানে, ঘটনা তা-ই। যন্ত্রণাকাতর মেয়েকে নিয়ে তার পরিবার ঢাকায় এসেছে চিকিত্সা করাতে। আর ওই দুরাত্মা পালিয়ে গেছে। থানায় মামলাও হয়েছে। তবে পুলিশ নাকি তাকে খুঁজেই পাচ্ছে না। শিলা-নিলুফার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দুর্বৃত্তরা উধাও কর্পূরের মতো একবোরে নিঃশেষে উবে যাওয়া তো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, আছে তারা কোথাও ঘাপটি মেরে। পরিস্থিতি বুঝে কিছুদিন পর বেরিয়ে আসবে নিশ্চয়ই। এবং অবধারিতভাবে এসে হুমকি-ধমকি দেবে মামলা তুলে নিতে। না হলে...। একপর্যায়ে অভিভাবকেরা হাল ছেড়ে দেবেন। এক জীবনযন্ত্রণা নিয়ে কাটবে ফুলের মতো কোমল এই মেয়েদের পরমায়ু। এই তো হয় আমাদের এখানে।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ১,৮০৫ জন নারী ও ৭১৪ জন শিশু এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। এসিড নিয়ন্ত্রণে সরকার একটি আইন করছে বটে কিন্তু বাস্ততার প্রয়োগ নেই। ফলে যত্রতত্র এসিড পাওয়া যাচ্ছে এবং তা ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে প্রধানত নারী ও শিশুদের ওপর। ২০০২ সালে শাস্তির আইন হয়েছে। সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। তবে এখনো কেউ সেই সাজা ভোগ করেনি। ফলে শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়নি, অপরাধের দৃষ্টান্তই শুধু বাড়ছে।
আসলে আমাদের সবগুলো ব্যাপারই কেমন যেন এক ধরনের গোলমেলে হয়ে পড়ে। যা হওয়ার তা না হয়ে অন্য রকম হয়ে যায়। দুনিয়াজোড়াই বিশেষ সম্মান আর প্রযত্ন দেওয়া হয় নারী ও শিশুদের প্রতি। অথচ আমাদের এখানে তাদের ওপরই ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে এসিডের মতো দাহ্য পদার্থ। প্রতিকারহীন ঘটনাপরম্পরা। আমাদের কী করণীয় তা বলে গিয়েছিলেন কবি—‘দুর্বলেরে রক্ষা করো দুর্জনেরে হানো...।’ আমরা গানটি গেয়েছি শুধু, কাজে তা পরিণত করিনি কখনো।
আশীষ-উর-রহমান: সাংবাদিক।
No comments