আলো থেকে অন্ধকারে পতিত হওয়ার কাহিনী -৭ নভেম্বর ১৯৭৫ by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। বাঙালি জাতির যে স্বপ্ন ছিল, যে প্রত্যাশা ছিল তা সবই আঘাতপ্রাপ্ত হয়, যখন তথাকথিত সিপাহি জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে সামরিক শাসনকে আনুষ্ঠানিকতা দেওয়া হয়। একটু ভেবে দেখুন, ওই দিনটিতে আমরা কী হারিয়েছি। এই দেশের তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা যথা খালেদ মোশাররফ, হুদা ও হায়দারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই মিথ্যা প্রচার করা হয় যে তাঁরা ভারতীয় দালাল ছিলেন। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলেই আপনি অনুধাবন করবেন, এই তিনটি মানুষ কী সাহসের সঙ্গে কতটা আত্মমর্যাদা বজায় রেখেই না দেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছেন। ওই যে তাঁদের হত্যা করা হলো, আজ পর্যন্ত সেই হত্যার বিচার হলো না। আর আমরা এই লজ্জা মাথায় নিয়েই নিজেদের সান্ত্বনা দিয়ে আসছি যে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, গণতন্ত্র আরও সুদৃঢ় হবে। এ সবই মুখের কথা। বাস্তব সত্য হলো এই যে যত দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, চার জাতীয় নেতার হত্যাকারী এবং ৭ নভেম্বরের হত্যাকারীদের বিচার না হয়, তত দিন আপনি আমি আমরা কেউ-ই এই দেশে সভ্যসমাজ পুনরায় গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারি না।
আজ কিছুসংখ্যক মানুষ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলার চেষ্টা করবে যে ১৯৭৫-এর এই দিনে বাংলাদেশকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছিল। সেই কথা যে পুরোটা মিথ্যে, তা বোধকরি আর আমাদের বোঝার বাকি নেই। প্রকৃত সত্য এই যে কর্নেল তাহের যখন জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেন, তখন দেশকে পঙ্গু করারই একটা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। অবশ্য অনেক ব্যক্তি এখনো রয়েছেন, যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাহেরের উদ্দেশ্য মহত্ ছিল এবং তিনি জনকল্যাণমুখী এবং সমাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরে। আসলেও কি তাই?
তাহেরের দেশপ্রেম সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যখনই আমাদের মনে পড়ে যায় যে তাঁর নেতৃত্বে এবং তাঁরই প্রেরণায় সেই দিন খালেদ মোশাররফের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে কথা ওঠে এবং তাঁকে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে হেয় করা হয়, তখন আমাদের দুঃখ হয়। এরই পাশাপাশি যখন স্মরণ করি যে তাহের মোশাররফকে প্রতিহত করার জন্য জিয়ার পক্ষ অবলম্বন করেন, তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সেদিন কর্নেল তাহের একটি ভুল করেছিলেন এবং সেই ভুলের জন্য এক বছর যেতে না যেতেই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়। যে জিয়াকে তিনি বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করলেন এবং যে জিয়াকে ব্যবহার করে তিনি দেশে একটি বিপ্লব সংঘটিত করার পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই জিয়াই তাঁকে একটি প্রহসনমূলক বিচারের দ্বারা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন।
এই ছিল তাহেরের ভুল। কিন্তু সেই ১৯৭৫ সালে ভুল অনেক হয়েছে এবং সেটা বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে। খালেদ মোশাররফের কথাই ভাবুন না একবার। ৩ নভেম্বরে তিনি একটি শান্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন এবং তাঁর এই পদক্ষেপের ফলে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল আমাদের মনে, সে সত্য কারও ভোলার কথা নয়। খন্দকার মোশতাক ও তাঁর খুনি চক্র অবশেষে বিতাড়িত হয়েছে, সেটাই একটি আশার বাণী ছিল জাতির জন্য। মোশাররফ জাতিকে আরও দৃঢ়ভাবে, আরও জোরদারভাবে দেশকে আবার সেই পুরোনো মূল্যবোধ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করতে পারতেন, যে মূল্যবোধ ইতিমধ্যেই ১৫ আগস্টে ধ্বংস করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সেই ধরনের কোনো উত্সাহ মোশাররফ আমাদের দিতে পারেননি। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন সর্বমোট তিন দিন এবং এই তিন দিনই তিনি ব্যস্ত রইলেন বঙ্গভবনে রাজনৈতিক দরকষাকষি নিয়ে। তিনি বুঝে উঠতে পারেননি যে তিনি বঙ্গভবনে যতটা সময় অতিবাহিত করছেন, ততটাই তাঁর পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। তাহের তাঁর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী স্লোগান উঠছে। এই দিকে আবার সংঘটিত হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ। সেই পুরোনো ইতিহাস অবলোকন করলে অথবা স্মৃতিচারণা করলে সহজেই বোঝা যায়, সেই সময় কী গভীর এবং বেদনাদায়ক ভুলগুলো করা হয় এবং ওই সব ভুলের কারণেই ৭ নভেম্বর সকালে আমাদের জীবনে আঁধার নেমে আসে। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল এবং পরে চার নেতাকে হত্যা করল, তাদের আবার বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমরা হলফ করে বলতে পারি না, এসব খুনিকে খালেদ মোশাররফই দেশত্যাগে সাহায্য করেছিলেন কি না। কিন্তু তাঁর ক্ষমতা গ্রহণ করা সত্ত্বেও যে তিনি মুজিবনগর সরকারের চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না, সেইটি আমাদের সামনে আজ একটি বড় ধরনের সত্য।
ভুলের কথা আরও বলা যায়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে ১৫ আগস্টে কেউ রক্ষা করার উদ্যোগ নেয়নি। যে বড় মাপের মানুষ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে গেলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে, সে মহামানবকে প্রাণ দিতে হলো অসহায়ভাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও কিন্তু প্রচুর সময় ছিল হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার। সরকারকে রক্ষা করা যেত এবং উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত হয়ে দেশকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হতেন, যদি তিন বাহিনীর প্রধান সম্মিলিতভাবে খুনিদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে নারকীয় ঘটনার বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তিন বাহিনীর প্রধান খন্দকার মোশতাকের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন। এবং তারপর তিন মাস চলে গেল কেউ কিছু করতে পারলেন না। ঠিক একইভাবে যখন ৭ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে জিয়া ও তাহের সমর্থক সৈনিকেরা রাস্তায় নেমে পড়ল, তখন আর কিছুই করা গেল না। যে লজ্জা আমাদের মাথা নত করতে বাধ্য করল তথাকথিত সিপাই-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে, সেই লজ্জা আমাদের জীবনে আজও রয়ে গেছে।
এবং কী ছিল সেই লজ্জা? স্মরণ করুন ৭ নভেম্বরের ভয়াবহ দৃশ্যগুলো। বিভিন্ন সেনানিবাসে দেশপ্রেমিক সৈনিক ও অফিসারদের হত্যা করার পর্ব চলছে। কোনো দলিল নেই এবং কোনো প্রমাণ নেই যে কর্নেল তাহের এবং জেনারেল জিয়া চেষ্টা করেছেন খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহযোগীদের প্রাণে বাঁচাতে। রাজধানী ঢাকার সড়কে সেই পাকিস্তানি কায়দায় স্লোগান শোনা গেল পুরো উদ্যমে। যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শোনা গিয়েছিল ১৫ আগস্টের ভোরবেলায়, সেই ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ই আরও জোরালোভাবে আমাদের শোনানো হলো ৭ নভেম্বরে। গোটা বাংলাদেশটাকে মনে হলো একটি ছোট পাকিস্তান। আবার এও বলা যায় যে সেদিন আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, দেশটি একটি বানানা রিপাবলিকে পরিণত হয়েছে। যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আমরা পাকিস্তানে সংগ্রাম করেছি এবং সংগ্রামে জয়ী হয়েছি, সেই সামরিক শাসন আবার স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের জীবনের ধারাটাকে একেবারে ইতিহাসবিরোধী একটি স্রোতে পরিণত করে দিল।
৭ নভেম্বর আমাদের আনন্দ দেয় না এবং সেটা এই কারণে যে ওই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি কলঙ্ক বয়ে এনেছে। আমাদের বুঝতে সেদিন অসুবিধা হয়নি যে ৭ নভেম্বরে বাঙালিকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এবং অচিরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই শুনতে পেলাম যে আমরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে পারব না। সেই খন্দকার আব্দুল হামিদ, যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁকেই জিয়া তাঁর কাছে টেনে নিলেন। এবং এই ব্যক্তির মুখে প্রথম উচ্চারিত হয় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর কথা। সুদূর জার্মানি থেকে এম জি তোয়াবকে দেশে আনা হয় বিমান বাহিনী পরিচালনার জন্য। তিনি একটি সিরাত সম্মেলনের আয়োজন করলেন এবং সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে বাঙালির রাষ্ট্র পরিণত হতে চলেছে পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলমান রাষ্ট্রে। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ আমাদের শিক্ষা দেয় যে দেশের নেতাদের অনায়াসে হত্যা করা যায়। এর পর যারা হত্যা করে তাদেরকে আবার কূটনীতিকের রূপ দেওয়া যায়। ৭ নভেম্বরে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছেন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। পরবর্তী সময়ে একে একে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিক এবং অফিসারকে আমরা হারিয়েছি। মনে পড়ে ওই সব মুক্তিযোদ্ধার কথা, যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে জিয়া হত্যার দায়ে? ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর কারণেই এ দেশে ইতিহাস বিকৃতির সূচনা হয় এবং এই দিনটি সুযোগ করে দেয় সেই পুরোনো পাকিস্তানি দোসরদের, যাতে করে তারা বাংলাদেশে সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারে।
এসব কথা শেষ হওয়ার নয়। আমাদের আঁধার এখনো কাটেনি। যে আলোর ভুবন আমরা তৈরি করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দ্বারা, সেই ভুবনটি আঁধারে ছেয়ে গেছে ওই দিন, যেদিন খালেদ মোশাররফকে প্রাণ দিতে হলো এই স্বাধীন দেশে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন আমাদের আলো দেখিয়েছেন এই বলে যে জেলহত্যা মামলার বিষয়ে পুনর্বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তার পাশাপাশি আমাদের দাবি এটাও থাকবে যেন, ৭ নভেম্বরের হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে তদন্ত ও বিচারের প্রক্রিয়ার সূচনা করা হয়।
আর একটি কথা। ৭ নভেম্বরের কলঙ্ক যত দিন পর্যন্ত না আমরা মুছে ফেলতে পারি, তত দিন পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, আমাদের আত্মমর্যাদা বিপদমুক্ত হবে না। যে বাঙালি ১৯৭১-এর ইতিহাস জানে, সেই বাঙালি তো জিন্দাবাদ রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তার বিশ্বাস, তার দেশপ্রেম, তার সমস্ত সুন্দর চিন্তা ওই দুটি শব্দে আবদ্ধ—এবং তা হলো ‘জয় বাংলা’।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
আজ কিছুসংখ্যক মানুষ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলার চেষ্টা করবে যে ১৯৭৫-এর এই দিনে বাংলাদেশকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছিল। সেই কথা যে পুরোটা মিথ্যে, তা বোধকরি আর আমাদের বোঝার বাকি নেই। প্রকৃত সত্য এই যে কর্নেল তাহের যখন জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেন, তখন দেশকে পঙ্গু করারই একটা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। অবশ্য অনেক ব্যক্তি এখনো রয়েছেন, যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাহেরের উদ্দেশ্য মহত্ ছিল এবং তিনি জনকল্যাণমুখী এবং সমাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরে। আসলেও কি তাই?
তাহেরের দেশপ্রেম সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যখনই আমাদের মনে পড়ে যায় যে তাঁর নেতৃত্বে এবং তাঁরই প্রেরণায় সেই দিন খালেদ মোশাররফের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে কথা ওঠে এবং তাঁকে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে হেয় করা হয়, তখন আমাদের দুঃখ হয়। এরই পাশাপাশি যখন স্মরণ করি যে তাহের মোশাররফকে প্রতিহত করার জন্য জিয়ার পক্ষ অবলম্বন করেন, তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সেদিন কর্নেল তাহের একটি ভুল করেছিলেন এবং সেই ভুলের জন্য এক বছর যেতে না যেতেই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়। যে জিয়াকে তিনি বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করলেন এবং যে জিয়াকে ব্যবহার করে তিনি দেশে একটি বিপ্লব সংঘটিত করার পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই জিয়াই তাঁকে একটি প্রহসনমূলক বিচারের দ্বারা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন।
এই ছিল তাহেরের ভুল। কিন্তু সেই ১৯৭৫ সালে ভুল অনেক হয়েছে এবং সেটা বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে। খালেদ মোশাররফের কথাই ভাবুন না একবার। ৩ নভেম্বরে তিনি একটি শান্ত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন এবং তাঁর এই পদক্ষেপের ফলে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল আমাদের মনে, সে সত্য কারও ভোলার কথা নয়। খন্দকার মোশতাক ও তাঁর খুনি চক্র অবশেষে বিতাড়িত হয়েছে, সেটাই একটি আশার বাণী ছিল জাতির জন্য। মোশাররফ জাতিকে আরও দৃঢ়ভাবে, আরও জোরদারভাবে দেশকে আবার সেই পুরোনো মূল্যবোধ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করতে পারতেন, যে মূল্যবোধ ইতিমধ্যেই ১৫ আগস্টে ধ্বংস করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সেই ধরনের কোনো উত্সাহ মোশাররফ আমাদের দিতে পারেননি। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন সর্বমোট তিন দিন এবং এই তিন দিনই তিনি ব্যস্ত রইলেন বঙ্গভবনে রাজনৈতিক দরকষাকষি নিয়ে। তিনি বুঝে উঠতে পারেননি যে তিনি বঙ্গভবনে যতটা সময় অতিবাহিত করছেন, ততটাই তাঁর পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। তাহের তাঁর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী স্লোগান উঠছে। এই দিকে আবার সংঘটিত হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ। সেই পুরোনো ইতিহাস অবলোকন করলে অথবা স্মৃতিচারণা করলে সহজেই বোঝা যায়, সেই সময় কী গভীর এবং বেদনাদায়ক ভুলগুলো করা হয় এবং ওই সব ভুলের কারণেই ৭ নভেম্বর সকালে আমাদের জীবনে আঁধার নেমে আসে। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল এবং পরে চার নেতাকে হত্যা করল, তাদের আবার বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমরা হলফ করে বলতে পারি না, এসব খুনিকে খালেদ মোশাররফই দেশত্যাগে সাহায্য করেছিলেন কি না। কিন্তু তাঁর ক্ষমতা গ্রহণ করা সত্ত্বেও যে তিনি মুজিবনগর সরকারের চার নেতাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না, সেইটি আমাদের সামনে আজ একটি বড় ধরনের সত্য।
ভুলের কথা আরও বলা যায়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে ১৫ আগস্টে কেউ রক্ষা করার উদ্যোগ নেয়নি। যে বড় মাপের মানুষ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে গেলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে, সে মহামানবকে প্রাণ দিতে হলো অসহায়ভাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও কিন্তু প্রচুর সময় ছিল হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার। সরকারকে রক্ষা করা যেত এবং উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর স্থলাভিষিক্ত হয়ে দেশকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হতেন, যদি তিন বাহিনীর প্রধান সম্মিলিতভাবে খুনিদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে নারকীয় ঘটনার বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তিন বাহিনীর প্রধান খন্দকার মোশতাকের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন। এবং তারপর তিন মাস চলে গেল কেউ কিছু করতে পারলেন না। ঠিক একইভাবে যখন ৭ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে জিয়া ও তাহের সমর্থক সৈনিকেরা রাস্তায় নেমে পড়ল, তখন আর কিছুই করা গেল না। যে লজ্জা আমাদের মাথা নত করতে বাধ্য করল তথাকথিত সিপাই-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে, সেই লজ্জা আমাদের জীবনে আজও রয়ে গেছে।
এবং কী ছিল সেই লজ্জা? স্মরণ করুন ৭ নভেম্বরের ভয়াবহ দৃশ্যগুলো। বিভিন্ন সেনানিবাসে দেশপ্রেমিক সৈনিক ও অফিসারদের হত্যা করার পর্ব চলছে। কোনো দলিল নেই এবং কোনো প্রমাণ নেই যে কর্নেল তাহের এবং জেনারেল জিয়া চেষ্টা করেছেন খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহযোগীদের প্রাণে বাঁচাতে। রাজধানী ঢাকার সড়কে সেই পাকিস্তানি কায়দায় স্লোগান শোনা গেল পুরো উদ্যমে। যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শোনা গিয়েছিল ১৫ আগস্টের ভোরবেলায়, সেই ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ই আরও জোরালোভাবে আমাদের শোনানো হলো ৭ নভেম্বরে। গোটা বাংলাদেশটাকে মনে হলো একটি ছোট পাকিস্তান। আবার এও বলা যায় যে সেদিন আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, দেশটি একটি বানানা রিপাবলিকে পরিণত হয়েছে। যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আমরা পাকিস্তানে সংগ্রাম করেছি এবং সংগ্রামে জয়ী হয়েছি, সেই সামরিক শাসন আবার স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের জীবনের ধারাটাকে একেবারে ইতিহাসবিরোধী একটি স্রোতে পরিণত করে দিল।
৭ নভেম্বর আমাদের আনন্দ দেয় না এবং সেটা এই কারণে যে ওই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি কলঙ্ক বয়ে এনেছে। আমাদের বুঝতে সেদিন অসুবিধা হয়নি যে ৭ নভেম্বরে বাঙালিকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এবং অচিরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই শুনতে পেলাম যে আমরা নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে পারব না। সেই খন্দকার আব্দুল হামিদ, যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁকেই জিয়া তাঁর কাছে টেনে নিলেন। এবং এই ব্যক্তির মুখে প্রথম উচ্চারিত হয় ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর কথা। সুদূর জার্মানি থেকে এম জি তোয়াবকে দেশে আনা হয় বিমান বাহিনী পরিচালনার জন্য। তিনি একটি সিরাত সম্মেলনের আয়োজন করলেন এবং সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে বাঙালির রাষ্ট্র পরিণত হতে চলেছে পাকিস্তানের ন্যায় একটি মুসলমান রাষ্ট্রে। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ আমাদের শিক্ষা দেয় যে দেশের নেতাদের অনায়াসে হত্যা করা যায়। এর পর যারা হত্যা করে তাদেরকে আবার কূটনীতিকের রূপ দেওয়া যায়। ৭ নভেম্বরে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়েছেন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। পরবর্তী সময়ে একে একে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিক এবং অফিসারকে আমরা হারিয়েছি। মনে পড়ে ওই সব মুক্তিযোদ্ধার কথা, যাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে জিয়া হত্যার দায়ে? ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর কারণেই এ দেশে ইতিহাস বিকৃতির সূচনা হয় এবং এই দিনটি সুযোগ করে দেয় সেই পুরোনো পাকিস্তানি দোসরদের, যাতে করে তারা বাংলাদেশে সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারে।
এসব কথা শেষ হওয়ার নয়। আমাদের আঁধার এখনো কাটেনি। যে আলোর ভুবন আমরা তৈরি করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দ্বারা, সেই ভুবনটি আঁধারে ছেয়ে গেছে ওই দিন, যেদিন খালেদ মোশাররফকে প্রাণ দিতে হলো এই স্বাধীন দেশে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন আমাদের আলো দেখিয়েছেন এই বলে যে জেলহত্যা মামলার বিষয়ে পুনর্বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তার পাশাপাশি আমাদের দাবি এটাও থাকবে যেন, ৭ নভেম্বরের হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে তদন্ত ও বিচারের প্রক্রিয়ার সূচনা করা হয়।
আর একটি কথা। ৭ নভেম্বরের কলঙ্ক যত দিন পর্যন্ত না আমরা মুছে ফেলতে পারি, তত দিন পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, আমাদের আত্মমর্যাদা বিপদমুক্ত হবে না। যে বাঙালি ১৯৭১-এর ইতিহাস জানে, সেই বাঙালি তো জিন্দাবাদ রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তার বিশ্বাস, তার দেশপ্রেম, তার সমস্ত সুন্দর চিন্তা ওই দুটি শব্দে আবদ্ধ—এবং তা হলো ‘জয় বাংলা’।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments