আকাশ ছাড়িয়ে স্বপ্ন -চারদিক by রেজাউল হক
কাপাসিয়া উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে নরসিংদী জেলার লাগোয়া মির্জানগর গ্রাম। গাজীপুর জেলার এই প্রান্তিক গ্রামটির মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন কৃষি। গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরের মানুষ সেখানে ফসলের রূপকার।
কৃষিনির্ভর গ্রামটিতে ২০ বছর ধরে ফসল ও বৃক্ষের নতুন নতুন চাষবাসের প্রসার ঘটছে। কিন্তু এসব চাষপদ্ধতির কারিগরি দিকগুলো সম্পর্কে মানুষের কাছে অনেক তথ্য পোঁছেনি। কৃষিবিষয়ক কারিগরি তথ্যের বিশাল শূন্যতার মধ্যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এখানকার কৃষি। অথচ জরুরি সময়ে সঠিক সমাধান পেলে বেঁচে যেতে পারে কৃষকের কষ্টের ফসল—যেমনটা বেঁচে গেছে সাদির উদ্দিন প্রধানের লিচুবাগান।
গ্রামের বড় বাঁশবাগানগুলোর একটার পাশে প্রধান বাড়ি বলে পরিচিত সাদির উদ্দিনদের বাড়ি। তাঁর দুই মেয়ে এক ছেলে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি ছোট ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস।
বছর বিশেক আগে কলমের চারা লাগিয়ে সদির উদ্দিন লিচুবাগান করেন। বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি আর নিজের কেনা কিছু জমি মিলিয়ে গড়ে তোলেন বাগান। ১৪ শতাংশ জমির বাগানে ১৯টা ‘বেলারি’ জাতের লিচুগাছ রয়েছে। গ্রামের মমতাজ উদ্দিন নামে প্রয়াত একজনের লিচুবাগান ছিল। অল্প জমির বাগান থেকে তাঁর আয় দেখে লিচুবাগান করার দিকে ঝোঁকেন সাদির উদ্দিন।
গত মৌসুমে ২৫ হাজার টাকা আর আগের মৌসুমে ৩৫ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করেন সাদির উদ্দিন। আগে বাগান আগাম বেচে দিতেন ব্যাপারিদের কাছে। লিচুতে সিঁদুরে রং এলে ব্যাপারিরা কিনে নেয়, লিচু পেড়ে নেওয়া পর্যন্ত তারাই বাগানের দেখভাল করে। এ ধরনের আগাম বিক্রিতে ৮-১০ হাজার টাকার বেশি পেতেন না সাদির উদ্দিন।
দুই মৌসুম ধরে নিজেই লিচু বিক্রি করেন সাদির উদ্দিন। এতে আগের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি টাকা আসে। এই জমিতে ধান চাষ করলে হয়তো বছরে একবার করতে পারতেন। উঁচু জমি বলে হলুদ বা শাকসবজি চাষ করা যেত। এতে বছরে দুই-আড়াই হাজার টাকার বেশি আসত না বলে জানান তিনি।
বাগান পরিচর্যার টুকিটাকি প্রতিবেশী ও ব্যাপারিদের কাছ থেকে শিখেছেন। সেই সামান্য জানা নিয়েই সারা বছর বাগানের যত্ন নেন। অনেক সমস্যারই সমাধানের উপায় তাঁর জানার বাইরে। আগে দু-একবার ঘন কুয়াশার জন্য লিচুগাছে ফুল ফোটেনি। এক টাকাও আসেনি বাগান থেকে। আবার পোক্ত হওয়ার আগেই ফল ঝরে যায়। বোঁটার গোড়ায় পোকার আক্রমণ। পাতায় সাদা ছত্রাক। পাতা ঝাঁঝরা করে ফেলে পোকা। এসব সমাধানের জন্য এখানে-সেখানে দৌড়ান। সঠিক সমাধান পাওয়া যায় না।
বাগানে সমস্যা হলে চলে যান কীটনাশক বিক্রেতাদের কাছে। একটা সমস্যায় পড়ে কীটনাশকের দোকানে গিয়ে তাদের কথামতো ৬০০ টাকার ওষুধ কিনে গাছে ছিটিয়েছেন। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। খরচাটাই সার।
গত মৌসুমে বেশ লিচু ধরেছিল। কিন্তু ফল মোটরদানার মতো হওয়ার পর ঝরে পড়তে থাকে। আশপাশের অনেকের কাছে গিয়েছেন। কেউ সমাধান দিতে পারেনি। প্রতিবেশী কৃষকদের কাছ থেকে জানতে পারেন, আড়ালবাজারে কমিউনিটি ইনফরমেশন সেন্টার আছে। নাম আকাশমেলা। সেখানে চাষবাসের সমস্যার কথা জানালে তারা সমাধান এনে দেয়। ‘সেখানে গেলাম। সমস্যার কথা তাদের জানালাম। দুই দিন পরে সমাধান পাই। তাদের পরামর্শমতো ওষুধ কিনে ১০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করেছি। লিচু ঝরা বন্ধ হয়ে যায়।’ বললেন সাদির উদ্দিন। ফলবাগানটা রক্ষা হয়। ২৫ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করেন তিনি। আগের মৌসুমের চেয়ে ১০ হাজার কম। গতবার জমি নিয়ে মামলায় জড়িয়েছেন। বিস্তর খরচ। বহুবার হাজিরা দিতে হয়েছে। ভালোভাবে বাগানের পরিচর্যা হয়নি বলে ফলন কম হয়েছে। মামলার খরচ জোগাতে প্রায় ৫ গণ্ডা জমি বেচে দিতে হয়েছে। লিচুবাগানের টাকাটা না এলে হয়তো আরও সম্পত্তি খোয়াতে হতো।
আকাশমেলার স্বত্বাধিকারী মাহবুব-এ-এলাহী ব্যক্তি-উদ্যোগে আড়ালবাজারে ২০০৫ সালে গড়ে তোলেন কম্পিউটারের দোকান। তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ, আয়ের উপায়ও এটি। ২০০৬ সালে গ্রামীণফোনের কমিউনিটি ইনফরমেশন সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হয় আকাশমেলা। ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সেবা পাওয়া যায় এখানে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আইসিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (বিআইআইডি) উদ্যোগে আকাশমেলায় কৃষিবিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ সেবার সূচনা করা হয়েছে।
মাহবুব জানান, সাদির উদ্দিনের সমস্যাটি জানার পর তিনি সমস্যাটি ই-মেইল করে পাঠিয়ে দেন ঢাকা উইন ইনকরপোরেটে। সেখান থেকে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শসহ ফিরতি মেইল আসে দুই দিন পর। এই সেবার জন্য তাঁর কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নেওয়া হয়নি।
তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারলে লাভবান হতে পারে কৃষক, বাঁচতে পারে কৃষি। আকাশমেলার এই উদ্যোগ তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কৃষকদের মধ্যে তথ্য নেওয়ার বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য বিআইআইডির একটি উদ্যোগ ই-কৃষি। আকাশ মেলার মাধ্যমে শতাধিক কৃষক যুক্ত হয়েছেন ই-কৃষির সঙ্গে। মাসে একবার তাঁদের সভা বসে। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন সরকারি কৃষি সম্প্রসারণকর্মী। ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে আরও সমৃদ্ধ হতে পারে গ্রামীণ কৃষি, এটি তারই ইঙ্গিত।
কৃষিনির্ভর গ্রামটিতে ২০ বছর ধরে ফসল ও বৃক্ষের নতুন নতুন চাষবাসের প্রসার ঘটছে। কিন্তু এসব চাষপদ্ধতির কারিগরি দিকগুলো সম্পর্কে মানুষের কাছে অনেক তথ্য পোঁছেনি। কৃষিবিষয়ক কারিগরি তথ্যের বিশাল শূন্যতার মধ্যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এখানকার কৃষি। অথচ জরুরি সময়ে সঠিক সমাধান পেলে বেঁচে যেতে পারে কৃষকের কষ্টের ফসল—যেমনটা বেঁচে গেছে সাদির উদ্দিন প্রধানের লিচুবাগান।
গ্রামের বড় বাঁশবাগানগুলোর একটার পাশে প্রধান বাড়ি বলে পরিচিত সাদির উদ্দিনদের বাড়ি। তাঁর দুই মেয়ে এক ছেলে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি ছোট ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস।
বছর বিশেক আগে কলমের চারা লাগিয়ে সদির উদ্দিন লিচুবাগান করেন। বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি আর নিজের কেনা কিছু জমি মিলিয়ে গড়ে তোলেন বাগান। ১৪ শতাংশ জমির বাগানে ১৯টা ‘বেলারি’ জাতের লিচুগাছ রয়েছে। গ্রামের মমতাজ উদ্দিন নামে প্রয়াত একজনের লিচুবাগান ছিল। অল্প জমির বাগান থেকে তাঁর আয় দেখে লিচুবাগান করার দিকে ঝোঁকেন সাদির উদ্দিন।
গত মৌসুমে ২৫ হাজার টাকা আর আগের মৌসুমে ৩৫ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করেন সাদির উদ্দিন। আগে বাগান আগাম বেচে দিতেন ব্যাপারিদের কাছে। লিচুতে সিঁদুরে রং এলে ব্যাপারিরা কিনে নেয়, লিচু পেড়ে নেওয়া পর্যন্ত তারাই বাগানের দেখভাল করে। এ ধরনের আগাম বিক্রিতে ৮-১০ হাজার টাকার বেশি পেতেন না সাদির উদ্দিন।
দুই মৌসুম ধরে নিজেই লিচু বিক্রি করেন সাদির উদ্দিন। এতে আগের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি টাকা আসে। এই জমিতে ধান চাষ করলে হয়তো বছরে একবার করতে পারতেন। উঁচু জমি বলে হলুদ বা শাকসবজি চাষ করা যেত। এতে বছরে দুই-আড়াই হাজার টাকার বেশি আসত না বলে জানান তিনি।
বাগান পরিচর্যার টুকিটাকি প্রতিবেশী ও ব্যাপারিদের কাছ থেকে শিখেছেন। সেই সামান্য জানা নিয়েই সারা বছর বাগানের যত্ন নেন। অনেক সমস্যারই সমাধানের উপায় তাঁর জানার বাইরে। আগে দু-একবার ঘন কুয়াশার জন্য লিচুগাছে ফুল ফোটেনি। এক টাকাও আসেনি বাগান থেকে। আবার পোক্ত হওয়ার আগেই ফল ঝরে যায়। বোঁটার গোড়ায় পোকার আক্রমণ। পাতায় সাদা ছত্রাক। পাতা ঝাঁঝরা করে ফেলে পোকা। এসব সমাধানের জন্য এখানে-সেখানে দৌড়ান। সঠিক সমাধান পাওয়া যায় না।
বাগানে সমস্যা হলে চলে যান কীটনাশক বিক্রেতাদের কাছে। একটা সমস্যায় পড়ে কীটনাশকের দোকানে গিয়ে তাদের কথামতো ৬০০ টাকার ওষুধ কিনে গাছে ছিটিয়েছেন। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। খরচাটাই সার।
গত মৌসুমে বেশ লিচু ধরেছিল। কিন্তু ফল মোটরদানার মতো হওয়ার পর ঝরে পড়তে থাকে। আশপাশের অনেকের কাছে গিয়েছেন। কেউ সমাধান দিতে পারেনি। প্রতিবেশী কৃষকদের কাছ থেকে জানতে পারেন, আড়ালবাজারে কমিউনিটি ইনফরমেশন সেন্টার আছে। নাম আকাশমেলা। সেখানে চাষবাসের সমস্যার কথা জানালে তারা সমাধান এনে দেয়। ‘সেখানে গেলাম। সমস্যার কথা তাদের জানালাম। দুই দিন পরে সমাধান পাই। তাদের পরামর্শমতো ওষুধ কিনে ১০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করেছি। লিচু ঝরা বন্ধ হয়ে যায়।’ বললেন সাদির উদ্দিন। ফলবাগানটা রক্ষা হয়। ২৫ হাজার টাকার লিচু বিক্রি করেন তিনি। আগের মৌসুমের চেয়ে ১০ হাজার কম। গতবার জমি নিয়ে মামলায় জড়িয়েছেন। বিস্তর খরচ। বহুবার হাজিরা দিতে হয়েছে। ভালোভাবে বাগানের পরিচর্যা হয়নি বলে ফলন কম হয়েছে। মামলার খরচ জোগাতে প্রায় ৫ গণ্ডা জমি বেচে দিতে হয়েছে। লিচুবাগানের টাকাটা না এলে হয়তো আরও সম্পত্তি খোয়াতে হতো।
আকাশমেলার স্বত্বাধিকারী মাহবুব-এ-এলাহী ব্যক্তি-উদ্যোগে আড়ালবাজারে ২০০৫ সালে গড়ে তোলেন কম্পিউটারের দোকান। তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ, আয়ের উপায়ও এটি। ২০০৬ সালে গ্রামীণফোনের কমিউনিটি ইনফরমেশন সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হয় আকাশমেলা। ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সেবা পাওয়া যায় এখানে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব আইসিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (বিআইআইডি) উদ্যোগে আকাশমেলায় কৃষিবিষয়ক তথ্য ও পরামর্শ সেবার সূচনা করা হয়েছে।
মাহবুব জানান, সাদির উদ্দিনের সমস্যাটি জানার পর তিনি সমস্যাটি ই-মেইল করে পাঠিয়ে দেন ঢাকা উইন ইনকরপোরেটে। সেখান থেকে কৃষি বিশেষজ্ঞের পরামর্শসহ ফিরতি মেইল আসে দুই দিন পর। এই সেবার জন্য তাঁর কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নেওয়া হয়নি।
তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারলে লাভবান হতে পারে কৃষক, বাঁচতে পারে কৃষি। আকাশমেলার এই উদ্যোগ তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কৃষকদের মধ্যে তথ্য নেওয়ার বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য বিআইআইডির একটি উদ্যোগ ই-কৃষি। আকাশ মেলার মাধ্যমে শতাধিক কৃষক যুক্ত হয়েছেন ই-কৃষির সঙ্গে। মাসে একবার তাঁদের সভা বসে। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন সরকারি কৃষি সম্প্রসারণকর্মী। ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে আরও সমৃদ্ধ হতে পারে গ্রামীণ কৃষি, এটি তারই ইঙ্গিত।
No comments