বলছি সেই কামানটির কথা -চারদিক by স্বপন কুমার দাস
আজকে বোফোর্স কামানের যুগে ‘বিবি মরিয়ম’কে সুবৃহত্ ও আকর্ষণীয় একটি লৌহখণ্ড বলেই এ যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে মনে হতে পারে। অথচ এককালে এ কামানটি ছিল বড় বিস্ময়। ঢাকার চার শ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ কামানটি। এ কামানের সঙ্গে আরও জড়িয়ে আছে মীর জুমলার নাম আর সেকালের ঢাকার কামান তৈরির কারিগরদের দক্ষতা। কামানটি ছিল ঢাকাবাসীর গর্বের ও ভালোবাসার ধন। একটি কামান নিয়ে কোনো নগরবাসীর এত আবেগ এত উচ্ছ্বাস ইতিহাসে বিরল।
১৭ শতকের গোড়ার দিকে সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপন করেন। ঢাকায় গড়ে ওঠে প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে ঢাকার নিরাপত্তা নিয়েও শাসকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। ঢাকার চারদিকে প্রবাহিত নদীতে তখন মগ, পর্তুগিজ ও আরাকানি জলদস্যুদের উপদ্রব ছিল। তাই ঢাকার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে বেশ কিছু কামান তৈরি করা হয়। এসব কামানের মধ্যে দুটি কামান ছিল বিখ্যাত। বিশালত্বে, নির্মাণশৈলীতে ও সৌন্দর্যে এগুলো ছিল ভারতখ্যাত। কামান দুটির একটির নাম কালে খাঁ জমজম ও অপরটির নাম বিবি মরিয়ম। ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ও পর্যটকেরা কালে খাঁকে দেখেই সবচেয়ে বেশি অবাক হন এবং এর বৃত্তান্ত লিখে রাখেন। কালে খাঁ বুড়িগঙ্গা নদীতে তলিয়ে গেলে সবার চোখ পড়ে বিবি মরিয়মের দিকে। বিবি মরিয়ম হয়ে ওঠে দর্শনীয় বস্তু। বিবি মরিয়মের দৈর্ঘ্য ১১ ফুট। মুখের ব্যাস ছয় ইঞ্চি। কামানে ব্যবহূত গোলার ওজন পাঁচ মণ। অত্যন্ত শক্ত ও পেটানো লোহা দিয়ে কামানটি তৈরি করা হয়েছে। তাতে মরচে ধরে না।
কামানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকার কামান তৈরির কারিগরদের দক্ষতা। মোগল আমলে ঢাকায় অনেক উন্নতমানের কামান তৈরির কারিগর ছিলেন। মজবুত ও টেকসই কামান তৈরিতে তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তখন ঢাকায় এ শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। সুবেদার ও জমিদারেরা ফরমায়েশ দিয়ে এসব কারিগর দিয়ে তাঁদের প্রয়োজনীয় কামান তৈরি করিয়ে নিতেন। বর্তমানে মুর্শিদাবাদে যে বিশাল কামানটি দেখা যায়, নবাব আলীবর্দী খান ঢাকায় কামান তৈরির কারিগর জনার্ধন কর্মকারকে দিয়ে তা তৈরি করিয়ে নেন। তবে কালে খাঁ জমজম ও বিবি মরিয়মের নকশা তৈরি এবং নির্মাণকাজ তদারকি করেন মোগল কামান নির্মাতারা।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬০ সালে মীর জুমলাকে বাংলার সুবেদার নিয়োগ করেন। মীর জুমলা ১৬৬১ সালে আসাম অভিযানের সময় ৬৭৫টি ভারী কামান ব্যবহার করেন। তাঁর মধ্যে বিবি মরিয়ম ছিল সর্ববৃহত্। যুদ্ধশেষে বিজয়ী হয়ে তিনি বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার দক্ষিণে সোয়ারিঘাটে স্থাপন করেন। তখন থেকে কামানটি মীর জুমলার কামান নামে পরিচিত লাভ করে। কালে খাঁর মতো মীর জুমলাও একই ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছিল মোগল শাসকদের পতনের পর। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকার ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও বিখ্যাত গ্রন্থাগার ডি. অয়লি লিখেছেন, ‘বিবি মরিয়ম ধীরে ধীরে কাদাপানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছিল। বর্ষাকালে কামানটির অর্ধেক থাকত পানির নিচে।’ ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালটার্স ১৮৪০ সালে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কামানটিকে কাদাপানি থেকে উদ্ধার করে চকবাজারের উত্তরে একটি বেদির ওপর স্থাপন করেন। তখন চকবাজার ছিল ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর স্থান। কামানটি চকবাজারে এনে রাখার পর তা দর্শনীয় হয়ে ওঠে। নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে সব বয়সী মানুষ এ কামান দেখার জন্য ভিড় করে। হিন্দু রমণীরা এসে কামানটির মুখে সিঁদুরের ফোঁটা দেন।
চকবাজার ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হলে ১৯২৫ সালে ঢাকার জাদুঘরের কিউরেটর নলিনীকান্ত ভট্টশালী কামানটিকে চকবাজার থেকে এনে সদরঘাটে স্থাপন করেন। তখন সদরঘাট ছিল ঢাকার সবচেয়ে মনোরম স্থান। এখানে এনে রাখার পর কামানটি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গত শতকের পঞ্চাশ দশকে পাকিস্তান আমলে মীর জুমলাকে সদরঘাট থেকে এনে শোভাবর্ধনের জন্য গুলিস্তানের চৌরাস্তার মাঝখানে স্থাপন করা হয়। তখন গুলিস্তান ছিল ঢাকার কেন্দ্রস্থল এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। এখানে এনে রাখার পর কামানটি গুলিস্তানের কামান নামে পরিচিতি লাভ করে। তখনো কামানটি বেশ জনপ্রিয় ছিল ঢাকাবাসীর কাছে। তখনো মানুষ কামানটি দেখে শিহরিত হতো। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় বেগম মতিয়া চৌধুরী এ কামানের ওপর দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন লাখো মানুষের সামনে।
১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের সময় মীর জুমলাকে গুলিস্তানের মোড় থেকে উঠিয়ে এনে ওসমানী উদ্যানের প্রধান ফটকের পেছনে স্থাপন করা হয়। আর তখন থেকেই এ কামান লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে দেশবাসী তো বটেই, ঢাকাবাসীও কামানটিকে ভুলতে বসেছে। তাই ঢাকাবাসীর কেউ কেউ মনে করেন, প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন সুবেদার মীর জুমলার স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক এ কামানকে লালবাগ দুর্গের কিংবা জাতীয় জাদুঘরের সামনে এনে রাখাই সমীচীন। তা হলে ঢাকাবাসী তাঁদের ভালোবাসা ও গর্বের ধন মীর জুমলাকে নিত্যদিন পাবেন।
১৭ শতকের গোড়ার দিকে সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপন করেন। ঢাকায় গড়ে ওঠে প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে ঢাকার নিরাপত্তা নিয়েও শাসকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। ঢাকার চারদিকে প্রবাহিত নদীতে তখন মগ, পর্তুগিজ ও আরাকানি জলদস্যুদের উপদ্রব ছিল। তাই ঢাকার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে বেশ কিছু কামান তৈরি করা হয়। এসব কামানের মধ্যে দুটি কামান ছিল বিখ্যাত। বিশালত্বে, নির্মাণশৈলীতে ও সৌন্দর্যে এগুলো ছিল ভারতখ্যাত। কামান দুটির একটির নাম কালে খাঁ জমজম ও অপরটির নাম বিবি মরিয়ম। ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ও পর্যটকেরা কালে খাঁকে দেখেই সবচেয়ে বেশি অবাক হন এবং এর বৃত্তান্ত লিখে রাখেন। কালে খাঁ বুড়িগঙ্গা নদীতে তলিয়ে গেলে সবার চোখ পড়ে বিবি মরিয়মের দিকে। বিবি মরিয়ম হয়ে ওঠে দর্শনীয় বস্তু। বিবি মরিয়মের দৈর্ঘ্য ১১ ফুট। মুখের ব্যাস ছয় ইঞ্চি। কামানে ব্যবহূত গোলার ওজন পাঁচ মণ। অত্যন্ত শক্ত ও পেটানো লোহা দিয়ে কামানটি তৈরি করা হয়েছে। তাতে মরচে ধরে না।
কামানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকার কামান তৈরির কারিগরদের দক্ষতা। মোগল আমলে ঢাকায় অনেক উন্নতমানের কামান তৈরির কারিগর ছিলেন। মজবুত ও টেকসই কামান তৈরিতে তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তখন ঢাকায় এ শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। সুবেদার ও জমিদারেরা ফরমায়েশ দিয়ে এসব কারিগর দিয়ে তাঁদের প্রয়োজনীয় কামান তৈরি করিয়ে নিতেন। বর্তমানে মুর্শিদাবাদে যে বিশাল কামানটি দেখা যায়, নবাব আলীবর্দী খান ঢাকায় কামান তৈরির কারিগর জনার্ধন কর্মকারকে দিয়ে তা তৈরি করিয়ে নেন। তবে কালে খাঁ জমজম ও বিবি মরিয়মের নকশা তৈরি এবং নির্মাণকাজ তদারকি করেন মোগল কামান নির্মাতারা।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬০ সালে মীর জুমলাকে বাংলার সুবেদার নিয়োগ করেন। মীর জুমলা ১৬৬১ সালে আসাম অভিযানের সময় ৬৭৫টি ভারী কামান ব্যবহার করেন। তাঁর মধ্যে বিবি মরিয়ম ছিল সর্ববৃহত্। যুদ্ধশেষে বিজয়ী হয়ে তিনি বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার দক্ষিণে সোয়ারিঘাটে স্থাপন করেন। তখন থেকে কামানটি মীর জুমলার কামান নামে পরিচিত লাভ করে। কালে খাঁর মতো মীর জুমলাও একই ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছিল মোগল শাসকদের পতনের পর। উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকার ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট ও বিখ্যাত গ্রন্থাগার ডি. অয়লি লিখেছেন, ‘বিবি মরিয়ম ধীরে ধীরে কাদাপানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছিল। বর্ষাকালে কামানটির অর্ধেক থাকত পানির নিচে।’ ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালটার্স ১৮৪০ সালে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কামানটিকে কাদাপানি থেকে উদ্ধার করে চকবাজারের উত্তরে একটি বেদির ওপর স্থাপন করেন। তখন চকবাজার ছিল ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর স্থান। কামানটি চকবাজারে এনে রাখার পর তা দর্শনীয় হয়ে ওঠে। নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে সব বয়সী মানুষ এ কামান দেখার জন্য ভিড় করে। হিন্দু রমণীরা এসে কামানটির মুখে সিঁদুরের ফোঁটা দেন।
চকবাজার ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হলে ১৯২৫ সালে ঢাকার জাদুঘরের কিউরেটর নলিনীকান্ত ভট্টশালী কামানটিকে চকবাজার থেকে এনে সদরঘাটে স্থাপন করেন। তখন সদরঘাট ছিল ঢাকার সবচেয়ে মনোরম স্থান। এখানে এনে রাখার পর কামানটি আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গত শতকের পঞ্চাশ দশকে পাকিস্তান আমলে মীর জুমলাকে সদরঘাট থেকে এনে শোভাবর্ধনের জন্য গুলিস্তানের চৌরাস্তার মাঝখানে স্থাপন করা হয়। তখন গুলিস্তান ছিল ঢাকার কেন্দ্রস্থল এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। এখানে এনে রাখার পর কামানটি গুলিস্তানের কামান নামে পরিচিতি লাভ করে। তখনো কামানটি বেশ জনপ্রিয় ছিল ঢাকাবাসীর কাছে। তখনো মানুষ কামানটি দেখে শিহরিত হতো। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় বেগম মতিয়া চৌধুরী এ কামানের ওপর দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন লাখো মানুষের সামনে।
১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের সময় মীর জুমলাকে গুলিস্তানের মোড় থেকে উঠিয়ে এনে ওসমানী উদ্যানের প্রধান ফটকের পেছনে স্থাপন করা হয়। আর তখন থেকেই এ কামান লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে দেশবাসী তো বটেই, ঢাকাবাসীও কামানটিকে ভুলতে বসেছে। তাই ঢাকাবাসীর কেউ কেউ মনে করেন, প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন সুবেদার মীর জুমলার স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক এ কামানকে লালবাগ দুর্গের কিংবা জাতীয় জাদুঘরের সামনে এনে রাখাই সমীচীন। তা হলে ঢাকাবাসী তাঁদের ভালোবাসা ও গর্বের ধন মীর জুমলাকে নিত্যদিন পাবেন।
No comments