কর্নেল তাহের: এক অমীমাংসিত চরিত্র -পঁচাত্তরের নভেম্বর by শাহাদুজ্জামান
কর্নেল তাহেরের যাত্রাপথটিকে অনুসরণ করতে গিয়ে লক্ষ করি সাহসী, নাটকীয়, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা এ মানুষটির অস্থির পথপরিক্রমা একটি চূড়ান্ত মুহূর্তে গিয়ে পৌঁছায় পঁচাত্তরের সাতই নভেম্বরে। কিন্তু ঐতিহাসিক দিনক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে যে নজিরবিহীন কিম্ভূত টানাপোড়েন রয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় দেখি দশকের পর দশক ধরে এই তারিখটির মূল রূপকার কর্নেল তাহের এবং তাঁর উদ্দেশ্যকে ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার করে রাখার চেষ্টা। সাতই নভেম্বরের ওপর যে দাপ্তরিক তকমা রয়েছে, তার সঙ্গে এর মূল উদ্দেশ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন আগেই বলেছি, একটি ঐতিহাসিক মোচড়ে কার্নেল তাহেরের হাত থেকে ফসকে গেছে তাঁরই হাতে তৈরি দিন সাতই নভেম্বর। এ তারিখটির জট খুলতে ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়েছেন অনেকে। সেই সত্তরের দশকেই তাহেরকে নিয়ে প্রথম বিস্তারিত গবেষণাটি করেন লরেন্স লিফশুলত্স, যার ফল তাঁর আনফিনিসড রেভ্যুলেশন বইটি। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে সাক্ষাত্কার দিয়ে, স্মৃতিকথা লিখে সেই সময়টির অনুপুঙ্খ বয়ান দিয়েছেন সেদিনের ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত জাসদের অনেক নেতা-কর্মী, সৈনিক সংস্থার সদস্য এবং কর্নেল তাহের পরিবারের সদস্যরাও। আমি নিজে লিফশুলত্স থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বহুজনের সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে বুঝে ওঠার চেষ্টা করি সেই কালপর্বটিকে।
নানা টুকরো তথ্য আর স্মৃতিকথার ভেতর আমি সেই মানুষটিকে দেখি, যিনি সাতই নভেম্বরের পূর্বাপর সময়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে নারায়ণগঞ্জের নিজের বাসা থেকে ক্যান্টনমেন্ট, সেখান থেকে অভ্যুত্থানের কার্যালয় অ্যালিফ্যান্ট রোডে ভাইয়ের বাড়িতে ছোটাছুটি করছেন। তাহেরের কৈশোর থেকে তারুণ্যের যাত্রাপথটির পরিপ্রেক্ষিতে ওই ছোটাছুটি যখন লক্ষ করি তখন টের পাই, তাহের বুঝতে পারছেন প্রতিটি ঘণ্টা-মিনিট তখন গুরুত্বপূর্ণ। একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ার যে স্বপ্ন করোটিতে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন তাহের, তার শেষ সুযোগ তখন তাঁর সামনে। বাংলাদেশ তখন এক টালমাটাল নৌকার মতো দুলছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের পৃথিবী তখন পুঁজিবাদী আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে স্টষ্ট বিভক্ত। বাংলাদেশ নৌকার বিহ্বল মাঝি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নানা দোদুল্যমানতায় শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পালে লাগাবেন সমাজতন্ত্রের হাওয়া। কিন্তু তাঁর রক্তাক্ত দেহ নদীতে ছুড়ে ফেলে নৌকাকে ঘোর পুঁজিবাদী স্রোতে টেনে নিতে তখন উদ্যত খন্দকার মোশতাক। সে স্রোতকে খানিকটা বাধাগ্রস্ত করেন খালেদ মোশাররফ তাঁর দ্বিধান্বিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু অস্পষ্ট খালেদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়। পাল্টা আঘাতের জন্য তখন প্রস্তুত পুঁজিবাদী বলয়। সেই ক্রান্তিতে তাহের দ্রুত নৌকাটির হাল সমাজতন্ত্রের দিকে টানার শেষ চেষ্টা করেন। কোনো ধোঁয়াচ্ছন্ন সমাজতন্ত্র নয়, তাঁর ভাবনায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। জাসদের প্ল্যাটফর্মে এবং তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় সাতই নভেম্বরের সিপাহি জনতার বিপ্লব। বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে, বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক এবং কাকতালীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন কর্নেল তাহেরকে নির্ভর করতে হয় তত্কালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার ওপর। অভ্যুত্থানের কৌশল হিসেবেই তাহের সেদিন বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন জেনারেল জিয়াকে। তারপর যে বিচিত্র নাগরদোলায় ইতিহাসের চাকা ঘুরে যায়, দৃশ্যপট থেকে সম্পূর্ণ ছিটকে পড়া জেনারেল জিয়া যেভাবে দৃশ্যের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন এবং খেলার ছক পুরোটা বদলে তাঁরই মুক্তিদাতা তাহেরকে দৃশ্যপট থেকে সম্পূর্ণ বিদায় করার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করেন, তার সীমাহীন নাটকীয়তাটি আমি ধরার চেষ্টা করেছি আমার ক্রাচের কর্নেল বইটিতে।
সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের দুটো অধ্যায় ছিল—একটি সামরিক, অন্যটি বেসামরিক। অভ্যুত্থানের সামরিক অধ্যায়টি সফল হয়েছিল পুরোটাই, বেসামরিক অধ্যায়টির জন্য তাহের নির্ভর করেছিলেন জাসদের গণবাহিনীর ওপর, সে অধ্যায়টি ব্যর্থ হয়েছিল। এ নিয়ে জাসদ নেতাদের মিশ্র মতামত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য জাসদের তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। বরাবরের মতো তিনি তাঁর রহস্য বজায় রেখেছেন। কিন্তু ঘটনা এই যে বাংলাদেশের দীর্ঘ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে সাতই নভেম্বরই প্রথম এবং শেষবারের মতো সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কোনো দল ক্ষমতা গ্রহণের এতটা নিকটবর্তী হয়েছিল।
দিনটি তাঁদের হাত ফসকে গেলে অবশেষে শুরু হয় তাহেরসহ জাসদ নেতাদের প্রহসনমূলক বিচার। তাহেরের ভাই ডক্টর আনোয়ার হোসেন সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যখন ঢাকায় কারাবন্দী ছিলেন, তখন জেলে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি আমাকে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন জেলের ঠিক সেই জায়গাগুলো, যেখানে সাতই নভেম্বরের সেই প্রহসনমূলক বিচারের অস্থায়ী আদালত বসেছিল। স্মৃতিচারণা করছিলেন তাহেরকে নিয়ে স্লোগান দিয়ে আদালত ত্যাগের দৃশ্যের। আরেক আসামি মেজর জিয়াউদ্দীন বলছিলেন, এই বিচারের সীমাহীন ষড়যন্ত্রে আবেগ আক্রান্ত ছিলেন তাঁরা। তিনি আদলতকক্ষে বসেই কবিতা লিখেছেন অজস্র। কর্নেল তাহের ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কবিতাটি পড়েছিলেন, সেটি ছিল জিয়াউদ্দীনেরই লেখা। বন্দী তাহেরকে মুক্ত করতে তখন এক আত্মঘাতী দল জিম্মি করে ভারতীয় হাইকমিশনারকে। সে জিম্মি নাটকে নিহত হন তাহেরের ভাই বাহার। তাহেরকে রক্ষার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রধান আসামি না হলেও বিচারে একমাত্র তাহেরকেই দেওয়া হয় ফাঁসির আদেশ। ইতিহাস যারা সে মুহূর্তে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে, তারা স্পষ্ট জানত, ইতিহাস সে মুহূর্তে ছিল একটি মানুষেরই হাতের মুঠোয়, তিনি কর্নেল তাহের।
আমরা জেনেছি, বীরের মতো ফাঁসির মঞ্চে উঠেছেন তাহের। ভোর রাতে উঠে পরিপাটি করে সেজেছেন। স্ত্রীর আনা আম কেটে খেয়েছেন এবং কবিতা কণ্ঠে নিয়ে ফাঁসির দড়ি পরেছেন। বরাবরের মতোই নাটকীয়, কিন্তু স্থির সংকল্প। বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক লজ্জাই রয়েছে, তার অন্যতম একটি তাহেরের এই প্রহসনমূলক ফাঁসি। যত দিন তাহেরের ফাঁসির ষড়যন্ত্রটি জনসমক্ষে উন্মোচিত না হচ্ছে, তত দিন এ লজ্জা ঘোচার নয়। তাহেরের মৃত্যুর পর থেকে একটি অমীমাংসিত ইতিহাসের ছায়া তাড়িত করে বেড়াচ্ছে একটি পরিবারকে। স্বল্পস্থায়ী দাম্পত্য জীবন লুত্ফার—দেড় বছরের মাথায় স্বামীকে দেখলেন পা হারাতে, সাত বছরের মাথায় জীবন। তাঁকে দেখি বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকেন ছোট ছেলে অসুস্থ মিশুর জন্য। আরেক ছেলে যিশু আমার সামনে খুলে ধরে ট্রাংকবোঝাই করে সযত্নে রেখে দেওয়া কর্নেল তাহেরবিষয়ক কাগজপত্রের স্তূপ। মেয়ে নীতু বসে বসে তৈরি করেন বাবার নামে ওয়েবসাইট। সাতই নভেম্বরের চাকাটি অন্যদিকে ঘুরলে নিয়তি তাঁদের নিয়ে যেত অন্যত্র।
অবশ্য সাতই নভেম্বরের চাকাটি অন্যদিকে ঘোরার সুযোগ আদৌ ছিল কি না, সে প্রশ্নও তোলেন অনেকে। প্রশ্ন ওঠে, জাসদ যথার্থ সমাজতান্ত্রিক দল ছিল কি না? প্রশ্ন ওঠে, তাহের বিপ্লব নিয়ে খানিকটা তাড়াহুড়ো করে হঠকারী সিদ্ধন্ত নিয়ে ফেলেছিলেন কি না? সেনাবহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার প্রমুখ যাঁদের ভাবনার মূল ঘোর শৃঙ্খলা নিয়ে, অনেকেই তাঁদের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থে বোধগম্য কারণেই তাহেরকে উল্লেখ করেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে, উল্লেখ করেন সিপাহি অফিসারের ভেতর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মদদদাতা হিসেবে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দলের কাছে কর্নেল তাহের একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ। কারণ তাঁরাই তাহেরের মৃত্যুর কারণ আবার আওয়ামী লীগের কাছেও কর্নেল তাহের কোনো স্বস্তিকর প্রসঙ্গ নয়। কারণ তাহের সক্রিয় ছিলেন তত্কালীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ জাসদের সঙ্গে। এমনকি খোদ জাসদের কাছেও তাহের হয়ে উঠতে পারেন বিব্রতকর প্রসঙ্গ। কারণ তাহেরকে নেতৃত্বে ঠেলে দিয়ে সে সময় যথার্থ সহযোগিতা দিতে পারেননি তাঁরা। তাহের মৃত্যুকে বরণ করে নিলেও বেঁচে গেছেন তাঁরা সবাই।
একটি স্বাপ্নিক প্রজন্মের নিঃসঙ্গ বলি কর্নেল তাহের। কিন্তু কেবল সাফল্য অথবা ব্যর্থতায় নয়, তাহেরকে আমি দেখতে চেষ্টা করি তাঁর আকাঙ্ক্ষার ভেতর। অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতার ঘোড়দৌড়ের ভেতর এমন স্বপ্নের বারুদ কোথাও দেখি না বলে খুঁড়ে দেখার চেষ্টা করি এই বিতর্কিত আপাতব্যর্থ চরিত্রটিকে। ঠিক ইতিহাস নয়, গবেষণা নয় আবার প্রচলিত অর্থে উপন্যাসও নয়—এই তিন উপাদান মিলিয়েই শুরু করি আমার গ্রন্থ ক্রাচের কর্নেল...এক কর্নেলের গল্প ।। যুদ্ধাহত, ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটা এক কর্নেল। কিংবা এ গল্প হয়তো শুধু ওই কর্নেলের নয়। জাদুর হাওয়া লাগা আরও অনেক মানুষের। নাগরদোলায় চেপে বসা এক জনপদের। ঘোর লাগা এক সময়ের। (শেষ)
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
নানা টুকরো তথ্য আর স্মৃতিকথার ভেতর আমি সেই মানুষটিকে দেখি, যিনি সাতই নভেম্বরের পূর্বাপর সময়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে নারায়ণগঞ্জের নিজের বাসা থেকে ক্যান্টনমেন্ট, সেখান থেকে অভ্যুত্থানের কার্যালয় অ্যালিফ্যান্ট রোডে ভাইয়ের বাড়িতে ছোটাছুটি করছেন। তাহেরের কৈশোর থেকে তারুণ্যের যাত্রাপথটির পরিপ্রেক্ষিতে ওই ছোটাছুটি যখন লক্ষ করি তখন টের পাই, তাহের বুঝতে পারছেন প্রতিটি ঘণ্টা-মিনিট তখন গুরুত্বপূর্ণ। একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ গড়ার যে স্বপ্ন করোটিতে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন তাহের, তার শেষ সুযোগ তখন তাঁর সামনে। বাংলাদেশ তখন এক টালমাটাল নৌকার মতো দুলছে। ঠান্ডা লড়াইয়ের পৃথিবী তখন পুঁজিবাদী আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে স্টষ্ট বিভক্ত। বাংলাদেশ নৌকার বিহ্বল মাঝি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নানা দোদুল্যমানতায় শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পালে লাগাবেন সমাজতন্ত্রের হাওয়া। কিন্তু তাঁর রক্তাক্ত দেহ নদীতে ছুড়ে ফেলে নৌকাকে ঘোর পুঁজিবাদী স্রোতে টেনে নিতে তখন উদ্যত খন্দকার মোশতাক। সে স্রোতকে খানিকটা বাধাগ্রস্ত করেন খালেদ মোশাররফ তাঁর দ্বিধান্বিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু অস্পষ্ট খালেদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়। পাল্টা আঘাতের জন্য তখন প্রস্তুত পুঁজিবাদী বলয়। সেই ক্রান্তিতে তাহের দ্রুত নৌকাটির হাল সমাজতন্ত্রের দিকে টানার শেষ চেষ্টা করেন। কোনো ধোঁয়াচ্ছন্ন সমাজতন্ত্র নয়, তাঁর ভাবনায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। জাসদের প্ল্যাটফর্মে এবং তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় সাতই নভেম্বরের সিপাহি জনতার বিপ্লব। বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে, বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক এবং কাকতালীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন কর্নেল তাহেরকে নির্ভর করতে হয় তত্কালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়ার ওপর। অভ্যুত্থানের কৌশল হিসেবেই তাহের সেদিন বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন জেনারেল জিয়াকে। তারপর যে বিচিত্র নাগরদোলায় ইতিহাসের চাকা ঘুরে যায়, দৃশ্যপট থেকে সম্পূর্ণ ছিটকে পড়া জেনারেল জিয়া যেভাবে দৃশ্যের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন এবং খেলার ছক পুরোটা বদলে তাঁরই মুক্তিদাতা তাহেরকে দৃশ্যপট থেকে সম্পূর্ণ বিদায় করার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করেন, তার সীমাহীন নাটকীয়তাটি আমি ধরার চেষ্টা করেছি আমার ক্রাচের কর্নেল বইটিতে।
সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের দুটো অধ্যায় ছিল—একটি সামরিক, অন্যটি বেসামরিক। অভ্যুত্থানের সামরিক অধ্যায়টি সফল হয়েছিল পুরোটাই, বেসামরিক অধ্যায়টির জন্য তাহের নির্ভর করেছিলেন জাসদের গণবাহিনীর ওপর, সে অধ্যায়টি ব্যর্থ হয়েছিল। এ নিয়ে জাসদ নেতাদের মিশ্র মতামত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য জাসদের তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। বরাবরের মতো তিনি তাঁর রহস্য বজায় রেখেছেন। কিন্তু ঘটনা এই যে বাংলাদেশের দীর্ঘ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে সাতই নভেম্বরই প্রথম এবং শেষবারের মতো সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কোনো দল ক্ষমতা গ্রহণের এতটা নিকটবর্তী হয়েছিল।
দিনটি তাঁদের হাত ফসকে গেলে অবশেষে শুরু হয় তাহেরসহ জাসদ নেতাদের প্রহসনমূলক বিচার। তাহেরের ভাই ডক্টর আনোয়ার হোসেন সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যখন ঢাকায় কারাবন্দী ছিলেন, তখন জেলে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে। তিনি আমাকে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন জেলের ঠিক সেই জায়গাগুলো, যেখানে সাতই নভেম্বরের সেই প্রহসনমূলক বিচারের অস্থায়ী আদালত বসেছিল। স্মৃতিচারণা করছিলেন তাহেরকে নিয়ে স্লোগান দিয়ে আদালত ত্যাগের দৃশ্যের। আরেক আসামি মেজর জিয়াউদ্দীন বলছিলেন, এই বিচারের সীমাহীন ষড়যন্ত্রে আবেগ আক্রান্ত ছিলেন তাঁরা। তিনি আদলতকক্ষে বসেই কবিতা লিখেছেন অজস্র। কর্নেল তাহের ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কবিতাটি পড়েছিলেন, সেটি ছিল জিয়াউদ্দীনেরই লেখা। বন্দী তাহেরকে মুক্ত করতে তখন এক আত্মঘাতী দল জিম্মি করে ভারতীয় হাইকমিশনারকে। সে জিম্মি নাটকে নিহত হন তাহেরের ভাই বাহার। তাহেরকে রক্ষার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রধান আসামি না হলেও বিচারে একমাত্র তাহেরকেই দেওয়া হয় ফাঁসির আদেশ। ইতিহাস যারা সে মুহূর্তে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে, তারা স্পষ্ট জানত, ইতিহাস সে মুহূর্তে ছিল একটি মানুষেরই হাতের মুঠোয়, তিনি কর্নেল তাহের।
আমরা জেনেছি, বীরের মতো ফাঁসির মঞ্চে উঠেছেন তাহের। ভোর রাতে উঠে পরিপাটি করে সেজেছেন। স্ত্রীর আনা আম কেটে খেয়েছেন এবং কবিতা কণ্ঠে নিয়ে ফাঁসির দড়ি পরেছেন। বরাবরের মতোই নাটকীয়, কিন্তু স্থির সংকল্প। বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেক লজ্জাই রয়েছে, তার অন্যতম একটি তাহেরের এই প্রহসনমূলক ফাঁসি। যত দিন তাহেরের ফাঁসির ষড়যন্ত্রটি জনসমক্ষে উন্মোচিত না হচ্ছে, তত দিন এ লজ্জা ঘোচার নয়। তাহেরের মৃত্যুর পর থেকে একটি অমীমাংসিত ইতিহাসের ছায়া তাড়িত করে বেড়াচ্ছে একটি পরিবারকে। স্বল্পস্থায়ী দাম্পত্য জীবন লুত্ফার—দেড় বছরের মাথায় স্বামীকে দেখলেন পা হারাতে, সাত বছরের মাথায় জীবন। তাঁকে দেখি বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকেন ছোট ছেলে অসুস্থ মিশুর জন্য। আরেক ছেলে যিশু আমার সামনে খুলে ধরে ট্রাংকবোঝাই করে সযত্নে রেখে দেওয়া কর্নেল তাহেরবিষয়ক কাগজপত্রের স্তূপ। মেয়ে নীতু বসে বসে তৈরি করেন বাবার নামে ওয়েবসাইট। সাতই নভেম্বরের চাকাটি অন্যদিকে ঘুরলে নিয়তি তাঁদের নিয়ে যেত অন্যত্র।
অবশ্য সাতই নভেম্বরের চাকাটি অন্যদিকে ঘোরার সুযোগ আদৌ ছিল কি না, সে প্রশ্নও তোলেন অনেকে। প্রশ্ন ওঠে, জাসদ যথার্থ সমাজতান্ত্রিক দল ছিল কি না? প্রশ্ন ওঠে, তাহের বিপ্লব নিয়ে খানিকটা তাড়াহুড়ো করে হঠকারী সিদ্ধন্ত নিয়ে ফেলেছিলেন কি না? সেনাবহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার প্রমুখ যাঁদের ভাবনার মূল ঘোর শৃঙ্খলা নিয়ে, অনেকেই তাঁদের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থে বোধগম্য কারণেই তাহেরকে উল্লেখ করেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে, উল্লেখ করেন সিপাহি অফিসারের ভেতর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মদদদাতা হিসেবে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী দলের কাছে কর্নেল তাহের একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ। কারণ তাঁরাই তাহেরের মৃত্যুর কারণ আবার আওয়ামী লীগের কাছেও কর্নেল তাহের কোনো স্বস্তিকর প্রসঙ্গ নয়। কারণ তাহের সক্রিয় ছিলেন তত্কালীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ জাসদের সঙ্গে। এমনকি খোদ জাসদের কাছেও তাহের হয়ে উঠতে পারেন বিব্রতকর প্রসঙ্গ। কারণ তাহেরকে নেতৃত্বে ঠেলে দিয়ে সে সময় যথার্থ সহযোগিতা দিতে পারেননি তাঁরা। তাহের মৃত্যুকে বরণ করে নিলেও বেঁচে গেছেন তাঁরা সবাই।
একটি স্বাপ্নিক প্রজন্মের নিঃসঙ্গ বলি কর্নেল তাহের। কিন্তু কেবল সাফল্য অথবা ব্যর্থতায় নয়, তাহেরকে আমি দেখতে চেষ্টা করি তাঁর আকাঙ্ক্ষার ভেতর। অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতার ঘোড়দৌড়ের ভেতর এমন স্বপ্নের বারুদ কোথাও দেখি না বলে খুঁড়ে দেখার চেষ্টা করি এই বিতর্কিত আপাতব্যর্থ চরিত্রটিকে। ঠিক ইতিহাস নয়, গবেষণা নয় আবার প্রচলিত অর্থে উপন্যাসও নয়—এই তিন উপাদান মিলিয়েই শুরু করি আমার গ্রন্থ ক্রাচের কর্নেল...এক কর্নেলের গল্প ।। যুদ্ধাহত, ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটা এক কর্নেল। কিংবা এ গল্প হয়তো শুধু ওই কর্নেলের নয়। জাদুর হাওয়া লাগা আরও অনেক মানুষের। নাগরদোলায় চেপে বসা এক জনপদের। ঘোর লাগা এক সময়ের। (শেষ)
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
No comments