শিশুদের স্কুলমুখী করেন তিনি by গোলাম রাব্বানী
নারায়ণগঞ্জের
চাষাঢ়া রেলস্টেশনে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ট্রেন ভেড়ে। নিজ নিজ গন্তব্যে স্টেশন
ছাড়তে ব্যস্ত যাত্রীরা। প্ল্যাটফর্মের উত্তর প্রান্তের একটি খোলা জায়গায়
দাঁড়িয়ে ছিলেন ২৪ বছরের তরুণ শুভ চন্দ্র দাস। স্টেশন ছাড়তে তাঁর কোনো তাড়া
নেই। কারণ, তাঁর মন পড়ে থাকে স্বপ্নের গন্তব্যে, যেখানে শিশুদের হাতে-কলমে
বর্ণমালা শেখান; এই শিক্ষা নিয়ে দরিদ্র শিশুরা হয় স্কুলগামী।
চার বছর ধরে চাষাঢ়া রেলস্টেশন ও আশপাশের এলাকার শিশুদের বিনা মূল্যে পড়াশোনা করাচ্ছেন চা-দোকানি শুভ চন্দ্র দাস। শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে দিচ্ছেন বই, খাতা, কলম, ব্যাগসহ পড়াশোনার প্রয়োজনীয় উপকরণ। এ পর্যন্ত শতাধিক ছেলেমেয়ে পড়তে-লিখতে শিখেছে তাঁর কাছে। অক্ষরজ্ঞান দিয়ে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থীকে তিনি ভর্তি করিয়েছেন আশপাশের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখনো তাদের নিয়মিত সরবরাহ করছেন পড়াশোনার উপকরণ।
নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া শুভ চন্দ্র পড়াশোনা শেষ করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা চালাতে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় গার্মেন্টসে শ্রমিকের চাকরি নেন। কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের মৃত্যু হয়। নানান কারণে আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা হয়নি। গার্মেন্টসে চাকরির পাশাপাশি পরিচিত এক স্কুলশিক্ষকের কাছে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই পড়েছেন। সেই শিক্ষকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাও শেষ হয়ে যায় তাঁর।
২৫ জুন বিকেলে চাষাঢ়া স্টেশনে পৌঁছাতেই দূর থেকে একটি জাতীয় পতাকা চোখে পড়ে, এটি ছোট্ট টংদোকানের সঙ্গে বাঁশে বাঁধা। এগিয়ে যেতেই কানে আসে ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি, আমার সোনার বাংলা’। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বুকে হাত রেখে একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গাইছে। এরপর শপথ পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পড়ালেখা। খোলা আকাশের নিচে ছেঁড়া চটে বই-খাতা নিয়ে সামনের সারিতে বসেছে শিশুরা। পেছনে একসঙ্গে বসেছে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শুভর পুরোনো শিক্ষার্থীরা। তাদের সামনেই সবুজ টংদোকান। দোকানের এক পাশে লেখা, ‘শ্রী শুভ চন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা খরচে লেখাপড়া শেখানো হয়।’ পড়ালেখা শেষে কথা হয় শুভর সঙ্গে। তিনি জানান পেছনের গল্প।
শুভ চন্দ্র বলেন, ‘স্টেশনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। খেয়াল করলাম, এখানকার শিশুরা সারা দিন ঝগড়া আর খেলাধুলা করে সময় কাটায়। বাবা-মায়েরা শিশুদের কাজ করতে পাঠায়, কিন্তু স্কুলে পাঠায় না। এসব শিশুর অভিভাবকেরা নিম্ন আয়ের। শিশুদের বাবারা রিকশা, ভ্যান চালায়; মায়েরা ঝিয়ের কাজ করে। অর্থ আর সচেতনতার অভাবে সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। ওদের দেখে আমার মনে দাগ কাটে। তখন থেকেই শিশুদের সঙ্গে মিশতে শুরু করি। ওদের বাবা-মাকে স্বপ্ন দেখাই। প্রায় পাঁচ বছর শিক্ষার্থী সংগ্রহ করার পর ২০১৬ সালের ১১ মার্চ তাদের পড়ানো শুরু করি। একসময় শিক্ষার্থী পাইনি। এখন বন্দর, পাগলাসহ দূর-দূরান্ত থেকে বাচ্চারা আসে।’
শুভ জানান, ১০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে তাঁর শিক্ষার্থী ৭৭ জন। প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে পড়াশোনা। শুভর স্বপ্ন, তাঁর এই কার্যক্রমের গণ্ডি বিস্তৃত হবে। এটি বিদ্যালয়ে রূপ নেবে, যেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকবে। বিদ্যালয়ের জায়গা হবে, শিশুদের মাথার ওপর ছাদ হবে। ওরা যেন রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট না পায়।
শুভর কাছে পড়ালেখা করে ছাদিয়া জাহান। সে স্থানীয় আনন্দ স্লাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছাদিয়া জানায়, সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। পাশের হামিদার ইচ্ছা শিক্ষক হওয়ার। ছাদিয়ার মা আসমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওরে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল আমাগো। কিন্তু ইচ্ছা ছিল না। উনি (শুভ) ইচ্ছাটা তৈরি কইরা দিছেন। মাইয়ারে পড়াশোনা করায়া পাশের স্কুলে ভর্তি করাইছেন। খাতা-কলম, সবই উনি ব্যবস্থা করেন।’
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ হোসাইন ও মাশরুল আফতাব। নিয়মিত আড্ডা দেন শুভর চায়ের দোকানে। আসিফ বলেন, ‘শুভ শুধু বাচ্চাদের শেখান না, আমাদের সমাজের করণীয় কী, সেটাও দেখিয়ে দেন। শুভ আমাদের সমাজেরও শিক্ষক।’
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ‘যে কাজটা রাষ্ট্রের করার কথা ছিল, সেটা করছেন শুভ। কোনো কিছুই যে স্বপ্নপূরণে বাধা হতে পারে না, তা শুভ আমাদের শেখান। শুভ সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের মধ্যে স্বপ্নের দীপ জ্বেলে দেন।’
চার বছর ধরে চাষাঢ়া রেলস্টেশন ও আশপাশের এলাকার শিশুদের বিনা মূল্যে পড়াশোনা করাচ্ছেন চা-দোকানি শুভ চন্দ্র দাস। শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে দিচ্ছেন বই, খাতা, কলম, ব্যাগসহ পড়াশোনার প্রয়োজনীয় উপকরণ। এ পর্যন্ত শতাধিক ছেলেমেয়ে পড়তে-লিখতে শিখেছে তাঁর কাছে। অক্ষরজ্ঞান দিয়ে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থীকে তিনি ভর্তি করিয়েছেন আশপাশের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখনো তাদের নিয়মিত সরবরাহ করছেন পড়াশোনার উপকরণ।
নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া শুভ চন্দ্র পড়াশোনা শেষ করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা চালাতে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় গার্মেন্টসে শ্রমিকের চাকরি নেন। কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের মৃত্যু হয়। নানান কারণে আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা হয়নি। গার্মেন্টসে চাকরির পাশাপাশি পরিচিত এক স্কুলশিক্ষকের কাছে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই পড়েছেন। সেই শিক্ষকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাও শেষ হয়ে যায় তাঁর।
২৫ জুন বিকেলে চাষাঢ়া স্টেশনে পৌঁছাতেই দূর থেকে একটি জাতীয় পতাকা চোখে পড়ে, এটি ছোট্ট টংদোকানের সঙ্গে বাঁশে বাঁধা। এগিয়ে যেতেই কানে আসে ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি, আমার সোনার বাংলা’। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বুকে হাত রেখে একসঙ্গে জাতীয় সংগীত গাইছে। এরপর শপথ পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পড়ালেখা। খোলা আকাশের নিচে ছেঁড়া চটে বই-খাতা নিয়ে সামনের সারিতে বসেছে শিশুরা। পেছনে একসঙ্গে বসেছে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শুভর পুরোনো শিক্ষার্থীরা। তাদের সামনেই সবুজ টংদোকান। দোকানের এক পাশে লেখা, ‘শ্রী শুভ চন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা খরচে লেখাপড়া শেখানো হয়।’ পড়ালেখা শেষে কথা হয় শুভর সঙ্গে। তিনি জানান পেছনের গল্প।
শুভ চন্দ্র বলেন, ‘স্টেশনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। খেয়াল করলাম, এখানকার শিশুরা সারা দিন ঝগড়া আর খেলাধুলা করে সময় কাটায়। বাবা-মায়েরা শিশুদের কাজ করতে পাঠায়, কিন্তু স্কুলে পাঠায় না। এসব শিশুর অভিভাবকেরা নিম্ন আয়ের। শিশুদের বাবারা রিকশা, ভ্যান চালায়; মায়েরা ঝিয়ের কাজ করে। অর্থ আর সচেতনতার অভাবে সন্তানদের পড়াশোনার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। ওদের দেখে আমার মনে দাগ কাটে। তখন থেকেই শিশুদের সঙ্গে মিশতে শুরু করি। ওদের বাবা-মাকে স্বপ্ন দেখাই। প্রায় পাঁচ বছর শিক্ষার্থী সংগ্রহ করার পর ২০১৬ সালের ১১ মার্চ তাদের পড়ানো শুরু করি। একসময় শিক্ষার্থী পাইনি। এখন বন্দর, পাগলাসহ দূর-দূরান্ত থেকে বাচ্চারা আসে।’
শুভ জানান, ১০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে তাঁর শিক্ষার্থী ৭৭ জন। প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে পড়াশোনা। শুভর স্বপ্ন, তাঁর এই কার্যক্রমের গণ্ডি বিস্তৃত হবে। এটি বিদ্যালয়ে রূপ নেবে, যেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকবে। বিদ্যালয়ের জায়গা হবে, শিশুদের মাথার ওপর ছাদ হবে। ওরা যেন রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট না পায়।
শুভর কাছে পড়ালেখা করে ছাদিয়া জাহান। সে স্থানীয় আনন্দ স্লাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছাদিয়া জানায়, সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। পাশের হামিদার ইচ্ছা শিক্ষক হওয়ার। ছাদিয়ার মা আসমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওরে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল আমাগো। কিন্তু ইচ্ছা ছিল না। উনি (শুভ) ইচ্ছাটা তৈরি কইরা দিছেন। মাইয়ারে পড়াশোনা করায়া পাশের স্কুলে ভর্তি করাইছেন। খাতা-কলম, সবই উনি ব্যবস্থা করেন।’
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসিফ হোসাইন ও মাশরুল আফতাব। নিয়মিত আড্ডা দেন শুভর চায়ের দোকানে। আসিফ বলেন, ‘শুভ শুধু বাচ্চাদের শেখান না, আমাদের সমাজের করণীয় কী, সেটাও দেখিয়ে দেন। শুভ আমাদের সমাজেরও শিক্ষক।’
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ‘যে কাজটা রাষ্ট্রের করার কথা ছিল, সেটা করছেন শুভ। কোনো কিছুই যে স্বপ্নপূরণে বাধা হতে পারে না, তা শুভ আমাদের শেখান। শুভ সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের মধ্যে স্বপ্নের দীপ জ্বেলে দেন।’
শিশুদের লেখা শেখাচ্ছেন শুভ চন্দ্র দাস। গত মঙ্গলবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া রেলস্টেশন এলাকায়। ছবি: দিনার মাহমুদ |
No comments