আমজনতা রবীন্দ্রনাথকে কতটুকু চেনে by আহমদ রফিক
রবীন্দ্রনাথকে
আমরা চিনি, জানি, কিন্তু কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? এ প্রশ্নটি অতিশয়
তাৎপর্যপূর্ণ। আর অপ্রিয় সত্যটি হলো আমরা স্বল্প সংখ্যক শিক্ষিত শ্রেণির,
সংস্কৃতিমনস্ক মানুষই তাকে চিনি এবং জানি। আর তাও তাকে জানি অংশত রোমান্টিক
প্রেমের কবি হিসেবে, ভক্তিবাদী কবি-গীতিকার হিসেবে। আমরা ভেসে যাই তার
গানের কথা ও সুরের অপরূপ মাধুর্যে।
জীবনের শেষ পর্বে এসে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লিখেছিলেন : ‘আমি তোমাদেরই লোক’। একেবারে শেষ দিকে অনেকটা আত্মসমালোচনার ভঙ্গিতে যা লেখেন কাব্যপঙ্ক্তিতে তার প্রাঞ্জল অর্থ তিনি কৃষকজীবনের শরিক হতে পারেননি, তাদের সঙ্গে কবি হিসেবেও আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করতে পারেননি। দুটো ভিন্নধর্মী কথা। কোনটা সঠিক?
প্রথম কথাটির বিচার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রশ্ন উঠে আসে- ‘তোমাদের লোক’ বলতে তিন কাদের কথা বোঝাতে চেয়েছেন? শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চশিক্ষিত এলিট শ্রেণি, স্বশ্রেণির মানুষ, না কি সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গীয় মানুষ, খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষ- এক কথায় জনসাধারণের কথাই বলতে চেয়েছেন। তারাই ওই আবেগ-জড়িত পঙ্ক্তিটির লক্ষ্য।
বিভিন্ন সময়ে তার লেখা, বিশেষ করে ১৯ শতকের শেষ দশকের শেষ থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে তথা শিলাইদহ-সাজাদপুর, পতিসর অঞ্চলে এসে সাময়িক বসবাস উপলক্ষে কবির যে অভিজ্ঞতা এবং কিছু লেখালেখি বিশেষত কবিতা, গল্প ও ছিন্ন পত্রাবলির মতো নিবন্ধটি তাতে স্পষ্ট লক্ষ করা যায় সাধারণ মানুষের প্রতি, এমনকি কৃষক জনতার প্রতি তার আত্মিক সহানুভূতির প্রকাশ।
দরিদ্র নিরন্ন কৃষকের সমস্যা উপলব্ধি, অনুধাবন ও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা- দুটো পদ্ধতিতে। প্রথমত, সমবায়ী আদর্শের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক স্বনির্ভর গ্রাম গড়ে তোলা- দ্বিতীয়ত, তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার আপাত সমাধানের উদ্দেশ্যে নিম্নবর্গীয়দের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ব্যাংক খুলে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালু করা যাতে গরিব কৃষকদের মহাজনের শোষণের শিকার হতে না হয়।
তাই প্রথমে শিলাইদহে, পরে কালিগ্রামের সদর কাচারি পতিসরে খোলেন কালিগ্রাম কৃষি ব্যাংক, যা মুখে মুখে পতিসর কৃষি ব্যাংক নামে পরিচিতি পায়। এই পতিসর কৃষি ব্যাংক রবীন্দ্রনাথ গড়ে তোলেন ধারদেনার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে, তাও ৮ শতকরা সুদে। প্রথমে পরিবারের কোনো কোনো সদস্যের কাছ থেকে, পরে অন্য সূত্রে এবং বন্ধুস্বজনদের কাছ থেকে।
লক্ষণীয় ও তুলনীয় যে, একালের বহু প্রশংসিত গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ে তার ব্যাংকের ঋণে সুদের হার ছিল অনেক কম- মাত্র ১২ শতাংশ সরল সুদ এবং তা কোনো প্রকার বন্ধকি ছাড়া। এটাও আরো গভীর অর্থে অধিকতর কৃষক-বান্ধব গ্রামীণ ব্যাংক। পতিসর কৃষি ব্যাংক অভাবিত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল কৃষকদের মধ্যে। কথাটা লেখা আছে তৎকালীন রাজশাহী গেজেটিয়ার্সে।
লিখেছিলেন ওই গেজেটিয়ার্সের সম্পাদক এক বিদেশি, নাম ও’ ম্যালি। তার লেখার ভাষ্যে জানা যায় যে, পতিসর কৃষি ব্যাংকের অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার কারণে কালিগ্রাম পরগনার গ্রামাঞ্চল থেকে মহাজনগণ তাদের আগ্রাসী থাবা গুটিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এ ব্যাংক চলে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। এতে কবি তার নোবেল পুরস্কারের টাকার বড়সড় অংশ জমা রাখেন ব্যাংকের প্রয়োজন মেটাতে। শেষোক্ত ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে উঠে যায় দুই কারণে। প্রথমত, একটি সরকারি আইন বেঙ্গল রুরাল টেনেন্সি অ্যাক্ট, দ্বিতীয়ত, প্রদত্ত ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়া। রবীন্দ্রনাথের বহু কষ্টে সংগৃহীত টাকা ও নোবেল পুরস্কারের অর্থ নাগর নদীতে ভেসে যায়। এমনই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের প্রথম দিকেও। এ রবীন্দ্রনাথকে কি কৃষক-বান্ধব বলা চলে না?
এ ছাড়াও বহু উদাহরণ রয়েছে তার কৃষক-বান্ধব চরিত্রের, কৃষি উত্থানের আধুনিক চেতনার কারিগর হিসেবে। অনেক গরিব কৃষকের খাজনা মওকুফ করেছেন, কাউকে কাউকে চরের জমি দান করেছেন। খরায়, বন্যায় অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগে গোমস্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন খাজনা আদায়ে কড়াকড়ি না করতে। কবিজীবনীকার প্রশান্ত কুমার পাল তার চিঠি উদ্ধার করে সেসব তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। এই হলো জনবান্ধব জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথ।
॥ দুই ॥
রবীন্দ্রনাথেরই লেখা ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে উদাহরণ মেলে, এই গ্রামীণ জীবনজনপদ নিয়ে, এখানকার দরিদ্র মানুষের অবস্থা নিয়ে, তাদের হৃদয়ানুভূতি নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির কথা, তাদের প্রতি সহানুভূতির কথা, ক্ষেত্রবিশেষে মর্মবেদনার কথা। পরিচয় মেলে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ এক কবির, যার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানকার গ্রীষ্ম-বর্ষা, শরৎ-বসন্তের রূপকার কবি রবীন্দ্রনাথ।
উদাহরণ কম নয়, যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রাণভরে প্রশংসায় নিজেকে উজাড় করেছেন, সে প্রশংসা গ্রামীণ জনপদ ও সেখানকার অসহায় মানুষগুলোকে নিয়ে। বিপরীত ধারায় সমালোচনা মহানগর, কঠিন হৃদয় ও কৃত্রিম জীবনযাত্রার কলকতাকে নিয়ে। ‘ছিন্নপত্রাবলী’ তার উদাহরণ ধারণ করে। আর পতিসর-ভিত্তিক কাব্যগ্রন্থ ‘চৈতালি’তে দেখা যায় গভীর মানবিকবোধের প্রকাশ- মানুষ থেকে অবোধ, নিরীহ প্রাণিজগতকে ঘিরে। সেসব মানুষ সবই নিম্নবর্গীয়।
কিছু উদাহরণ-নির্ভর এই মানবিক চেতনার রবীন্দ্রনাথ, যার অনুভূতিতে-উপলব্ধিতে মানুষ-প্রকৃতি-ঈশ্বর একাকার, এক ত্রিভুজের অন্তর্গত, এর তিনকোণে প্রতিষ্ঠিত তাকে আমরা কোন অভিধায় চিহ্নিত করবো? জনবান্ধব, জনদরদি একজন গভীর হৃদয়ানুভূতি সম্পন্ন মানুষ হিসেবে, তেমনই চরিত্রের একজন কবি হিসেবে, নাকি একজন জমিদার হিসেবে।
ঘটনা, উদাহরণ, সাক্ষ্যপ্রমাণ তাকে প্রথমোক্ত চরিত্রের একজন মানুষ, একজন কবি হিসেবেই চিহ্নিত করে। জমিদার তার বাড়তি পরিচয়। এ রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি, জানি, কিন্তু কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? এ প্রশ্নটি অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ।
আর অপ্রিয় সত্যটি হলো আমরা স্বল্প সংখ্যক শিক্ষিত শ্রেণির, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষই তাকে চিনি এবং জানি। আর তাও তাকে জানি অংশত রোমান্টিক প্রেমের কবি হিসেবে, ভক্তিবাদী কবি-গীতিকার হিসেবে। আমরা ভেসে যাই তার গানের কথা ও সুরের অপরূপ মাধুর্যে। এর বাইরে তাকে কতটুকু চিনি বা জানি?
॥ তিন ॥
এর বড় অপ্রিয় প্রশ্ন হলো যে, সাধারণ মানুষের জন্য তার গভীর হৃদানুভূতির কথা ইতোপূর্বে দুই-আড়াই পৃষ্ঠাব্যাপী বিবরণে বলা হলো সেইসব সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গীয় মানুষ রবীন্দ্রনাথকে কতটুকু চেনে বা জানে? এ প্রশ্নের গভীর অপ্রিয় সত্য হলো, জানে না। চেনা তো দূরের কথা। নিরক্ষরদের জানানোর এই দায়িত্বটা পুরোপুরি শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব বড় একটা পালন করছেন বলে মনে হয় না।
আমার জীবনের একটি অধিকতর অপ্রিয় ঘটনা হলো, এই জানানোর দায়ের সত্যটা বলতে গিয়ে বিশ্বভারতীর এক প্রবীণ অধ্যাপকের তির্যক মন্তব্যের সম্মুখীন হয়েছিলাম। তার কথা, বিশ শতকের শেষার্ধে এসেও যদি রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করাতে হয়, তাহলে দরকার নেই সে প্রচেষ্টার। কিন্তু বাস্তবতা সর্বদাই অপ্রিয় সত্যই তুলে ধরে।
যে সত্যটা আমি জানি, আমাদের বেশকিছু সংখ্যক রবীন্দ্রানুরাগী জানেন যে কী পশ্চিমবঙ্গে, কী বাংলাদেশে নিরক্ষর সাধারণ মানুষ রবীন্দ্রনাথকে প্রায় চেনে না, জানে না বললে চলে, সেই সত্যটি সম্প্রতি ভারত বিচিত্রায় প্রকাশিত পঙ্কজ সাহার ‘আমজনতার রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি ছোট্ট নিবন্ধে, যা তার তৈরি ভিডিও তথ্যভিত্তিক ছোট প্রামাণ্য চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। সত্যই তারা রবীন্দ্রনাথকে চেনে না, জানে না, যাদের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের অমর বক্তব্য : ‘আমি তোমাদেরই লোক’।
মহানগর কলকাতায় বা রাজধানী ঢাকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমরা যতই উন্মাদনা প্রকাশ করি, করি তার সঙ্গীতানুষ্ঠানের আসরে, গ্রামাঞ্চলের বিশাল আমজনতার কাছে রবীন্দ্রনাথ এখনো মূলত অচেনা-অজানাই রয়ে গেছেন। এ অপ্রিয় সত্যটি না মেনে উপায় নেই।
এর দায় না রবীন্দ্রনাথের, না ওই আমজনতার। দায় আমাদের। অর্থাৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অর্থাৎ ভদ্রলোকশ্রেণির এবং সেইসঙ্গে রাজনৈতিক শাসকশ্রেণির, যারা গোটা জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তুলতে পারেনি, তেমন কোনো চেষ্টাও তাদের নেই; তাদের সংস্কৃতিমনস্ক করে তোলা তো অনেক দূরের কথা।
জীবনের শেষ পর্বে এসে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লিখেছিলেন : ‘আমি তোমাদেরই লোক’। একেবারে শেষ দিকে অনেকটা আত্মসমালোচনার ভঙ্গিতে যা লেখেন কাব্যপঙ্ক্তিতে তার প্রাঞ্জল অর্থ তিনি কৃষকজীবনের শরিক হতে পারেননি, তাদের সঙ্গে কবি হিসেবেও আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি করতে পারেননি। দুটো ভিন্নধর্মী কথা। কোনটা সঠিক?
প্রথম কথাটির বিচার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রশ্ন উঠে আসে- ‘তোমাদের লোক’ বলতে তিন কাদের কথা বোঝাতে চেয়েছেন? শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চশিক্ষিত এলিট শ্রেণি, স্বশ্রেণির মানুষ, না কি সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গীয় মানুষ, খেটে-খাওয়া মেহনতি মানুষ- এক কথায় জনসাধারণের কথাই বলতে চেয়েছেন। তারাই ওই আবেগ-জড়িত পঙ্ক্তিটির লক্ষ্য।
বিভিন্ন সময়ে তার লেখা, বিশেষ করে ১৯ শতকের শেষ দশকের শেষ থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে তথা শিলাইদহ-সাজাদপুর, পতিসর অঞ্চলে এসে সাময়িক বসবাস উপলক্ষে কবির যে অভিজ্ঞতা এবং কিছু লেখালেখি বিশেষত কবিতা, গল্প ও ছিন্ন পত্রাবলির মতো নিবন্ধটি তাতে স্পষ্ট লক্ষ করা যায় সাধারণ মানুষের প্রতি, এমনকি কৃষক জনতার প্রতি তার আত্মিক সহানুভূতির প্রকাশ।
দরিদ্র নিরন্ন কৃষকের সমস্যা উপলব্ধি, অনুধাবন ও সমস্যা সমাধানের চেষ্টা- দুটো পদ্ধতিতে। প্রথমত, সমবায়ী আদর্শের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক স্বনির্ভর গ্রাম গড়ে তোলা- দ্বিতীয়ত, তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার আপাত সমাধানের উদ্দেশ্যে নিম্নবর্গীয়দের দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ব্যাংক খুলে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালু করা যাতে গরিব কৃষকদের মহাজনের শোষণের শিকার হতে না হয়।
তাই প্রথমে শিলাইদহে, পরে কালিগ্রামের সদর কাচারি পতিসরে খোলেন কালিগ্রাম কৃষি ব্যাংক, যা মুখে মুখে পতিসর কৃষি ব্যাংক নামে পরিচিতি পায়। এই পতিসর কৃষি ব্যাংক রবীন্দ্রনাথ গড়ে তোলেন ধারদেনার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে, তাও ৮ শতকরা সুদে। প্রথমে পরিবারের কোনো কোনো সদস্যের কাছ থেকে, পরে অন্য সূত্রে এবং বন্ধুস্বজনদের কাছ থেকে।
লক্ষণীয় ও তুলনীয় যে, একালের বহু প্রশংসিত গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ে তার ব্যাংকের ঋণে সুদের হার ছিল অনেক কম- মাত্র ১২ শতাংশ সরল সুদ এবং তা কোনো প্রকার বন্ধকি ছাড়া। এটাও আরো গভীর অর্থে অধিকতর কৃষক-বান্ধব গ্রামীণ ব্যাংক। পতিসর কৃষি ব্যাংক অভাবিত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল কৃষকদের মধ্যে। কথাটা লেখা আছে তৎকালীন রাজশাহী গেজেটিয়ার্সে।
লিখেছিলেন ওই গেজেটিয়ার্সের সম্পাদক এক বিদেশি, নাম ও’ ম্যালি। তার লেখার ভাষ্যে জানা যায় যে, পতিসর কৃষি ব্যাংকের অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার কারণে কালিগ্রাম পরগনার গ্রামাঞ্চল থেকে মহাজনগণ তাদের আগ্রাসী থাবা গুটিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এ ব্যাংক চলে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। এতে কবি তার নোবেল পুরস্কারের টাকার বড়সড় অংশ জমা রাখেন ব্যাংকের প্রয়োজন মেটাতে। শেষোক্ত ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে উঠে যায় দুই কারণে। প্রথমত, একটি সরকারি আইন বেঙ্গল রুরাল টেনেন্সি অ্যাক্ট, দ্বিতীয়ত, প্রদত্ত ঋণের টাকা ফেরত না পাওয়া। রবীন্দ্রনাথের বহু কষ্টে সংগৃহীত টাকা ও নোবেল পুরস্কারের অর্থ নাগর নদীতে ভেসে যায়। এমনই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের প্রথম দিকেও। এ রবীন্দ্রনাথকে কি কৃষক-বান্ধব বলা চলে না?
এ ছাড়াও বহু উদাহরণ রয়েছে তার কৃষক-বান্ধব চরিত্রের, কৃষি উত্থানের আধুনিক চেতনার কারিগর হিসেবে। অনেক গরিব কৃষকের খাজনা মওকুফ করেছেন, কাউকে কাউকে চরের জমি দান করেছেন। খরায়, বন্যায় অর্থাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগে গোমস্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন খাজনা আদায়ে কড়াকড়ি না করতে। কবিজীবনীকার প্রশান্ত কুমার পাল তার চিঠি উদ্ধার করে সেসব তথ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। এই হলো জনবান্ধব জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথ।
॥ দুই ॥
রবীন্দ্রনাথেরই লেখা ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে উদাহরণ মেলে, এই গ্রামীণ জীবনজনপদ নিয়ে, এখানকার দরিদ্র মানুষের অবস্থা নিয়ে, তাদের হৃদয়ানুভূতি নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির কথা, তাদের প্রতি সহানুভূতির কথা, ক্ষেত্রবিশেষে মর্মবেদনার কথা। পরিচয় মেলে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ এক কবির, যার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানকার গ্রীষ্ম-বর্ষা, শরৎ-বসন্তের রূপকার কবি রবীন্দ্রনাথ।
উদাহরণ কম নয়, যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রাণভরে প্রশংসায় নিজেকে উজাড় করেছেন, সে প্রশংসা গ্রামীণ জনপদ ও সেখানকার অসহায় মানুষগুলোকে নিয়ে। বিপরীত ধারায় সমালোচনা মহানগর, কঠিন হৃদয় ও কৃত্রিম জীবনযাত্রার কলকতাকে নিয়ে। ‘ছিন্নপত্রাবলী’ তার উদাহরণ ধারণ করে। আর পতিসর-ভিত্তিক কাব্যগ্রন্থ ‘চৈতালি’তে দেখা যায় গভীর মানবিকবোধের প্রকাশ- মানুষ থেকে অবোধ, নিরীহ প্রাণিজগতকে ঘিরে। সেসব মানুষ সবই নিম্নবর্গীয়।
কিছু উদাহরণ-নির্ভর এই মানবিক চেতনার রবীন্দ্রনাথ, যার অনুভূতিতে-উপলব্ধিতে মানুষ-প্রকৃতি-ঈশ্বর একাকার, এক ত্রিভুজের অন্তর্গত, এর তিনকোণে প্রতিষ্ঠিত তাকে আমরা কোন অভিধায় চিহ্নিত করবো? জনবান্ধব, জনদরদি একজন গভীর হৃদয়ানুভূতি সম্পন্ন মানুষ হিসেবে, তেমনই চরিত্রের একজন কবি হিসেবে, নাকি একজন জমিদার হিসেবে।
ঘটনা, উদাহরণ, সাক্ষ্যপ্রমাণ তাকে প্রথমোক্ত চরিত্রের একজন মানুষ, একজন কবি হিসেবেই চিহ্নিত করে। জমিদার তার বাড়তি পরিচয়। এ রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি, জানি, কিন্তু কতটুকু চিনি, কতটুকু জানি? এ প্রশ্নটি অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ।
আর অপ্রিয় সত্যটি হলো আমরা স্বল্প সংখ্যক শিক্ষিত শ্রেণির, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষই তাকে চিনি এবং জানি। আর তাও তাকে জানি অংশত রোমান্টিক প্রেমের কবি হিসেবে, ভক্তিবাদী কবি-গীতিকার হিসেবে। আমরা ভেসে যাই তার গানের কথা ও সুরের অপরূপ মাধুর্যে। এর বাইরে তাকে কতটুকু চিনি বা জানি?
॥ তিন ॥
এর বড় অপ্রিয় প্রশ্ন হলো যে, সাধারণ মানুষের জন্য তার গভীর হৃদানুভূতির কথা ইতোপূর্বে দুই-আড়াই পৃষ্ঠাব্যাপী বিবরণে বলা হলো সেইসব সাধারণ মানুষ, নিম্নবর্গীয় মানুষ রবীন্দ্রনাথকে কতটুকু চেনে বা জানে? এ প্রশ্নের গভীর অপ্রিয় সত্য হলো, জানে না। চেনা তো দূরের কথা। নিরক্ষরদের জানানোর এই দায়িত্বটা পুরোপুরি শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব বড় একটা পালন করছেন বলে মনে হয় না।
আমার জীবনের একটি অধিকতর অপ্রিয় ঘটনা হলো, এই জানানোর দায়ের সত্যটা বলতে গিয়ে বিশ্বভারতীর এক প্রবীণ অধ্যাপকের তির্যক মন্তব্যের সম্মুখীন হয়েছিলাম। তার কথা, বিশ শতকের শেষার্ধে এসেও যদি রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করাতে হয়, তাহলে দরকার নেই সে প্রচেষ্টার। কিন্তু বাস্তবতা সর্বদাই অপ্রিয় সত্যই তুলে ধরে।
যে সত্যটা আমি জানি, আমাদের বেশকিছু সংখ্যক রবীন্দ্রানুরাগী জানেন যে কী পশ্চিমবঙ্গে, কী বাংলাদেশে নিরক্ষর সাধারণ মানুষ রবীন্দ্রনাথকে প্রায় চেনে না, জানে না বললে চলে, সেই সত্যটি সম্প্রতি ভারত বিচিত্রায় প্রকাশিত পঙ্কজ সাহার ‘আমজনতার রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি ছোট্ট নিবন্ধে, যা তার তৈরি ভিডিও তথ্যভিত্তিক ছোট প্রামাণ্য চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। সত্যই তারা রবীন্দ্রনাথকে চেনে না, জানে না, যাদের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের অমর বক্তব্য : ‘আমি তোমাদেরই লোক’।
মহানগর কলকাতায় বা রাজধানী ঢাকায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমরা যতই উন্মাদনা প্রকাশ করি, করি তার সঙ্গীতানুষ্ঠানের আসরে, গ্রামাঞ্চলের বিশাল আমজনতার কাছে রবীন্দ্রনাথ এখনো মূলত অচেনা-অজানাই রয়ে গেছেন। এ অপ্রিয় সত্যটি না মেনে উপায় নেই।
এর দায় না রবীন্দ্রনাথের, না ওই আমজনতার। দায় আমাদের। অর্থাৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অর্থাৎ ভদ্রলোকশ্রেণির এবং সেইসঙ্গে রাজনৈতিক শাসকশ্রেণির, যারা গোটা জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তুলতে পারেনি, তেমন কোনো চেষ্টাও তাদের নেই; তাদের সংস্কৃতিমনস্ক করে তোলা তো অনেক দূরের কথা।
No comments