সৃজনশীলতায় হিরোশিমা-নাগাসাকির অনুপ্রেরণা by মনজুরুল হক
প্রতিবছর
আগস্ট মাসের ৬ ও ৯ তারিখ জাপানিদের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে
হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিকতাকে। ৭৪ বছর আগে প্রথমে হিরোশিমা শহরে এবং
এর তিন দিন পর নাগাসাকিতে ফেলা হয়েছিল আণবিক বোমা। এ বোমা কেবল
তাৎক্ষণিকভাবে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণই বধ করেনি, সেই সঙ্গে পৃথিবীকে জানান
দিয়েছিল এক কালের সূচনার; মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা করা যখন পেয়ে যাবে নতুন
এক মাত্রা। আণবিক যুগের সূচনা যদি হয়ে থাকে ৬ আগস্ট হিরোশিমায় আণবিক বোমার
বিস্ফোরণ ঘটানোর মধ্য দিয়ে, ৯ আগস্ট নাগাসাকির মর্মান্তিকতা স্পষ্ট করে
দেখিয়ে দিয়ে গেছে ব্যাপক ধ্বংস ও সাধারণ মানুষের প্রাণ বধ এখন থেকে আর
বিবেকের দংশনে তাড়িত হওয়ার মতো কোনো কিছু বলে গণ্য হবে না। কেননা, বোমা
যারা নিক্ষেপ করেছে, হিরোশিমার মর্মান্তিকতা তাদের বিবেককে তাড়িত করলে ঠিক
তিন দিন পর নাগাসাকির ওপর একই বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো থেকে তারা হয়তো বিরত
থাকত।
তবে ৭৪ বছর আগে আমাদের এই পৃথিবী আণবিক যুগে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে আধিপত্য বিস্তারের নতুন এক খেলায় মত্ত হলেও পাশাপাশি আবার সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ সেদিন থেকেই বলা যায় দাঁড়িয়ে গেছে শক্তির এই দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। ফলে হিরোশিমা–নাগাসাকি একই সঙ্গে হয়ে উঠেছে আমাদের স্বপ্নের শহর, যে শহরের সেদিনের ধ্বংসলীলা আজও আমাদের সাহস জুগিয়ে চলেছে প্রতিবাদী হওয়ার, আমাদের উদ্বুদ্ধ করছে মানবসভ্যতার সম্ভাব্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে। তাই ১৯৪৫ সালের সেই দিন থেকেই জাপানের এই দুই শহর আর জাপানের একার থাকেনি, বরং রূপান্তরিত হয়েছে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের প্রাণের শহরে। অকারণেই হয়তো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতিচর্চায় নিবেদিত লোকজন এতটা আকৃষ্ট হয়েছেন এই দুই শহরের প্রতি, যে আকর্ষণে কোনো রকম ঘাটতি কখনো দেখা যায়নি। শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী সেসব প্রতিবাদী মানুষের দলে জাপানিদের সংশ্লিষ্টতা স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
ফিরিয়ে দাও আমার পিতাকে ফিরিয়ে দাও আমার মাতাকে
ফিরিয়ে দাও বৃদ্ধদের
ফিরিয়ে দাও শিশুদের
ফিরিয়ে দাও আমাকে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে
ফিরিয়ে দাও মানবতা
যত দিন আছে মানবিক এক বিশ্ব
ফিরিয়ে দাও আমাদের সেই শান্তি চিরায়ত শান্তি
হিরোশিমার তরতাজা স্মৃতিকে সামনে রেখে কবিতাটি লিখেছিলেন আণবিক বোমা হামলার সরাসরি অভিজ্ঞতা হওয়া জাপানি কবি সানকিচি তোগে। ১৯৫৩ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হিরোশিমার এক হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এই কবি, যাঁর কবিতা ১৯৪৫ সালের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর নাটকীয় এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। তোগেকে ধরা হয় সেই সাহিত্যিকদের একজন, হিরোশিমার অভিজ্ঞতা যাঁরা নিজেদের রচনায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন। সেই একই ধারার আরেক প্রতিনিধি হলেন হারা তামিকি, যাঁর ‘গ্রীষ্মের ফুল’ নামের ছোটগল্প হচ্ছে অসাধারণ এক সৃষ্টি। হারা তামিকি একই সঙ্গে ছিলেন কবি আর ছোটগল্পের লেখক এবং বোমা হামলার সময় হিরোশিমা অবস্থান করায় তেজস্ক্রিয়তার বিষের ছোবল থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি। মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর শঙ্কা তিনি তখন থেকেই অনুভব করতে শুরু করেন। আতঙ্ক অল্প দিনের মধ্যে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল আত্মহননের পথে।
হিরোশিমার মর্মান্তিকতা শিল্প-সাহিত্যের জগতে প্রচণ্ড যে আলোড়ন নিয়ে এসেছিল, তার প্রভাব লক্ষ করা যায় বিংশ শতাব্দী অতিক্রম করে একুশ শতকের এই সময় পর্যন্ত। আর সেই আলোড়ন যে কেবল জাপানে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়; সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে হিরোশিমা নতুন এক চেতনায় জাগ্রত করে তোলে, যার প্রভাব দেখা যায় এদের নিজ নিজ সৃজনশীল কর্মে।
জাপানের বাইরে হিরোশিমার স্মৃতির সবচেয়ে সাড়া–জাগানো সৃষ্টি সম্ভবত হচ্ছে ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্গারেট ডুরাসের অমর উপন্যাস ‘হিরোশিমা মন অমর’, যে উপন্যাসকে অনেক বেশি অর্থবহ করে ছায়াছবির পর্দায় নিয়ে এসেছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আলাঁ রেনে তাঁর একই নামে তৈরি চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। জাপানের ছায়াছবির জগতেও বারবার ঘুরেফিরে এসেছে হিরোশিমা আর নাগাসাকি, কখনো তিক্ত বেদনায় দর্শকদের ভাসিয়ে দিয়ে, কখনো আবার শান্তির অন্বেষণে জড়িত হওয়ার ব্রত দর্শকদের মনের পর্দায় গেঁথে দিয়ে। শোহেই ইমামুরা যেমন মাসুজি ইবুসির অমর উপন্যাস ‘কালো বৃষ্টি’ অবলম্বনে তৈরি করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলোর একটি। একইভাবে আকিরা কুরোসাওয়াও পিছিয়ে থাকেননি আণবিক বোমার দুঃস্বপ্নকে ছায়াছবির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা থেকে। তাঁর ‘র্যাপসডি ইন আগস্ট’–এ আমরা দেখি যুদ্ধের অনেক পরেও বোমা হামলার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হওয়া প্রজন্মের পরবর্তী জীবনের বাস্তবতাকে সহজে মেনে নেওয়ার অপারগতার এক মানবিক প্রতিফলন।
পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফিচার ছবির বাইরে অ্যানিমেশন বা কার্টুন ছবির নির্মাতারাও তাঁদের নিজস্ব অবস্থান থেকে আলোকপাত করেছেন হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিকতার ওপর। ‘হাদাশি-নো-গেন’ বা ‘নগ্নপদের গেন’ নামে কার্টুন আকারে প্রকাশিত কেইজি নাকাজাওয়ার রচনা পরে কার্টুন ছবিতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শুনিয়ে গেছে হিরোশিমার এক বালকের দুর্দশার কথা, বোমা হামলা যার জীবনে নিয়ে এসেছিল করুণ পরিণতি। সেই কার্টুন ছবিটি তৈরি করেছেন পরিচালক মোরি মাসাকি। দর্শকদের চোখ ভিজিয়ে দেওয়া আরেকটি কার্টুন ছবি হচ্ছে ‘হোতারু নো হাকা’ বা ‘জোনাকির কবর’। হিরোশিমা-নাগাসাকি সেখানে সরাসরি উপস্থিত না হলেও খুব বেশি দূরে থাকেনি। যুদ্ধ এক পরিবারের দুই কিশোর সদস্যের জীবনকে কীভাবে ওলট-পালট কররে দিয়ে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়, তার খুবই মর্মস্পর্শী বর্ণনা সেই গল্পে দিয়েছেন প্রয়াত লেখক নোসাকা আকিইয়ুকি এবং তাঁর সেই কাহিনিকে অ্যানিমেশন ছবিতে নিয়ে আসেন পরিচালক তয়া সাতো। বছর দুয়েক আগে মুক্তি পাওয়া আরেকটি মর্মস্পর্শী কার্টুন ছবি হচ্ছে ‘পৃথিবীর এই কোনায়’, ফুমিও কোনোর লেখা যে কার্টুনকাহিনি নিয়ে অ্যানিমেশন ছবি তৈরি করেছেন পরিচালক সানাও কাতাবুচি। সেই কার্টুন ছবিতে সদ্য বিবাহিত তরুণী সুজু উরানোর কথা বলা হয়েছে, যুদ্ধের সময় হিরোশিমার পাশের শহর কুরেতে সংসার গড়তে এসে যুদ্ধ আর বোমা হামলায় ছারখার হয়ে যায় যার ছোট্ট স্বপ্ন।
জাপানের ওপর আণবিক বোমা হামলা নিয়ে সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় যাঁকে থাকতে দেখা গেছে, তিনি হলেন কেনজাবুরো ওয়ে। তাঁর ‘হিরোশিমা নোটস’ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বোমা হামলায় সাধারণ নাগরিকদের যে দুর্দশা ভোগ করে হয়েছে, সেই দিক। নিজে হিরোশিমা ভ্রমণে গিয়ে বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের দুর্দশা লিপিবদ্ধ করার মধ্যেই নিজের কর্মকাণ্ড তিনি সীমিত রাখেননি; একই সঙ্গে একই আণবিক বোমা হামলার সঙ্গে সম্পর্কিত গল্পের সংকলন তিনি প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে আণবিক বোমা সাহিত্য নামে পরিচয় লাভ করা সাহিত্যের সেদিকে সেই সংকলন ছিল প্রথম একটি উল্লেখযোগ্য সহযোজন। ইংরেজিতে ‘ক্রেজি আইরিস অ্যান্ড আদার স্টোরিস’ নামে অনূদিত সেই সংকলন ভুক্তভোগীরা কীভাবে বোমা হামলাকে দেখেছেন, ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে তার বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিল।
সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পাশাপাশি শিল্পীরাও জড়িত হয়েছেন হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিকতা রং-তুলিতে তুলে ধরে বিশ্ববাসীর বিবেককে জাগ্রত করে তোলার প্রয়াসে। সেই দলে শুরুতেই নাম নিতে হয় মুরাকি দম্পতির। তারো ওকামোতোর ‘আগামীকালের কিংবদন্তি’ নামের ছবিটি শিল্পী এঁকেছিলেন পারমাণবিক বিশ্বের ভয়াবহতা তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। দীর্ঘ এই প্যানেল ছবিতে একসময় হারিয়ে গেলে পরে মেক্সিকোতে সেটা খুঁজে পাওয়া যায় এবং টোকিও মেট্রোপলিটন সরকার পরে সেটা কিনে এনে টোকিওর শিবুইয়া স্টেশন মানুষের দেখার জন্য সেটি রেখেছে।
৭৪ বছর আগের আণবিক বোমা হামলা তাই একদিক থেকে জাপানের জন্য ভয়ংকর দুর্দশা এনে দিলেও অন্যদিকে শান্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে করে তুলেছে অনেক বেশি সচেতন, যে সচেতনতার প্রকাশ দেখা যায় জাপানের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সৃজনশীল লোকজনের নানা রকম কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার মধ্যে। ফলে, সেই মর্মান্তিকতার পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটতে পারে, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও এখন একেবারে কম নয় এবং এটাই ধ্বংসের স্মৃতির মধ্যেও আশার বার্তা আমাদের শোনায়।
তবে ৭৪ বছর আগে আমাদের এই পৃথিবী আণবিক যুগে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে আধিপত্য বিস্তারের নতুন এক খেলায় মত্ত হলেও পাশাপাশি আবার সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ সেদিন থেকেই বলা যায় দাঁড়িয়ে গেছে শক্তির এই দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। ফলে হিরোশিমা–নাগাসাকি একই সঙ্গে হয়ে উঠেছে আমাদের স্বপ্নের শহর, যে শহরের সেদিনের ধ্বংসলীলা আজও আমাদের সাহস জুগিয়ে চলেছে প্রতিবাদী হওয়ার, আমাদের উদ্বুদ্ধ করছে মানবসভ্যতার সম্ভাব্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে। তাই ১৯৪৫ সালের সেই দিন থেকেই জাপানের এই দুই শহর আর জাপানের একার থাকেনি, বরং রূপান্তরিত হয়েছে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের প্রাণের শহরে। অকারণেই হয়তো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতিচর্চায় নিবেদিত লোকজন এতটা আকৃষ্ট হয়েছেন এই দুই শহরের প্রতি, যে আকর্ষণে কোনো রকম ঘাটতি কখনো দেখা যায়নি। শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী সেসব প্রতিবাদী মানুষের দলে জাপানিদের সংশ্লিষ্টতা স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
ফিরিয়ে দাও আমার পিতাকে ফিরিয়ে দাও আমার মাতাকে
ফিরিয়ে দাও বৃদ্ধদের
ফিরিয়ে দাও শিশুদের
ফিরিয়ে দাও আমাকে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে
ফিরিয়ে দাও মানবতা
যত দিন আছে মানবিক এক বিশ্ব
ফিরিয়ে দাও আমাদের সেই শান্তি চিরায়ত শান্তি
হিরোশিমার তরতাজা স্মৃতিকে সামনে রেখে কবিতাটি লিখেছিলেন আণবিক বোমা হামলার সরাসরি অভিজ্ঞতা হওয়া জাপানি কবি সানকিচি তোগে। ১৯৫৩ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হিরোশিমার এক হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এই কবি, যাঁর কবিতা ১৯৪৫ সালের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর নাটকীয় এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। তোগেকে ধরা হয় সেই সাহিত্যিকদের একজন, হিরোশিমার অভিজ্ঞতা যাঁরা নিজেদের রচনায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন। সেই একই ধারার আরেক প্রতিনিধি হলেন হারা তামিকি, যাঁর ‘গ্রীষ্মের ফুল’ নামের ছোটগল্প হচ্ছে অসাধারণ এক সৃষ্টি। হারা তামিকি একই সঙ্গে ছিলেন কবি আর ছোটগল্পের লেখক এবং বোমা হামলার সময় হিরোশিমা অবস্থান করায় তেজস্ক্রিয়তার বিষের ছোবল থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি। মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর শঙ্কা তিনি তখন থেকেই অনুভব করতে শুরু করেন। আতঙ্ক অল্প দিনের মধ্যে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল আত্মহননের পথে।
হিরোশিমার মর্মান্তিকতা শিল্প-সাহিত্যের জগতে প্রচণ্ড যে আলোড়ন নিয়ে এসেছিল, তার প্রভাব লক্ষ করা যায় বিংশ শতাব্দী অতিক্রম করে একুশ শতকের এই সময় পর্যন্ত। আর সেই আলোড়ন যে কেবল জাপানে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়; সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে হিরোশিমা নতুন এক চেতনায় জাগ্রত করে তোলে, যার প্রভাব দেখা যায় এদের নিজ নিজ সৃজনশীল কর্মে।
জাপানের বাইরে হিরোশিমার স্মৃতির সবচেয়ে সাড়া–জাগানো সৃষ্টি সম্ভবত হচ্ছে ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্গারেট ডুরাসের অমর উপন্যাস ‘হিরোশিমা মন অমর’, যে উপন্যাসকে অনেক বেশি অর্থবহ করে ছায়াছবির পর্দায় নিয়ে এসেছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আলাঁ রেনে তাঁর একই নামে তৈরি চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। জাপানের ছায়াছবির জগতেও বারবার ঘুরেফিরে এসেছে হিরোশিমা আর নাগাসাকি, কখনো তিক্ত বেদনায় দর্শকদের ভাসিয়ে দিয়ে, কখনো আবার শান্তির অন্বেষণে জড়িত হওয়ার ব্রত দর্শকদের মনের পর্দায় গেঁথে দিয়ে। শোহেই ইমামুরা যেমন মাসুজি ইবুসির অমর উপন্যাস ‘কালো বৃষ্টি’ অবলম্বনে তৈরি করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ছবিগুলোর একটি। একইভাবে আকিরা কুরোসাওয়াও পিছিয়ে থাকেননি আণবিক বোমার দুঃস্বপ্নকে ছায়াছবির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা থেকে। তাঁর ‘র্যাপসডি ইন আগস্ট’–এ আমরা দেখি যুদ্ধের অনেক পরেও বোমা হামলার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হওয়া প্রজন্মের পরবর্তী জীবনের বাস্তবতাকে সহজে মেনে নেওয়ার অপারগতার এক মানবিক প্রতিফলন।
পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফিচার ছবির বাইরে অ্যানিমেশন বা কার্টুন ছবির নির্মাতারাও তাঁদের নিজস্ব অবস্থান থেকে আলোকপাত করেছেন হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিকতার ওপর। ‘হাদাশি-নো-গেন’ বা ‘নগ্নপদের গেন’ নামে কার্টুন আকারে প্রকাশিত কেইজি নাকাজাওয়ার রচনা পরে কার্টুন ছবিতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শুনিয়ে গেছে হিরোশিমার এক বালকের দুর্দশার কথা, বোমা হামলা যার জীবনে নিয়ে এসেছিল করুণ পরিণতি। সেই কার্টুন ছবিটি তৈরি করেছেন পরিচালক মোরি মাসাকি। দর্শকদের চোখ ভিজিয়ে দেওয়া আরেকটি কার্টুন ছবি হচ্ছে ‘হোতারু নো হাকা’ বা ‘জোনাকির কবর’। হিরোশিমা-নাগাসাকি সেখানে সরাসরি উপস্থিত না হলেও খুব বেশি দূরে থাকেনি। যুদ্ধ এক পরিবারের দুই কিশোর সদস্যের জীবনকে কীভাবে ওলট-পালট কররে দিয়ে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়, তার খুবই মর্মস্পর্শী বর্ণনা সেই গল্পে দিয়েছেন প্রয়াত লেখক নোসাকা আকিইয়ুকি এবং তাঁর সেই কাহিনিকে অ্যানিমেশন ছবিতে নিয়ে আসেন পরিচালক তয়া সাতো। বছর দুয়েক আগে মুক্তি পাওয়া আরেকটি মর্মস্পর্শী কার্টুন ছবি হচ্ছে ‘পৃথিবীর এই কোনায়’, ফুমিও কোনোর লেখা যে কার্টুনকাহিনি নিয়ে অ্যানিমেশন ছবি তৈরি করেছেন পরিচালক সানাও কাতাবুচি। সেই কার্টুন ছবিতে সদ্য বিবাহিত তরুণী সুজু উরানোর কথা বলা হয়েছে, যুদ্ধের সময় হিরোশিমার পাশের শহর কুরেতে সংসার গড়তে এসে যুদ্ধ আর বোমা হামলায় ছারখার হয়ে যায় যার ছোট্ট স্বপ্ন।
জাপানের ওপর আণবিক বোমা হামলা নিয়ে সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় যাঁকে থাকতে দেখা গেছে, তিনি হলেন কেনজাবুরো ওয়ে। তাঁর ‘হিরোশিমা নোটস’ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বোমা হামলায় সাধারণ নাগরিকদের যে দুর্দশা ভোগ করে হয়েছে, সেই দিক। নিজে হিরোশিমা ভ্রমণে গিয়ে বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের দুর্দশা লিপিবদ্ধ করার মধ্যেই নিজের কর্মকাণ্ড তিনি সীমিত রাখেননি; একই সঙ্গে একই আণবিক বোমা হামলার সঙ্গে সম্পর্কিত গল্পের সংকলন তিনি প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে আণবিক বোমা সাহিত্য নামে পরিচয় লাভ করা সাহিত্যের সেদিকে সেই সংকলন ছিল প্রথম একটি উল্লেখযোগ্য সহযোজন। ইংরেজিতে ‘ক্রেজি আইরিস অ্যান্ড আদার স্টোরিস’ নামে অনূদিত সেই সংকলন ভুক্তভোগীরা কীভাবে বোমা হামলাকে দেখেছেন, ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে তার বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিল।
সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পাশাপাশি শিল্পীরাও জড়িত হয়েছেন হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিকতা রং-তুলিতে তুলে ধরে বিশ্ববাসীর বিবেককে জাগ্রত করে তোলার প্রয়াসে। সেই দলে শুরুতেই নাম নিতে হয় মুরাকি দম্পতির। তারো ওকামোতোর ‘আগামীকালের কিংবদন্তি’ নামের ছবিটি শিল্পী এঁকেছিলেন পারমাণবিক বিশ্বের ভয়াবহতা তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। দীর্ঘ এই প্যানেল ছবিতে একসময় হারিয়ে গেলে পরে মেক্সিকোতে সেটা খুঁজে পাওয়া যায় এবং টোকিও মেট্রোপলিটন সরকার পরে সেটা কিনে এনে টোকিওর শিবুইয়া স্টেশন মানুষের দেখার জন্য সেটি রেখেছে।
৭৪ বছর আগের আণবিক বোমা হামলা তাই একদিক থেকে জাপানের জন্য ভয়ংকর দুর্দশা এনে দিলেও অন্যদিকে শান্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে করে তুলেছে অনেক বেশি সচেতন, যে সচেতনতার প্রকাশ দেখা যায় জাপানের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সৃজনশীল লোকজনের নানা রকম কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার মধ্যে। ফলে, সেই মর্মান্তিকতার পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটতে পারে, সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও এখন একেবারে কম নয় এবং এটাই ধ্বংসের স্মৃতির মধ্যেও আশার বার্তা আমাদের শোনায়।
No comments