রবীন্দ্র ছোটোগল্পে মানবতাবাদ by মাহবুবুল হক
রবীন্দ্রনাথ
অবশ্য ঈশ্বর ও মানুষ দুই-ই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তার সাহিত্যভাবনায়
ইউরোপীয় মানবতাবাদের সুরটি দুর্লক্ষ নয়। দেবতা বা ঈশ্বর মানুষকে রক্ষা করে-
এ তিনি মানেননি।
মানুষের ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আস্থা রবীন্দ্রসাহিত্য ও রবীন্দ্রমননের মূল ভিত্তি। তাই রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ও লেখায় মানবতাবাদী ভাব-ধারণার উজ্জ্বল প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তাতে প্রাচ্য মানবতাবাদের প্রভাব যেমন চোখে পড়ে তেমনি পাশ্চাত্য মানবতাবাদের লক্ষণও দুর্লক্ষ নয়।
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় যে উপনিষদের প্রভাব পড়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু উপনিষদের মানবিকতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মানবিকতার কিছুটা পার্থক্যও বিবেচ্য। উপনিষদের মানবিকতার ভিত্তি সার্বস্বয়বাদ। রবীন্দ্রনাথ সার্বস্বয়বাদকে স্বীকার করে নিলেও ঈশ্বরের আলাদা অস্তিত্বকেও স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে উপনিষদের মানবিকতার ধারণার আধুনিক রূপ দেখা যায় বিবেকানন্দের দর্শনের মধ্যে। সে দর্শনের মূল কথা হলো, সকল জীবের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটলেও মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বিশেষ প্রকাশ উপলব্ধি করা এবং বিশ্বমানবের সেবাকে ঈশ্বরের সেবা বলে গণ্য করা। রবীন্দ্রনাথের পরিণত মানবচিন্তার সঙ্গে এই মতের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।
তবে আধুনিককালে মানবতা বলতে আমরা পাশ্চাত্য হিউম্যানিজমকেই বুঝি। চোদ্দো থেকে ষোলো শতকে ইউরোপে যে রেনেসাঁস হয় তখন তা ভাবাদর্শগত আন্দোলনের রূপ নেয়। এর মূল কথা হলো, মানুষের মর্যাদাকে সবার উপরে স্থান দেয়া, মানুষের কল্যাণ, তার সার্বিক বিকাশ, মানুষের সামাজিক জীবনের উপযোগী অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ। ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে স্বীকার করা, মানুষের ইহজাগতিক প্রয়োজনীয়তা ও আকাক্সক্ষা মেটানোর জন্য মানুষের অধিকারকে সমর্থন, ধর্মের চোখে নয়, মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ঈশ্বর ও মানুষ দুই-ই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তার সাহিত্যভাবনায় ইউরোপীয় মানবতাবাদের সুরটি দুর্লক্ষ নয়। দেবতা বা ঈশ্বর মানুষকে রক্ষা করে- এ তিনি মানেননি। তাঁর মতে, মানুষই নিজের চিন্তা, কর্ম ও জ্ঞানের শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছে এবং করছে। বস্তুত, মানব-বিশ্বাসের রেনেসাঁসধর্মী ঐতিহ্যকেই তিনি তার সাহিত্যকর্মে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এদিক থেকে তিনি পরিপূর্ণ জীবনবাদী। তার রচনা মানবের জয়গানে মুখর। মানব জীবনের সমস্ত বদ্ধ দুয়ার ভেঙে ফেলার প্রেরণা সেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পেও তার এই মানবতাবাদী ভাবনার আশ্চর্য প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবিক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। এতে বৃহত্তর মানবতার সুর ধ্বনিত। এই গল্পে মানুষের স্নেহ-মমতাকে সর্বজনীনতামণ্ডিত করে তিনি দেখিয়েছেন, মানবতার মৌল সম্পর্কের ক্ষেত্রটি জাতিধর্ম ও দেশ-কালের ঊর্ধ্বে।
অনেকগুলো গল্পে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছে সমাজ জীবনে মানুষের অধিকার, স্বাভাবিক জীবন বিকাশ ও অস্তিত্বের সংকটকে কেন্দ্র করে। যেমন বরপণ প্রথার হৃদয়হীনতার ছবি ফুটে উঠেছে ‘দেনা-পাওনা’, ‘ঠাকুরদা’, ‘পণরক্ষা’, ‘হৈমন্তী’, ‘অপরাজিতা’ ইত্যাদি গল্পে।
‘দেনা-পাওনা’ গল্পে বিধৃত হয়েছে নির্ধারিত পণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় শ্বশুর বাড়িতে বধূর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের ঘটনা।
‘হৈমন্তী’ গল্পে পুরুষ গল্পকথকের জবানীতে রবীন্দ্রনাথ পণপ্রথা-কবলিত নারীর নিষ্ঠুর অবমাননার জ্বলন্ত ছবি এঁকেছেন। পণপ্রথা কীভাবে নারীর জীবনকে তিলে তিলে মৃত্যুও দিকে ঠেলে দেয় হৈমন্তী তারই গল্প।
কন্যাপণ ও অর্থলোলুপতার বশবর্তী একশ্রেণির মানুষের অমানবিক রূঢ়তার ছবি পাওয়া যায় ‘অপরাজিতা’ গল্পে।
মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনার বেদনাকে মূর্ত করা হয়েছে ‘রাকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পে। এ গল্পে সত্যনিষ্ঠ ধর্মভীরু মানুষের মনুষ্যত্ব লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত হওয়ার অসহায় বেদনাকে রামকানাই চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
সামাজিক বিবেচনাহীনতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরিচয় রয়েছে ‘বিচারক’ গল্পে। যে পুরুষ নারীত্বের মহিমাকে ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে তাকে বিচারকের আসনে বসিয়ে বিবেকহীন সমাজের বিরুদ্ধে ও মানবিকতার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদমুখর হয়েছেন এই গল্পে।
মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ তার কয়েকটি গল্পে জাতীয় চেতনা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাকে প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তবে স্মরণীয়, তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবন সমস্ত রাজনৈতিক আলোড়নের ঊর্ধ্বে। সেই জীবনের পূর্ণমূল্য দিয়েই মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ সম্ভব। তার ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে ইংরেজদের আমলাতন্ত্রের নিষ্ঠুর বর্বরতাকে চূড়ান্ত ধিক্কারে জর্জরিত করা হয়েছে। ইংরেজ শাসক, মালিক-ম্যানেজার ও বিচারকের জুলুম, আইনের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা, শাসিত জাতির প্রতি জুলুম ও দম্ভ ইত্যাদির বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে জমিদার-নায়েবদের বিরুদ্ধে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, ‘দুর্বুদ্ধি’ গল্পে দেশি আমলাদের হৃদয়হীনতা ও নির্লজ্জ লোভের জ্বলন্ত ছবি ফুটে উঠেছে। দারোগা ও ডাক্তারের পাপচক্রের স্বরূপ উদঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে লাঞ্ছিত অপমানিত জনগণের বেদনাকে তুলে ধরা হয়েছে।
ছোটোগল্পে চিরন্তন মানবের মহিমার প্রকাশ ঘটলেও এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি একান্তভাবে বিশ্বাস করতেন, মানুষের জীবনের অন্ধকার দিকটাই একমাত্র সত্য নয়। তাই তিনি মানুষের জীবন সংগ্রামের কালো দিকটাকে চিত্রিত করাকে তার সাহিত্যিক দায়িত্ব বলে গণ্য করেননি। তিনি সাহিত্যে মানুষের আশা ও আনন্দকে চির জাগরূক করে রাখতে চেয়েছেন।
‘নামঞ্জুর গল্প’ ও ‘সংস্কার’ গল্পে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের হীনমন্যতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেইসঙ্গে হীনবর্ণভুক্ত মানুষের প্রতি প্রকাশ করেছেন তার গভীর ভালোবাসা ও তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণের দাবি। ‘অনধিকার প্রবেশ’ গল্পে ধর্মের নামে, বর্ণভেদ ও জাতিভেদের সংকীর্ণতার প্রতি প্রচণ্ড বিদ্রুপাত্মক আঘাত ও কঠোর প্রতিবাদ মূর্ত হয়েছে।
জাতিভেদ, বর্ণভেদ, ধর্মহীনতা- সব ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ সবার উপরে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন। তাই ‘রবিবার’ গল্পের অভীককে দিয়ে তিনি বলিয়েছেন : ‘যে দেশে দিনরাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি সে দেশে সর্ব ধর্মকে মেলাবার পুণ্যব্রত আমার মতো নাস্তিকেরই।’ ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের নন্দকিশোর সামাজিক অর্থে ধর্মকে স্বীকার করেনি এবং মোহিনীর মতো নিম্নস্তরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে বর্ণাশ্রয়ী সমাজের মানসিকতার বিরুদ্ধে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো গল্পে সমাজের নিচুতলার নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার অসুখী প্রকাশ ঘটেছে। যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিষ্ঠুরতায় একদিকে জমিদারদের জীবন উৎসবমুখর হলেও দরিদ্র মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার মর্মান্তিক ছবি আঁকা হয়েছে ‘শাস্তি’ গল্পে।
‘মুসলমানি গল্পে’ রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর জোর দিয়েছেন। এ ধরনের গল্পে ধর্মনিরপেক্ষ হৃদয়ধর্মের প্রতি তাঁর আজন্ম আকর্ষণ তীব্র ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ নারীসমাজের মর্যাদা ও মহিমার পক্ষেও কলম ধরেছিলেন। পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীর মুক্তিপথের নানা অন্তরায় তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। পণপ্রথা, সহমরণ, বিধবা বিবাহ ও বহুবিবাহের মতো যে সমস্ত সমস্যা সেকালে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীর অবস্থানকে অমর্যাদাকর ও সংকটাপন্ন করে তুলেছিল, পাশ্চাত্যের নারীর অবস্থান,অধিকার ও মর্যাদার আলোয় রবীন্দ্রনাথ তাকে বিচার করেছিলেন। স্বভাবতই নারীমুক্তির প্রসঙ্গ হয়েছিল তার ভাবনার বিষয়। আর তাই নারীর পক্ষে পূর্ণ সহানুভূতি লক্ষ করা যায় তার ছোটোগল্পে।
নিষ্ঠুর সমাজ-শাসনে নারীর অসহায় অবস্থ’ার ছবি তুলে ধরে তাই তিনি যেন চাবুক মেরে সমাজের চেতনাকে জাগাতে চেয়েছেন। সন্ন্যাসীর স্ত্রী কুসুমের বঞ্চিত জীবনের হাহাকারকে তিনি বাক্সময় করে তুলেছেন ‘ঘাটের কথা’ গল্পে। ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের দুর্ভাগা কাদম্বিনীকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছে যে সে মরেওনি। ‘কঙ্কাল’ গল্পে নারীর রূপ সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও স্বরূপ তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, তা নারীর মানবিক জীবন-চেতনার পথে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ।
‘খাতা’ গল্পের বালিকা বধূ উমা লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখাতে গিয়ে বিড়ম্বিত হয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত স্বামীর কাছে। ‘পয়লা নম্বর’ গল্পে বুদ্ধিজীবী পুরুষের নিষ্ঠুর নিস্পৃহতা ও কর্তৃত্বপরায়ণ ক্ষমতা-বলয়ের কবলে পড়া নারীর অবমাননার স্বরূপ ও তার অন্তর্বেদনার রূপটি ফুটে উঠেছে।
এক কথায় সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার ও নারীর অধিকারহীনতার স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ উদঘাটন করেছেন তার ছোটোগল্পগুলোতে। শুধু তাই নয়, এই অমানবিক সমাজের বেড়াজাল ভেঙেচুরে বের হয়ে আসার প্রেরণাও তাঁর গল্পে রয়েছে। ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তির প্রসঙ্গ টেনেছেন ব্যক্তিত্বসচেতন নারী মৃণালের জবানীতে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে। মৃণাল সংসারের অন্যায়-অবিচার, হৃদয়হীনতা ও বৈষম্য সইতে না পেরে অবশেষে বিদ্রোহ করেছে। তার বিদ্রোহী নারী হৃদয় হৃদয়হীন সংসারের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে লাভ করেছে মুক্তির স্বাদ। ‘বদনাম’ গল্পের সৌদামিনীও এমনিভাবে বিদ্রোহী হয়েছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কাব্যে ও প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন মানবতার বাণীকে বাক্সময় করে তুলেছেন তেমনি তার ছোটোগল্পেও চিত্রিত হয়েছে তার বহুবর্ণিল ছবি।
মানুষের ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আস্থা রবীন্দ্রসাহিত্য ও রবীন্দ্রমননের মূল ভিত্তি। তাই রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ও লেখায় মানবতাবাদী ভাব-ধারণার উজ্জ্বল প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তাতে প্রাচ্য মানবতাবাদের প্রভাব যেমন চোখে পড়ে তেমনি পাশ্চাত্য মানবতাবাদের লক্ষণও দুর্লক্ষ নয়।
রবীন্দ্রনাথের চেতনায় যে উপনিষদের প্রভাব পড়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু উপনিষদের মানবিকতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মানবিকতার কিছুটা পার্থক্যও বিবেচ্য। উপনিষদের মানবিকতার ভিত্তি সার্বস্বয়বাদ। রবীন্দ্রনাথ সার্বস্বয়বাদকে স্বীকার করে নিলেও ঈশ্বরের আলাদা অস্তিত্বকেও স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
অন্যদিকে উপনিষদের মানবিকতার ধারণার আধুনিক রূপ দেখা যায় বিবেকানন্দের দর্শনের মধ্যে। সে দর্শনের মূল কথা হলো, সকল জীবের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটলেও মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বিশেষ প্রকাশ উপলব্ধি করা এবং বিশ্বমানবের সেবাকে ঈশ্বরের সেবা বলে গণ্য করা। রবীন্দ্রনাথের পরিণত মানবচিন্তার সঙ্গে এই মতের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।
তবে আধুনিককালে মানবতা বলতে আমরা পাশ্চাত্য হিউম্যানিজমকেই বুঝি। চোদ্দো থেকে ষোলো শতকে ইউরোপে যে রেনেসাঁস হয় তখন তা ভাবাদর্শগত আন্দোলনের রূপ নেয়। এর মূল কথা হলো, মানুষের মর্যাদাকে সবার উপরে স্থান দেয়া, মানুষের কল্যাণ, তার সার্বিক বিকাশ, মানুষের সামাজিক জীবনের উপযোগী অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব আরোপ। ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে স্বীকার করা, মানুষের ইহজাগতিক প্রয়োজনীয়তা ও আকাক্সক্ষা মেটানোর জন্য মানুষের অধিকারকে সমর্থন, ধর্মের চোখে নয়, মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ঈশ্বর ও মানুষ দুই-ই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তার সাহিত্যভাবনায় ইউরোপীয় মানবতাবাদের সুরটি দুর্লক্ষ নয়। দেবতা বা ঈশ্বর মানুষকে রক্ষা করে- এ তিনি মানেননি। তাঁর মতে, মানুষই নিজের চিন্তা, কর্ম ও জ্ঞানের শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছে এবং করছে। বস্তুত, মানব-বিশ্বাসের রেনেসাঁসধর্মী ঐতিহ্যকেই তিনি তার সাহিত্যকর্মে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এদিক থেকে তিনি পরিপূর্ণ জীবনবাদী। তার রচনা মানবের জয়গানে মুখর। মানব জীবনের সমস্ত বদ্ধ দুয়ার ভেঙে ফেলার প্রেরণা সেখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পেও তার এই মানবতাবাদী ভাবনার আশ্চর্য প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবিক চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। এতে বৃহত্তর মানবতার সুর ধ্বনিত। এই গল্পে মানুষের স্নেহ-মমতাকে সর্বজনীনতামণ্ডিত করে তিনি দেখিয়েছেন, মানবতার মৌল সম্পর্কের ক্ষেত্রটি জাতিধর্ম ও দেশ-কালের ঊর্ধ্বে।
অনেকগুলো গল্পে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছে সমাজ জীবনে মানুষের অধিকার, স্বাভাবিক জীবন বিকাশ ও অস্তিত্বের সংকটকে কেন্দ্র করে। যেমন বরপণ প্রথার হৃদয়হীনতার ছবি ফুটে উঠেছে ‘দেনা-পাওনা’, ‘ঠাকুরদা’, ‘পণরক্ষা’, ‘হৈমন্তী’, ‘অপরাজিতা’ ইত্যাদি গল্পে।
‘দেনা-পাওনা’ গল্পে বিধৃত হয়েছে নির্ধারিত পণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় শ্বশুর বাড়িতে বধূর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনের ঘটনা।
‘হৈমন্তী’ গল্পে পুরুষ গল্পকথকের জবানীতে রবীন্দ্রনাথ পণপ্রথা-কবলিত নারীর নিষ্ঠুর অবমাননার জ্বলন্ত ছবি এঁকেছেন। পণপ্রথা কীভাবে নারীর জীবনকে তিলে তিলে মৃত্যুও দিকে ঠেলে দেয় হৈমন্তী তারই গল্প।
কন্যাপণ ও অর্থলোলুপতার বশবর্তী একশ্রেণির মানুষের অমানবিক রূঢ়তার ছবি পাওয়া যায় ‘অপরাজিতা’ গল্পে।
মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনার বেদনাকে মূর্ত করা হয়েছে ‘রাকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পে। এ গল্পে সত্যনিষ্ঠ ধর্মভীরু মানুষের মনুষ্যত্ব লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত হওয়ার অসহায় বেদনাকে রামকানাই চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
সামাজিক বিবেচনাহীনতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরিচয় রয়েছে ‘বিচারক’ গল্পে। যে পুরুষ নারীত্বের মহিমাকে ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে তাকে বিচারকের আসনে বসিয়ে বিবেকহীন সমাজের বিরুদ্ধে ও মানবিকতার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদমুখর হয়েছেন এই গল্পে।
মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ তার কয়েকটি গল্পে জাতীয় চেতনা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাকে প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তবে স্মরণীয়, তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবন সমস্ত রাজনৈতিক আলোড়নের ঊর্ধ্বে। সেই জীবনের পূর্ণমূল্য দিয়েই মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ সম্ভব। তার ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে ইংরেজদের আমলাতন্ত্রের নিষ্ঠুর বর্বরতাকে চূড়ান্ত ধিক্কারে জর্জরিত করা হয়েছে। ইংরেজ শাসক, মালিক-ম্যানেজার ও বিচারকের জুলুম, আইনের প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা, শাসিত জাতির প্রতি জুলুম ও দম্ভ ইত্যাদির বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে জমিদার-নায়েবদের বিরুদ্ধে তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, ‘দুর্বুদ্ধি’ গল্পে দেশি আমলাদের হৃদয়হীনতা ও নির্লজ্জ লোভের জ্বলন্ত ছবি ফুটে উঠেছে। দারোগা ও ডাক্তারের পাপচক্রের স্বরূপ উদঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে লাঞ্ছিত অপমানিত জনগণের বেদনাকে তুলে ধরা হয়েছে।
ছোটোগল্পে চিরন্তন মানবের মহিমার প্রকাশ ঘটলেও এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি একান্তভাবে বিশ্বাস করতেন, মানুষের জীবনের অন্ধকার দিকটাই একমাত্র সত্য নয়। তাই তিনি মানুষের জীবন সংগ্রামের কালো দিকটাকে চিত্রিত করাকে তার সাহিত্যিক দায়িত্ব বলে গণ্য করেননি। তিনি সাহিত্যে মানুষের আশা ও আনন্দকে চির জাগরূক করে রাখতে চেয়েছেন।
‘নামঞ্জুর গল্প’ ও ‘সংস্কার’ গল্পে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের হীনমন্যতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেইসঙ্গে হীনবর্ণভুক্ত মানুষের প্রতি প্রকাশ করেছেন তার গভীর ভালোবাসা ও তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণের দাবি। ‘অনধিকার প্রবেশ’ গল্পে ধর্মের নামে, বর্ণভেদ ও জাতিভেদের সংকীর্ণতার প্রতি প্রচণ্ড বিদ্রুপাত্মক আঘাত ও কঠোর প্রতিবাদ মূর্ত হয়েছে।
জাতিভেদ, বর্ণভেদ, ধর্মহীনতা- সব ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ সবার উপরে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন। তাই ‘রবিবার’ গল্পের অভীককে দিয়ে তিনি বলিয়েছেন : ‘যে দেশে দিনরাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি সে দেশে সর্ব ধর্মকে মেলাবার পুণ্যব্রত আমার মতো নাস্তিকেরই।’ ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের নন্দকিশোর সামাজিক অর্থে ধর্মকে স্বীকার করেনি এবং মোহিনীর মতো নিম্নস্তরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে বর্ণাশ্রয়ী সমাজের মানসিকতার বিরুদ্ধে মানুষের মহিমাকেই বড় করে দেখিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো গল্পে সমাজের নিচুতলার নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার অসুখী প্রকাশ ঘটেছে। যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিষ্ঠুরতায় একদিকে জমিদারদের জীবন উৎসবমুখর হলেও দরিদ্র মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার মর্মান্তিক ছবি আঁকা হয়েছে ‘শাস্তি’ গল্পে।
‘মুসলমানি গল্পে’ রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর জোর দিয়েছেন। এ ধরনের গল্পে ধর্মনিরপেক্ষ হৃদয়ধর্মের প্রতি তাঁর আজন্ম আকর্ষণ তীব্র ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ নারীসমাজের মর্যাদা ও মহিমার পক্ষেও কলম ধরেছিলেন। পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীর মুক্তিপথের নানা অন্তরায় তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। পণপ্রথা, সহমরণ, বিধবা বিবাহ ও বহুবিবাহের মতো যে সমস্ত সমস্যা সেকালে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নারীর অবস্থানকে অমর্যাদাকর ও সংকটাপন্ন করে তুলেছিল, পাশ্চাত্যের নারীর অবস্থান,অধিকার ও মর্যাদার আলোয় রবীন্দ্রনাথ তাকে বিচার করেছিলেন। স্বভাবতই নারীমুক্তির প্রসঙ্গ হয়েছিল তার ভাবনার বিষয়। আর তাই নারীর পক্ষে পূর্ণ সহানুভূতি লক্ষ করা যায় তার ছোটোগল্পে।
নিষ্ঠুর সমাজ-শাসনে নারীর অসহায় অবস্থ’ার ছবি তুলে ধরে তাই তিনি যেন চাবুক মেরে সমাজের চেতনাকে জাগাতে চেয়েছেন। সন্ন্যাসীর স্ত্রী কুসুমের বঞ্চিত জীবনের হাহাকারকে তিনি বাক্সময় করে তুলেছেন ‘ঘাটের কথা’ গল্পে। ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের দুর্ভাগা কাদম্বিনীকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছে যে সে মরেওনি। ‘কঙ্কাল’ গল্পে নারীর রূপ সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও স্বরূপ তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে, তা নারীর মানবিক জীবন-চেতনার পথে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ।
‘খাতা’ গল্পের বালিকা বধূ উমা লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখাতে গিয়ে বিড়ম্বিত হয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত স্বামীর কাছে। ‘পয়লা নম্বর’ গল্পে বুদ্ধিজীবী পুরুষের নিষ্ঠুর নিস্পৃহতা ও কর্তৃত্বপরায়ণ ক্ষমতা-বলয়ের কবলে পড়া নারীর অবমাননার স্বরূপ ও তার অন্তর্বেদনার রূপটি ফুটে উঠেছে।
এক কথায় সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার ও নারীর অধিকারহীনতার স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ উদঘাটন করেছেন তার ছোটোগল্পগুলোতে। শুধু তাই নয়, এই অমানবিক সমাজের বেড়াজাল ভেঙেচুরে বের হয়ে আসার প্রেরণাও তাঁর গল্পে রয়েছে। ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ নারীমুক্তির প্রসঙ্গ টেনেছেন ব্যক্তিত্বসচেতন নারী মৃণালের জবানীতে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে। মৃণাল সংসারের অন্যায়-অবিচার, হৃদয়হীনতা ও বৈষম্য সইতে না পেরে অবশেষে বিদ্রোহ করেছে। তার বিদ্রোহী নারী হৃদয় হৃদয়হীন সংসারের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে লাভ করেছে মুক্তির স্বাদ। ‘বদনাম’ গল্পের সৌদামিনীও এমনিভাবে বিদ্রোহী হয়েছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কাব্যে ও প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যেমন মানবতার বাণীকে বাক্সময় করে তুলেছেন তেমনি তার ছোটোগল্পেও চিত্রিত হয়েছে তার বহুবর্ণিল ছবি।
No comments