ডেঙ্গুর দায় কার? by হাসান মাহমুদ রিপন
‘ডেঙ্গু
কেড়েছে বাবার প্রাণ, আইসিইউতে মা এবং ভাইয়ের ছেলেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ভারাক্রান্ত মনে এমনটাই জানালেন সাবেক প্রধান শিক্ষক মৃত আবদুল ওয়াহেদের
ছেলে বদলগাছীর সিনিয়র উদ্যানতত্ত¡বিদ আ ন ম আনোয়ারুল হাসান। তিনি জানান,
ডেঙ্গুজ্বরে প্রথমে আমার ভাইয়ের ছেলে আক্রান্ত হয় জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে।
ঢাকায় তাকে দেখে নওগাঁর আত্রাইয়ের সাহেবগঞ্জ গ্রামের বাড়ি ফিরে ডেঙ্গুজ্বরে
আক্রান্ত হয়ে ২৫ জুলাই মারা গেলেন বাবা আব্দুল ওয়াহেদ (৭৫)। এরপর মা
আকিকুন্নাহার (৬৫) আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের আইসিইউতে
চিকিৎসাধীন আছেন এখনো। সব মিলিয়ে গত একটা মাস ধরে আমাদের চলছে বিভীষিকাময়
এক জীবন।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতার জন্য ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করছেন নগরবাসী। সময়মতো মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। কেউ কেউ বলছেন এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও তাদের দায় এড়াতে পারে না। অপরদিকে রাজধানীর মশা দমনের মূল লক্ষ্য নিয়ে ‘মশক নিবারণ দফতর’ প্রতিষ্ঠা করা হলে মশা নিধনের কাজে না লাগিয়ে এটিকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য নগরবাসী একচেটিয়াভাবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকেই দায়ী করলেও আসলে কার্যক্রমটি সমন্বিত। পরিবেশ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। নগরীতে এডিস মশা যাতে না জন্মাতে পারে সে ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের প্রধান ভ‚মিকা রয়েছে। এ ছাড়া কমিউনিটি ভিত্তিক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে স্বাস্থ্য অধিদফতরেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। পাশাপাশি মশক নিধনের ভ‚মিকা সিটি কর্পোরেশনের। আবার সিটি কর্পোরেশনকে যাবতীয় তদারকির দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। এভাবে এটি হচ্ছে সমন্বিত একটি কার্যক্রম। আর তাই এককভাবে এ ব্যাপারে কোনো সংস্থা বা কাউকে দায়ী করা সঠিক নয়।
রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে পরিস্থিতি। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করেছেন। তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত রাজধানীসহ দেশবাসী। আতঙ্কের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে বেড়েছে উদ্বেগও। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করলেও সংশ্লিষ্ট মহলের টনক নড়েনি। ডেঙ্গু দ্রæত বিস্তার লাভ করা একটি সংক্রামক রোগ হলেও তা প্রতিরোধে দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা না নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কিছু অপ্রয়োজনীয় বুলি আওড়াচ্ছেন আর জনসচেতনতা কার্যক্রমের নামে লোক দেখানো ফটোসেশন করছেন বলে অভিযোগ নগরবাসীর। অপরদিকে রাজধানীর মশা দমনের মূল লক্ষ্য নিয়ে ‘মশক নিবারণ দফতর’ প্রতিষ্ঠা করা হলেও মশা দমনের কাজে নাই এই দফতরটি। নগরবাসীর জিজ্ঞাসা রাজধানী ছাড়িয়ে এখন ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার দায় কার!
দেশজুড়ে এখন এক আতঙ্কের নাম মশা আর ডেঙ্গু। চলতি আগস্ট মাসের ১ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত ৬ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৪৫১ জন। সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা ঢাকতে জনসচেতনতাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই রোগে ইতোমধ্যে বেসরকারি হিসেবে প্রায় অর্ধশত মানুষ মারা গেছেন। অথচ বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বশীলদের অসংলগ্ন কথা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে নানা সমালোচনা। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, মশার ওষুধের মান নিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে, সিটি কর্পোরেশনের ছিটানো ওষুধ কার্যকর। অথচ একই মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং খোদ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাই উচ্চ আদালতে মশা নিধনের ওষুধ মানহীন বলে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। আবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ে ছেলেধরার মতো বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, মশক নিধনে অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। সবকিছু মিলিয়ে দায়িত্বশীলদের কিছু বিভ্রান্তিকর কথায় মানুষের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
এদিকে রাজধানীর মশা নিবারণের জন্য একটি ‘মশক নিবারণ দফতর’ থাকলেও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন যখন মশা মারতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন এই দফতর করে যাচ্ছে শুধুই প্রশাসনিক কাজ।
যদিও মশা দমনের মূল লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এক সময় এই দফতরের কাজে প্রাণচাঞ্চল্য থাকলেও বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে সুনসান নীরবতা। এখন শহরের মশা দমনের কাজে নয়, সিটি কর্পোরেশনের মশার ওষুধের খালি ড্রাম সংরক্ষণের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হয় এই দফতরটি। সরেজমিন ঘুরে এবং সেখানকার কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, মশা নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো কর্মসূচি বা গবেষণা কার্যক্রম নেই। কর্মীদের মধ্যে ক্রু, সুপারভাইজার, কয়েকজন ইনসেক্ট কালেক্টর (আইসি) রয়েছে। তাদের অধিকাংশই দফতরের অধীন কাজ করেন না, দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তবে সিটি কর্পোরেশনের অধীন কাজ করলেও কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে এ দফতর।
বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব অ. ন. ম ফয়জুল হক দফতরের সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘দফতরের প্রশাসনিক কার্যক্রম, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা দেয়া ছাড়া, দফতরের কর্মসূচি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। দফতরের কাজ নিয়ে বলতে পারবেন দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
ঢাকা মশক নিবারণী দফতর সরকারি কর্মচারী সমিতির সেক্রেটারি গিয়াসউদ্দিন জানান, প্রতিষ্ঠার সময় ম্যালেরিয়া মোকাবিলা করতে ঢাকায় সব ধরনের মশা নিধনে কাজ করত এ প্রতিষ্ঠানটি। তখন সংস্থাটি বেশ জমজমাট ছিল। অনেক লোক কাজ করতেন। মশা নিয়ন্ত্রণে বেশ ভালো ভ‚মিকা পালন করত এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু কখন কীভাবে এই অবস্থা হলো জানা নেই। প্রতিষ্ঠানটির কাজই ছিল মশা নিধন করা। তবে এখন সেই ক্ষমতা নেই। আমরা শুধু ঢাকা-উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী মশা মারার ওষুধ বিভিন্ন জোনে বিতরণ করি।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে গতকাল মঙ্গলবার ভারত থেকে আনা নতুন ওষুধের কার্যকারিতা নগর ভবনে পরীক্ষা করা হয়। এ সময় নয়টি করে খাঁচার প্রতিটিতে ৫০টি করে মশা সারিবদ্ধভাবে রেখে তিন ফুট দূর থেকে মেশিনের মাধ্যমে ওষুধ স্প্রে করা হয়। ম্যালাথিয়ন আর ডেল্টামেথ্রিন ওষুধ স্প্রে করে দেখা হয় কতটি মশা মারা যায়। স্প্রে করার ২০ মিনিট পর মরা মশা গোনা হয়। ওষুধের মধ্যে ম্যালাথিউন ৫% এবং ডেল্টামিথারিন ১.২৫% স্প্রে করা হয়। মশার নিধনের নতুন ওষুধ এডিস মশা নিধনে কার্যকর কিনা তা জানতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে। তবে প্রাথমিক পরীক্ষায় প্রায় ৮০ ভাগ মশা অজ্ঞান হচ্ছে বলে মনে করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান।
এদিকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারাদেশে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা। গতকাল মঙ্গলবারও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে প্রবাসী হাফসা লিপি (৩৪) এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) তিনজনসহ সারাদেশে মারা গেছেন আটজন। এদের মধ্যে ঢামেকে মনোয়ারা বেগম (৭৫), আমজাদ মণ্ডল (৫২) ও হাবিবুর রহমান (২১)। রংপুর ও চাঁদপুরে একজন করে শিশু এবং দিনাজপুরে এক কিশোর ও মানিকগঞ্জে এক যুবক রয়েছে।
এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালের অষ্টম তলায় শিশু ওয়ার্ডের সিঁড়ির গোড়ায় অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৫০০ শয্যার হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগী ৪৭৩ জন, মুগদা হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. খাইরুল আলমের দেয়া তথ্যমতে, ৫০০ শয্যার মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৪৮৪ জন। এদের মধ্যে মেডিসিন ওয়ার্ডে ৩৭৩, শিশু ওয়ার্ডে ৭৯ এবং কেবিনে ভর্তি ৩২ জন। আর টোটাল রোগীর সংখ্যা ৭৯০ জন। অর্থাৎ এই মুহূর্তে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর ৬১ শতাংশ হচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত। হাসপাতালটিতে গত এক মাসে ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন মোট ৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডাক্তার আয়েশা আক্তার জানান, ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৩৪৮ জন। এর মধ্যে রাজধানীতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২৮৪ জন এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে এ সংখ্যা ১ হাজার ৬৪।
হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮৩ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ১০৪ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৩৮ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৮৬ জন, বারডেম হাসপাতালে ২০ জন, বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ৪৩ জন, পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগে ২৬ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২১ জন, বিজিবি হাসপাতালে ৭ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৪২ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসাপাতালে ৪৮ জন ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে ৪৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী। আর ঢাকা শহর ব্যতীত ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোর হাসপাতালগুলোতে মোট ২৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ২৩১ জন, খুলনা বিভাগে ১৬৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ১০৬ জন, বরিশাল বিভাগে ১২৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৮ জন, রংপুর বিভাগে ৬৬ জন এবং সিলেট বিভাগে ৩২ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে।
এদিকে বছরের শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নগরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সতর্কতা জারি করা হলেও তা আমলে নেয়নি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, শুরুতেই দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই সিটি কর্পোরেশন যদি বিষয়টি আমলে নিত তাহলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। মেয়রদের মাঠে দেখা গেলেও এ ইস্যুতে কাউন্সিলরদের তৎপরতা এখনো প্রত্যাশিত নয় বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। এসব অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু ভয়াবহতা পেয়েছে। এখন প্রতি মুহূর্তে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এখন দুই সিটি প্রতিদিনই সচেতনতামূলক কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করলেও মশা বা লার্ভা নিধনে তেমন কার্যকর ভ‚মিকা রাখছে না। অনেকে এসব কাজকে লোক দেখানো মশক নিধন কার্যক্রম বলে অভিমত ব্যক্ত করছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও প্রখ্যাত ভাইরালজিস্ট অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে দেশে ডেঙ্গুর এমন অবস্থা সৃষ্টি হতো না। তিনি দেশবাসীকে নির্দেশ দিলে সবাই কোদাল হাতে চারপাশ পরিষ্কার করত।’ অধ্যাপক নজরুল বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হচ্ছে লার্ভা ও মশা নিধন করা। যার যা করা দরকার, তাকে সেটা করতে হবে।
ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা আগস্ট মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গু মশার প্রজনন বাড়তে পারে। জরুরি ভিত্তিতে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন স্বাস্থ্য অধিদফতর।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মাহমুদ খান বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর যেসব প্রতিবেদন দিয়েছে সেটি যদি দুই সিটি কর্পোরেশন আমলে নিত তাহলে আজকে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তিনি বলেন, মশা মারার বাজেট বাড়ানো হলেও নাগরিকরা সেবা পাচ্ছেন না। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছেÑ এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে তাতে মশা মরছে না। অকার্যকর মশার ওষুধের কারণে যতই বাজেট বাড়ানো হোক, কোনো কাজে আসবে না। এর মধ্যে দুর্নীতির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।’
দুই সিটি কর্পোরেশন ও নগরীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, ওষুধ কার্যকর হচ্ছে না, এটা এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। রোগতত্ত¡, কীটতত্ত¡ বিভাগ ও আইসিডিডিআরবিসহ কিছু সংস্থা গত ৩ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিষয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। দুই মেয়রের কাছে তারা তুলে ধরেছে, মশক নিধনের ওষুধ এখন আর কার্যকর নয়। তারপরও তিন বছরে বিকল্প ওষুধ বা বিদ্যমান ওষুধ কার্যকর আছে কিনা, তা অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নগরবাসীকে রক্ষার বাস্তবিক প্রয়াস দুই মেয়র নেননি। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে হলে মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে আরো সক্রিয় হতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কাযর্ক্রম আরো জোরদার করা দরকার। ব্যক্তি সচেতন হলে মশাবাহিত এই রোগ হ্রাস পেতে পারে, এমনটি মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক কাযর্ক্রমও ব্যাপকহারে বাড়ানো দরকার।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতার জন্য ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করছেন নগরবাসী। সময়মতো মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। কেউ কেউ বলছেন এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও তাদের দায় এড়াতে পারে না। অপরদিকে রাজধানীর মশা দমনের মূল লক্ষ্য নিয়ে ‘মশক নিবারণ দফতর’ প্রতিষ্ঠা করা হলে মশা নিধনের কাজে না লাগিয়ে এটিকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য নগরবাসী একচেটিয়াভাবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকেই দায়ী করলেও আসলে কার্যক্রমটি সমন্বিত। পরিবেশ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে। নগরীতে এডিস মশা যাতে না জন্মাতে পারে সে ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের প্রধান ভ‚মিকা রয়েছে। এ ছাড়া কমিউনিটি ভিত্তিক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে স্বাস্থ্য অধিদফতরেরও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। পাশাপাশি মশক নিধনের ভ‚মিকা সিটি কর্পোরেশনের। আবার সিটি কর্পোরেশনকে যাবতীয় তদারকির দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। এভাবে এটি হচ্ছে সমন্বিত একটি কার্যক্রম। আর তাই এককভাবে এ ব্যাপারে কোনো সংস্থা বা কাউকে দায়ী করা সঠিক নয়।
রাজধানীসহ সারাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে পরিস্থিতি। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি করেছেন। তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত রাজধানীসহ দেশবাসী। আতঙ্কের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে বেড়েছে উদ্বেগও। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করলেও সংশ্লিষ্ট মহলের টনক নড়েনি। ডেঙ্গু দ্রæত বিস্তার লাভ করা একটি সংক্রামক রোগ হলেও তা প্রতিরোধে দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা না নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কিছু অপ্রয়োজনীয় বুলি আওড়াচ্ছেন আর জনসচেতনতা কার্যক্রমের নামে লোক দেখানো ফটোসেশন করছেন বলে অভিযোগ নগরবাসীর। অপরদিকে রাজধানীর মশা দমনের মূল লক্ষ্য নিয়ে ‘মশক নিবারণ দফতর’ প্রতিষ্ঠা করা হলেও মশা দমনের কাজে নাই এই দফতরটি। নগরবাসীর জিজ্ঞাসা রাজধানী ছাড়িয়ে এখন ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার দায় কার!
দেশজুড়ে এখন এক আতঙ্কের নাম মশা আর ডেঙ্গু। চলতি আগস্ট মাসের ১ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত ৬ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৪৫১ জন। সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা ঢাকতে জনসচেতনতাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই রোগে ইতোমধ্যে বেসরকারি হিসেবে প্রায় অর্ধশত মানুষ মারা গেছেন। অথচ বিষয়টি নিয়ে দায়িত্বশীলদের অসংলগ্ন কথা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে নানা সমালোচনা। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, মশার ওষুধের মান নিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে, সিটি কর্পোরেশনের ছিটানো ওষুধ কার্যকর। অথচ একই মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং খোদ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাই উচ্চ আদালতে মশা নিধনের ওষুধ মানহীন বলে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। আবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ে ছেলেধরার মতো বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেছেন, মশক নিধনে অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। সবকিছু মিলিয়ে দায়িত্বশীলদের কিছু বিভ্রান্তিকর কথায় মানুষের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
এদিকে রাজধানীর মশা নিবারণের জন্য একটি ‘মশক নিবারণ দফতর’ থাকলেও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন যখন মশা মারতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন এই দফতর করে যাচ্ছে শুধুই প্রশাসনিক কাজ।
যদিও মশা দমনের মূল লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এক সময় এই দফতরের কাজে প্রাণচাঞ্চল্য থাকলেও বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে সুনসান নীরবতা। এখন শহরের মশা দমনের কাজে নয়, সিটি কর্পোরেশনের মশার ওষুধের খালি ড্রাম সংরক্ষণের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার হয় এই দফতরটি। সরেজমিন ঘুরে এবং সেখানকার কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, মশা নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো কর্মসূচি বা গবেষণা কার্যক্রম নেই। কর্মীদের মধ্যে ক্রু, সুপারভাইজার, কয়েকজন ইনসেক্ট কালেক্টর (আইসি) রয়েছে। তাদের অধিকাংশই দফতরের অধীন কাজ করেন না, দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তবে সিটি কর্পোরেশনের অধীন কাজ করলেও কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে এ দফতর।
বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব অ. ন. ম ফয়জুল হক দফতরের সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘দফতরের প্রশাসনিক কার্যক্রম, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা দেয়া ছাড়া, দফতরের কর্মসূচি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। দফতরের কাজ নিয়ে বলতে পারবেন দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
ঢাকা মশক নিবারণী দফতর সরকারি কর্মচারী সমিতির সেক্রেটারি গিয়াসউদ্দিন জানান, প্রতিষ্ঠার সময় ম্যালেরিয়া মোকাবিলা করতে ঢাকায় সব ধরনের মশা নিধনে কাজ করত এ প্রতিষ্ঠানটি। তখন সংস্থাটি বেশ জমজমাট ছিল। অনেক লোক কাজ করতেন। মশা নিয়ন্ত্রণে বেশ ভালো ভ‚মিকা পালন করত এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু কখন কীভাবে এই অবস্থা হলো জানা নেই। প্রতিষ্ঠানটির কাজই ছিল মশা নিধন করা। তবে এখন সেই ক্ষমতা নেই। আমরা শুধু ঢাকা-উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্দেশনা অনুযায়ী মশা মারার ওষুধ বিভিন্ন জোনে বিতরণ করি।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে গতকাল মঙ্গলবার ভারত থেকে আনা নতুন ওষুধের কার্যকারিতা নগর ভবনে পরীক্ষা করা হয়। এ সময় নয়টি করে খাঁচার প্রতিটিতে ৫০টি করে মশা সারিবদ্ধভাবে রেখে তিন ফুট দূর থেকে মেশিনের মাধ্যমে ওষুধ স্প্রে করা হয়। ম্যালাথিয়ন আর ডেল্টামেথ্রিন ওষুধ স্প্রে করে দেখা হয় কতটি মশা মারা যায়। স্প্রে করার ২০ মিনিট পর মরা মশা গোনা হয়। ওষুধের মধ্যে ম্যালাথিউন ৫% এবং ডেল্টামিথারিন ১.২৫% স্প্রে করা হয়। মশার নিধনের নতুন ওষুধ এডিস মশা নিধনে কার্যকর কিনা তা জানতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগবে। তবে প্রাথমিক পরীক্ষায় প্রায় ৮০ ভাগ মশা অজ্ঞান হচ্ছে বলে মনে করছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান।
এদিকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারাদেশে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা। গতকাল মঙ্গলবারও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে প্রবাসী হাফসা লিপি (৩৪) এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) তিনজনসহ সারাদেশে মারা গেছেন আটজন। এদের মধ্যে ঢামেকে মনোয়ারা বেগম (৭৫), আমজাদ মণ্ডল (৫২) ও হাবিবুর রহমান (২১)। রংপুর ও চাঁদপুরে একজন করে শিশু এবং দিনাজপুরে এক কিশোর ও মানিকগঞ্জে এক যুবক রয়েছে।
এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালের অষ্টম তলায় শিশু ওয়ার্ডের সিঁড়ির গোড়ায় অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৫০০ শয্যার হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগী ৪৭৩ জন, মুগদা হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. খাইরুল আলমের দেয়া তথ্যমতে, ৫০০ শয্যার মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৪৮৪ জন। এদের মধ্যে মেডিসিন ওয়ার্ডে ৩৭৩, শিশু ওয়ার্ডে ৭৯ এবং কেবিনে ভর্তি ৩২ জন। আর টোটাল রোগীর সংখ্যা ৭৯০ জন। অর্থাৎ এই মুহূর্তে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর ৬১ শতাংশ হচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত। হাসপাতালটিতে গত এক মাসে ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন মোট ৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডাক্তার আয়েশা আক্তার জানান, ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৩৪৮ জন। এর মধ্যে রাজধানীতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২৮৪ জন এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে এ সংখ্যা ১ হাজার ৬৪।
হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮৩ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ১০৪ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৩৮ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৮৬ জন, বারডেম হাসপাতালে ২০ জন, বিএসএমএমইউ হাসপাতালে ৪৩ জন, পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগে ২৬ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২১ জন, বিজিবি হাসপাতালে ৭ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৪২ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসাপাতালে ৪৮ জন ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে ৪৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী। আর ঢাকা শহর ব্যতীত ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোর হাসপাতালগুলোতে মোট ২৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ২৩১ জন, খুলনা বিভাগে ১৬৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ১০৬ জন, বরিশাল বিভাগে ১২৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৮ জন, রংপুর বিভাগে ৬৬ জন এবং সিলেট বিভাগে ৩২ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে।
এদিকে বছরের শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নগরজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সতর্কতা জারি করা হলেও তা আমলে নেয়নি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, শুরুতেই দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই সিটি কর্পোরেশন যদি বিষয়টি আমলে নিত তাহলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। মেয়রদের মাঠে দেখা গেলেও এ ইস্যুতে কাউন্সিলরদের তৎপরতা এখনো প্রত্যাশিত নয় বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। এসব অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু ভয়াবহতা পেয়েছে। এখন প্রতি মুহূর্তে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। এখন দুই সিটি প্রতিদিনই সচেতনতামূলক কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করলেও মশা বা লার্ভা নিধনে তেমন কার্যকর ভ‚মিকা রাখছে না। অনেকে এসব কাজকে লোক দেখানো মশক নিধন কার্যক্রম বলে অভিমত ব্যক্ত করছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও প্রখ্যাত ভাইরালজিস্ট অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে দেশে ডেঙ্গুর এমন অবস্থা সৃষ্টি হতো না। তিনি দেশবাসীকে নির্দেশ দিলে সবাই কোদাল হাতে চারপাশ পরিষ্কার করত।’ অধ্যাপক নজরুল বলেন, ‘ডেঙ্গু পরিস্থিতি থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হচ্ছে লার্ভা ও মশা নিধন করা। যার যা করা দরকার, তাকে সেটা করতে হবে।
ডেঙ্গু বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা আগস্ট মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গু মশার প্রজনন বাড়তে পারে। জরুরি ভিত্তিতে মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন স্বাস্থ্য অধিদফতর।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মাহমুদ খান বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতর যেসব প্রতিবেদন দিয়েছে সেটি যদি দুই সিটি কর্পোরেশন আমলে নিত তাহলে আজকে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। তিনি বলেন, মশা মারার বাজেট বাড়ানো হলেও নাগরিকরা সেবা পাচ্ছেন না। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছেÑ এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে তাতে মশা মরছে না। অকার্যকর মশার ওষুধের কারণে যতই বাজেট বাড়ানো হোক, কোনো কাজে আসবে না। এর মধ্যে দুর্নীতির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।’
দুই সিটি কর্পোরেশন ও নগরীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, ওষুধ কার্যকর হচ্ছে না, এটা এখন আর নতুন কোনো বিষয় নয়। রোগতত্ত¡, কীটতত্ত¡ বিভাগ ও আইসিডিডিআরবিসহ কিছু সংস্থা গত ৩ বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিষয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। দুই মেয়রের কাছে তারা তুলে ধরেছে, মশক নিধনের ওষুধ এখন আর কার্যকর নয়। তারপরও তিন বছরে বিকল্প ওষুধ বা বিদ্যমান ওষুধ কার্যকর আছে কিনা, তা অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নগরবাসীকে রক্ষার বাস্তবিক প্রয়াস দুই মেয়র নেননি। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে হলে মশক নিধনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে আরো সক্রিয় হতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কাযর্ক্রম আরো জোরদার করা দরকার। ব্যক্তি সচেতন হলে মশাবাহিত এই রোগ হ্রাস পেতে পারে, এমনটি মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক কাযর্ক্রমও ব্যাপকহারে বাড়ানো দরকার।
No comments