এটাই কী আমার অপরাধ? by পিয়াস সরকার
হাসপাতালে
গিয়েছিলাম প্রচণ্ড জ্বর আর শরীর ব্যথা নিয়ে। ডাক্তার দেখানোর প্রতিটি
পদক্ষেপ ছিল যেন একেকটি যুদ্ধ। টিকিট নিতে নারী-পুরুষ নিয়ে প্রথম দ্বিধা।
টিকিট কাউন্টারে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন আমি অন্যায় কোনো কাজ করতে এসেছি।
ডাক্তারের রুমের সামনে ছিল বিশাল লাইন। সেখানেও একই সমস্যা, দাঁড়াবো কোন
লাইনে- ছেলেদের না মেয়েদের? আমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখ আমার দিকে এবং
নীরবতা নেমে এলো সেখানে। বলতে বলতে চোখের কোণে পানি চলে আসে নূরজাহান
বেগমের। তিনি আরো বলেন, তবে ডাক্তার খুব ভালো ছিল। তিনি আমাকে খুব ভালোভাবে
দেখেছেন। ওষুধ লিখে দিয়েছেন।
চলতে ফিরতে প্রায়শই হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের চোখে পড়ে আমাদের। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এসব মানুষদের আমরা নিগ্রহের চোখেই দেখি। চাঁদাবাজি, অশোভন আচরণ, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্য হয়তো করেছেন আমাদের সামনে আসা হিজড়াদের বয়স আনুমানিক ১৮ থেকে ৪০। কিন্তু এর বেশি বয়সের হিজড়ারা আমাদের লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে যায়।
নূরজাহান বেগম, বয়স আনুমানিক ৭০। থাকেন রায়ের বাজার বস্তির হিজড়া পল্লীতে। বয়সের সঙ্গে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগ। হাঁটুর ব্যথায় যেমন কাতর তেমনি প্রায়শই আঘাত হানে মাথা ব্যথা। মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হলে তিন দিন অচল। নূরজাহান বেগম বলেন, বয়স হয়ে গেছে, খাই অন্যের টাকায়। তবে, এখানে রক্তের সম্পর্কের কেউ না থাকলেও সবাই আপন।
নূরজাহান বেগমের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায়। ৮ ভাই ১ বোন আর নুরজাহান সবার ছোট। তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে জন্ম নেয়ায় ১২ বছর বয়সে বাবা তাকে রেখে আসে ফরিদপুর হিজড়া পল্লীতে। তারপর সেখানে ছয় বছর থাকার পর পাড়ি জমান ঢাকাতে। আমার জীবনের সব থেকে সুখের সময় ছিল ছোট বেলায়। অভাবের সংসার হলেও বাবা-মা ভাইবোন নিয়ে অনেক ভালো ছিলাম। কিন্তু যত বড় হই, লোকজনের কথা তত বাড়তে থাকে। বাবা একদিন মেলায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রেখে আসে পল্লীতে। ফরিদপুর থেকে ঢাকা আসার সময় একবার গিয়েছিলাম বাড়িতে। আমার মা খুবই খুশি হয়েছিল তখন। দুইদিন ছিলাম। আসার সময় মায়ের কান্না দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। সেটাই ছিল মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা। মা মারা গেছে সেটা আমি জানি বছর খানেক পর। বাবার মৃত্যুর খবর পাই নাই। নিশ্চয়ই এতদিনে মারা গেছেন। আমার ভাই-বোন কেমন আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানি না। বলতে বলতে আবারো কেঁদে ফেলেন তিনি।
এখন কিভাবে সময় কাটে? এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখন শুধুই মৃত্যুর অপেক্ষা। নামাজ পড়ি, আল্লাহকে ডাকি। দুনিয়াতে তো সুখ দিলো না আল্লাহ। পরপারে যেন সুখ পাই।
রাস্তাঘাটে, দোকানে, বাচ্চা জন্মানো, বিয়ে বাড়ি ইত্যাদি স্থানে চাঁদাবাজি নিয়ে বলেন- জানি এটা খারাপ কাজ। কিন্তু আমাদেরও পেট আছে। আমাদেরও খেতে হয়। আমরা কাজ চাইলেও পাই না। তাই আমাদের বাধ্য হয়ে এসব করতে হয়। বলেন, আমি কেন বাড়ি ছাড়া? আমি হিজড়া হয়ে জন্মেছি, তাতে আমার তো কোনো দোষ ছিল না। ১৯৮০ সালের কথা, শীতকাল। তখন আমরা দলগতভাবে দোকানে দোকানে টাকা তুলি। ফার্মগেটে একদোকানদার হঠাৎ আমার মুখ ও হাত বেঁধে ফেলে। ফাঁকা দোকানের ভেতর নিয়ে যায়। এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমার, প্রায় ৪-৫ জন ছিল। একজন আমার শরীরে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেয়। আর একজন কথাবার্তা ছাড়া মারতে শুরু করে। উলঙ্গ করে দেয় আমায়। শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। এমন অবস্থায় রেখে চলে যায় তারা, রুম বন্ধ করে। ঘণ্টাখানেক পর এসে আমার মুখ খুলে দেয়। তখন নিঃশ্বাস নিয়ে মনে হয়েছিল যেন জীবন ফিরে পেলাম। উলঙ্গ অবস্থায় বেশ কিছু সময় হাসি তামাশা করে ছেড়ে দেয়। আপনি বলেন, আমি হিজড়া এটাই কি আমার অপরাধ?
আরেকদিন, আমরা টাকা তুলে সবাই বসে বিশ্রাম করছিলাম ফার্মগেটের একটা চায়ের দোকানে। তখন দেখি ৭-৮ বছরের একটা শিশু কাঁদছে। কথা বলে জানতে পারি, সে তার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আমরা তাকে নিয়ে তার বাবাকে খোঁজা শুরু করি। এমন সময় তার বাবা পেছন থেকে এসে বলে, এই তোরা আমার ছেলেকে নিয়ে কোথায় পালাচ্ছিস? নানান কথা। লোকজন জড়ো হলে বাচ্চাটি বলে উঠে ‘না বাবা ওরা আমাকে নিয়ে পালাচ্ছে না।’ তার ছেলের মুখে সব কথা শোনার পর কিছু না বলেই ছেলেকে নিয়ে চলে যায়।
বয়স বেড়ে যাবার পর একমাত্র আয় এখন ‘দোয়া’। অনেকে আমাদের ভয়ে ছোট বাচ্চা লুকিয়ে রাখে। আবার অনেক পরিবার আমাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যায় ছোট বাচ্চাকে দোয়া করার জন্য। আগে দেখতাম এমন দাওয়াত অনেক আসত। কিন্তু এখন মাসে দুই একটার বেশি আসে না। খুব ভালো লাগে আমাদের সম্মান করে কেউ বাড়িতে নিয়ে যায়। আমরা প্রাণ ভরে দোয়া করি এসব বাচ্চাদের জন্য। আমারো খুব শখ ছিল মা হওয়ার। এই ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেয় নাই। তাই দোয়া করেই মন ভরাই। আসার সময় খুশি হয়ে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয় এটাই একমাত্র আয়।
স্বপ্ন? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, আমি অল্প কিছু দিন স্কুলে গিয়েছিলাম। আমি পড়তে জানি। অল্প লিখতেও পারি। আমি চাই সব হিজড়া তার পরিবারের সদস্য হয়ে থাকুক। আমার বাবার মতো যেন মেলায় যাওয়ার কথা বলে পল্লীতে রেখে আসতে না হয়। একটাই স্বপ্ন হিজড়ারাও যে মানুষ সমাজ তা মেনে নিক।
চলতে ফিরতে প্রায়শই হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের চোখে পড়ে আমাদের। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি এসব মানুষদের আমরা নিগ্রহের চোখেই দেখি। চাঁদাবাজি, অশোভন আচরণ, ভিক্ষাবৃত্তি ইত্যাদির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু একটা বিষয় লক্ষ্য হয়তো করেছেন আমাদের সামনে আসা হিজড়াদের বয়স আনুমানিক ১৮ থেকে ৪০। কিন্তু এর বেশি বয়সের হিজড়ারা আমাদের লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে যায়।
নূরজাহান বেগম, বয়স আনুমানিক ৭০। থাকেন রায়ের বাজার বস্তির হিজড়া পল্লীতে। বয়সের সঙ্গে শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান রোগ। হাঁটুর ব্যথায় যেমন কাতর তেমনি প্রায়শই আঘাত হানে মাথা ব্যথা। মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হলে তিন দিন অচল। নূরজাহান বেগম বলেন, বয়স হয়ে গেছে, খাই অন্যের টাকায়। তবে, এখানে রক্তের সম্পর্কের কেউ না থাকলেও সবাই আপন।
নূরজাহান বেগমের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায়। ৮ ভাই ১ বোন আর নুরজাহান সবার ছোট। তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে জন্ম নেয়ায় ১২ বছর বয়সে বাবা তাকে রেখে আসে ফরিদপুর হিজড়া পল্লীতে। তারপর সেখানে ছয় বছর থাকার পর পাড়ি জমান ঢাকাতে। আমার জীবনের সব থেকে সুখের সময় ছিল ছোট বেলায়। অভাবের সংসার হলেও বাবা-মা ভাইবোন নিয়ে অনেক ভালো ছিলাম। কিন্তু যত বড় হই, লোকজনের কথা তত বাড়তে থাকে। বাবা একদিন মেলায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রেখে আসে পল্লীতে। ফরিদপুর থেকে ঢাকা আসার সময় একবার গিয়েছিলাম বাড়িতে। আমার মা খুবই খুশি হয়েছিল তখন। দুইদিন ছিলাম। আসার সময় মায়ের কান্না দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। সেটাই ছিল মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা। মা মারা গেছে সেটা আমি জানি বছর খানেক পর। বাবার মৃত্যুর খবর পাই নাই। নিশ্চয়ই এতদিনে মারা গেছেন। আমার ভাই-বোন কেমন আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানি না। বলতে বলতে আবারো কেঁদে ফেলেন তিনি।
এখন কিভাবে সময় কাটে? এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখন শুধুই মৃত্যুর অপেক্ষা। নামাজ পড়ি, আল্লাহকে ডাকি। দুনিয়াতে তো সুখ দিলো না আল্লাহ। পরপারে যেন সুখ পাই।
রাস্তাঘাটে, দোকানে, বাচ্চা জন্মানো, বিয়ে বাড়ি ইত্যাদি স্থানে চাঁদাবাজি নিয়ে বলেন- জানি এটা খারাপ কাজ। কিন্তু আমাদেরও পেট আছে। আমাদেরও খেতে হয়। আমরা কাজ চাইলেও পাই না। তাই আমাদের বাধ্য হয়ে এসব করতে হয়। বলেন, আমি কেন বাড়ি ছাড়া? আমি হিজড়া হয়ে জন্মেছি, তাতে আমার তো কোনো দোষ ছিল না। ১৯৮০ সালের কথা, শীতকাল। তখন আমরা দলগতভাবে দোকানে দোকানে টাকা তুলি। ফার্মগেটে একদোকানদার হঠাৎ আমার মুখ ও হাত বেঁধে ফেলে। ফাঁকা দোকানের ভেতর নিয়ে যায়। এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমার, প্রায় ৪-৫ জন ছিল। একজন আমার শরীরে ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেয়। আর একজন কথাবার্তা ছাড়া মারতে শুরু করে। উলঙ্গ করে দেয় আমায়। শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। এমন অবস্থায় রেখে চলে যায় তারা, রুম বন্ধ করে। ঘণ্টাখানেক পর এসে আমার মুখ খুলে দেয়। তখন নিঃশ্বাস নিয়ে মনে হয়েছিল যেন জীবন ফিরে পেলাম। উলঙ্গ অবস্থায় বেশ কিছু সময় হাসি তামাশা করে ছেড়ে দেয়। আপনি বলেন, আমি হিজড়া এটাই কি আমার অপরাধ?
আরেকদিন, আমরা টাকা তুলে সবাই বসে বিশ্রাম করছিলাম ফার্মগেটের একটা চায়ের দোকানে। তখন দেখি ৭-৮ বছরের একটা শিশু কাঁদছে। কথা বলে জানতে পারি, সে তার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আমরা তাকে নিয়ে তার বাবাকে খোঁজা শুরু করি। এমন সময় তার বাবা পেছন থেকে এসে বলে, এই তোরা আমার ছেলেকে নিয়ে কোথায় পালাচ্ছিস? নানান কথা। লোকজন জড়ো হলে বাচ্চাটি বলে উঠে ‘না বাবা ওরা আমাকে নিয়ে পালাচ্ছে না।’ তার ছেলের মুখে সব কথা শোনার পর কিছু না বলেই ছেলেকে নিয়ে চলে যায়।
বয়স বেড়ে যাবার পর একমাত্র আয় এখন ‘দোয়া’। অনেকে আমাদের ভয়ে ছোট বাচ্চা লুকিয়ে রাখে। আবার অনেক পরিবার আমাদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যায় ছোট বাচ্চাকে দোয়া করার জন্য। আগে দেখতাম এমন দাওয়াত অনেক আসত। কিন্তু এখন মাসে দুই একটার বেশি আসে না। খুব ভালো লাগে আমাদের সম্মান করে কেউ বাড়িতে নিয়ে যায়। আমরা প্রাণ ভরে দোয়া করি এসব বাচ্চাদের জন্য। আমারো খুব শখ ছিল মা হওয়ার। এই ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেয় নাই। তাই দোয়া করেই মন ভরাই। আসার সময় খুশি হয়ে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয় এটাই একমাত্র আয়।
স্বপ্ন? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, আমি অল্প কিছু দিন স্কুলে গিয়েছিলাম। আমি পড়তে জানি। অল্প লিখতেও পারি। আমি চাই সব হিজড়া তার পরিবারের সদস্য হয়ে থাকুক। আমার বাবার মতো যেন মেলায় যাওয়ার কথা বলে পল্লীতে রেখে আসতে না হয়। একটাই স্বপ্ন হিজড়ারাও যে মানুষ সমাজ তা মেনে নিক।
No comments