আপিল শুনানিতে ফের উত্তাপ, হইচই রায় মঙ্গলবার
বিএনপির
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে আগামী ১৫ই মে রায় দেবেন সুপ্রিম
কোর্টের আপিল বিভাগ। গতকাল এ বিষয়ে শুনানি শেষে রায়ের জন্য এদিন ধার্য করেন
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত চার বিচারপতির আপিল
বিভাগ। গতকাল শুনানির শেষ দিনে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে দফায় দফায় তুমুল
হট্টগোল, হইচই ও উত্তেজনা দেখা দেয়। প্রধান বিচারপতি এ নিয়ে একাধিকবার
উষ্মা প্রকাশ করে আইনজীবীদের সতর্ক করেন। শুনানির শেষ দিকে হট্টগোলের সময়
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে আদালত থেকে
বেরিয়ে যেতে উদ্যত হন। এর আগে সোমবারও খালেদা জিয়ার জামিন শুনানিতে হইচই
হট্টগোল হয়। আদালত এদিনও আইনজীবীদের সতর্ক করেন। গতকাল সকালে খালেদা জিয়ার
পক্ষে শুনানির অসমাপ্ত বক্তব্য তুলে ধরেন তার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী।
খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে আরো অংশ নেন সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব
হোসেন, মওদুদ আহমদ ও জয়নুল আবেদীন। তারা খালেদার জামিনের স্বপক্ষে বক্তব্য
তুলে ধরেন। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে
ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। গতকালও শুনানিতে খালেদা জিয়ার
আইনজীবীরা এ মামলার শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের অংশগ্রহণের এখতিয়ার নিয়ে
প্রশ্ন তোলেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলটির স্থায়ী
কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু করেন খালেদার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ মামলায় আমাদের বিচার ব্যবস্থায় হাইকোর্ট জামিন দিলে আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেনি। এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, এই মামলাকে অন্য সকল মামলা থেকে আলাদা করে এনে দ্রুত বিচার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা মানি বা না মানি গোটা রাষ্ট্রকে এই মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। এটি বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপের শামিল। আমি সারা দেশ ঘুরেছি। সারা দেশেই আইনজীবীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা যে, কোন মামলায় জামিন হবে কী হবে না, সেটা নির্ভর করছে বিশেষ ক্লিয়ারেন্স আছে কিনা, সেটার ওপর। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল এই বক্তব্যের আপত্তি জানিয়ে বলেন, এটা সত্য নয়। এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, খালেদা জিয়াকে নির্জন পরিত্যক্ত কারাগারে রাখা হয়েছে। তখন সেটা কারাগার ছিল, কিন্তু সেটাকে এখনও কারাগার ঘোষণা করা হয়নি। আমার বলার পর হয়তো সরকার একটা ফাইল তৈরি করে ফেলবে। এভাবেই স্বেচ্ছাচারিতা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, অদৃশ্য দ্রুততার সঙ্গে এ মামলা নিষ্পত্তি করতে চাচ্ছে। ভিন্ন উদ্দেশ্যে এই মামলাটা আনা হচ্ছে। এটা অপ্রত্যাশিত। এ অবস্থায় হাইকোর্ট তার বয়স, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, কম সাজা সব বিবেচনায় যথাযথভাবেই জামিন দিয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত রাখতে এই জামিন বহাল রাখা হোক। হাইকোর্টের আদেশে হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না। এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, নিম্ন আদালতের রায়ে বলা হয়েছে এটা অর্থনৈতিক অপরাধ। এজন্য শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু অর্থনৈতিক অপরাধ হলে তার বিচারের জন্য দেশে অন্য আইন রয়েছে। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় এই অপরাধের বিচারের সুযোগ নেই।
খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানিতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। এ সময় তিনি মামলাজট নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেন, সারা দেশে নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে লাখ লাখ মামলা ঝুলে আছে। কিন্তু এ মামলা নিয়ে তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে। খন্দকার মাহবুব হোসেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, হাইকোর্ট কোনো মামলায় জামিন দেয়ার পর আপিল বিভাগ সেখানে হস্তক্ষেপ করেন না। করার নজিরও নেই। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে এই মামলার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কোনো কাগজপত্রে তাঁর স্বাক্ষরও নেই। এই মামলা যখন শুরু হয়েছিল, তখন ছিল মাইনাস টু ফর্মুলা। আর এখন মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা। ভারতের সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রী জয় ললিতা ও লালু প্রসাদ যাদবের জামিন সংক্রান্ত বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের দেয়া উদাহরণের প্রেক্ষিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, জয় ললিতার চার বছর সাজা হয়েছিল। সাত দিনের মধ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাকে জামিন দিয়েছে। আর লালু প্রসাদ যাদবের ৫ বছররের সাজায় দুই মাসের মধ্যে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট জামিন দিয়েছে।
খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা। কিন্তু এখানে দুদক ও সরকার একাকার হয়ে গেছে। আমরা ৫ জন আইনজীবী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি গুরুতর অসুস্থ। তাঁর হাত ফুলে উঠেছে। ঘাড় নাড়াতে পারছেন না। তিনি কথাও বলতে পারছেন না। জেলখানায় তার সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না। অথচ সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, খালেদা জিয়া নাকি বিশ্রামে আছেন। আদালতের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মানুষের জন্য আদালত, আপনাদের মন আছে, বিবেক আছে। এটি সর্বোচ্চ আদালত। এর মান মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনাদেরও দায়িত্ব আছে। জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদেরও দায়িত্ব আছে। এখন সরকারের এই সমস্ত কর্মকাণ্ড যদি আমরা মেনে নিই আপনারাও যদি মেনে নেন তাহলে কি হবে?
এ সময় প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের উদ্দেশ্যে বলেন, সরকারে গেলে আপনারাও তাই করবেন।
শুনানিতে জয়নুল আবেদীন আরো বলেন, খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৩ বছর। মানুষের জন্যই আদালত। আদালতের চোখ আছে, মন আছে, বিবেক আছে। পাবলিক পারসেপশন আছে। এই কোর্ট ছাড়া আমাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। আমরা আশা করি আদালত এসব কিছু বিবেচনা করবেন। এ সময় জয়নুল আবেদীন খালেদা জিয়ার জামিনের স্বপক্ষে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন নজির তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ ধরনের অনেক মামলায় জামিন হয়েছে। কিন্তু দুদক তো আপিল করেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও সাবেক মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের মামলার উদাহরণ টেনে বলেন, তাদেরকে স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনা করে জামিন দিয়েছে। ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিলও করেনি দুদক ও রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার বয়স ও অসুস্থার বিষয় বিবেচনা করে জামিন বহাল রাখা হোক। খালেদার জামিন শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের শুনানি করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল কোন কর্তৃত্ব বলে বক্তব্য দিয়েছেন আইন তা অনুমোদন করে না। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, তাহলে আপনারা কেন রাষ্ট্রকে পক্ষ করলেন। জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, করতে হয় তাই করেছি।
শুনানিতে খালেদার আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, বকশীবাজারে যে আদালতে এই মামলার বিচারকাজ হয়েছে এটি কোনো পাবলিক কোর্ট নয়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে এই মামলা এতদূর পর্যন্ত এসেছে। খালেদা জিয়া যদি বিএনপির চেয়ারপারসন না হতেন তাহলে এই মামলা এতদূর আসতো না। তিনি বলেন, এটি একটি প্রাইভেট ট্রাস্ট। আমি যদি আমার বাবা মায়ের নামে ট্রাস্ট করে ট্রাস্টের টাকা আত্মসাৎ করবো এটি অবিশ্বাস্য। তিনি আরো বলেন, যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে দুই কোটি টাকার ব্যাপার। আমি আর নাই বা বললাম। মওদুদ বলেন, দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা দুদক আইনের ৫ (২) ধারার অধীনে সাজা হয় না। একটি সাজা দিতে হবে। তাই বিচারিক আদালত ৪০৯ ধারায় সাজা দিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের শুনানি শেষে দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম খান শুনানি শুরু করেন। এ সময় খালেদা জিয়ার জামিনের বিপক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরে আপিল শুনানির শুরুর আর্জি জানান তিনি। আদালতকে তিনি বলেন, এই মামলা বিচারিক আদালতে শেষ হতে ৯ বছর লেগেছে। আমরা চাই না উচ্চ আদালতেও এত সময় লাগুগ। আদালতকে তিনি বলেন, দুদকের স্থায়ী কোনো প্রসিকিউশন নেই। অস্থায়ীভাবে তাদের নিয়োগ দেয়। যে মামলা পরিচালনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়, শুধু সেই মামলাই তাঁরা পরিচালনা করেন। এই মামলায় বিচারিক আদালত ভুল করেছে- এমন উল্লেখ করে দুদক আইনজীবী বলেন, এই কারণে আমরা হাইকোর্টে রিভিশন করেছি।
দুপুর একটার দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। এই মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের অংশগ্রহণ নিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন এবং রাষ্ট্রপক্ষে মানি লন্ডারিংয়ের একটি মামলায় প্রথম অংশ নেন। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের করা একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানিতে অংশ নেন তিনি। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার নজির তুলে ধরে এ মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তার অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাকে আমরাই অ্যাডমিট করেছি। বেঞ্চের অন্য বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বলেন, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আপনি যে কোনো মামলায় অংশ নিতে পারেন। একপর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় টাকার উৎস সম্পর্কে বক্তব্য দিতে থাকেন। তিনি বলেন ১৯৯১ সালে এই টাকা এসেছিল। অ্যাকাউন্ট খোলা ও টাকা কীভাবে বিভিন্ন ভাবে ভাগ হয়েছে সে বিষয়ে আদালতে বক্তব্য তুলে ধরতে থাকেন তিনি। এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের এসব বক্তব্যে আমাদের আপত্তি আছে। উনি যদি পিছনে যেতে চান তাহলে আমরাও পিছনে যাব। জয়নুল আবেদীনের এই বক্তব্যের সঙ্গে আদালতে উপস্থিত বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা চিৎকার করতে থাকেন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, টাকা কীভাবে ভাগ হয়ে চলে গেছে, সেটা তো আমাকে বলতে হবে। এ সময় জয়নুল আবেদীনের পাশে থাকা খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন উচ্চস্বরে অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন। এ পর্যায়ে দুইপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন আইনজীবী উঠে দাঁড়িয়ে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। মাহবুব উদ্দিন খোকন অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বলেন ‘আপনি কোর্টকে শেষ করে দিচ্ছেন’। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এভাবে হইচই করলে কোর্ট চালাতে পারব না। আপনারা যদি হইচই করেন তাহলে কোর্ট চালানো অসম্ভব হয়ে যাবে’। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হন। তিনি বলেন, ‘এমন পরিবেশে কীভাবে সাবমিশন রাখব।’ এ পর্যায়ে সিনিয়র আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল আবারো তার বক্তব্য তুলে ধরেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে জামিনের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার যে রোগের কথা বলা হচ্ছে, সেই রোগ নিয়েই তিনি রাজনীতি করেছেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। এই রোগ নিয়েই তিনি সবকিছু করছেন। এটা সহনীয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শেষে আপিল বিভাগ রায়ের জন্য মঙ্গলবার (১৫ই মে) দিন ধার্য করেন।
গতকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু করেন খালেদার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ মামলায় আমাদের বিচার ব্যবস্থায় হাইকোর্ট জামিন দিলে আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেনি। এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, এই মামলাকে অন্য সকল মামলা থেকে আলাদা করে এনে দ্রুত বিচার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা মানি বা না মানি গোটা রাষ্ট্রকে এই মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। এটি বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপের শামিল। আমি সারা দেশ ঘুরেছি। সারা দেশেই আইনজীবীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা যে, কোন মামলায় জামিন হবে কী হবে না, সেটা নির্ভর করছে বিশেষ ক্লিয়ারেন্স আছে কিনা, সেটার ওপর। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল এই বক্তব্যের আপত্তি জানিয়ে বলেন, এটা সত্য নয়। এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, খালেদা জিয়াকে নির্জন পরিত্যক্ত কারাগারে রাখা হয়েছে। তখন সেটা কারাগার ছিল, কিন্তু সেটাকে এখনও কারাগার ঘোষণা করা হয়নি। আমার বলার পর হয়তো সরকার একটা ফাইল তৈরি করে ফেলবে। এভাবেই স্বেচ্ছাচারিতা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, অদৃশ্য দ্রুততার সঙ্গে এ মামলা নিষ্পত্তি করতে চাচ্ছে। ভিন্ন উদ্দেশ্যে এই মামলাটা আনা হচ্ছে। এটা অপ্রত্যাশিত। এ অবস্থায় হাইকোর্ট তার বয়স, স্বাস্থ্যগত অবস্থা, কম সাজা সব বিবেচনায় যথাযথভাবেই জামিন দিয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত রাখতে এই জামিন বহাল রাখা হোক। হাইকোর্টের আদেশে হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না। এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, নিম্ন আদালতের রায়ে বলা হয়েছে এটা অর্থনৈতিক অপরাধ। এজন্য শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু অর্থনৈতিক অপরাধ হলে তার বিচারের জন্য দেশে অন্য আইন রয়েছে। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় এই অপরাধের বিচারের সুযোগ নেই।
খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানিতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। এ সময় তিনি মামলাজট নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেন, সারা দেশে নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে লাখ লাখ মামলা ঝুলে আছে। কিন্তু এ মামলা নিয়ে তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে। খন্দকার মাহবুব হোসেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, হাইকোর্ট কোনো মামলায় জামিন দেয়ার পর আপিল বিভাগ সেখানে হস্তক্ষেপ করেন না। করার নজিরও নেই। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে এই মামলার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কোনো কাগজপত্রে তাঁর স্বাক্ষরও নেই। এই মামলা যখন শুরু হয়েছিল, তখন ছিল মাইনাস টু ফর্মুলা। আর এখন মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা। ভারতের সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রী জয় ললিতা ও লালু প্রসাদ যাদবের জামিন সংক্রান্ত বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের দেয়া উদাহরণের প্রেক্ষিতে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, জয় ললিতার চার বছর সাজা হয়েছিল। সাত দিনের মধ্যে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাকে জামিন দিয়েছে। আর লালু প্রসাদ যাদবের ৫ বছররের সাজায় দুই মাসের মধ্যে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট জামিন দিয়েছে।
খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীন আদালতকে বলেন, দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা। কিন্তু এখানে দুদক ও সরকার একাকার হয়ে গেছে। আমরা ৫ জন আইনজীবী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি গুরুতর অসুস্থ। তাঁর হাত ফুলে উঠেছে। ঘাড় নাড়াতে পারছেন না। তিনি কথাও বলতে পারছেন না। জেলখানায় তার সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না। অথচ সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, খালেদা জিয়া নাকি বিশ্রামে আছেন। আদালতের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মানুষের জন্য আদালত, আপনাদের মন আছে, বিবেক আছে। এটি সর্বোচ্চ আদালত। এর মান মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনাদেরও দায়িত্ব আছে। জয়নুল আবেদীন বলেন, আমাদেরও দায়িত্ব আছে। এখন সরকারের এই সমস্ত কর্মকাণ্ড যদি আমরা মেনে নিই আপনারাও যদি মেনে নেন তাহলে কি হবে?
এ সময় প্রধান বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের উদ্দেশ্যে বলেন, সরকারে গেলে আপনারাও তাই করবেন।
শুনানিতে জয়নুল আবেদীন আরো বলেন, খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৩ বছর। মানুষের জন্যই আদালত। আদালতের চোখ আছে, মন আছে, বিবেক আছে। পাবলিক পারসেপশন আছে। এই কোর্ট ছাড়া আমাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। আমরা আশা করি আদালত এসব কিছু বিবেচনা করবেন। এ সময় জয়নুল আবেদীন খালেদা জিয়ার জামিনের স্বপক্ষে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন নজির তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ ধরনের অনেক মামলায় জামিন হয়েছে। কিন্তু দুদক তো আপিল করেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও সাবেক মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের মামলার উদাহরণ টেনে বলেন, তাদেরকে স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনা করে জামিন দিয়েছে। ওই জামিনের বিরুদ্ধে আপিলও করেনি দুদক ও রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার বয়স ও অসুস্থার বিষয় বিবেচনা করে জামিন বহাল রাখা হোক। খালেদার জামিন শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেলের শুনানি করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল কোন কর্তৃত্ব বলে বক্তব্য দিয়েছেন আইন তা অনুমোদন করে না। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, তাহলে আপনারা কেন রাষ্ট্রকে পক্ষ করলেন। জবাবে জয়নুল আবেদীন বলেন, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, করতে হয় তাই করেছি।
শুনানিতে খালেদার আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেন, বকশীবাজারে যে আদালতে এই মামলার বিচারকাজ হয়েছে এটি কোনো পাবলিক কোর্ট নয়। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে এই মামলা এতদূর পর্যন্ত এসেছে। খালেদা জিয়া যদি বিএনপির চেয়ারপারসন না হতেন তাহলে এই মামলা এতদূর আসতো না। তিনি বলেন, এটি একটি প্রাইভেট ট্রাস্ট। আমি যদি আমার বাবা মায়ের নামে ট্রাস্ট করে ট্রাস্টের টাকা আত্মসাৎ করবো এটি অবিশ্বাস্য। তিনি আরো বলেন, যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে দুই কোটি টাকার ব্যাপার। আমি আর নাই বা বললাম। মওদুদ বলেন, দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা দুদক আইনের ৫ (২) ধারার অধীনে সাজা হয় না। একটি সাজা দিতে হবে। তাই বিচারিক আদালত ৪০৯ ধারায় সাজা দিয়েছেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের শুনানি শেষে দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম খান শুনানি শুরু করেন। এ সময় খালেদা জিয়ার জামিনের বিপক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরে আপিল শুনানির শুরুর আর্জি জানান তিনি। আদালতকে তিনি বলেন, এই মামলা বিচারিক আদালতে শেষ হতে ৯ বছর লেগেছে। আমরা চাই না উচ্চ আদালতেও এত সময় লাগুগ। আদালতকে তিনি বলেন, দুদকের স্থায়ী কোনো প্রসিকিউশন নেই। অস্থায়ীভাবে তাদের নিয়োগ দেয়। যে মামলা পরিচালনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়, শুধু সেই মামলাই তাঁরা পরিচালনা করেন। এই মামলায় বিচারিক আদালত ভুল করেছে- এমন উল্লেখ করে দুদক আইনজীবী বলেন, এই কারণে আমরা হাইকোর্টে রিভিশন করেছি।
দুপুর একটার দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। এই মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের অংশগ্রহণ নিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন এবং রাষ্ট্রপক্ষে মানি লন্ডারিংয়ের একটি মামলায় প্রথম অংশ নেন। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের করা একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানিতে অংশ নেন তিনি। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার নজির তুলে ধরে এ মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তার অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাকে আমরাই অ্যাডমিট করেছি। বেঞ্চের অন্য বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বলেন, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আপনি যে কোনো মামলায় অংশ নিতে পারেন। একপর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় টাকার উৎস সম্পর্কে বক্তব্য দিতে থাকেন। তিনি বলেন ১৯৯১ সালে এই টাকা এসেছিল। অ্যাকাউন্ট খোলা ও টাকা কীভাবে বিভিন্ন ভাবে ভাগ হয়েছে সে বিষয়ে আদালতে বক্তব্য তুলে ধরতে থাকেন তিনি। এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের এসব বক্তব্যে আমাদের আপত্তি আছে। উনি যদি পিছনে যেতে চান তাহলে আমরাও পিছনে যাব। জয়নুল আবেদীনের এই বক্তব্যের সঙ্গে আদালতে উপস্থিত বিএনপি সমর্থক আইনজীবীরা চিৎকার করতে থাকেন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, টাকা কীভাবে ভাগ হয়ে চলে গেছে, সেটা তো আমাকে বলতে হবে। এ সময় জয়নুল আবেদীনের পাশে থাকা খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন উচ্চস্বরে অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মন্তব্য করতে থাকেন। এ পর্যায়ে দুইপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন আইনজীবী উঠে দাঁড়িয়ে বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। মাহবুব উদ্দিন খোকন অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশ্যে বলেন ‘আপনি কোর্টকে শেষ করে দিচ্ছেন’। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এভাবে হইচই করলে কোর্ট চালাতে পারব না। আপনারা যদি হইচই করেন তাহলে কোর্ট চালানো অসম্ভব হয়ে যাবে’। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হন। তিনি বলেন, ‘এমন পরিবেশে কীভাবে সাবমিশন রাখব।’ এ পর্যায়ে সিনিয়র আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল আবারো তার বক্তব্য তুলে ধরেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে জামিনের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার যে রোগের কথা বলা হচ্ছে, সেই রোগ নিয়েই তিনি রাজনীতি করেছেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। এই রোগ নিয়েই তিনি সবকিছু করছেন। এটা সহনীয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শেষে আপিল বিভাগ রায়ের জন্য মঙ্গলবার (১৫ই মে) দিন ধার্য করেন।
No comments