হাওরজুড়ে বজ্রপাত আতংক by ইমাদ উদ দীন
পাকা
বোরো ধান মাঠে দোল খাচ্ছে। কিন্তু প্রত্যাশিত সে ধান ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কায়
পড়েছেন কৃষক। গেল প্রায় ১০-১২ দিন থেকে এ সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। কারণ সকাল
থেকেই আকাশ থাকছে মেঘাচ্ছন্ন। আর এরই সঙ্গে থাকছে ঝড়ো হাওয়া, বিজলি চমকানো,
ভারি বৃষ্টি ও বজ্রপাত। সোমবার জেলায় বজ্রপাতে দুইজন নিহত ও তিনজন আহত
হওয়াসহ দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়ে চলায় এখন বজ্রপাত আতঙ্ক বিরাজ করছে।
আর এ কারণে অনুকূল আবহাওয়া না হলে কেউই ঘর হতে বের হচ্ছেন না। আকাশের
অবস্থা দেখে চাষিরাও মাঠে যাচ্ছেন। বোরো চাষি কৃষকদের সঙ্গে আলাপে তারা
জানালেন মাঠে পাকা ধান সংগ্রহে তারা ভয় নিয়ে ক্ষেতের জমিতে নামছেন। কারণ এ
বছর বজ্রপাত নিয়ে তারা আতঙ্কে আছেন। তাই আকাশে বিজলি চমকালে কিংবা
মেঘাচ্ছন্ন হলেই তারা দ্রুত ঘরে ফিরছেন। এতে পাকা ধান কাটা হচ্ছে কম। এদিকে
সময় যত যাচ্ছে ভারি বৃষ্টিপাত বেড়ে চলায় পাকা বোরো ধানও পানিতে তলিয়ে
যাচ্ছে। তারা জানালেন, এ বছর পানিতে জোঁক আর আকাশ থেকে নামছে বজ্রপাত। এই
দুই ভয় এ জেলায় ধান কাটা শ্রমিকের সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে। ৫শ’-৬শ’ টাকা মজুরি
দিয়েও মিলছে না ধান কাটা শ্রমিক। কৃষকরা জানালেন, আরো সপ্তাহ দিন আবহাওয়া
অনুকূলে না থাকলে পাকা বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে জেলার মোট বোরো
আবাদের ১০-১৫ ভাগ ফসল ঘরে উঠানো যাবে না। গতকাল সরজমিন জেলার কাউয়াদিঘি ও
হাইল হাওর এলাকায় গেলে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। জেলার হাকালুকি ও হাইল হাওরের
বিল এলাকায় আবাদকৃত বোরো ধান কাটা প্রায় ৯৬ ভাগ শেষ হয়েছে। তবে, কাউয়াদিঘি
হাওরে সেচ পাম্প সুবিধা থাকায় ওই হাওরে প্রায় ৩৭ ভাগ ধান এখনো কাটা হয়নি।
কাটার অপেক্ষায় থাকা বেশিরভাগ ধানই ব্রি-ধান-২৯ ও বিআর-১৪ জাতের ধান। আর
জেলার হাওর ও নদী তীরবর্তী উঁচু এলাকায় আবাদকৃত বোরো ধান কাটা প্রায় ৭৮ ভাগ
শেষ হয়েছে। জানা যায়, এ বছর স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী জেলার
তিনটি হাওরের বিল এলাকায় আগাম জাতের ধান ব্রি-ধান-২৮ আবাদ করেন চাষিরা। আর
বিআর-১৪ ও ব্রি-ধান-২৯ আবাদ হয় হাওর ও নদী তীরবর্তী অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে।
বিআর-১৪ ও ব্রি-ধান-২৯ ধানের ফলন ভালো হলেও ফলন কম হয়েছে ব্রি-ধান-২৮ এর।
ব্লাস্ট ও নেক ব্লাস্টের কারণে অধিকাংশ ব্রি-ধান-২৮ এ চিটা হওয়াতে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক। এর অন্যতম কারণ হিসেবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের
কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর বোরো আবাদের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায়
ব্লাস্ট রোগের বিস্তার ঘটেছে বেশি। যেহেতু মৌসুমের প্রথম দিকে ২৮ ধানের
চারা লাগানো হয়েছে সে কারণে ওই ধানই বেশি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
তবে, ব্রি-ধান-২৯ ও বিআর-১৪ ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত কম হওয়ায় ফলন ভালো
হলেও এখন বজ্রপাতের ভয়ে তা পুরোপুরি ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষক। জেলা কৃষি
সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় বোরো আবাদের
লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২ হাজার হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৫৪.১২ হেক্টর। এর মধ্যে
হাওরাঞ্চলে ১৯ হাজার ৩৬৬ হেক্টর। বাকিটুকু চাষ হয়েছে নদী ও হাওরের তীরবর্তী
এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চলে। হেক্টর প্রতি উৎপাদন (চাল) হাইব্রিড চার
টন। আর উচ্চ ফলনশীল তিন টন। তাদের তথ্য মতে, এ বছর এ পর্যন্ত জেলার হাওরে
৯৯ ভাগ বোরো ধান কাটা হয়েছে। আর হাওর ছাড়া প্রায় ৬৭ ভাগ ধান কাটা শেষ। পুরো
জেলায় এ পর্যন্ত প্রায় ৭৮ ভাগ বোরো ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বিকালে
হাইল হাওরের তীরবর্তী কাইঞ্জর বন্দ ও বিন্নার বন্দ এলাকায় গেলে কথা হয়
কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। হঠাৎ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ায় তারা দ্রুত বাড়ি ফেরার
প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মোকাম বাজার এলাকার জরিফ মিয়া (৪৮), গুমরা গ্রামের
হামদু মিয়া (৬৮), শরিফ মিয়া (৪৫), কালাপুরের মছকন মিয়া (৪২), রফিকুল ইসলাম
(২৪), সাইদুর রহমান ইমন (৩০) জানালেন- এ বছর ব্রি-ধান-২৮ জাতের ধান ছাড়া
অন্যান্য জাতের ধান ভালো হয়েছে। বিঘাপ্রতি মিলছে ১৫ থেকে ২০ মণ ধান। কিন্তু
এখন আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় আর বজ্রপাতের ভয়ে মাঠে থাকা পাকা ধান ঘরে
তোলা সম্ভব হচ্ছে না। শ্রমিক কিংবা মালিক কেউই এখন বজ্রপাতের ভয়ে ক্ষেতের
মাঠে যেতে চান না। আবহাওয়া ভালো দেখে ক্ষেতের মাঠে গেলেও সেখানেও থাকতে হয়
শঙ্কায়। তারা নিজেদের ক্ষেতের জমি দেখিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন- যেভাবে
ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে তাতে ২-৩ দিনের মধ্যেই পাকা ধান পানিতে তলিয়ে যাবে।
কৃষকরা জানান, গেল ২-৩ বছরের মতো তারা আগে এভাবে বজ্রপাত হতে দেখেননি। তারা
বলেন, এভাবে বজ্রপাত হলে আগামীতে বোরো চাষ অনেকটাই ব্যাহত হবে। জেলা কৃষি
সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. শাহজাহান মানবজমিনকে বলেন, এ
বছর জেলাজুড়ে বোরো ধানের আবাদ ভালো হয়েছে। শুধু ব্রি-ধান-২৮ জাতের ধানে
ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় এ জাতের ধানের ফলন একটু কম হয়েছে। হাওর এলাকায়
বোরো ধান কাটা শেষ হলেও নদী ও হাওর তীরবর্তী এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু অংশে
এখনো বোরো ধান কাটা শেষ হয়নি। সম্প্রতি বজ্রপাত শুরু হওয়ায় ভয়ে মাঠে
যাচ্ছেন না কৃষক। এ ছাড়া বজ্রপাতের ভয় থাকায় আউশ ধানের চারা রোপণেও মাঠে
কাজ করতে সাহস পাচ্ছেন না কৃষক। মাঠ পরিদর্শনে গেলে কৃষকরা তাদের ভয়ের কথা
আমাদের বলছেন।
No comments