খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন
অনেক চেষ্টা করেও শিশু হুমায়রার মুখে খাবার তুলতে পারলেন বাবা মাসুক মিয়া। লবণমাখা ভাত যে আর গলা দিয়ে নামে না শিশুর! বন্যায় বাড়িঘর তলিয়ে গেলে ঈদের আগে একটি স্কুলে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেন মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর পারের মাসুক মিয়া। প্রথম দিকে কিছু ত্রাণ পাওয়া যেত। পাঁচ-ছয় দিন ধরে কোনো ত্রাণ নেই। লবণ-ভাত খেয়েই দিন কাটছে তাদের। কিন্তু ছোট ছোট শিশুরা এ খাবার আর মুখে নিতে চায় না। তার ওপর আশ্রয় কেন্দ্র ছাড়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে দুর্ভোগ আর আতঙ্কে হাঁপিয়ে উঠছেন আশ্রিতরা। এদিকে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, জামালপুরসহ দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এসব জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কামালপুর ও চন্দনবাইশা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন এসব গ্রামের বাসিন্দারা। এখানে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। অনেকে মাটির চুলায় রান্না বসালেও বাতাসে বারবার আগুন নিভে যায়। দুপুরের রান্না শেষ করতে বিকাল গড়িয়ে যায়। রোববার সেখানে এক মাকে দেখা যায় তার শিশুপুত্রকে শুধু শাকের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছেন। সিরাজগঞ্জে যমুনার ভাঙনে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ও ৫০০ বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে কুড়িগ্রাম ও জামালপুরে ৮৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সিলেটে বন্যার উন্নতি হলেও সেখানে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না। এদিকে বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
বড়লেখা (মৌলভীবাজার) : হাকালুকি হাওর পারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি গ্রামের দুই বছরের শিশুকন্যা হুমায়রা। বন্যায় বসতঘর তলিয়ে যাওয়ায় বাবা-মা আর ভাইবোনের সঙ্গে তার ঠাঁই হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে। ঈদের আগে ছিদ্দেক আলী উচ্চ বিদ্যালয় বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে আসে তার পরিবার। শনিবার হুমায়রার বাবা মাসুক মিয়া ও মা ফরমিনা বেগম যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রথম প্রথম সাহায্য পেলেও এখন আর ত্রাণ মিলছে না। নিজেরা না খেলেও কষ্ট নেই। কিন্তু ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে থাকলে কষ্টের সীমা থাকে না। ৫ জুলাই থেকে অর্ধাহার-অনাহারে আছি। লবণ-ভাত খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। এর ওপর প্রশাসনের লোকজন আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে যেতে চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের বাড়িঘরে এখনও কোমর পানি। এ অবস্থায় আমরা যাব কোথায়।’ তারা জানান, এখানে আশ্রয় নেয়া হতদরিদ্র আরও ৮৪ পরিবারেরও একই দশা। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ৫ জুলাই মাধ্যমিক ও প্রাইমারি স্কুলের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। বন্যার কারণে তা ১১ জুলাইয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। আশ্রিতরা না গেলে পরীক্ষা নেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। শিক্ষার্থীদের বিষয়টিও আমাদের ভাবতে হবে।
জামালপুর, ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ : ইসলামপুর উপজেলায় নতুন করে আরও কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইসলামপুর উপজেলার ২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ ক’টি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে মানুষের খাদ্যের পাশাপাশি গোখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। চুকাইবাড়ি, বাহাদুরাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার বানবাসী লোকজন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। রোববার পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়নি।
সিরাজগঞ্জ ও শাহজাদপুর : বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় শাহজাদপুর উপজেলার সোনাতুনি ইউনিয়নে যমুনা নদীর ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সাত দিনের ভাঙনে এ ইউনিয়নের আটটি গ্রামের কমপক্ষে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ও ৫০০ বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামগুলো হল- ধীতপুর, শ্রীপুর, সোনাতুনি, বানতিয়ার, বড় চানতারা, ছোট চানতারা, মাকড়া ও কুরসি। এসব গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে অনেকে আত্মীয়স্বজন ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ সব হারিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীভাঙনে ধীতপুর ও শ্রীপুর বাজার বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে বাজার দুটির সিকি ভাগ তলিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলীমুন রাজীব বলেন, সোনাতুনি ইউপি চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সেটি হাতে পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কুলাউড়া : হাকালুকি হাওর পারের মানুষ দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়ার নেপথ্যে হাওরের সঙ্গে কুশিয়ারা নদীতে দেয়া অপরিকল্পিত বুড়িকিয়ারী বাঁধ। এই বাঁধের কারণে হাকালুকি হাওরে বন্যা ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী রূপ ধারণ করে। অপরিকল্পিত এই বাঁধটি অপসারণের দাবিতে হাওর পারের তিন উপজেলাবাসী আন্দোলনে নামছে। রোববার জুড়ী উপজেলায় সর্বস্তরের মানুষ বুড়িকিয়ারী বাঁধ অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন করেছে।
গাইবান্ধা : সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার প্রায় ২৭ হাজার পরিবার পানিবন্দি। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে নিন্ম ও চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি।
বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। রোববার সকালে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতে বন্যার পানি ঢুকেছে। এতে প্রায় ১০ হাজার পরিবারে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ৬১ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। অনেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বা আশপাশের স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বন্যাদুর্গতরা বিশুদ্ধ পানির অভাবে রয়েছেন। পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গত এলাকায় পানিবাহিত রোগের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রাম : ধরলা, দুধকুমর, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তলিয়ে যাওয়া নিন্মাঞ্চলের ৭৫ হাজার মানুষ এখনও কোনো ত্রাণ সহায়তা পাননি। এদিকে বন্যায় ৬৭টি স্কুলে পানি ঢোকায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। রোববার সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে দেখা যায়, পানিবন্দি এলাকাগুলোতে নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুদের বন্যার পানি ডিঙিয়ে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এ ছাড়াও সেনিটেশন কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন মাস্টার জানান, চর ও দ্বীপচরগুলোতে পানি ওঠায় চারণভূমির ঘাস ও কাশিয়া তলিয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে চরম গোখাদ্য সংকট। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষ স্বল্পমূল্যে গবাদিপশু বিক্রি করে দিচ্ছে। সিভিল সার্জন ডা. আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যার কারণে সদর উপজেলার কাচিচর ও যাত্রাপুর এলাকায় দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তবে পাশের উঁচু স্থানে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ : ঘরের ভেতর হাঁটু পানি। এর মধ্যে দুর্বিষহ বসবাস করছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জে খাদেশ্বরের ফতেহপুর মাঝপাড়া গ্রামের আয়াতুন্নেছা (৬৫), ইলিয়াছ আলী, লুৎফুর রহমান, রুহেল আহমদ ও সুলতানা বেগম। তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুশিয়ারা নদী। ইতিমধ্যে নদীভাঙনে বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ায় অন্যত্র চলে গেছেন এ বাড়ির কয়েকটি পরিবার। আফসোস করে বৃদ্ধ ইলিয়াছ আলী বলেন, ‘আমরারে এখনও কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি। এমনকি মেম্বারের দেখাও পাইনি। আমরা কিতা না খাইয়া মরমু?’ সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও জেলার বন্যাকবলিত ছয় ইউনিয়নে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীতে বাড়ছে পানি। ফলে মানুষের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিবের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ হবে এমন খবরে উপজেলা সদরের চণ্ডী প্রসাদ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে রোববার সকাল থেকে বন্যার্ত নারী-পুরুষ ভিড় করেন। সন্ধ্যার দিকে কিছু লোকের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও শত শত নারী-পুরুষ খালি হাতে ফিরে যান। এ ব্যাপারে ত্রাণ পরিচালনা কমিটির সমন্বয়কারী এবিএম কিবরিয়া ময়নুল বলেন, আমরা আড়াইশ’ জনের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছি। যারা ত্রাণ পায়নি তাদের পরে দেয়া হবে।
বড়লেখা (মৌলভীবাজার) : হাকালুকি হাওর পারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের ভোলারকান্দি গ্রামের দুই বছরের শিশুকন্যা হুমায়রা। বন্যায় বসতঘর তলিয়ে যাওয়ায় বাবা-মা আর ভাইবোনের সঙ্গে তার ঠাঁই হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে। ঈদের আগে ছিদ্দেক আলী উচ্চ বিদ্যালয় বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে আসে তার পরিবার। শনিবার হুমায়রার বাবা মাসুক মিয়া ও মা ফরমিনা বেগম যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রথম প্রথম সাহায্য পেলেও এখন আর ত্রাণ মিলছে না। নিজেরা না খেলেও কষ্ট নেই। কিন্তু ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা না খেয়ে থাকলে কষ্টের সীমা থাকে না। ৫ জুলাই থেকে অর্ধাহার-অনাহারে আছি। লবণ-ভাত খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। এর ওপর প্রশাসনের লোকজন আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে যেতে চাপ দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের বাড়িঘরে এখনও কোমর পানি। এ অবস্থায় আমরা যাব কোথায়।’ তারা জানান, এখানে আশ্রয় নেয়া হতদরিদ্র আরও ৮৪ পরিবারেরও একই দশা। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ৫ জুলাই মাধ্যমিক ও প্রাইমারি স্কুলের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। বন্যার কারণে তা ১১ জুলাইয়ে পরিবর্তন করা হয়েছে। আশ্রিতরা না গেলে পরীক্ষা নেয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। শিক্ষার্থীদের বিষয়টিও আমাদের ভাবতে হবে।
জামালপুর, ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ : ইসলামপুর উপজেলায় নতুন করে আরও কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইসলামপুর উপজেলার ২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ ক’টি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে মানুষের খাদ্যের পাশাপাশি গোখাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। চুকাইবাড়ি, বাহাদুরাবাদসহ বিভিন্ন এলাকার বানবাসী লোকজন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। রোববার পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়নি।
সিরাজগঞ্জ ও শাহজাদপুর : বন্যার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় শাহজাদপুর উপজেলার সোনাতুনি ইউনিয়নে যমুনা নদীর ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সাত দিনের ভাঙনে এ ইউনিয়নের আটটি গ্রামের কমপক্ষে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ও ৫০০ বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামগুলো হল- ধীতপুর, শ্রীপুর, সোনাতুনি, বানতিয়ার, বড় চানতারা, ছোট চানতারা, মাকড়া ও কুরসি। এসব গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে অনেকে আত্মীয়স্বজন ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ সব হারিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীভাঙনে ধীতপুর ও শ্রীপুর বাজার বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে বাজার দুটির সিকি ভাগ তলিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলীমুন রাজীব বলেন, সোনাতুনি ইউপি চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সেটি হাতে পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কুলাউড়া : হাকালুকি হাওর পারের মানুষ দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়ার নেপথ্যে হাওরের সঙ্গে কুশিয়ারা নদীতে দেয়া অপরিকল্পিত বুড়িকিয়ারী বাঁধ। এই বাঁধের কারণে হাকালুকি হাওরে বন্যা ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী রূপ ধারণ করে। অপরিকল্পিত এই বাঁধটি অপসারণের দাবিতে হাওর পারের তিন উপজেলাবাসী আন্দোলনে নামছে। রোববার জুড়ী উপজেলায় সর্বস্তরের মানুষ বুড়িকিয়ারী বাঁধ অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন করেছে।
গাইবান্ধা : সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার প্রায় ২৭ হাজার পরিবার পানিবন্দি। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে নিন্ম ও চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি।
বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। রোববার সকালে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টিতে বন্যার পানি ঢুকেছে। এতে প্রায় ১০ হাজার পরিবারে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ৬১ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। অনেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বা আশপাশের স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। নলকূপ ডুবে যাওয়ায় বন্যাদুর্গতরা বিশুদ্ধ পানির অভাবে রয়েছেন। পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গত এলাকায় পানিবাহিত রোগের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রাম : ধরলা, দুধকুমর, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তলিয়ে যাওয়া নিন্মাঞ্চলের ৭৫ হাজার মানুষ এখনও কোনো ত্রাণ সহায়তা পাননি। এদিকে বন্যায় ৬৭টি স্কুলে পানি ঢোকায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। রোববার সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে দেখা যায়, পানিবন্দি এলাকাগুলোতে নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় নারী ও শিশুদের বন্যার পানি ডিঙিয়ে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এ ছাড়াও সেনিটেশন কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন মাস্টার জানান, চর ও দ্বীপচরগুলোতে পানি ওঠায় চারণভূমির ঘাস ও কাশিয়া তলিয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে চরম গোখাদ্য সংকট। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষ স্বল্পমূল্যে গবাদিপশু বিক্রি করে দিচ্ছে। সিভিল সার্জন ডা. আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যার কারণে সদর উপজেলার কাচিচর ও যাত্রাপুর এলাকায় দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তবে পাশের উঁচু স্থানে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
সিলেট, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ : ঘরের ভেতর হাঁটু পানি। এর মধ্যে দুর্বিষহ বসবাস করছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জে খাদেশ্বরের ফতেহপুর মাঝপাড়া গ্রামের আয়াতুন্নেছা (৬৫), ইলিয়াছ আলী, লুৎফুর রহমান, রুহেল আহমদ ও সুলতানা বেগম। তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুশিয়ারা নদী। ইতিমধ্যে নদীভাঙনে বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ায় অন্যত্র চলে গেছেন এ বাড়ির কয়েকটি পরিবার। আফসোস করে বৃদ্ধ ইলিয়াছ আলী বলেন, ‘আমরারে এখনও কোনো ত্রাণ দেয়া হয়নি। এমনকি মেম্বারের দেখাও পাইনি। আমরা কিতা না খাইয়া মরমু?’ সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও জেলার বন্যাকবলিত ছয় ইউনিয়নে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীতে বাড়ছে পানি। ফলে মানুষের মাঝে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান হাবিবের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ হবে এমন খবরে উপজেলা সদরের চণ্ডী প্রসাদ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে রোববার সকাল থেকে বন্যার্ত নারী-পুরুষ ভিড় করেন। সন্ধ্যার দিকে কিছু লোকের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও শত শত নারী-পুরুষ খালি হাতে ফিরে যান। এ ব্যাপারে ত্রাণ পরিচালনা কমিটির সমন্বয়কারী এবিএম কিবরিয়া ময়নুল বলেন, আমরা আড়াইশ’ জনের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছি। যারা ত্রাণ পায়নি তাদের পরে দেয়া হবে।
No comments