জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংলাপ ও জনপ্রত্যাশা
আমরা গণমাধ্যমের সূত্রে জেনেছি, নির্বাচন কমিশন খুব শিগগিরই সংলাপ শুরু করবে। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, প্রথমেই তারা সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে। নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ তৈরি করেছিল, তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ সংলাপ শুরু হতে যাচ্ছে। কারণ নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপের মধ্যে সংলাপের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুতরাং এ সংলাপ নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপেরই অংশ। নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপটি তৈরি করেছে, এটি আগামী নির্বাচনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রশংসনীয় এবং আমরা সবাই এটিকে স্বাগত জানাই। কারণ নির্বাচনী রোডম্যাপটি হল কর্মপরিকল্পনামূলক। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কখন কোন কাজটি তারা করবে, কীভাবে করবে তার একটি রূপরেখা ওই রোডম্যাপে রয়েছে। ২০১৮ সালের শেষে বা ২০১৯ সালের শুরুর দিকে যে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, সেই নির্বাচনকে সামনে রেখেই এই রোডম্যাপ তারা তৈরি করেছেন। এরই অংশ হিসেবে তারা সংলাপ শুরু করতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের রোডম্যাপের বিষয়টি প্রথম শুরু করে ড. হুদা কমিশন। সেই কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফলভাবে গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে অনুষ্ঠান করতে পেরেছে- এ জন্য রোডম্যাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পক্ষান্তরে গত নির্বাচন কমিশন অর্থাৎ রকিবউদ্দীন কমিশন এরকম কোনো কর্মপরিকল্পনামূলক রোডম্যাপ তৈরি করেছে বলে আমরা শুনিনি। হয়তো করেছে, কিন্তু সেটি আলোর মুখ দেখেনি। তেমন কোনো কর্মতৎপরতাও আমাদের চোখে পড়েনি। যার ফলে এ কমিশন জাতীয় নির্বাচনসহ সব নির্বাচনেই ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনগুলোতে কারচুপি হয়েছে, সেগুলো বিতর্কিত হয়েছে, ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছে। অতএব, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচনী রোডম্যাপকে আমাদের সাধুবাদ জানাতেই হয়। এখন প্রশ্ন হল, নির্বাচনকে সামনে রেখে যে সংলাপ, সেটাকে যদি সফল করতে হয়, তাহলে করণীয় কী হতে পারে? প্রথমেই নির্বাচন কমিশনে এর জন্য প্রস্তুতি লাগবে। নির্বাচন কমিশন সংলাপে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে, কীভাবে আলোচনা করবে এবং যারা আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে তাদের কী রকম তথ্য সরবরাহ করতে হবে, যাতে করে অংশগ্রহণকারীরা ফলপ্রসূভাবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে- এ জন্য নির্বাচন কমিশনের পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। আমরা আশা করব, বর্তমান নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিয়েই সংলাপে অংশগ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুটি অভিজ্ঞতার কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরছি। হুদা কমিশন সংলাপ করেছে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধানকে সংশোধনের জন্য। যেমন আরপিও সংশোধন। হুদা কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা ‘সুজন’-এর পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে আরপিও’র একটি ড্রাফট দিয়েছিলাম। অন্যরাও এ ব্যাপারে তাদের সুপারিশ দিয়েছে। তার ভিত্তিতে হুদা কমিশন নির্বাচনের ব্যাপারে কী কী বিষয়ে পরিবর্তন আনা যেতে পারে তা নিয়ে নিজেদের একটি সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে। এরপর সংলাপে সেটি উপস্থাপন করে, যার ভিত্তিতে যারা সংলাপে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারা যথাযথভাবে তাদের প্রাসঙ্গিক মতামত দিতে পেরেছেন। তাই নির্বাচন কমিশন যে ব্যাপারেই আলাপ-আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুক না কেন, সেটা প্রস্তুতি নিয়ে এবং যাতে মানুষ কার্যকরভাবে তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আরেকটি অভিজ্ঞতা হল, গত নির্বাচন কমিশন অর্থাৎ রকিবউদ্দীন কমিশন একটিই সংলাপ করেছে। ওই সংলাপে নাগরিক সমাজকে এবং সুজনের পক্ষ থেকে আমাকেও ডাকা হয়েছিল এবং আমি তাতে উপস্থিত ছিলাম।
সেই নির্বাচনী সংলাপে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু তারা এ বিষয়ে একটি থিওরিটিক্যাল আলাপ-আলোচনাই শুধু করেছেন। এ বিষয়ে তাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না, বক্তব্য ছিল না, মতামত ছিল না, কোনো প্রকার কনসেপ্ট নোটও ছিল না। যার ফলে যার যা ইচ্ছা, যার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটাই বলেছেন। সুতরাং ওই সংলাপটি কোনোভাবেই সফল হয়েছে বলে মনে করি না। যেহেতু নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ ছাড়া আর কোনো সুনির্দিষ্ট বা সুস্পষ্ট আলোচনার বিষয় ছিল না, তাই এ সংলাপ নিয়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছে। তারা যদি নির্বাচনী সীমানার পুনর্নির্ধারণের বিষয়টির ওপর একটি খসড়া তৈরি করত, তাহলে সংলাপটি ফলপ্রসূ হতো বলে আমার বিশ্বাস। ওই সংলাপটি যেহেতু সফল হয়নি, তাই এরপর রকিবউদ্দীন কমিশন আর কোনো সংলাপ করেনি। আরেকটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যে নাগরিক সমাজ, রাজনীতিক, সুশীল সমাজ সংলাপ করবে, তাদেরও পূর্ব-ধারণা নিয়ে অর্থাৎ প্রস্তুতি নিয়েই সংলাপে অংশগ্রহণ করতে হবে। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, নাগরিক বা সুশীল সমাজের যাদের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ হয়েছে, তাদের অনেকেরই নির্বাচনী আইন-কানুন, বিধি-বিধান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তাদের অনেক বিষয়েই হয়তো গভীর জ্ঞান আছে; কিন্তু নির্বাচনের বিষয়ে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা সংলাপে প্রাসঙ্গিক কথা বলতে পারেননি। তাই যাদেরকে সংলাপে ডাকা হবে, তারা যেন নিজেরা প্রস্তুতি নিয়ে অর্থাৎ নির্বাচনের ইস্যুগুলো সম্পর্কে জেনেশুনে তবেই সংলাপে যান। নির্বাচনী সংলাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলের প্রস্তুতি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনৈতিক দলকেই কিন্তু এই নির্বাচনী আইন-কানুন, বিধি-বিধান এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে কথা বলতে হবে, তাই তাদেরকেও নির্বাচনের সব বিষয় সম্পর্কে প্রস্তুতি নিয়ে হোমওয়ার্ক করে সংলাপে অংশগ্রহণ করতে হবে। যাতে সংলাপে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কতগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়। কেননা সংলাপের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছানো। সংলাপে গেলাম, কোনো ঐকমত্যেই পৌঁছতে পারলাম না, তাহলে ওই সংলাপের প্রয়োজনীয়তা কী? আমাদের রাজনৈতিক দলে তেমন কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা হয় না, কোনো চর্চাও হয় না। সবকিছুই যেন স্লোগাননির্ভর হয়ে গেছে। সবকিছুতেই সমালোচনা, অনেকটা যা মনে আসে তাই বলে দেয়ার মতো। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার আইনগত ক্ষমতা রয়েছে। তবে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংলাপ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা অধিক কার্যকর হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এখন সবচেয়ে হট ইস্যু হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। নির্বাচনকালীন সরকার কীরকম হবে সেটা কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত নয়। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন সরকার ঠিক করে দেবে না। এটা ঠিক করবে সরকার। তবে কমিশনের কাছে এ বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। সরকার নির্বাচনকালীন সরকারকে দু’ভাবে ঠিক করতে পারে। এক. যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক নির্দেশনা রয়েছে, তাই দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। নির্বাচন পরিচালনায় এখানে অন্যদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ থাকবে না। দুই. নির্দলীয়-নিরপেক্ষ একটি অস্থায়ী সরকারের অধীনেও নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। আমাদের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রই হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানে জনগণের সম্মতির শাসন। জনগণের সম্মতি অর্জিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচন মানেই তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এভাবে না হলে জনগণের সম্মতি অর্জিত হয় না এবং নির্বাচন হয় অর্থহীন। যেহেতু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হল সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা, তাই সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে তাদেরকে সংসদ নির্বাচনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তাদের এখতিয়ারভুক্ত নয়। সুতরাং নির্বাচন কমিশনকে দাবি করতে হবে যে, নির্বাচনকালীন যে সরকার থাকবে, সে সরকার যেন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনকালীন সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে পরিচালনা করে। এ প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে বা তারা যদি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে, তাহলে সবচেয়ে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আর সাংবিধানিকভাবে সরকারের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন যে সহযোগিতা চায়, সেটা প্রদান করা। নির্বাচনকালীন দলীয় সরকার নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বড়ই করুণ, বড়ই দুঃখময়। দলীয় সরকারের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে, সব কটিতে দেখা গেছে যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। পক্ষান্তরে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোয় ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এবং বিরোধী দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। দলীয় সরকারের আওতায় রকিবউদ্দীন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসহযোগিতা দেখেছি এবং নির্বাচনী দায়িত্বে যারা ছিলেন তারাও সরকারের পক্ষে কাজ করেছেন, সরকারি দলের পক্ষে ব্যালট পেপারে প্রকাশ্যে সিল মেরেছেন। প্রশাসন বিরোধী দলকে হয়রানি করেছে। অনেক ভোট কেন্দ্রে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স পূরণ করে রাখা হয়েছে। এগুলো হয়েছে প্রশাসনের ব্যাপক দলীয়করণের কারণে এবং এটা দিন দিন আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। তাই দলীয়করণই সুষ্ঠু নির্বাচনের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা দুরাশা মাত্র। তাই আমাদের রাজনীতিকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন চান, নাকি ক্ষমতা চান। যদি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন চান, তাহলে আমাদেরকে একটি সমঝোতায় পৌঁছতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন
No comments