চিকুনগুনিয়া ‘মহামারি’ আকারে দেখা দিয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে
চিকুনগুনিয়া
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। ঢাকা মহানগরে
চিকুনগুনিয়া ‘মহামারি’ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে
পড়ার আশঙ্কার বিষয়ে জানা থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো
কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে। এ রকমই মত দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য
বিশেষজ্ঞরা।
গত ছয় মাসে কত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত
হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন হলেও অনুমিত কোনো তথ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর গতকাল রোববার পর্যন্ত বলতে পারেনি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) মুঠোফোনভিত্তিক যে জরিপ করছে, তাতেও রোগটির ব্যাপকতা সম্পর্কে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না।
এডিস মশার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস ছড়ায়। গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঢাকায় দেখা দিতে থাকে। প্রতি মাসেই আইইডিসিআরে এই রোগে আক্রান্ত মানুষ শনাক্ত হয়েছে। রাজধানীর মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীর ভিড় বাড়তে থাকে এ বছরের এপ্রিল থেকেই। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও পাড়ায় পাড়ায় ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীর ভিড় দিন দিন বাড়তে থাকে। এদের একটি বড় অংশ শিশু ও বয়স্ক। এই রোগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই বলা হলেও রাজধানীর একাধিক বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি হচ্ছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পেছনে মো. রফিকুল ইসলামের গাড়ির গ্যারেজ। দুই ভাই ও কর্মচারী নিয়ে গ্যারেজ চালান। গতকাল সকালে রফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৫ রোজার দিন আমার জ্বর আসে। তিন দিন টানা জ্বর ছিল। হাতে, পায়ে, গিরায় গিরায় ব্যথা ছিল। কয়েক দিন পর অন্য ভাইয়ের জ্বরও হয়।’ তিনি বলেন, গ্যারেজ কয়েক দিন বন্ধ রাখতে হয়।
রফিকুলের সঙ্গে কথা বলার সময় আশপাশের গ্যারেজের শ্রমিক-কর্মচারীরাও ভিড় জমান। কিশোর রাসেল চিকুনগুনিয়ার কারণে চার দিন কাজে আসতে পারেনি। আকাশ মোল্লা পাঁচ দিন গ্যারেজে আসতে পারেননি। তাঁরা প্রত্যেকে বলেছেন, চিকুনগুনিয়ার কারণে তাঁদের আয়-রোজগার কমেছে।
রাজধানীর একটি স্কুলের শিক্ষক খন্দকার আতিক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, চিকুনগুনিয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারছে না।
মহামারি বলাতে আপত্তি
জনস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা বলছেন, মহামারির সঙ্গে মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। একটি নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট স্থানে আশঙ্কার চেয়ে বেশি পরিমাণে রোগের প্রকোপ দেখা দিলে তাকে মহামারি বলা হয়।
চিকুনগুনিয়ার বর্তমান ব্যাপকতাকে মহামারি বলতে রাজি নন সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) কর্মসূচির পরিচালক সানিয়া তহমিনা বলেন, ‘আমরা বড় আকারের প্রাদুর্ভাব (বিগ আউটব্রেক) বলতে পারি। কিন্তু মহামারি বলতে চাই না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) মাইক্রোবায়োলজি ও মাইকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি মহামারির, সুতরাং মহামারি না বলার কোনো কারণ নেই। জ্বরের পরে বহু মানুষ নিদারুণ কষ্ট পাচ্ছে।’
সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক আরও বলেন, ‘রাস্তাঘাটে, বাসে, গণমাধ্যমে, আড্ডায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে, স্কুল-কলেজ, অফিসে—সব জায়গায় একই আলোচনা, চিকুনগুনিয়া। কোনো রোগ নিয়ে এ রকম আলোচনা আগে দেখা যায়নি। এত বিপুল পরিমাণ মানুষের ভোগান্তির কথাও সম্প্রতি শোনা যায়নি।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক পরামর্শক এ এম জাকির হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় অল্প সময়ে অসংখ্য মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। একে মহামারি না বললে কাকে মহামারি বলবেন।’
বিলম্বে উদ্যোগ
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে। চিকুনগুনিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা আগে জানা থাকলেও তারা গুরুত্ব দেয়নি।
এ ব্যাপারে সিডিসির অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দ্রুততম সময়ে পদক্ষেপ নিয়েছি।’ আর আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব হয়নি।
আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর চিকুনগুনিয়ার একটি প্রাদুর্ভাব বা আউটব্রেকের তথ্য আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই সময় রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার ৩০ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। আইইডিসিআরই তা শনাক্ত করেছিল।
একাধিক সূত্র জানায়, রাজধানীর একটি এলাকায় হঠাৎ এত মানুষের মধ্যে চিকুনগুনিয়া দেখা দেওয়ায় রোগটি দ্রুত ঢাকা মহানগরে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সাবেক মহাপরিচালক। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। সানিয়া তহমিনা এটা স্বীকারও করেছেন।
কিন্তু রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। ৫ মে চিকুনগুনিয়া-সম্পর্কিত বার্তা পাঠানো হয় প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও প্রধান প্রধান স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান ও দপ্তরগুলোয়। কিন্তু তত দিনে ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। ২৪ এপ্রিল প্রথম আলোয় ‘সচেতনতাই পারে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ করতে’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। তাতে বলা হয়েছিল, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত অনেক মানুষ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চিকিৎসক প্রশিক্ষণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, মশা মারতে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নেওয়া, ১২ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে পরিচ্ছন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাকির হোসেন বলেন, এই কাজগুলো ডিসেম্বরের পরপর করলে এত মানুষ আক্রান্ত হতো না।
কত মানুষ আক্রান্ত
গতকাল পুলিশের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কাজে আসছেন না। ৩ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সিরাজুল হক খান পরিবারের সদস্যদের চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাঁঠালবাগানে একই সীমানায় বিভিন্ন ভবনে ৩৮টি পরিবারের মধ্যে গত চার মাসে ৫৫ জনের বেশি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সচিবালয় কর্মকর্তা থেকে গাড়ির গ্যারেজের কর্মচারী—সর্বস্তরের মানুষই এতে আক্রান্ত হয়েছেন। এই রোগে ওষুধ হিসেবে চিকিৎসকেরা প্যারাসিটামল সেবন করতে বলেছেন।
জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশের শীর্ষ দুটি ওষুধ কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, অতীতের যেকোনো বছরের তুলনায় তাদের প্যারাসিটামল বিক্রির পরিমাণ অনেক বেশি।
তবে চিকুনগুনিয়ায় কত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের বক্তব্য, ঢাকার হাজারো মানুষ এতে আক্রান্ত। ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়ার রোগী।
সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, চিকুনগুনিয়ার বর্তমান প্রাদুর্ভাব সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। কিন্তু এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। পরিস্থিতি নজরে রাখার জন্য ঢাকায় গত সপ্তাহে চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে।
মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, ময়মনসিংহে চিকুনগুনিয়ার রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে এসব রোগী ঢাকা থেকে যাওয়া।
মীরজাদী সেব্রিনা আরও জানান, প্রতিটি জেলায় নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলার জন্য সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঠাকুরগাঁওসহ কয়েকটি জেলার সিভিল সার্জনের কাছে নির্দেশনা গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনরা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
গত ছয় মাসে কত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত
হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান বের করা কঠিন হলেও অনুমিত কোনো তথ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর গতকাল রোববার পর্যন্ত বলতে পারেনি। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) মুঠোফোনভিত্তিক যে জরিপ করছে, তাতেও রোগটির ব্যাপকতা সম্পর্কে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না।
এডিস মশার মাধ্যমে চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস ছড়ায়। গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঢাকায় দেখা দিতে থাকে। প্রতি মাসেই আইইডিসিআরে এই রোগে আক্রান্ত মানুষ শনাক্ত হয়েছে। রাজধানীর মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীর ভিড় বাড়তে থাকে এ বছরের এপ্রিল থেকেই। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও পাড়ায় পাড়ায় ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীর ভিড় দিন দিন বাড়তে থাকে। এদের একটি বড় অংশ শিশু ও বয়স্ক। এই রোগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই বলা হলেও রাজধানীর একাধিক বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি হচ্ছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পেছনে মো. রফিকুল ইসলামের গাড়ির গ্যারেজ। দুই ভাই ও কর্মচারী নিয়ে গ্যারেজ চালান। গতকাল সকালে রফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৫ রোজার দিন আমার জ্বর আসে। তিন দিন টানা জ্বর ছিল। হাতে, পায়ে, গিরায় গিরায় ব্যথা ছিল। কয়েক দিন পর অন্য ভাইয়ের জ্বরও হয়।’ তিনি বলেন, গ্যারেজ কয়েক দিন বন্ধ রাখতে হয়।
রফিকুলের সঙ্গে কথা বলার সময় আশপাশের গ্যারেজের শ্রমিক-কর্মচারীরাও ভিড় জমান। কিশোর রাসেল চিকুনগুনিয়ার কারণে চার দিন কাজে আসতে পারেনি। আকাশ মোল্লা পাঁচ দিন গ্যারেজে আসতে পারেননি। তাঁরা প্রত্যেকে বলেছেন, চিকুনগুনিয়ার কারণে তাঁদের আয়-রোজগার কমেছে।
রাজধানীর একটি স্কুলের শিক্ষক খন্দকার আতিক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, চিকুনগুনিয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারছে না।
মহামারি বলাতে আপত্তি
জনস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা বলছেন, মহামারির সঙ্গে মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। একটি নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট স্থানে আশঙ্কার চেয়ে বেশি পরিমাণে রোগের প্রকোপ দেখা দিলে তাকে মহামারি বলা হয়।
চিকুনগুনিয়ার বর্তমান ব্যাপকতাকে মহামারি বলতে রাজি নন সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) কর্মসূচির পরিচালক সানিয়া তহমিনা বলেন, ‘আমরা বড় আকারের প্রাদুর্ভাব (বিগ আউটব্রেক) বলতে পারি। কিন্তু মহামারি বলতে চাই না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) মাইক্রোবায়োলজি ও মাইকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি মহামারির, সুতরাং মহামারি না বলার কোনো কারণ নেই। জ্বরের পরে বহু মানুষ নিদারুণ কষ্ট পাচ্ছে।’
সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক এই পরিচালক আরও বলেন, ‘রাস্তাঘাটে, বাসে, গণমাধ্যমে, আড্ডায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে, স্কুল-কলেজ, অফিসে—সব জায়গায় একই আলোচনা, চিকুনগুনিয়া। কোনো রোগ নিয়ে এ রকম আলোচনা আগে দেখা যায়নি। এত বিপুল পরিমাণ মানুষের ভোগান্তির কথাও সম্প্রতি শোনা যায়নি।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক পরামর্শক এ এম জাকির হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় অল্প সময়ে অসংখ্য মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। একে মহামারি না বললে কাকে মহামারি বলবেন।’
বিলম্বে উদ্যোগ
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পদক্ষেপ নিতে দেরি করেছে। চিকুনগুনিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা আগে জানা থাকলেও তারা গুরুত্ব দেয়নি।
এ ব্যাপারে সিডিসির অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দ্রুততম সময়ে পদক্ষেপ নিয়েছি।’ আর আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব হয়নি।
আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর চিকুনগুনিয়ার একটি প্রাদুর্ভাব বা আউটব্রেকের তথ্য আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই সময় রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার ৩০ জনের চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। আইইডিসিআরই তা শনাক্ত করেছিল।
একাধিক সূত্র জানায়, রাজধানীর একটি এলাকায় হঠাৎ এত মানুষের মধ্যে চিকুনগুনিয়া দেখা দেওয়ায় রোগটি দ্রুত ঢাকা মহানগরে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সাবেক মহাপরিচালক। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। সানিয়া তহমিনা এটা স্বীকারও করেছেন।
কিন্তু রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। ৫ মে চিকুনগুনিয়া-সম্পর্কিত বার্তা পাঠানো হয় প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও প্রধান প্রধান স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান ও দপ্তরগুলোয়। কিন্তু তত দিনে ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। ২৪ এপ্রিল প্রথম আলোয় ‘সচেতনতাই পারে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ করতে’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। তাতে বলা হয়েছিল, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত অনেক মানুষ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চিকিৎসক প্রশিক্ষণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, মশা মারতে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নেওয়া, ১২ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে পরিচ্ছন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জাকির হোসেন বলেন, এই কাজগুলো ডিসেম্বরের পরপর করলে এত মানুষ আক্রান্ত হতো না।
কত মানুষ আক্রান্ত
গতকাল পুলিশের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কাজে আসছেন না। ৩ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব সিরাজুল হক খান পরিবারের সদস্যদের চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাঁঠালবাগানে একই সীমানায় বিভিন্ন ভবনে ৩৮টি পরিবারের মধ্যে গত চার মাসে ৫৫ জনের বেশি এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সচিবালয় কর্মকর্তা থেকে গাড়ির গ্যারেজের কর্মচারী—সর্বস্তরের মানুষই এতে আক্রান্ত হয়েছেন। এই রোগে ওষুধ হিসেবে চিকিৎসকেরা প্যারাসিটামল সেবন করতে বলেছেন।
জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশের শীর্ষ দুটি ওষুধ কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, অতীতের যেকোনো বছরের তুলনায় তাদের প্যারাসিটামল বিক্রির পরিমাণ অনেক বেশি।
তবে চিকুনগুনিয়ায় কত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের বক্তব্য, ঢাকার হাজারো মানুষ এতে আক্রান্ত। ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়ার রোগী।
সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, চিকুনগুনিয়ার বর্তমান প্রাদুর্ভাব সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। কিন্তু এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। পরিস্থিতি নজরে রাখার জন্য ঢাকায় গত সপ্তাহে চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে।
মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, ময়মনসিংহে চিকুনগুনিয়ার রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে এসব রোগী ঢাকা থেকে যাওয়া।
মীরজাদী সেব্রিনা আরও জানান, প্রতিটি জেলায় নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলার জন্য সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঠাকুরগাঁওসহ কয়েকটি জেলার সিভিল সার্জনের কাছে নির্দেশনা গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনরা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
No comments