রাজধানীতে কোটিপতি ইয়াবা পরিবার
রাজধানীর ১৭৩ এলিফ্যান্ট রোড। শেল সিদ্দিক নামের বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট। ভবনের ৯ তলায় ৮/বি নম্বর ফ্ল্যাটে বাস করেন আসমা আহমেদ ডালিয়া নামের এক গৃহবধূ ও তার স্বামী রবিউল ইসলাম। গৃহনির্মাণের বিদেশি ফিটিংসের ব্যবসা তাদের। সবাই জানেন তাদের এমন ব্যবসার কথা। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্য যা বলছে তা রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজধানীর বড় ধরনের ইয়াবা নেটওয়ার্কের সঙ্গে পুরো পরিবারটি যুক্ত। রোববার হাতেনাথে তার প্রমাণও মিলেছে। একে একে তাদের তিনটি বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ৫০ হাজার পিস ইয়াবা। গ্রেফতার করা হয় মা, দুই মেয়ে, দুই জামাই ও গৃহকর্মীসহ ৬ জনকে। জানা যায়, নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার পর পুরো পরিবারটি তিন মাস গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিল। এ সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি টিম পালা করে ফ্ল্যাটের নিচে অবস্থান করতে থাকে। লুঙ্গি আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরে কখনও সবজি বিক্রেতা ও কখনও তালা-চাবিওয়ালার ছদ্মবেশে নজরদারি চালানো হয়। এক পর্যায়ে তারা নিশ্চিত হন গোয়েন্দা তথ্য সঠিক। পুরো পরিবারটি রাজধানীতে একটি বড়সড় ইয়াবা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। এরপর গতকাল সফল এই অফিযানের খবর আসে। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের খিলগাঁও সার্কেলের ইন্সপেক্টর সুমনুর রহমান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ডালিয়া ও তার স্বামীর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে আমরা ভোর ৫টায় ফ্ল্যাটে অভিযান চালাই। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ডালিয়া ও তার স্বামী সটকে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। পরে তারা নিজেরাই বিভিন্ন কক্ষ থেকে ৩২ হাজার পিস ইয়াবা বের করে দেন।’ এরপর জিজ্ঞাসাবাদে ডালিয়া জানান, ৪৮ উত্তর ধানমণ্ডির একটি বাড়িতে তার ছোট বোন স্বপ্না থাকেন। ওই ফ্ল্যাটেও ইয়াবার মজুদ আছে। দ্বিতীয় দফা অভিযান চালানো হয় ধানমণ্ডি এলাকায়। ধানমণ্ডির শেল হাসনাহেনা নামের একটি বহুতল ভবনের এ/১ ফ্ল্যাটে গিয়ে অবাক হতে হয়। কারণ সাড়ে তিন কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটি অভিজাত গৃহসজ্জায় ঠাসা। সেখান থেকে আটক করা হয় স্বপ্না ও তার স্বামী শামীম আহমেদকে। স্বপ্না নিজেই তার শোয়ার ঘর থেকে ৬ হাজার ইয়াবা বড়ি বের করে আনেন।
ওই ফ্ল্যাট থেকে মাহমুদা বেগম রানী নামের আরেক নারীকে আটক করা হয়। রানী মূলত বড় বড় পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে ইয়াবার চালান পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করতেন। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের অবিশ্বাস্য তথ্য দেন তারা। স্বপ্না বলেন, এই ইয়াবা সিন্ডিকেটের মূল হোতা তাদের মা। তার নাম মনোয়ারা বেগম। তিনি থাকেন ৫২/৩ পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায়। কালবিলম্ব না করে বেলা ১১টায় পশ্চিম রাজাবাজারের ওই ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় মনোয়ারা বেগমকে। তার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় আরও ১২ হাজার পিস ইয়াবা বড়ি ও মাদক বিক্রির ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এরপর গ্রেফতারকৃত ৬ জনের পুরো পরিবারটিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অধিদফতরের নবনিযুক্ত মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন বলেন, এটি একটি পরিপূর্ণ সফল অভিযান। টিমওয়ার্কের সততা ও সাহস নিশ্চিত করায় এ রকম সফলতা এসেছে। তিনি জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জনবল খুবই স্বল্প। জনবল বাড়ানোসহ এই প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বলেন, গোটা পরিবার এই ইয়াবা নেটওয়ার্কে জড়িত ছিল। তিনি জানান, স্যানিটারিসামগ্রীর ব্যবসার আড়ালে এই পরিবারের সদস্যরা শাক্তিশালী ইয়াবা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। রাজধানীর হাতিরপুল এলাকায় রেইন বাথ নামে তাদের একটি স্যানিটারি দোকান রয়েছে। অভিযানে মোট ৫০ হাজার পিস ইয়াবা ও ২০ লাখ ৮০ হাজার টাকা উদ্ধারের কথা জানান তিনি। অভিযানে অংশ নেন পরিচালক অপারেশন সৈয়দ তৌফিক উদ্দীন আহমেদ, গোয়েন্দা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার, ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা, ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের সহকারী পরিচালক শামসুল আলম ও ইন্সপেক্টর হেলাল উদ্দীন ভুঁইয়া।
No comments