রায় নিয়ে উত্তাল সংসদ
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিষয়ে সংসদে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন এমপিরা। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে ফিরিয়ে নেয়ার যে রায় দেয়া হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করেন তারা। রিভিউর মাধ্যমে ৯৬ ধারা পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। অনেকে এই রায়কে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছেন। এছাড়া অ্যামিকাস কিউরিদের কঠোর সমালোচনা করে সংসদ সদস্যরা বলেন, জাতিকে তারা ভুল তথ্য দিয়েছেন। অসত্য কথা বলেছেন। তারা সুবিধাবাদী। তারা আরও বলেন, এই পার্লামেন্ট যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারকে ইমপিচ করার ক্ষমতা রাখে, সেখানে বিচারকরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে কি করে হয়। তারা কি নিজেরাই নিজেদের বিচার করবেন। রোববার রাতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন জাসদের সিনিয়র পার্লামেন্টারিয়ান মঈনুদ্দিন খান বাদল। এ সময় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ৩ জুলাই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এ রায়ের ফলে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা হারায় জাতীয় সংসদ। মঈনুদ্দিন খান বাদল বলেন, সারা জীবনের একটি অংশ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সম্প্রতি এমন কিছু সিদ্ধান্ত আমরা দেখছি, সিদ্ধান্তগুলো একান্ত অনভিজ্ঞ। বিচার বিভাগ ও সুপ্রিমকোর্টের ৯৬ ধারা যেটা বাতিল করেছেন, যা প্রকৃত সংবিধানে ছিল, সেটা কোথায়? সে বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য চাইব। আমার প্রশ্ন, সংসদে কোনো আইন পাস হলে বিচার বিভাগ কি বাতিল করে দিতে পারেন? বেসিক স্ট্রাকচার নষ্ট করতে পারেন কিনা। বেসিক স্ট্রাকচারের বিষয়ে আমাদের একমত হতে হবে। ’৭২ সালের সংবিধান অনুসারে আমরা ৯৬ ধারাকে পুনঃস্থাপন করেছিলাম।
কিন্তু ওই ধারায় কোথায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ হয়েছে সেটা বলতে হবে। তিনি বলেন, এই সংসদ কবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। এই সংসদ কি বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করেনি। তাদের সুদৃঢ় অবস্থানের জন্য যা যা করণীয় তা বর্তমান সংসদ করে গেছে। তাহলে সমস্যা কোথায়? এখানে কোনো বিচারক যদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান তাহলে তার বিচার কে করবে? আমি বলতে চাই, বিচার বিভাগ কি সংবিধানের ঊর্ধ্বে? আপনারা জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত, জিয়াউর রহমানের আমল ও ক্ষমতা গ্রহণকে অন্যায়-অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ওগুলো অবৈধ আর তার আমলে করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কি বৈধ হয়ে গেল? বিচারক অন্যায় করলে কীভাবে অপসারিত হবেন, কমনওয়েতে ২-৩ পদ্ধতি আছে। সেটা করতে কোন জায়গায় বেসিক স্ট্রাকচারের ব্যত্যয় ঘটেছে, জবাব চাইব। বাদল বলেন, ন্যাচারাল জাস্টিস বলে কথা আছে। আপনি আপনার নিজের বিচার নিজে করতে পারেন না। আপনি কি স্বয়ং ভগবান যে, নিজেই নিজের বিচার করবেন? জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, আজ এক অ্যামিকাস কিউরি ১/১১ সময়ে কালো টাকা সাদা করেছিলেন। আজকে সেই অ্যামিকাস কিউরি নীতির কথা বলেন। এই সংসদ নতুন কিছু করেনি। যা ছিল সেটাই পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে সংসদ থাকা সত্ত্বেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রয়েছে। তিনি বলেন, জনগণ সব ক্ষমতার উৎস। জনগণ দ্বারা নির্বাচিত এই সংসদ। এই পার্লামেন্ট স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ করার ক্ষমতা রাখে, সেখানে বিচারকরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে কি করে হয়। এই পার্লামেন্ট নতুন কিছু করেনি। আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রধান বিচারপতি যদি কোনো অপরাধ করেন তার বিচার অন্য বিচারপতিরা করবেন, এটা কি করে হয়? তাই আমরা ’৭২-র সংবিধান পুনঃস্থাপন করেছি মাত্র। এই রায় বিবেচনার আহ্বান জানান তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ’৭২-র সংবিধানকে উপমহাদেশের সেরা সংবিধান বলা হয়। সুপ্রিমকোর্টের রায় সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না। আমি বলব, যারা অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন তাদের কথা। ড. কামাল হোসেন বলেছেন, আমরা ভারতকে অনুসরণ করেছিলাম, এখন ভারতে এটা নেই। তার মতো একজন মানুষ এ ধরনের অসত্য কথা বলতে পারেন? ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলামও নানা কথা বলেছেন। এরা সংবিধান প্রণয়নের সময় ’৭২-এর সংবিধান যখন করা হল তখন বললেন একরকম, আবার এখন তারা বলছেন আরেক রকম। তারা বলছেন, পৃথিবীতে নাকি এটা নেই। তাদের বলতে চাই- যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংসদ বিচারপতিদের ইমপিচ করে থাকে। একমাত্র ব্যতিক্রম পাকিস্তানে। তিনি আরও বলেন, সামরিক শাসক আইয়ুব খান সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করেছিলেন। সেই আইয়ুব খানের পদ্ধতি আমাদের দেশে অ্যামিকাস কিউরিদের পছন্দ। এই সুপ্রিম জুডিশিয়ালে বলা আছে, প্রধান বিচারপতি এবং আরও দু’জন বিচারপতির সমন্বয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হবে। কিন্তু যদি প্রধান বিচারপতিই অভিযুক্ত হন তাহলে তার সহকর্মী কি তার বিচার করতে পারবেন? অ্যামিকাস কিউরিরা ভুল তথ্য দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এই সংসদকে হেয় করেছেন, কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়েছেন। দেশের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। সেই জনগণের ভোটে এ সংসদ নির্বাচিত। আমরা রাষ্ট্রপতি, স্পিকারকে ইমপিচমেন্ট করতে পারি। কিন্তু এক জায়গায় করা যাবে না। তোফায়েল আহমেদ বলেন, কেউ সংবিধানকে যদি তছনছ করে থাকে তাহলে সেটা করেছে জিয়াউর রহমান। আইয়ুব খানকে অনুসরণ করে জিয়া এটা করেছিলেন। সেই জুডিশিয়াল কাউন্সিলের জন্য এখন অনেকের দয়া-মায়া হয়। এখন আমাদের বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সুপ্রিমকোর্ট ৫ম সংশোধনী বাতিল করেছেন। সেটা বাতিল হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল থাকে কিভাবে। কামাল হোসেন নামের আগে লেখেন সংবিধান প্রণেতা। ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম বলেছেন, তারা সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। তারা ’৭২-এর সংবিধান করলেন একরকম আবার এখন বলছেন আরেক রকম। তারা মানুষের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবেন। যারা এই সংশোধনী বাতিলের পক্ষে ওকালতি করেন তাদের নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই। তারা নিজের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাদের ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কিছু নেই। তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমার প্রশ্ন- প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তার অধীনস্থরা কি তার বিচার করতে পারবে? তিনি বলেন, এমপিদের বিরুদ্ধে তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছে। সব ক্ষমতার উৎস জনগণ। সেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত এমপিরা। আইপিইউ-সিপিএ’র চেয়ারম্যান এই সংসদের সদস্য। এখানে আমরা রাষ্ট্রপতিকে ইমপিচ করতে পারি, বাট তাদের করা যাবে না। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানকে অনুসরণ করে সপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করেছেন। এখন সেটা রক্ষা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী পদক্ষেপ নেবেন। তিনি বলেন, আদালত বাতিল করেছেন, এ বিষয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু যারা সমর্থন করেছেন, তাদের নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। তারা সুবিধাবাদী। আপনি সংবিধান প্রণয়নের সময় বললেন বেস্ট সংবিধান, বাট এখন কার বিরোধিতা করছে। কারণ আপনারা সংসদ সদস্য হতে পারেননি। স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, এই সংবিধান বেস্ট সংবিধান। চিফ জাস্টিস অন্যায় করতে পারেন, তার বিচার কে করবে? এই রায় অন্যায়। তিনি বলেন, অ্যামিকাস কিউরিরা সুবিধাবাদীর মতো কথা বলেন। আমরা আইন করার আগেই তারা অবৈধ ঠিক করেননি। তারা ভুল করেছেন। এটার রিভিউ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে জাসদের একাংশের কার্যকরী সভাপতি মঈনুদ্দিন খান বাদল বলেন, ৯৬ ধারা সংবিধানের বেসিক জায়গার কোথায় আঘাত করেছে, ধাক্কা দিয়েছে- এটা সুপ্রিমকোর্টকে প্রমাণ দিতে হবে। প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি কি যে কোনো আইন যেটা সংসদ তৈরি করে, আপনি সেটা বাতিল করতে পারেন। সংবিধান কি সেই অধিকার আপনাকে দিয়েছে। তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টের কাছে প্রশ্ন, আমরাই তো বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর করেছি, বেতন-ভাতা বাড়িয়েছি। সুপ্রিমকোর্টের অর্থের সংস্থান করেছে এ সংসদ। এসব বিষয়ে তো বিচার বিভাগের কোনো প্রশ্ন উঠেনি। একজন বিচারক যিনি অন্যায় করলে তার বিচার কিভাবে, তার অপসারণ কিভাবে হবে সেটাই শুধু করা হয়েছিল। এখানে বিচার বিভাগের বেসিক জায়গায় কোথায় আঘাত করল? বাদল বলেন, আমরা বিচার বিভাগের বন্ধু। আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছি। এ রায় জনগণের কাছে কতটুক গ্রহণযোগ্য হবে সেটা ইতিহাসের কাছে বিচার্য। বিচারপতিদের উদ্দেশে সাবেক মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, আপনারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর থেকে ক’জন বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন? একজনেরও করেননি। আমার কাছে তথ্য আছে। একমাত্র জয়নুল আবেদিনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ শুরু হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। তিনি বলেন, বিচারপতিদের একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকতে হবে। আপনারা বিভিন্ন মিটিং-সেমিনারে গিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। আপনারা তো সেখানেই সংবিধান লঙ্ঘন করেন। কেন বক্তব্য দেন। কোন আশায়। সেই আশা বাংলাদেশে আর হবে না। যে কোনো অন্যায়ের বিচার বাংলার মাটিতে হবে। অ্যামিকাস কিউরিদের সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, কিছু সুবিধাভোগী লোক সংসদের সঙ্গে বিচার বিভাগের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে যদি কোনো সুবিধা পাওয়া যায় সেই চিন্তায় আছেন। সেটা করে লাভ হবে না। সুপ্রিমকোর্টের এ রায় নিয়ে তিনি আরও বলেন, সংসদ যদি এ রায় গ্রহণ না করে তাহলে এ রায় কার্যকর হবে না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী, এরা নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। ওই রায়ে ইমপিচমেন্ট বন্ধ হবে না। এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংসদকে রুখে দাঁড়াতে হবে। ৩৫০ জন সংসদ সদস্যকে কাজ করতে হবে। বিচারপতিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আর্টিকেল ৭ লঙ্ঘন করেছেন। আপনাদেরই রিভিউ করে এ রায় বাতিল করতে হবে। এটা কোনো বৃহত্তর ষড়যন্ত্র কিনা, এটা বিবেচনায় আনার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান রাশেদ খান মেনন।
No comments