সবার গুদামে চালের ঘাটতি
সরকারি গুদামে চালের মজুত দুই লাখ টনের নিচে নেমে এসেছে। এ সময় ব্যবসায়ীদের হাতেও মজুত কম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি দুই খাতেই চালের মজুত এখন সবচেয়ে কমে গেছে। স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ লাখ টন চাল কম নিয়ে ২০১৭ সাল শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ রকম পরিস্থিতিতে মোটা চালের পর বাজারে এবার সরু চালের দাম কেজিতে ২ টাকা বেড়েছে। মোটা চালের দামও কমার লক্ষণ নেই। ‘খাদ্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন জুন-২০১৭’ শীর্ষক এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়ার প্রধান চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কমেছে। সরকারি-বেসরকারি সব খাতে চালের এই ঘাটতির কারণেই বাজারে দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত সপ্তাহে বাজারে সরু চালের কেজি ছিল ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা। এ সপ্তাহে তা ২ টাকা বেড়ে ৫৬ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোটা চালের দাম ৪৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৮ টাকা। সব ধরনের চালের দাম গত এক মাসে ৪ থেকে ৮ শতাংশ এবং এক বছরে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশে প্রতি কেজি চালের দাম ১০ টাকা বেশি হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি খাতে চাল আমদানি কম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬—এই দুই অর্থবছরে দেশে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে চাল আমদানি হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ টন। ওই সময়ে দেশে চালের দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। আর এখন চালের কেজি ৫০ টাকা ছুঁইছুঁই করলেও গত এক বছরে মাত্র ১ লাখ ২৮ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও চাল আমদানির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি কেজি চাল আমদানিতে ৯ টাকা করে শুল্ক দিতে হচ্ছে। এর সঙ্গে ব্যাংকঋণ ও অন্যান্য খরচ যোগ করে চালের দাম যা দাঁড়ায়, তাতে তাঁদের আমদানি করে পোষাচ্ছে না। তাই বাজারে চালের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা আমদানির দিকে যাচ্ছেন না।
সরকার ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে চাল আমদানির উদ্যোগ নিলেও তা আগামী এক থেকে দুই মাসের আগে দেশে আসছে না। এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় সরকারের কৃষিসচিবের দায়িত্ব পালনকারী ড. এ এম এম শওকত আলী বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে চালের মজুত কমে যাচ্ছে—এ তথ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নিয়মিত যায়। তখন তারা কী করছিল? দেশে চালের এ সংকটের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্বল তদারকি সবচেয়ে বেশি দায়ী। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, সরকারি গুদামে সব সময় ৬ থেকে ১০ লাখ টন চাল মজুত থাকা উচিত। কিন্তু দুই বছর ধরে সরকারি চালের মজুত ৬ লাখ টনের নিচে ছিল। তিন মাস ধরে তা ৩ লাখ টনের নিচে। হাওরে ফসল বিপর্যয় ও বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগের কারণে সরকারি হিসাবে ১২ লাখ টন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তবে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ ৪০ থেকে ৫০ লাখ টন। বাজারে চালের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। শওকত আলী গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘২০০৮ সালে দেশে চাল নিয়ে একই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছিল। বেসরকারি মজুত কমে যাওয়ায় চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যে শিক্ষা নিইনি, বর্তমান পরিস্থিতি তারই প্রমাণ। সরকারের উচিত অন্তত আমন ওঠার আগ পর্যন্ত চালের আমদানি শুল্ক উঠিয়ে দেওয়া। এতে আমদানি বেড়ে বাজারে জোগান বাড়বে, দামও কমবে।’ এই পরিস্থিতিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ও বেসরকারি খাতে আমদানির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। তারা মনে করছে, খাদ্য অধিদপ্তর একা চালের দাম নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারবে না। গত রোববার খাদ্য মন্ত্রণালয় চালের মজুত ও জোগান পরিস্থিতি নিয়ে যে সভা করেছে, তাতে তারা বেসরকারি খাতে চালের জোগান বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে চাল আমদানি বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার ওপরে তারা গুরুত্ব দিয়েছে। এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চালকলমালিকদের কাছ থেকে মজুতের হিসাব ইতিমধ্যে নিয়েছি। সেখানে খুব বেশি চালের মজুত নেই। ব্যবসায়ীদের কাছে কী পরিমাণ চাল আছে, তা আমরা অনুসন্ধান করে দেখছি। আর বেসরকারি খাতে আমদানি শুল্ক কমানোর সুপারিশ আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে কয়েক দফা বলেছি।’ এ ব্যাপারে দেশের অন্যতম শীর্ষ খাদ্যপণ্য আমদানিকারক ও বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম দ্রুত বাড়ছে। ফলে যা আমদানি করার এখনই করতে হবে। কিন্তু প্রতি কেজিতে ৮-১০ টাকা শুল্ক দিয়ে চাল আমদানি করতে গেলে আমাদের পোষাচ্ছে না।’ শুল্ক প্রত্যাহার হলে ব্যবসায়ীরা আমদানি বাড়াবেন বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশে উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমেছে
চালের উৎপাদনের যে হিসাব এফএওর প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গড়ে ৩ কোটি ৪৫ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৬ সালে তা থেকে ২০ লাখ টন উৎপাদন বেড়েছিল। ২০১৭ সালে উৎপাদন বৃদ্ধির পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমে মাত্র ১০ লাখ টন হয়। ভারতে গত এক বছরে চালের উৎপাদন বেড়েছে ১২ লাখ টন, পাকিস্তানে ২ লাখ টন, থাইল্যান্ডে ৪ লাখ টন এবং ভিয়েতনামে ৩ লাখ টন।
মজুত জানার আইন আছে, প্রয়োগ নেই
২০১১ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয় কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল ফুড কমোডিটি অ্যাক্ট সংশোধন ও হালনাগাদ করে। ওই আইন অনুযায়ী খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দেশের সব চাল, গম, ভোজ্যতেল ও ডালের মজুতের হিসাব পাক্ষিকভাবে দিতে হবে। ওই আইন প্রণয়নের প্রথম দুই বছর খাদ্য মজুতের হিসাব রাখা হয়। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে মজুত রাখার ওই নিয়ম অনিয়মিত হয়ে যায়। তবে সরকারি গুদামগুলোতে চালের মজুতের হিসাব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে রয়েছে। এই মজুত প্রতি সপ্তাহে ৫ থেকে ১০ হাজার টন করে কমছে। বর্তমানে সরকারি গুদামে চালের মজুত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার টনে, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মজুত সংকটের কারণে সরকারের খোলাবাজারে চাল বিক্রিসহ (ওএমএস) বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে চাল বিতরণ বন্ধ রয়েছে। চলতি বছরের মে মাস থেকে চালের মজুত কমতে থাকায় খাদ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি খাতের মজুতের হিসাব নেওয়ার কাজ শুরু করে। গত সপ্তাহে খাদ্য অধিদপ্তর থেকে বেসরকারি খাতে মজুতের হালনাগাদ তথ্যের হিসাব দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ী ও চালকলমালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ অটো, হাসকিং ও মেজর চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তেমন চালের মজুত নেই। বরং চালের অভাবে আমাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত ২২ হাজার চালকলের অর্ধেকই বন্ধ রয়েছে। অর্থাভাবে আমরা চাল কিনতে পারছি না। চাল যদি কিছু থেকে থাকে, তা ব্যবসায়ীদের কাছে আছে।’ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে যা ভুল হওয়ার হয়ে গেছে। আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ—এই আত্মতুষ্টিতে ভুগে দেশে চালের ঘাটতি ও মজুতের বিষয়টি ভুলে গেছি। পরিস্থিতি আরও জটিল ও খারাপ হওয়ার আগে সরকারের উচিত বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া, ২৮ শতাংশ শুল্ক সীমিত সময়ের জন্য প্রত্যাহার করা।’
বাংলাদেশে উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমেছে
চালের উৎপাদনের যে হিসাব এফএওর প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গড়ে ৩ কোটি ৪৫ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৬ সালে তা থেকে ২০ লাখ টন উৎপাদন বেড়েছিল। ২০১৭ সালে উৎপাদন বৃদ্ধির পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমে মাত্র ১০ লাখ টন হয়। ভারতে গত এক বছরে চালের উৎপাদন বেড়েছে ১২ লাখ টন, পাকিস্তানে ২ লাখ টন, থাইল্যান্ডে ৪ লাখ টন এবং ভিয়েতনামে ৩ লাখ টন।
মজুত জানার আইন আছে, প্রয়োগ নেই
২০১১ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয় কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল ফুড কমোডিটি অ্যাক্ট সংশোধন ও হালনাগাদ করে। ওই আইন অনুযায়ী খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দেশের সব চাল, গম, ভোজ্যতেল ও ডালের মজুতের হিসাব পাক্ষিকভাবে দিতে হবে। ওই আইন প্রণয়নের প্রথম দুই বছর খাদ্য মজুতের হিসাব রাখা হয়। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে মজুত রাখার ওই নিয়ম অনিয়মিত হয়ে যায়। তবে সরকারি গুদামগুলোতে চালের মজুতের হিসাব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে রয়েছে। এই মজুত প্রতি সপ্তাহে ৫ থেকে ১০ হাজার টন করে কমছে। বর্তমানে সরকারি গুদামে চালের মজুত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার টনে, যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। মজুত সংকটের কারণে সরকারের খোলাবাজারে চাল বিক্রিসহ (ওএমএস) বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে চাল বিতরণ বন্ধ রয়েছে। চলতি বছরের মে মাস থেকে চালের মজুত কমতে থাকায় খাদ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি খাতের মজুতের হিসাব নেওয়ার কাজ শুরু করে। গত সপ্তাহে খাদ্য অধিদপ্তর থেকে বেসরকারি খাতে মজুতের হালনাগাদ তথ্যের হিসাব দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ী ও চালকলমালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ অটো, হাসকিং ও মেজর চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তেমন চালের মজুত নেই। বরং চালের অভাবে আমাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত ২২ হাজার চালকলের অর্ধেকই বন্ধ রয়েছে। অর্থাভাবে আমরা চাল কিনতে পারছি না। চাল যদি কিছু থেকে থাকে, তা ব্যবসায়ীদের কাছে আছে।’ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে যা ভুল হওয়ার হয়ে গেছে। আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ—এই আত্মতুষ্টিতে ভুগে দেশে চালের ঘাটতি ও মজুতের বিষয়টি ভুলে গেছি। পরিস্থিতি আরও জটিল ও খারাপ হওয়ার আগে সরকারের উচিত বেসরকারিভাবে চাল আমদানি বাড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া, ২৮ শতাংশ শুল্ক সীমিত সময়ের জন্য প্রত্যাহার করা।’
No comments