গণমাধ্যমে ভেজালবিরোধী খবর উপেক্ষিত কেন?

প্রথম পাতায় জায়গা হয় না। শেষ পাতায়ও না। কেউ কেউ ভেতরের পাতার কোনাকাঞ্চিতে জায়গা দেন। ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস নিয়ে না বসলে খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, দুটো-তিনটে প্যারায় বড়জোর শ খানেক, শ দেড়েক শব্দ। ছবির কথা দূরে থাক। আর বেশির ভাগ কাগজে তো একেবারেই ব্ল্যাকআউট। গণমাধ্যমে ভেজালবিরোধী অভিযানের খবরের দুর্দশা চলছেই। মূলধারা, উপধারা, সামাজিক ধারা, কোথাও ভেজালবিরোধী অভিযানকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এই উদাসীনতা নতুন নয়। ছিল, আছে। বরং এখন পৌঁছেছে অবজ্ঞার পর্যায়ে। অথচ ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভেজালবিরোধী অভিযান থেমে নেই। তাহলে কেন ভুলে থাকছে গণমাধ্যম? কেন এই অবহেলা? ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভেজালবিরোধী অভিযানের কথা এলেই আমাদের অনেকেরই মনে পড়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রোকনুদ্দৌলার কথা। তাঁর অভিযান, সাজা প্রদানের ধরন ছিল একটা সময় গণমাধ্যমের হট টপিক। তিনি রিপোর্টারদের সঙ্গে নিয়েই অভিযানে নামতেন। বেশ ফলাও করে বেরোত খবরগুলো টেলিভিশনে, খবরের কাগজে। এর পরেও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষে আরও অনেক কর্মকর্তাই ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছেন। আলোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে ঢের। এতে লাভ হয়েছিল সাধারণ ভোক্তাশ্রেণির। ফরমালিন দেওয়া খাবার, ফলফলাদি না খাওয়ার ব্যাপারে সাধারণ পর্যায়ে একধরনের সচেতনতা গড়ে উঠেছিল। কমে এসেছিল কারবাইড দিয়ে ফল পাকানোর প্রবণতাও। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে গণমাধ্যম সম্মিলিতভাবে যখন কোনো বিষয়কে গুরুত্ব দেয়, কোনো দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে, আখেরে সেটার একটা ফল মেলে। সরকারও পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। থেমে যায় অপরাধীদের আগে বাড়া। ভেজাল পণ্যের ব্যাপারেও ঠিক সেই কাজটিই করেছিল গণমাধ্যম, যা এখন করা হচ্ছে না। এখন বাজারে টসটসা আপেল দেখলে মনে হয়, এর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ফরমালিন দেওয়া নেই তো! বাজারে যেসব মাল্টা, নাসপাতি মেলে, কুড়ি-পঁচিশ দিনেও তা অটুট থাকে! এখন আমের মৌসুম। একেকটা আম একেক সময় বাজারে আসে। কিন্তু কার সময় আছে এত অপেক্ষা করার? না ব্যবসায়ীর, না ভোক্তার। আধা পাকা ফল কারবাইড মেরে পাকিয়ে বাজারে আনলেই মওকা। সচেতনতা নেই বলে এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন না।
আর আমাদের মতো ভোক্তারা সন্দিগ্ধ মন নিয়ে ফল কিনছেন, দেদার খাওয়া চলছে। কেন গণমাধ্যম ভেজালবিরোধী অভিযানকে আমলে নিচ্ছে না, জানতে চেয়েছিলাম একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের কাছে, যিনি বিষয়টি নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করছেন। তাঁর ভাষ্য, কেবল অভিযানের খবরটি কভার করাই যথেষ্ট নয়। ভেজাল বিষয়টি গণমাধ্যমের নিজস্ব এজেন্ডায় থাকতে হবে, যা একটি বা দুটি মিডিয়া বাদে কারও নেই বললেই চলে। শুধু প্রতিবেদন লেখাই যথেষ্ট নয়, ধারাবাহিকভাবে রচনা করতে হবে সংবাদ বিশ্লেষণ, সম্পাদকীয়, মতামত। কিন্তু দুঃখজনক হলো, লেগে থাকা তো দূরের কথা, সামান্য কভারই করা হচ্ছে না। তাহলে কি ভেজালবিরোধী অভিযানের গতি স্তিমিত হয়ে গেছে? প্রশ্নটি করেছিলাম মাসুম আরেফিনকে। তিনি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (তদন্ত)। এই রমজানে তিনি একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের কোনো দুর্বলতা দেখেন না। তিনি মনে করেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত যদি সঠিক জায়গায় হিট করতে পারেন, তাহলে সে খবর গণমাধ্যম গুরুত্ব না দিয়ে পারে না। বলছিলেন, তিনি সম্প্রতি অভিযান পরিচালনা করে একটি প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন, সে খবরটি গণমাধ্যমে কল্কে পায়নি। কিন্তু আরেক দিন এক লাখ টাকা জরিমানা করেছেন, সে খবরটির ঠিকই জায়গা হয়েছে। অর্থাৎ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়াধীন এই কর্মকর্তা মনে করছেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতকে অগ্রাধিকার ঠিক করে অভিযানে নামতে হবে। সাধারণ মানুষ কোথায়, কীভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে, সেটা বুঝে কাজ করতে হবে। একটা সাধারণ আলোচনা আছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত রাঘববোয়ালদের সামান্য পশমও ধরতে পারে না, কিন্তু ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানের টুঁটি চেপে ধরে। অর্থাৎ সবলকে বাঁচিয়ে কেবল দুর্বলের ওপর আইন ফলায়। সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে, বিষয়টি বিবেচনায় নিলে অভিযানের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। একই প্রশ্ন করি র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমকে। প্রায় নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে। তাঁর মতে, গণমাধ্যম অন্য নানা বিষয়ে ব্যস্ত। যে কারণে এখন আর এ খবরগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে না। তবে সরকারের যেসব সংস্থা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে, তাদেরও তৎপর হতে হবে। যেমন অভিযানের খবর গণমাধ্যমকে নিবিড়ভাবে জানানো, সাপ্তাহিক-মাসিক ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি এবং পৌঁছানো, নিয়মিত ব্রিফিংয়ের আয়োজন। সারওয়ার আলম মনে করেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাজটি যে গুরুত্বপূর্ণ, এটা আগে তাদের বুঝতে হবে। তারা বুঝলে গণমাধ্যম না বুঝে বসে থাকতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা দেখেন না রোবায়েত ফেরদৌস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপকের পর্যবেক্ষণ, গণমাধ্যম কোনো একটা ইস্যু ধরে বেশ এগোয়। তারপর মাঝপথে ফেলে চলে যায়। এরপর আর খবর নেয় না। ভেজালবিরোধী অভিযান কভার করার ক্ষেত্রেও গণমাধ্যম অনেকটা এ রকম করেছে। তাঁর মতে, গণমাধ্যম কখনো কখনো মাঝামাঝি অবস্থানও নিয়ে থাকে। কোনো কোনো মহল থেকে সমালোচনা করে বলা যায়, এসব খবর ফলাও প্রচার করে গণমাধ্যম মূলত দেশীয় কৃষিজাত ও ক্ষুদ্রশিল্পের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে। এসব সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক সময় গণমাধ্যম পিছু হটে। কিন্তু গণমাধ্যমকে কি পিছু হটলে চলবে? গণমাধ্যম পিছু হটলে এ দেশের গণমানুষের আশার জায়গাটি আর রইল কোথায়? প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যম কেন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় হতে বাধ্য করে না? আমরা কালের আয়নায় গণমাধ্যমের ঝাপসা মুখ দেখতে চাই না।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
alimkzaman@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.