ট্রাম্পের বক্তব্য কপটতায় ভরা by রবার্ট ফিস্ক
ফে
ইক নিউজ (বানোয়াট সংবাদ) আবিষ্কার করার পর আমেরিকার খ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট
রোববার বিশ্বের মুসলিমদের সামনে নিজেই এক বানোয়াট বক্তব্য দিলেন। ডনাল্ড
ট্রাম্প বললেন, সৌদি আরবে তিনি ‘লেকচার’ দিতে যান নি। কিন্তু পরক্ষণেই
বিশ্বের ইসলাম ধর্মপ্রচারকদের বলে দিলেন কি বলতে হবে। ‘ইসলামিস্ট টেররিজম’
এর সমালোচনা করলেন, ভাবখানা এমন যে সহিংসতা কেবল মুসলিম সংশ্লিষ্ট একটা
বিষয়। এরপর ওল্ড টেস্টামেন্টের একজন পয়গম্বরের মতো ঘোষণা দিলেন যে তিনি
‘শুভ-অশুভের লড়াইয়ের’ মাঝে আছেন। কোন সমবেদনা ছিল না, সহমর্মিতাও না। গেল
বছর তার বৈষম্যমূলক, মুসলিমবিরোধী বক্তব্যের জন্য একটি শব্দও ছিল না।
আরো তাজ্জব বিষয় হলো তিনি ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উসকে দেয়া’র জন্য ইরানকে দোষারোপ করেছেন, আইসিসকে নয়। ইরান যেদিন একজন উদারমনা সংস্কারপন্থিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছে তার একদিন পর ট্রাম্প ইরানি জনগণকে তাদের ‘হতাশা’র জন্য করুণা প্রকাশ করেছেন। সেইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে সর্ববৃহৎ শিয়াপ্রধান দেশটিকে আরো বিচ্ছিন্ন করে তোলার দাবি জানিয়েছেন। ‘এতো বেশি অস্থিতিশীলতার’ জন্য দায়ী হলো ইরান। নিন্দার শিকার হয়েছে শিয়া হিজবুল্লাহও। বাদ যায় নি শিয়া ইয়েমেনিরাও। ট্রাম্পের এমন বিচক্ষণতায় প্রীত হয়েছেন তার সুন্নি সৌদি আমন্ত্রণকর্তারা।
সিএনএন এটাকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ‘রিসেট’ (পুনরায় শুরু করা) করার বক্তব্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ‘রিসেট’কে আপনি ‘রিপেয়ার’ (মেরামত) পড়তে পারেন। তবে, রোববার রিয়াদে ট্রাম্পের তীব্র নিন্দামূলক বক্তব্য ‘রিসেট’ও ছিল না ‘রিপেয়ার’ও ছিল না। এটা ছিল ওই ‘লেকচার’ যেটা তিনি দেবেন না বলে দাবি করেছিলেন।
ট্রাম্প বললেন, ‘প্রতিবারই যখন একজন সন্ত্রাসী একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে ভুলভাবে সৃষ্টিকর্তার নাম টেনে আনে, তা প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসীর জন্যই অপমানজনক হওয়া উচিত।’ তিনি পুরোটাই এড়িয়ে গেলেন যে, ইরান নয় সৌদি আরবই ওয়াহাবি সালাফি জঙ্গিবাদের আদিউৎস যাদের ‘সন্ত্রাসীরা’ ‘নিরপরাধ মানুষ’ খুন করে। অবশ্য ট্রাম্পের এটা এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না।
তিনি তার পুরোনো বৈষম্যমূলক ‘র্যাডিক্যাল ইসলামিক এক্সট্রিমিস্ট’ (উগ্রপন্থি ইসলামি জঙ্গি) মন্ত্র আওড়ানো থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করেছেন। আর এর পরিবর্তে বলার চেষ্টা করেছেন ‘ইসলামিস্ট এক্সট্রিমিজম’ (ইসলামপন্থি জঙ্গিবাদ)। কিন্তু তিনি দৃশ্যত তার শব্দচয়নে তালগোল পাকিয়েছেন। আর ‘ইসলামিক’ শব্দটাও ব্যবহার করেছেন। ইংরেজিতে তিনি সূক্ষ্ম যে পার্থক্য গড়ার চেষ্টা করছিলেন তা মুসলিমদের কাছে ওই ‘সন্ত্রাসীরা মুসলিম’ ধারণার ভিন্ন এক রূপ বৈ অন্য কিছু ছিল না।
এসব এসেছে সৌদি আরবের সঙ্গে ট্রাম্প আরেকটি ভয়ানক অস্ত্র চুক্তি (১১ হাজার কোটি ডলার) করা, আর কাতারের মার্কিন অস্ত্র ক্রয়ের প্রস্তাবের পর- ট্রাম্প যেসব অস্ত্রকে কদর্যভাবে আখ্যা দিয়েছেন ‘সুন্দর সব সামরিক সরঞ্জাম’ হিসেবে। এটা বিচিত্র যে তিনি এমন একটা মন্তব্য এমন সময় করলেন, যার দু’দিন পরই তিনি কায়রোতে পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। আর যেই পোপ দু’সপ্তাহ আগে আল আজহারের মুসলিম শেখের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করেছেন।
ট্রাম্প সৌদিদের ও আরো ৫০ মুসলিম রাষ্ট্রের নেতাদের রোববার বলেন, ‘আমরা নীতিনিষ্ঠ এক বাস্তববাদ গ্রহণ করছি যা আমাদের অভিন্ন মূল্যবোধ আর স্বার্থের মধ্যে প্রোথিত।’
ট্রাম্প যখন বললেন যে, ‘আমাদের মিত্ররা কখনই আমাদের সমর্থন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না, আর আমাদের শত্রুরা আমাদের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সংশয় প্রকাশ করবে না,’ ট্রাম্প কি তার বন্ধু বলতে সৌদিদের বুঝিয়েছেন? নাকি ‘ইসলামিক বিশ্ব’কে বুঝিয়েছেন যেখানে নিশ্চিতভাবে ইরান, সিরিয়া ও ইয়েমেনও থাকবে, আরো থাকবে লিবিয়ার যুদ্ধরত মিলিশিয়ারা? ‘শত্রু’ বলতে কি তিনি আইসিস বুঝিয়েছেন? নাকি রাশিয়া? বা সিরিয়া? অথবা ইরান? যে দেশটির নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিশ্চিতভাবে আমেরিকার সঙ্গে শান্তি চায়। নাকি তিনি বিশ্বের সুন্নি মুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আর শিয়া মুসলিমদের প্রতি বৈরিতার ঘোষণা দিচ্ছিলেন?- মুসলিম বিশ্বের একাংশ সঙ্গত কারণেই যেটা মনে করবে।
এ কারণে এটাই আসলে ছিল রিয়াদ বক্তব্য-উৎসবের আসল কথা। এই উদ্ধৃতিটা ধরুন: ‘আমরা বাস্তব জগতের ফলের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেবো- অনমনীয় ভাবাদর্শের ওপর নয়। আমরা অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা দিয়ে পরিচালিত হবো, অটল চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা দিয়ে নয়। আর যেখানেই সম্ভব আমরা ক্রমাগত সংস্কারের চেষ্টা করবো- আকস্মিক হস্তক্ষেপ নয়।’ এখন ছোট্ট এই বিভিষিকার বিশ্লেষন করা যাক। ‘বাস্তব জগতের ফলের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত’- এর অর্থ হলো নৃশংস প্রয়োগবাদ। ‘ক্রমাগত সংস্কার’ ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের জন্য কিছু করবে না, মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রতিহত করতে কোনো পদক্ষেপ নেবে না- যদি না সেগুলো ইরান, সিরিয়া, ইরাকি শিয়া, লেবাননের শিয়া হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের শিয়া হুতিরা করে।
পুরো বিষয়টা ছিল ‘অংশীদারিত্ব’ নিয়ে- আমাদের এমনটাই বিশ্বাস করার কথা ছিল। বিষয়টা ছিল একটি ‘জোট’- নিয়ে। আপনি এটা নিশ্চিত হতে পারেন। আমেরিকা ইরাক ও আফগানিস্তানে যেমনটা রক্ত বইয়েছে তেমনটা আর করবে না। নিজেদের মাঝে লড়াইরত আরবদেরকেই রক্তাক্ত হতে হবে যারা সর্ববৃহৎ অস্ত্র সরবরাহকারীর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত। সুতরাং ট্রাম্প তাদের লেকচার দিলেন ‘তাদের অংশের বোঝা’ বহন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। আরবরা ‘একতাবদ্ধ আর শক্তিশালী’ হবে ‘মঙ্গলের শক্তি’ হিসেবে। লড়াইটা যদি ‘সকল ধর্মের সজ্জন’ আর ‘বর্বর অপরাধীদের’ মধ্যে হয়- ‘শুভ আর অশুভের মধ্যে’ হয়- যেমনটা ট্রাম্প ধরে নিয়েছেন, তাহলে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে এই লড়াইটা শুরু হচ্ছে সুন্নি সৌদি আরবের ‘পবিত্র ভূমিতে’। গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?
যে সময়ে ট্রাম্প তার বক্তব্যের ওই অংশে পৌঁছেছেন যেখানে তিনি মন্দলোকদের হুঁশিয়ারি দেন- ‘আপনি যদি সন্ত্রাসের পথ বেছে নেন, আপনার জীবন হবে শূন্য। আপনার জীবন হবে সংক্ষিপ্ত। আর আপনার আত্মা হবে অভিশপ্ত’- তাকে আইসিসের বক্তব্য-লেখকদের মতো শোনাচ্ছিল। দৃশ্যত, ট্রাম্পের মূল বক্তব্য আংশিকভাবে ওই একই লোকের প্রস্তুত করা যিনি যুক্তরাষ্ট্রে ৭টি দেশের মুসলিমদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে ট্রাম্পের হাস্যকর (এবং ব্যর্থ) আইনি প্রচেষ্টার অনেকখানি প্রস্তুত করেছিলেন। সবমিলিয়ে বেশ একটা ‘রিসেট’ বটে। ট্রাম্প শান্তির কথা বলছিলেন কিন্তু একইসঙ্গে আরবদের প্রস্তুত করছিলেন একটি সুন্নি-শিয়া যুদ্ধের জন্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যুক্তরাষ্ট্রের পাগল প্রেসিডেন্ট যখন তার বক্তব্য শেষ করেন তখন মুসলিম বিশ্বের তোষামোদি নেতারা তালি বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু তারা কি বুঝেছেন তার কথাগুলো আসলে কোন অশনি সংকেতের আলামত?
[বৃটেনের অনলাইন ইন্ডিপেন্ডেন্টে প্রকাশিত রবার্ট ফিস্কের লেখা ‘ডনাল্ড ট্রাম্প’স স্পিচ টু দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড ওয়াজ ফিলড উইথ হিপোক্রেসি অ্যান্ড কনডেসেনশন’ শীর্ষক নিবন্ধের অনুবাদ। ইন্ডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি রবার্ট ফিস্ক একাধিক পুরস্কারজয়ী বর্ষীয়ান একজন সাংবাদিক। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি আরব বিশ্বে বসবাস করছেন। দীর্ঘ এ সময়ে তিনি লেবানন পরিস্থিতি, ৫টি ইসরাইলি আগ্রাসন, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন, আলজেরিয়ান গৃহযুদ্ধ, সাদ্দাম হুসেইনের কুয়েত আক্রমণ, বসনিয়া ও কসোভো যুদ্ধ, ইরাকে মার্কিন হামলা ও দখলদারিতা এবং ২০১১’র আরব অভ্যুত্থান কভার করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে তার লেখা গ্রন্থ ‘পিটি দ্য নেশন’ ও ‘দ্য গ্রেট ওয়ার ফর সিভিলাইজেশন’ বেস্ট সেলার।]
আরো তাজ্জব বিষয় হলো তিনি ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উসকে দেয়া’র জন্য ইরানকে দোষারোপ করেছেন, আইসিসকে নয়। ইরান যেদিন একজন উদারমনা সংস্কারপন্থিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছে তার একদিন পর ট্রাম্প ইরানি জনগণকে তাদের ‘হতাশা’র জন্য করুণা প্রকাশ করেছেন। সেইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে সর্ববৃহৎ শিয়াপ্রধান দেশটিকে আরো বিচ্ছিন্ন করে তোলার দাবি জানিয়েছেন। ‘এতো বেশি অস্থিতিশীলতার’ জন্য দায়ী হলো ইরান। নিন্দার শিকার হয়েছে শিয়া হিজবুল্লাহও। বাদ যায় নি শিয়া ইয়েমেনিরাও। ট্রাম্পের এমন বিচক্ষণতায় প্রীত হয়েছেন তার সুন্নি সৌদি আমন্ত্রণকর্তারা।
সিএনএন এটাকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ‘রিসেট’ (পুনরায় শুরু করা) করার বক্তব্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ‘রিসেট’কে আপনি ‘রিপেয়ার’ (মেরামত) পড়তে পারেন। তবে, রোববার রিয়াদে ট্রাম্পের তীব্র নিন্দামূলক বক্তব্য ‘রিসেট’ও ছিল না ‘রিপেয়ার’ও ছিল না। এটা ছিল ওই ‘লেকচার’ যেটা তিনি দেবেন না বলে দাবি করেছিলেন।
ট্রাম্প বললেন, ‘প্রতিবারই যখন একজন সন্ত্রাসী একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে ভুলভাবে সৃষ্টিকর্তার নাম টেনে আনে, তা প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসীর জন্যই অপমানজনক হওয়া উচিত।’ তিনি পুরোটাই এড়িয়ে গেলেন যে, ইরান নয় সৌদি আরবই ওয়াহাবি সালাফি জঙ্গিবাদের আদিউৎস যাদের ‘সন্ত্রাসীরা’ ‘নিরপরাধ মানুষ’ খুন করে। অবশ্য ট্রাম্পের এটা এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না।
তিনি তার পুরোনো বৈষম্যমূলক ‘র্যাডিক্যাল ইসলামিক এক্সট্রিমিস্ট’ (উগ্রপন্থি ইসলামি জঙ্গি) মন্ত্র আওড়ানো থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করেছেন। আর এর পরিবর্তে বলার চেষ্টা করেছেন ‘ইসলামিস্ট এক্সট্রিমিজম’ (ইসলামপন্থি জঙ্গিবাদ)। কিন্তু তিনি দৃশ্যত তার শব্দচয়নে তালগোল পাকিয়েছেন। আর ‘ইসলামিক’ শব্দটাও ব্যবহার করেছেন। ইংরেজিতে তিনি সূক্ষ্ম যে পার্থক্য গড়ার চেষ্টা করছিলেন তা মুসলিমদের কাছে ওই ‘সন্ত্রাসীরা মুসলিম’ ধারণার ভিন্ন এক রূপ বৈ অন্য কিছু ছিল না।
এসব এসেছে সৌদি আরবের সঙ্গে ট্রাম্প আরেকটি ভয়ানক অস্ত্র চুক্তি (১১ হাজার কোটি ডলার) করা, আর কাতারের মার্কিন অস্ত্র ক্রয়ের প্রস্তাবের পর- ট্রাম্প যেসব অস্ত্রকে কদর্যভাবে আখ্যা দিয়েছেন ‘সুন্দর সব সামরিক সরঞ্জাম’ হিসেবে। এটা বিচিত্র যে তিনি এমন একটা মন্তব্য এমন সময় করলেন, যার দু’দিন পরই তিনি কায়রোতে পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। আর যেই পোপ দু’সপ্তাহ আগে আল আজহারের মুসলিম শেখের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করেছেন।
ট্রাম্প সৌদিদের ও আরো ৫০ মুসলিম রাষ্ট্রের নেতাদের রোববার বলেন, ‘আমরা নীতিনিষ্ঠ এক বাস্তববাদ গ্রহণ করছি যা আমাদের অভিন্ন মূল্যবোধ আর স্বার্থের মধ্যে প্রোথিত।’
ট্রাম্প যখন বললেন যে, ‘আমাদের মিত্ররা কখনই আমাদের সমর্থন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না, আর আমাদের শত্রুরা আমাদের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সংশয় প্রকাশ করবে না,’ ট্রাম্প কি তার বন্ধু বলতে সৌদিদের বুঝিয়েছেন? নাকি ‘ইসলামিক বিশ্ব’কে বুঝিয়েছেন যেখানে নিশ্চিতভাবে ইরান, সিরিয়া ও ইয়েমেনও থাকবে, আরো থাকবে লিবিয়ার যুদ্ধরত মিলিশিয়ারা? ‘শত্রু’ বলতে কি তিনি আইসিস বুঝিয়েছেন? নাকি রাশিয়া? বা সিরিয়া? অথবা ইরান? যে দেশটির নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিশ্চিতভাবে আমেরিকার সঙ্গে শান্তি চায়। নাকি তিনি বিশ্বের সুন্নি মুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আর শিয়া মুসলিমদের প্রতি বৈরিতার ঘোষণা দিচ্ছিলেন?- মুসলিম বিশ্বের একাংশ সঙ্গত কারণেই যেটা মনে করবে।
এ কারণে এটাই আসলে ছিল রিয়াদ বক্তব্য-উৎসবের আসল কথা। এই উদ্ধৃতিটা ধরুন: ‘আমরা বাস্তব জগতের ফলের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেবো- অনমনীয় ভাবাদর্শের ওপর নয়। আমরা অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষা দিয়ে পরিচালিত হবো, অটল চিন্তাধারার সীমাবদ্ধতা দিয়ে নয়। আর যেখানেই সম্ভব আমরা ক্রমাগত সংস্কারের চেষ্টা করবো- আকস্মিক হস্তক্ষেপ নয়।’ এখন ছোট্ট এই বিভিষিকার বিশ্লেষন করা যাক। ‘বাস্তব জগতের ফলের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত’- এর অর্থ হলো নৃশংস প্রয়োগবাদ। ‘ক্রমাগত সংস্কার’ ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের জন্য কিছু করবে না, মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রতিহত করতে কোনো পদক্ষেপ নেবে না- যদি না সেগুলো ইরান, সিরিয়া, ইরাকি শিয়া, লেবাননের শিয়া হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের শিয়া হুতিরা করে।
পুরো বিষয়টা ছিল ‘অংশীদারিত্ব’ নিয়ে- আমাদের এমনটাই বিশ্বাস করার কথা ছিল। বিষয়টা ছিল একটি ‘জোট’- নিয়ে। আপনি এটা নিশ্চিত হতে পারেন। আমেরিকা ইরাক ও আফগানিস্তানে যেমনটা রক্ত বইয়েছে তেমনটা আর করবে না। নিজেদের মাঝে লড়াইরত আরবদেরকেই রক্তাক্ত হতে হবে যারা সর্ববৃহৎ অস্ত্র সরবরাহকারীর কাছ থেকে অনুপ্রাণিত। সুতরাং ট্রাম্প তাদের লেকচার দিলেন ‘তাদের অংশের বোঝা’ বহন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। আরবরা ‘একতাবদ্ধ আর শক্তিশালী’ হবে ‘মঙ্গলের শক্তি’ হিসেবে। লড়াইটা যদি ‘সকল ধর্মের সজ্জন’ আর ‘বর্বর অপরাধীদের’ মধ্যে হয়- ‘শুভ আর অশুভের মধ্যে’ হয়- যেমনটা ট্রাম্প ধরে নিয়েছেন, তাহলে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে এই লড়াইটা শুরু হচ্ছে সুন্নি সৌদি আরবের ‘পবিত্র ভূমিতে’। গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?
যে সময়ে ট্রাম্প তার বক্তব্যের ওই অংশে পৌঁছেছেন যেখানে তিনি মন্দলোকদের হুঁশিয়ারি দেন- ‘আপনি যদি সন্ত্রাসের পথ বেছে নেন, আপনার জীবন হবে শূন্য। আপনার জীবন হবে সংক্ষিপ্ত। আর আপনার আত্মা হবে অভিশপ্ত’- তাকে আইসিসের বক্তব্য-লেখকদের মতো শোনাচ্ছিল। দৃশ্যত, ট্রাম্পের মূল বক্তব্য আংশিকভাবে ওই একই লোকের প্রস্তুত করা যিনি যুক্তরাষ্ট্রে ৭টি দেশের মুসলিমদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে ট্রাম্পের হাস্যকর (এবং ব্যর্থ) আইনি প্রচেষ্টার অনেকখানি প্রস্তুত করেছিলেন। সবমিলিয়ে বেশ একটা ‘রিসেট’ বটে। ট্রাম্প শান্তির কথা বলছিলেন কিন্তু একইসঙ্গে আরবদের প্রস্তুত করছিলেন একটি সুন্নি-শিয়া যুদ্ধের জন্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যুক্তরাষ্ট্রের পাগল প্রেসিডেন্ট যখন তার বক্তব্য শেষ করেন তখন মুসলিম বিশ্বের তোষামোদি নেতারা তালি বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু তারা কি বুঝেছেন তার কথাগুলো আসলে কোন অশনি সংকেতের আলামত?
[বৃটেনের অনলাইন ইন্ডিপেন্ডেন্টে প্রকাশিত রবার্ট ফিস্কের লেখা ‘ডনাল্ড ট্রাম্প’স স্পিচ টু দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড ওয়াজ ফিলড উইথ হিপোক্রেসি অ্যান্ড কনডেসেনশন’ শীর্ষক নিবন্ধের অনুবাদ। ইন্ডিপেন্ডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি রবার্ট ফিস্ক একাধিক পুরস্কারজয়ী বর্ষীয়ান একজন সাংবাদিক। চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি আরব বিশ্বে বসবাস করছেন। দীর্ঘ এ সময়ে তিনি লেবানন পরিস্থিতি, ৫টি ইসরাইলি আগ্রাসন, ইরান-ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন, আলজেরিয়ান গৃহযুদ্ধ, সাদ্দাম হুসেইনের কুয়েত আক্রমণ, বসনিয়া ও কসোভো যুদ্ধ, ইরাকে মার্কিন হামলা ও দখলদারিতা এবং ২০১১’র আরব অভ্যুত্থান কভার করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে তার লেখা গ্রন্থ ‘পিটি দ্য নেশন’ ও ‘দ্য গ্রেট ওয়ার ফর সিভিলাইজেশন’ বেস্ট সেলার।]
No comments