ছাত্রলীগকে ছাত্রলীগ হয়ে ওঠায় সাহায্য করুন
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের এখন শুধু মন্ত্রী নন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। ছাত্রলীগকে পরিচালনা, সুপথ দেখানো ও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বও তার ওপর রয়েছে। এ কারণে এখন যে কোনো জায়গায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সামনে বক্তৃতা দিতে গেলে সতর্কতামূলক ও উপদেশমূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন তিনি। নানা বিষয়ে রাখঢাক না করে কথা বলার সুখ্যাতি তার রয়েছে। ছাত্রলীগ নিয়ে তার সাম্প্রতিক দেয়া নির্দেশনামূলক বক্তব্যে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সুহৃদ যারা তারা আশান্বিত হয়েছেন। ভাবছেন এতে যদি ছাত্রলীগ সুপথে আসে। যেমন দিন কয়েক আগে- সম্ভবত ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামে এক সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের গ্রুপিংয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে এ সময়ে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। এ সুযোগে তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে- ১. দল ক্ষমতায় না থাকলে টাকা ও ক্ষমতা দুটিই যাবে আর ২. ব্যক্তিগত স্বার্থে কেউ ছাত্রলীগকে ব্যবহার করবেন না। বক্তব্য দুটি আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। প্রসঙ্গটি নিয়ে পরে কথা বলছি। ছাত্ররাজনীতিকে এর গৌরবময় জায়গা থেকে টেনে এনে অন্ধকারে ছুড়ে ফেলেছে আমাদের দেশের ক্ষমতাপ্রবণ নষ্ট রাজনীতি। আমি বিশ্বাস করি, একমাত্র অন্ধ বিবেক ছাড়া কেউ এ সত্যকে অস্বীকার করবেন না।
পাকিস্তানের এককালের লৌহমানবখ্যাত প্রেসিডেন্ট আইউব খান দিয়ে ছাত্র সন্ত্রাসের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত তরুণরা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সরব ছিলেন। তখন জাতীয় রাজনীতির তল্পিবাহক ছিল না ছাত্ররা। দলীয় রাজনীতিতে সমর্থন থাকলেও দেশ-জাতির কল্যাণে তাদের স্বকীয় চিন্তা ছিল। তাই ১১ দফা কর্মসূচি দিয়ে ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল। যা গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট রচনায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। আইউব খান ভীত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাঠিয়াল ছাত্রশক্তি আমদানি করলেন। গঠিত হল ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন অর্থাৎ এনএসএফ। গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার জন্য হকিস্টিক দিয়ে বিপক্ষ দলের বন্ধুদের পিটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসন্ত্রাস আমদানি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশজুড়ে সন্ত্রাস, খুনোখুনির একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পড়তে থাকে। পরীক্ষায় প্রকাশ্যে গণটোকাটুকি শুরু হয়ে যায়। ছাত্র সংগঠনের ছাত্রকল্যাণ ও দেশকল্যাণের রাজনীতি ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে থাকে। প্রবেশ করতে থাকে শক্তি প্রয়োগের রাজনীতি। বিপক্ষ দলকে দমন করার রাজনীতি। এর মধ্য দিয়ে জাসদের জন্ম হয়। ভাঙন ধরে ছাত্রলীগের। মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগ নামে বড় দাগে ভাঙন হয়। উভয়ে হয়ে যায় পরস্পরের শত্রুপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি-হানাহানি অর্থাৎ সন্ত্রাস ধীরে ধীরে নিজ আসন পাকাপোক্ত করতে থাকে। আর ছাত্ররা এ সময় থেকে তাদের মুক্তচিন্তার জায়গাটিকে অচেনা করে ফেলে। যার যার জাতীয় দলের নেতাদের আজ্ঞাবহ হয়ে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মেধাবী ছাত্ররা চেষ্টা করে রাজনীতি থেকে নিজেদের সযত্নে সরিয়ে রাখতে। ছাত্ররাজনীতির স্খলনের পর্ব শুরু হয় এখান থেকেই। এরপর জিয়াউর রহমান মঞ্চে আসেন। রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণের লক্ষ্যে বা আন্তর্জাতিক কোনো দেশ বা দেশ সমন্বয়ের এজেন্ডা পূরণের জন্য পাকিস্তানঘেঁষা বিএনপি নামের দল গঠন করেন। এরপর দৃষ্টি দিলেন ছাত্রশক্তির ওপর।
গঠন করলেন ছাত্রদল। মুজিববাদী এবং জাসদ ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বের সময়েই ছাত্ররাজনীতির শক্তিতে আগ্নেয়াস্ত্র যুক্ত হয়েছিল, এবার জিয়াউর রহমান অস্ত্র ও অর্থশক্তি দুটোর সঙ্গেই ছাত্রদের পরিচয় করান। বলা যায় ছাত্ররাজনীতির অহংকার করার জায়গাটি এ সময় থেকে পুরোপুরি ভেঙে যায়। প্রেসিডেন্ট এরশাদ নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ এবং পরবর্তী সময়ের ছাত্র সমাজ গঠন করে স্খলনের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকেন। ক্যাম্পাসে বিরুদ্ধ পক্ষের বন্ধুদের রক্ত ঝরিয়ে রাজনীতি করার পাশাপাশি রাজনীতি করা ছাত্ররা চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভর্তি বণিক, সিট বণিক, তোলাবাজ এসব নানা গুণে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল। এখন তো বাস্তবতা অন্যরকম। যে দল সরকারে থাকে তাদের সহযোগী ছাত্রদের ক্যাম্পাসে দাপুটে অবস্থান। অন্য দলের ছাত্রদের ম্রিয়মান দশা। অস্ত্রশক্তি আর অর্থলোভ ছাত্রদের সুকুমার বৃত্তিগুলো নষ্ট করে দিতে থাকে। তাই লোভের ঊর্ধ্বে উঠে ক্যাম্পাসে ছাত্রকল্যাণের জন্য যে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের ভূমিকা রাখা উচিত, এর প্রায় পুরোটাই ভুলিয়ে দেয়া হয়। বিপক্ষ দল রঙ্গভূমিতে না থাকায় এখন ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের উন্মত্ত অবস্থান। ফলে ওরা এখন নিজেদের মধ্যেই অন্তর্কলহে লিপ্ত থাকছে। হল দখলের কর্তৃত্ব আর অর্থ বাণিজ্যের দ্বন্দ্বে মারামারি করছে নিজেরাই। কখনও কখনও দখল বাণিজ্যে কোনো শক্তির হয়ে ভাড়া খাটছে। রাজনৈতিক নেতাদের লাঠিয়াল হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় দুই আওয়ামী লীগ নেতার রেশারেশিতে চট্টগ্রামে স্টেডিয়াম দখল-বেদখল নিয়ে ছাত্রলীগের লাঠিয়াল ভূমিকার পর সম্ভবত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ নেতাদের কারও পক্ষ নিয়ে ব্যবহৃত না হওয়া উপদেশ দিলেন। আমাদের সমাজের তরুণ-তরুণী, আমাদের ভাইবোন, ছেলেমেয়ে, আমাদের প্রিয় ছাত্রদের তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। ওদের নষ্ট করে ফেলেছেন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা। তরুণ বয়সে তো একটি হিরোইজমের মজা থাকেই। সেটি মন্দার্থে, না সদর্থে তা ভাবার মতো চিন্তাশক্তি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ফলে ক্যাম্পাসে সতীর্থদের সামনে দাপট দেখিয়ে বিকৃত আনন্দ পাচ্ছে তারা। শক্তি প্রয়োগ করে মিছিলে যেতে বাধ্য করে হলে সিট বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অর্থ-চৌর্যবৃত্তির ভাগীদার হয়েছে। এ কারণে দীর্ঘদিন থেকে সেই গৌরবের ছাত্রলীগ ইতিহাস হয়ে গেছে। এখন এর একটি বিকৃত কঙ্কাল আমরা দেখছি। এ বিকৃতি ঘটিয়েছে তাদের রাজনৈতিক গুরুরাই। সুতরাং এখন সব সুবচনই নির্বাসনে গেছে। চট্টগ্রামে জনাব কাদেরের দ্বিতীয় বক্তব্যটি ঠিকভাবে এসেছে কিনা আমি বুঝতে পারলাম না। তিনি যদি বলে থাকেন দল ক্ষমতায় না থাকলে ক্ষমতা ও টাকা দুটোই থাকবে না, তাহলে কি ছাত্রলীগের অর্থ-বাণিজ্যকে পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দেয়া হল? প্রার্থনা করি আমার বোঝাটা ভুল হোক।
সুবচন যে ছাত্রলীগের কাছ থেকে নির্বাসনে গেছে এর অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। প্রাসঙ্গিক সাম্প্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। চট্টগ্রামে ওবায়দুল কাদেরের হেদায়েতের পরই হয়তো ঘটেছিল ঘটনাটি। নারায়ণগঞ্জে শহীদ মিনার চত্বরে রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন করেছে নারায়ণগঞ্জের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এখানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি। এর আগে জনাব রাব্বিকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে ছাত্রলীগ। এই সূত্রে ছাত্রলীগ হামলা করে লাঞ্ছিত করেছে রফিউর রাব্বিকে। পণ্ড করেছে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান। এই রিপোর্টটি পড়ে আমার মধ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। শহীদ মিনারে যাওয়া যে কারোরই নাগরিক অধিকার। এমন কারও ওপর চড়াও হওয়া যায় কি? শুনেছি প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ পরিবারের সঙ্গে জনাব রাব্বির দ্বন্দ্ব আছে। এবং এর সূত্র ত্বকী হত্যা। এখানে ছাত্রলীগের যুক্ত হওয়ার সূত্র কী? নিহত নিরপরাধ ত্বকী তো একজন ছাত্র ছিল। ত্বকী হত্যার বিচারের জন্য রাজপথে নামার কথা ছিল ছাত্রলীগের। সে দায়িত্ব কখনও পালন করেছে ছাত্রলীগ? ছাত্রলীগ তো ভুলেই গেছে শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় এ সংগঠনটির উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে। আজ ছাত্রলীগ কোনো পক্ষের লাঠিয়াল হতে গিয়ে পণ্ড করে দেয় রবীন্দ্রজয়ন্তী। আইউব খানের আত্মা বুঝি এবার সত্যিই শান্তি পেল। এ রিপোর্টটি পড়ার পর আমি পরের দিনগুলোর পত্রিকায় নজর রেখেছি। নারায়ণগঞ্জের অনেক বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রেখেছি। প্রত্যাশা করেছিলাম অন্তত রবীন্দ্রজয়ন্তী পণ্ড করার জন্য নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগকে তিরস্কার করবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগেরও প্রতিক্রিয়া জানব। কিন্তু ছাত্রলীগের উন্মত্ততারই জয় হল। তাই আমি যেহেতু শিক্ষক, আমার শেষ আশ্রয় আমার ছাত্রদের ওপরই। অপঘটনায় জড়িত নারায়ণগঞ্জ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিবেকের কাছেই প্রশ্ন রাখব, যে কাজটি তারা শহীদ মিনারে করেছে সেটি কি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের করণীয় কর্তব্য? ছাত্রশক্তিকে বরাবর ক্ষমতাসীনরা ভয় পেয়েছে। জেনেছে এরা নির্লোভ। ছাত্রকল্যাণ, সমাজকল্যাণ ও দেশকল্যাণের আন্দোলনে এরা হাসতে হাসতে জীবনও দিতে পারে। কোনো নেতা, কোনো গোষ্ঠী আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে। কিন্তু ছাত্রলীগ থাকবে। ছাত্রলীগ পরিপুষ্ট হবে, উজ্জ্বল হবে এর অতীত গরিমার কারণেই। আমি বুঝে পাই না আওয়ামী লীগ নেতারা, যাদের অধিকাংশই গৌরবের ছাত্রলীগের অংশীদার ছিলেন, তারা ছাত্রলীগকে এমন নিষ্প্রভ হতে দিচ্ছেন কেন! ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ছাত্রশক্তির মেরুদণ্ড আর আদর্শ ভেঙে দিয়ে তারা দেশের এবং নিজেদেরও ক্ষতি করছেন, এ বাস্তব চিন্তাটি কি করতে পারছেন না? আমি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ শাসক দলের নীতিনির্ধারক মহাত্মনদের কাছে অনুরোধ করব, শুধু সুপরামর্শে নয়, শক্ত নীতি প্রয়োগ করে ছাত্রলীগকে ঐতিহ্যের ছাত্রলীগে ফিরিয়ে আনতে পারেন কিনা দয়া করে সে চেষ্টা করুন। যদি মনে করেন সামনে নির্বাচন, তাই ছাত্রলীগের আসুরিক শক্তিরই প্রয়োজন। তবে আমি সাধারণ মানুষের একজন হয়ে বলব মানুষ এখন অনেক সচেতন। আবেগের বাইরে থেকে ভালোমন্দের হিসাবটা তারা করতে শিখেছে। কোন নীতি কখন বুমেরাং হবে রঙিন চশমায় তা হয়তো বোঝা যাবে না।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com
No comments