জোহরার নকল চেক কারবার by ওয়েছ খছরু
নকল
চেকে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের ‘ভয়ংকর’ জালিয়াত চক্র ধরা পড়েছে সিলেটে।
আর ওই চক্রের হয়ে গোটা দেশের ব্যাংকের বিভিন্ন ব্রাঞ্চে টাকা তুলতো জোহরা
ওরফে শারমিন নামের এক মহিলা। বোরকা পরিহিত ওই মহিলা যখন ব্যাংকে যেত তার
আগেই বাইরে থেকে ইন্টারনেটে মেসেজের মাধ্যমে ফরোয়ার্ডিং দিয়ে রাখতো প্রতারক
চক্রের সদস্যরা। এভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি শতাধিক ব্যাংকের ব্রাঞ্চ
থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। শুধু ব্যাংকই নয়- ওই চক্রের
সদস্যরা নকল চেকের মাধ্যমে স্বর্ণের দোকান থেকেও স্বর্ণ কিনে নিতো। সিলেটের
তিনটি স্বর্ণের দোকান থেকে তারা প্রায় ১০ লাখ টাকার স্বর্ণ এভাবে হাতিয়ে
নিয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। এদিকে- রোববার বিকালে তাদের জিন্দাবাজারের
সোনালী ব্যাংক থেকে আটকের পর রাতভর থানা হাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করে ভয়ংকর এ
জালিয়াত চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। তাদের এই জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হওয়া
মাত্র ব্যাংক কর্মকর্তারা হতবাক। গ্রেপ্তারকৃত জালিয়াত চক্রের সদস্য জোহরা
ওরফে শারমিন পুলিশের কাছে তার ঠিকানা একেক সময় একেকটি দিয়েছে। পুলিশ তার
কাছে যে ভোটার আইডি পেয়েছে সেটিতে জোহরার বাড়ি ঢাকার লালবাগের ইসলামপুর বলে
জানা গেছে। সিলেটে তার সঙ্গে স্বামী শামসুল আলম খান ছিল বলে জানিয়েছে
জোহরা। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর শামসুল নিজে থেকে গা-ঢাকা দিয়েছে। আর তার
সঙ্গে আটক হওয়া যুবক দাউদ ইব্রাহিম তার আপন চাচাতো ভাই। রোববার বিকালে
সিলেটের জিন্দাবাজারের সোনালী ব্যাংকের কর্পোরেট ব্রাঞ্চে তিন চেকে ২৯ লাখ
টাকা উত্তোলন করতে চায় জোহরা। এ সময় তার পরনে ছিল বোরকা। ব্যাংকের এজিএম
মো. ইমরান উল্লাহ চেক দেখে সন্দেহ হলে তিনি ওই মহিলাকে বসিয়ে রাখেন। তবে-
তার আগেই তিনি দেখেন অনলাইনে অ্যাকাউন্টের মালিকের ফরোয়ার্ডিং রয়েছে। কারণ-
জোহরা যে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করতে চাইছিল ওই অ্যাকাউন্টের মালিক
হচ্ছেন একজন লন্ডন প্রবাসী। এভাবে আগে কখনো ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা
উত্তোলন হয়নি। ব্যাংকের এজিএমের সন্দেহ হলে তিনি মহিলাকে বসিয়ে রেখে চেক
বইটি আসল কী না- পরীক্ষা করেন। এ সময় তারা দেখতে পারেন চেক বইটি নকল।
সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান- একেবারে ব্যাংকের হুবহু চেক ওই
প্রতারকচক্র তৈরি করে ফেলেছে। একই সঙ্গে চেক বইয়ের সিরিয়ালও ঠিক আছে। পরে
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জোহরা নামের ওই মহিলাকে আটক করে। তার সঙ্গে পুরুষ সদস্য
দাউদ ইব্রাহিমকে জোহরার মাধ্যমে ব্যাংকে ডেনে এনে আটক করা হয়। দুই জনকে
আটকের পর তারা প্রাথমিকভাবে চেক বইটি জাল নয় এরকম চ্যালেঞ্জ করে। পরে
ব্যাংক কর্মকর্তারা পুলিশ ডেকে এনে তাদের হাতে তুলে দেন। এদিকে- চেক বই
জালিয়াতি করে টাকা উত্তোলনের ঘটনার রাতেই সিলেটের কোতোয়ালি থানায় মামলা
করেন ব্যাংকের এজিএম ইমরান মোল্লাহ। মামলায় তিনি আসামি করেন জোহরা ও দাউদ
ইব্রাহিমকে। রাতে পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে ভয়ংকর তথ্য বেরিয়ে
আসে। রাতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জোহরা প্রথমে তার একাধিক নাম রয়েছে জানায়।
সে তার স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে কয়েকটি ঠিকানা দেয়। পাশাপাশি দাউদ ইব্রাহিমও
তার নাম একেক সময় একেক নাম বলে। পুলিশ ধারণা করছে- দাউদ ইব্রাহিমের বাড়িও
একই এলাকায়। তারা একে অপরকে চাচাত ভাই বোন বলে পরিচয় দেয়। এ সময় জোহরা
জানায়- সিলেটে তার সঙ্গে তার স্বামী শামসুল আলম খানও অবস্থান করছে। সে
ব্যাংকের বাইরে রয়েছে। তবে- ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশ শামসুলকে
গ্রেপ্তার করতে পারেনি। জোহরা জানায়- তারা গত এক সপ্তাহ ধরে সিলেটে অবস্থান
করছে। এর মধ্যে তারা সোনালী ব্যাংকের দরগাহ গেট শাখা থেকে ৭ লাখ টাকা
উত্তোলন করেছে। বৃহস্পতিবার ৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকার একটি চেক ক্লিয়ারেন্সের
জন্য জমা দিয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে নকল চেক জালিয়াতির
মাধ্যমে তারা কয়েক লাখ টাকা উত্তোলন করেছে। একই সঙ্গে তারা সিলেটের তিনটি
জুয়েলারি দোকান থেকে নকল চেক প্রদানের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকার স্বর্ণ হাতিয়ে
নিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। এই তিন জুয়েলারি দোকানের মধ্যে রয়েছে-
জিন্দাবাজারের মহারানী জুয়েলার্স, দরগাহ গেটের পরমেশ্বর জুয়েলার্স ও নুর
আমীন জুয়েলার্স। নকল চেক দিয়ে তারা স্বর্ণ কিনেছে বলে জানায়। জোহরা পুলিশকে
আরও জানিয়েছে- গত ৫ বছর ধরে তারা গোটা দেশে নকল চেকের মাধ্যমে টাকা
উত্তোলন করে যাচ্ছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ টাকা সে নিজেই উত্তোলন করেছে।
ঢাকা, চাঁদপুর ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তারা টাকা উত্তোলন করে। পুলিশ
জানিয়েছে- এভাবে তারা ঠিক কত টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেছে তার কোনো
হিসেব মেলেনি। ইতিমধ্যে তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রাথমিক
জিজ্ঞাসাবাদে ধারণা মিলেছে। সোনালী ব্যাংকের সিলেট কর্পোরেট শাখার এজিএম
মো. ইমরান উল্লাহ গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- নকল চেকে টাকা
উত্তোলন প্রতারক চক্রের কারণে গোটা দেশের ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে
অস্থিরতা বিরাজ করছিল। তারা টাকা তুললেও কখনো কোনো ব্যাংকই সন্দেহ করেনি।
এতে করে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা নিজের পকেট থেকে টাকা ভর্তুকি দিয়েছেন বলে
জানান তিনি। তিনি বলেন- জোহরা কিংবা দাউদ ইব্রাহিম নয় ওদের একটি শক্তিশালী
নেটওয়ার্ক রয়েছে গোটা দেশে। তারা ব্যাংকের চেকবই তৈরি করে। এসব কাজে বেশ
কয়েকজনের দক্ষ টিম থাকতে পারে। তাদের গ্রেপ্তার করলে আরো তথ্য বেরিয়ে আসবে
বলে জানান তিনি। এ সময় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার
(মিডিয়া) জেদান আল মুসাও ধারণা করছেন- এদের সঙ্গে একটি বড় চক্র আছে,
দেশব্যাপী তাদের নেটওয়ার্ক রয়েছে। তিনি বলেন, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ
করা হলে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। গতকাল দুপুরে পুলিশ তাদের আদালতে প্রেরণ
করেছে। আদালত তাদের জেল হাজতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কোতোয়ালি পুলিশ তাদের
রিমান্ড চাইবে বলে জানান জেদান আল মুসা।
No comments