পুলিশের গাফিলতি নয় কিছু ব্যত্যয় ঘটেছে : ডিএমপি কমিশনার
বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে বনানীর দ্য রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি ছিল। এ কারণে পুলিশের গুলশান বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও বনানী থানার দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে গাফিলতি তদন্তে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে এ তথ্য জানিয়েছেন। এ কমিটির প্রধান ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মিজানুর রহমান। কমিটির অন্য দু’জন সদস্য হলেন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় ও যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন। ধর্ষিত দুই তরুণী থানায় গেলে মামলা না নিয়ে পুলিশ ভুক্তভোগীদের সঙ্গে অসদাচরণ করেছিল বলে অভিযোগে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গাফিলতি তদন্তে কমিটি গঠন করে দেন। তদন্ত কমিটি তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল না। তবে কিছু ব্যত্যয় ঘটেছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। জবাব পেলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সোমবার ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে আসন্ন রমজানের নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব তথ্য দেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলার সব আসামি গ্রেফতার হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে। আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে। তদন্ত শেষ করে দ্রুত এ মামলার চার্জশিট দেয়া হবে। ধর্ষণের মামলা নিতে দেরি হওয়ার ব্যাখ্যায় কমিশনার বলেন, এর আগে আমি এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছি। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৭ ধারার বিধান মতে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ এলে যুক্তিসঙ্গত কারণে প্রাথমিক তদন্তের প্রয়োজনীয়তা থাকলে তিনি তা খতিয়ে দেখতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে তিনি মামলা নেবেন। কোনো নিরীহ ব্যক্তি যেন ফেঁসে না যান, এজন্য এটা ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান। বনানীর ঘটনার ১ মাস ৭ দিন পর আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসেছে ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে কেন পুলিশকে জানানো হয়নি। এ কারণে প্রাথমিক তদন্তের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ডিএমপি কমিশনার বলেন, প্রশ্ন উঠেছে, মামলা নিতে বিলম্ব হলো কেন, আসামি গ্রেফতারে কেন দেরি হল। এ কারণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একজন অতিরিক্ত কমিশনারের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কমিটি এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী আমরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা তলব করব। ব্যাখ্যা তলব শেষে অভিযোগ এবং তাদের জবানবন্দি পর্যালোচনা, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পর্যালোচনা, বাস্তবভিত্তিক সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। দায়িত্ব পালন না করে, অন্যায় আচরণ করে, আইনবহির্ভূত কাজ করে ডিএমপির কোনো সদস্যের পার পাওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে কমিশনার বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে অনেকে বুঝে না বুঝে অনেক কথা বলেছেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলব, পেশাদার বাহিনী হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্বে একবিন্দু গাফিলতি করিনি। আইনের বাইরে একটি কাজও করিনি।
ন্যায়বিচার ব্যাহত হতে পারে, আমরা এমন কাজ করিনি। আসামি গ্রেফতারেও পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল না জানিয়ে কমিশনার বলেন, মামলা রুজু হওয়ার পর পুলিশের বিভিন্ন বিভাগের সম্মিলিত চেষ্টায় আসামিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ১ মাস ৭ দিন পর ধর্ষণের অনেক আলামত বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এ কারণে মূল আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রিমান্ডে থাকা আসামিও আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেবে বলে আশা করছি। ধর্ষিত দুই তরুণীর অভিযোগ, ২৮ মার্চ দ্য রেইনট্রি হোটেলে রাতভর আটকে রেখে তাদের ধর্ষণ করে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ (প্রকৃত নাম আবদুল হালিম)। এ সময় সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন পুরো ঘটনার ভিডিও করে। এ ঘটনায় সাফাতের বন্ধু সাদমান সাকিফ (রেগনাম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে) ও সাফাতের বডিগার্ড রহমত আলী সহযোগিতা করেছিল। দুই তরুণী প্রথমে কোনো অভিযোগ করতে চাননি। পরে সাফাত ও নাঈম সেই ভিডিও প্রকাশ করে দেয়ার হুমকি দিলে তারা ৪ মে থানায় মামলা করতে যান। এ সময় বনানী থানা পুলিশ মামলা নিতে চায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি পুলিশ ধর্ষকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে। পরে পুলিশ অভিযোগ নিলেও এ ঘটনায় তাদের গালাগাল করেছে। এ ঘটনার জন্য উল্টো ধর্ষিত দুই তরুণীকেই দায়ী করছিল থানা পুলিশ। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে মামলা হলেও আসামিদের গ্রেফতার করেনি বনানী থানা পুলিশ। মামলার তদন্তভার পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগে যাওয়ার পর পাঁচ আসামি গ্রেফতার হয়। চাঞ্চল্যকর এ মামলার প্রধান আসামি সাফাত, তার বন্ধু সাকিফ ও গাড়িচালক বিল্লাল এরই মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বর্তমানে তারাও কারাগারে আটক রয়েছে। সাফাতের বডিগার্ড রহমত আলী রিমান্ড শেষে কারাগারে রয়েছে। এছাড়া মামলার অপর আসামি ধর্ষক নাঈম বর্তমানে রিমান্ডে আছে।
No comments