হাঁড়িভাঙা আমের বাড়ি
খুব ছোটবেলা থেকেই ভ্রমণ কাহিনীর প্রতি আলাদা একটা টান ছিল। সময় পেলেই ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে পড়তে বসে যেতাম। আর ভাবতাম বড় হয়ে ইবনে বতুতার মতো বের হয়ে যাব বিশ্ব ভ্রমণে। ভেবে দেখুন বতুতা মাত্র ২০ বছর বয়সে পৃথিবী দেখতে বেরিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তার ৪৯ বছর বয়সে। অর্থাৎ পৃথিবীর পথে পথেই কেটেছে তার ২৯ বছর। সেটি সেই ১৪ শতকের ঘটনা। জলদস্যু, মরুভূমির ঝড় আর পাগলা রাজাদের আক্রমণ ঠেকিয়ে বতুতা কখনও হেঁটে, কখনও জাহাজে চড়ে তার বিশ্বভ্রমণ করেছেন। আর এখনকার এই দারুণ প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগে আমরা তিনদিন চার রাত ধরনের প্যাকেজ ট্যুর ছাড়া কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে জটিল অঙ্ক শেষ করে এক মাস আগে থেকে ঠিক করি কোথায় যাব, কীভাবে যাব, কত দিন থাকব, কোথায় থাকব ইত্যাদি। এরই মাঝে সবকিছুকে উড়িয়ে দিয়ে ‘বতুতাদর্শে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম দেশের উত্তরাঞ্চলের দিকে। ভ্রমণসঙ্গী আমার মা। কোনো দর্শনীয় জায়গা দেখার ইচ্ছা নিয়ে নয়, ইচ্ছাটা ছিল উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন ধারা দেখব। যেখানে রাত হবে, সেখানেই কাত হব; যেতে যেতে যে রাস্তা ভালো লাগবে, সেদিকেই চলতে শুরু করব। এদিকে শুক্র শনিবার এর বন্ধসহ অফিসের ছুটি পেয়েছি একদিন মাত্র তাই তিন দিন সময় এর মাঝে আমাকে ঘুরে আসতে হবে।
আগে ভেবেছিলাম ছুটি আরেকটু বেশি দিন পাব তা পেলে উত্তরাঞ্চলে মোটামুটি ঘুরে আসা যাবে কিন্তু বিধি বাম জুনে তাই বড় স্যারের হুকুম একদিনের বেশি ছুটি দেয়া যাবে না তাই আর ভালোভাবে উত্তরাঞ্চল ঘোরার প্ল্যানটা মাঠে মারা যাওয়ার জোগাড়। আমার অফিসের সবাই এক বাক্যে না বলছে এবার না যাওয়ার জন্য। খুব গরম পড়েছে। আর এত অল্প সময়ে তেমন কিছুই দেখতে পারব না বুঝি। এদিকে আমি নাছোড়বান্দা। যেহেতু যাব বলেছি, সেহেতু যাবই। সব প্রতিকূলতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে আমি আর আমার মা রওনা দিলাম উত্তরাঞ্চলের দিকে। আমার আবার ট্রেনে করে ভ্রমণ করতে খুব ভালো লাগে। সে মোতাবেক আমরা রওনা দিলাম ঢাকা থেকে সকালের ট্রেনে উত্তরাঞ্চলে দিকে। সকাল ৯টায় আমাদের ট্রেন রংপুর এক্সপ্রেস। ৯টার আগেই আমরা স্টেশনে এসে উপস্থিত কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে কিছুটা বিলম্বে যাত্রা যেন প্রথাগত ব্যাপার। ৯টার ট্রেন ১০টায় ছাড়ল। আমরা যাত্রা শুরু করলাম। প্রকৃতির মায়াবী রূপকে সঙ্গী করে ট্রেন তার সেই মধুর কু ঝিক ঝিক ঝিক শব্দে এগিয়ে চলল। ট্রেনের ঝক ঝক শব্দ, যানজটবিহীন পথ যে কারোই ভালো লাগার কথা। ট্রেন লাইনের দু’পাশে কখন বস্তি আবার কখন সারি সারি গাছের মাঝে ছুটে চলছে। আশপাশে বাড়িঘর সব কিছুকে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে ট্রেন তার গন্তব্যে। ট্রেনের জানালার পাশে বসে প্রকৃতির রূপ দেখা খুবই উপভোগ্য। মাঝে মাঝে ট্রেনের গতি কমে এলেই মানুষদের তার গন্তব্যে নেমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব, চাটমোহর, নাটোর,
সান্তাহার, বগুড়া পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যে। ট্রেনে বসে কথা হল প্রকৃতি বাংলাদেশের সুজন সেন গুপ্তের সঙ্গে। সময় যেহেতু কম তাই কম সময়ে তিনি রংপুর বিখ্যাত হাড়িভাঙা আমের বাগান দেখে আসার পরামর্শ দিলেন, সঙ্গে দিলেন আবু জাহিদ ভাইয়ের মোবাইল নাম্বার। আবু জাহিদ ভাইয়ের বাড়ি রংপুরে। তার রংপুরের পদাগঞ্জ এলাকায় তিন একর জায়গার ওপর আম বাগান আছে। রাত আঁটটা আমাদের ট্রেন এসে নোঙ্গর করল রংপুর স্টেশনে। আগে থেকে আবু জাহিদ ভাই স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। রংপুর স্টেশন থেকে আমরা রিকশা করে জাহাজ কোম্পানি মোড়ে গোল্ডেন টাওয়ার হোটেলে পৌঁছালাম। বেশ শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। কিছু সময় রেস্ট নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাতের আঁধারে রংপুর শহর ঘুরতে। রংপুর শহরের জুম্মাপাড়া, গোমস্তপাড়া, বেদ পট্টি, স্টেশন রোড, নবাব বাড়ি, আমলাতলা এলাকাগুলো আমরা রিকশা করে ঘুরে বেড়ালাম। পায়রা চত্বরে এসে দেখা মিলল মিষ্টি দোকান পুষ্টির। আমি আবার মিষ্টি দেখলে লোভ সামলাতে পানি না। অগত্যা মা না বলার পরও মিষ্টি দোকানে ঢুকে হরেক রকম মিষ্টি চেখে দেখলাম। অসাধারণ টেস্ট। ঢাকা শহরের তুলনায় মিষ্টির দাম তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। তাই তিন বক্স শুকনো মিষ্টি সঙ্গে করে নিলাম ঢাকাবাসীর জন্য। পরের দিন সকালবেলা আবু জাহিদ ভাই এসে উপস্থিত। আমরা নাস্তা করে বের হয়ে পড়লাম। গন্তব্য মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ গ্রামে। আমের বাগান। আমরা সিএনজি করে যাত্রা শুরু করলাম পথি মধ্যে আবু জাহিদ জানালেন আমের নাম কেন হাড়িভাঙা হল এ নিয়ে লোকজনের মাঝে নানা কথার প্রচলন রয়েছে।
তবে যতদূর জানা যায়, পদাগঞ্জের এক ব্যক্তি বাজার থেকে আম কিনে আনেন। সেই আম খেয়ে তিনি বীজটি রেখে দেন একটি পরিত্যক্ত হাঁড়িতে। ওই হাঁড়িতেই বীজ থেকে চারা গাছ বের হয়ে আসে। আর সেই গাছটি তিনি বাড়ির পাশে রোপণ করেন। ওই ব্যক্তির নিবিড় পরিচর্যায় গাছে আম ধরতে শুরু করে। হাঁড়ি থেকে ওই আমের উৎপত্তি হওয়ায় এর নাম হয় হাঁড়িভাঙা আম। এদিকে মা শুরু করলেন তার স্মৃতির কুঠোর থেকে আমের ইতিহাস বলা- খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে দিগি জয়ী বীর সম্রাট আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণের পর এক আম বাগানে তাঁবু গেড়ে বিশ্রাম নেয়ার সময় আমের সঙ্গে পরিচিত হন। সুস্বাদু আম খেয়ে এতটাই ভক্ত হয়ে পড়েন যে প্রাসাদের চার ধারে আমের বাগানে ছেয়ে দেন। প্রাচীন শাস্ত্রে আমগাছকে ‘কল্প বৃক্ষ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কখনও বলা হয়ে ইচ্ছাপূরণের বৃক্ষ। আমের পাতা মঞ্জরিকে নিয়ে আছে লোক কাহিনী। আমের কচি পাতার ডাল শুভ ও মঙ্গলকাজে ব্যবহার হয়। পনেরো শতকের দিকে স্পেনিশ পরিব্রাজক ও পর্তুগিজরা মহাদেশে আম নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় প্রাচীন চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ও আরব অভিযাত্রী ইবনে হানকাল আমের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে ভ্রমণ কাহিনীকে সমৃদ্ধ করেন। তারও বহু আগে প্রেমের দেবতা কিউপিড মানব হৃদয়ে প্রণয় জাগাতে প্রেমের তীরের অগ্রভাবে আমের মুকুল গেঁথে দেন। আম মুঘল সম্রাট আকবরের এতটাই প্রিয় ছিল যে, আম দিয়েই শুরু হতো অতিথি আপ্যায়ন। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্য পদাগঞ্জে। এসেই চেখে পড়ল বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শুধু হাঁড়িভাঙা আমের বাগান। যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকে শুধু বাগান আর বাগান। এমন কেউ নেই যিনি বাড়ির আঙিনা, উঠান কিংবা ফসলি জমিতে আমের গাছ রোপণ করেননি। আবু জাহিদ ভাই তার বাগানে নিয়ে গেলেন। বিশাল এলাকা নিয়ে জাহিদ ভাইয়ের আম বাগান কতটুকু এলাকা নিয়ে আম বাগান জানতে চাইলে জাহিদ ভাই জানালেন চার একর জায়গার ওপর তার বাগান। ছয় বছর ধরে তিনি আমের বাগান করছেন। আর আপনারা যে গাছগুলো দেখছেন তাদের বয়স চার বছর।
প্রতিগাছ থেকে তিন থেকে চার মণ আম পাওয়া যায়। আম পাকলে কিছুটা লালচে রং ধারণ করে। প্রতিটি আমের ওজন ২০০ গ্রাম থেকে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। এত আম দেখে লোভ কি সামলানো যায়, আপনারাই বলুন। তাই নির্লজ্জের মতো জাহিদ ভাইকে বললাম আম খাওয়াবেন না জাহিদ ভাই, জিভে কামড় দিয়ে বলে আরে ভুলেই গিয়েছিলাম আপনাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে। সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল দুলালভাইয়ের। তিনি এখানে দেখভাল করেন। শুরু হল আমাদের আম খাওয়ার পর্ব। একের পর এক আম সাবাড় করছি। হঠাৎ মনে হল অনেক সময় শুনি আম বাগানে আম পাকানোর জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। তাই জাহিদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কীটনাশক দেন নাই তো আম পাকানোর জন্য? জাহিদ ভাই বললেন, আপনারা নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। আমার এখানে শুধু আমের মুকুল আসার আগে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় পোকামাকড় আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। দেখতে দেখতে আমাদের শহর পানে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। ফিরে যাওয়ার আগে আবু জাহিদ ভাই মিলবাজার এলাকার বিখ্যাত লুচি আর সবজি খাইয়ে আমাদের বিদায় দিলেন। পথের ঠিকানা- ঢাকা থেকে ট্রেনে করে রংপুর। ভাড়া নেবে ৩৯০ থেকে ১৩৯৫ টাকা অথবা বাসে করে (এসআর ট্রাভেলস, এসএ পরিবহন, নাবিল এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন প্রতিটির এসি/নন এসি বাস আছে ) রংপুর ভাড়া ৪৫০ থেকে ৬৫০ টাকা। রংপুর শহর থেকে অটো করে পদাগঞ্জ রিজার্ভ নিলে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। বাস করে গেলে ৩০ টাকা।
No comments